রাজমহল পর্ব -০৫

#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫

যা শোনে আমি আবারও ভয় পেয়ে গেলাম।কারণ হাসিব বললো সে আমাকে রাত তিনটা বাজে কল দিয়ে এমন কিছুই বলেনি। কথাটা শোনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম মনে হচ্ছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে কলটা হাসিবের নম্বর থেকে এসেছে। আর আমিতো হাসিবের কন্ঠ চিনতে ভুল করব না। দুই বছরের সম্পর্ক আমাদের। ভালোবাসা বুঝার আগেই সম্পর্ক হয়েছিল অল্প বয়সে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম হয়তো হাসিব ভাবছে আমি ভয় বেশি পেয়েছি তাই এমন মিথ্যা কথা বলছে। আমি হাসিবকে হালকা ধমক দিয়ে বললাম

– তুমি সত্যি কথা বলো।

– আরে তন্দ্রা মিথ্যা বলতে কেন যাব। সত্যিই আমি তোমাকে কল দিইনি। এমন কিছুই আমার সাথে ঘটেনি। তুমি তোমার মোবাইল চ্যাক করলেই তো হয়।

আমি হাসিবের কথা শোনে পাল্টা জবাব না দিয়ে কলটা কেটে দিয়ে কল লিস্টে গেলাম। কল লিস্টে গিয়ে দেখলাম রাত তিনটেয় যে কলটা এসেছে সেটা হাসিবের নম্বর থেকে না। বিস্ময়টা বাড়তে লাগল আমার। কারণ হাসিবের নামটায় স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল তখন। তাহলে এখন অন্য নম্বর হলো কি করে। হাত কাঁপতে লাগল আমার। কাঁপা কাঁপা হাতে নম্বরটায় কল দিলাম। ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে বলছে
“আপনি যে নম্বরে কল করেছেন এ নম্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই”

বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবাতে লাগল। আমি কল ডিউরেশনটা খেয়াল করে দেখলাম আধা ঘন্টা কথা হয়েছে। ভাবতে লাগলাম যে নম্বরের অস্তিত্ব নেই সে নম্বরে আমি এত কথা কি করে বললাম আর সেটা যদি হাসিব নাহয় তাহলে কার সাথেই বা কথা বললাম।বলেই নম্বটার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম মোবাইলটা আপনাআপনি চলছে।আমি মোবাইলটা টাচ করতে চাইলেও সেটা কাজ করছে না। মোবাইলটা আপন গতিতে চলছে।নম্বরটা ডিলেট বাটনে লেগে ডিলেটও হয় আপনাআপনি। ডিলেট হওয়ার সাথে সাথে মোবাইলটা আপনাআপনি চলা বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল। হাতটা কাঁপতে কাঁপতে মোবাইলটা নীচে পড়ে গেল। নীচে পড়তেই সন্ধি ঘরে প্রবেশ করে বলল

– আরে আরে আপু মোবাইলটা পড়ে গেল তো।

বলেই মোবাইলটা মেঝে থেকে তুলল। সন্ধি মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল

– আপু তুই তো মোবাইলের স্ক্রিনটা ভেঙ্গে দিলি।

সন্ধির কথায় মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম স্ক্রিনটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। সন্ধি স্ক্রিনটায় হাত দিয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথে স্ক্রিনটা অলৌকিক ভাবে ঠিক হয়ে গেল। আমি বিষয়টা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সেই সাথে সন্ধিও চমকে গেল। সন্ধি আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল

– আপু এটা কি করে সম্ভব? আমার হাতের স্পর্শে স্ক্রিনটা ঠিক হয়ে গেল কি করে?

এতটাই বিস্মিত হয়েছিলাম যে সন্ধির কথায় জবাব দিতে পারছিলাম না। হা করে মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে শুধু দেখতে লাগলাম।সন্ধিও আমার নীরবতা দেখে চুপ হয়ে মোবাইলটা শুধু এপাশ ওপাশ করে দেখতে লাগল। বিষয়টাতে এবার গরমিল আছে মনে হলো। মনে হচ্ছে কড়া একটা রহস্য আছে যেটা আমি আর সন্ধি কেউ এই উদঘাটন করতে পারছি না। তবে বিষয়টা কি? রহস্যটা কি আদৌ বের করতে পারব। এসব প্রশ্ন মনে ঘুরতে লাগল আমার। দুজনের নীরবতায় ঘরটা তখন পিনপনা নিস্তবতা বিরাজ করছে। নিস্তবতার অবসান ঘটলো সায়রা আপুর চিৎকারে। আমি আর সন্ধি সায়রা আপুর আচমকা চিৎকারে ভয় পেয়ে গেলাম। দুজনেই দৌঁড় লাগালাম সায়রা আপুর রুমের দিকে। সায়রা আপুর রুমে গিয়ে দেখলাম আপু মেঝেতে পড়ে আছে। উঠার চেষ্টা করছে তবে উঠতে পারছে না। আমি আর সন্ধি আপুকে কোনো রকম ধরে খাটে উঠালাম। বুঝতে পারলাম আপু পায়ে ব্যথা পেয়েছে। আপুকে বসিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে আপু বলল

– পা টা মচকে গিয়েছে হয়তো। ডাক্তারকে কল দেওয়ার দরকার নেই।তুই শুধু রসুন তেল গরম করে আন। পায়ে মালিশ করলেই ঠিক হয়ে যাবে।

আমি সন্ধিকে আপুর পাশে বসিয়ে রসুন তেল গরম করতে গেলাম। রান্না ঘরে গিয়ে কড়াইয়ে তেল নিয়ে চুলা জ্বালিয়ে দিলাম। তেলটা হালকা গরম হতেই খোসা ছাড়ানো রসুন গুলো ছাড়তেই তেলটা লাল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে রক্ত টগবগ করে ফুটছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছিল। মাথাটাও ঝিমঝিম করছিল। এমন সময় রান্না ঘরের জানালা দিয়ে একটা বরফ শীতল বাতাস এসে আমার গায়ে লাগতেই আমি চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। সাথে সাথেই আমার সামনে কিছুর উপস্থিতি টের পেলাম। আমি চোখটা খুলে দেখলাম কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে তেলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তেলটাও স্বাভাবিক। একটু আগের যে লাল হয়ে গেছিল সেটা আর নেই। ভাবতে লাগলাম এটা আমার মানসিক সমস্যা নাকি বাস্তব। কেন যে এমন হচ্ছে তা বুঝতে না পেরে একের পর এক প্রশ্ন মনে জাগছে। নিজের ভেতরেই যেন এক অস্থিরতা ঝড় তুলছে। দমাতে চাইলেও সেটা দমাতে পারছিলাম না৷ এমন সময় মনে হলো কেউ একজন পিঠে হাত রেখেছে। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাতেই খেয়াল করলাম সন্ধি। সন্ধিকে দেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম

– কি হয়েছে?

সন্ধি আমার কথার জবাব না দিয়ে চুলাটা বন্ধ করে বলল

– রসুন পুড়া গন্ধে চারপাশ মুহুমুহু করছে আর তুই হাবলির মতো দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস?

আমি সন্ধির কথায় নিজেকে ভাবনার জগৎ থেকে বের করে কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রসুন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললাম

– জানি না কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে এসব। তোর আর আমার জীবনে এ কোন কালো অধ্যায় নেমে আসলো। একের পর এক অসহনীয় অবাস্তব ঘটনা চোখের সামনে ঘটছে যার কোনো ভিত্তি নেই। কেনই বা এসব হচ্ছে। পাগল হয়ে গেলাম নাকি বুঝতে পারছি না।

সন্ধিও আমার কথায় কেঁদে দিয়ে বলল

– তোর এতেই এমন লাগছে। চিন্তা কর আমার কেমন লাগছে। আমার পেটে বাচ্চা কি করে আসলো আমি জানি না। সারাদিন পেটে হালকা নড়াচড়া উপলব্ধি করি। কেমন যে লাগে আমার সেটা তো আমিও বলে বুঝাতে পারব না। তুই ভবছিস আমি কারও সাথে সম্পর্ক করে আবেগে কিছু করে এমন দশা করেছি। কিন্তু তোকে কীভাবে বুঝাব আমি এমন কিছুই করিনি। এত কঠিন শাস্তি কেন পাচ্ছি জানি না।

আমি সন্ধির কথা শোনে সন্ধিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। এমন সময় সায়রা আপুর তীক্ষ্ণ কন্ঠে আমরা স্বাভাবিক হয়ে চোখ মুছে সায়রা আপুর দিকে তাকিয়ে দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম।সায়রা আপুর হাতে বাজারের ব্যাগ। আর আপু সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধি আপুর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল

– আপু তুমি এখানে?

আপু রাগ রাগ চোখ করে চোখগুলো বড় বড় করে বলল

– তো কোথায় থাকব? আর তোরা রান্না ঘরে এসে এভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?

আমি বিস্মিত হয়ে চোখগুলো কপালে তুলে বললাম

– আমি তো এসেছিলাম তোমার জন্য রসুন তেল গরম করতে। তোমার পা মালিশ করার জন্য।

আপু বিরক্ত গলায় জবাব দিল

– পাগল হয়ে গেছিস তুই? আমার পা মালিশ করবি কেন হুট করে?

– না আপু কিছুক্ষণ আগে তুমি তো পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলে পায়ে। তাই রসুন তেল গরম করতে বললে আমি সেটা গরম করছিলাম। এমন সময় রসুন পুড়ে গন্ধ বের হচ্ছিল তাই সন্ধি এসে চুলা বন্ধ করলো।

আমার কথা শোনে আপুর রাগটা যেন বেড়ে গেল। আপুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি কোনো আষাঢ়ে গল্প করছি। রাগী কন্ঠে কপালটা কুচকে চার পাঁচটা ভাজ তুলে বলল

– আমি পড়ে গেলাম কখন? কিসব হাবিজাবি বলছিস? আমি বের হয়েছিলাম বাজার করতে। কিছু পথ এগুতে মনে হলো পার্সটা ফেলে এসেছি তাই পার্স নিতে ঘরে ঢুকলাম আর রান্না ঘর থেকে কান্নার আওয়ার পেয়ে ঢুকে দেখলাম তোরা কাঁদছিস। আর এখন কিসব আবোল তাবোল বলছিস। আর রসুন তেল গরম কি চুলাতেই করেছিস কড়াই ছাড়া?

আপুর কথা শোনে সন্ধি বিস্মিয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল

– মানে?

আপু সন্ধির মানে উত্তরটা শোনে কপালটা একবার সমান্তরালভাবে আবার লম্বভাবে ভাঁজ করে বলল

– মানে চুলাতে কড়াই নেই। রসুন তেল গরমটা কোথায় করলি?

আপুর কথা শোনে সন্ধি আর আমি পেছন ফিরে চুলায় তাকিয়ে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কারণ চুলাটা একদম খালি। তাহলে একটু আগে আমাদের সাথে যা ঘটলো সেটা কি কোনো মতিভ্রম। আমি চুলার দিকে তাকিয়ে হা হয়েই রইলাম। সন্ধি আপুকে হালকা ঢুক গিলতে গিলতে বলল

– জানি না কড়াই কোথায় গেল।

সন্ধির কথা শোনে আপু আরও রেগে গেল। রেগে গিয়ে হালকা আওয়াজ তুলে ধমক দিয়ে বলল

– বলি তোরা কি পাগল হয়ে গেলি নাকি৷ মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছিস। সাত পাঁচ দিয়ে আমাকে আর বুঝাতে হবে না। নিশ্চিত তোরা ঝগড়া করেছিস। ঝগড়া করে মিটমাট করে একে অপরকে ধরে কাঁদছিলি। আমাকে এভাবে আসতে দেখে ভয়ে এসব আষাঢ়ে গল্প বানিয়ে বলছিস। হয়েছে হয়েছে আর এসব হাবিজাবি বলে আমার মাথা খেতে হবে না। ঘরে গিয়ে পড়তে বস। আমি বাজারে গেলাম। এর মধ্যে আর ঝগড়া করলে একদম এসে উত্তম মধ্যম দিব জানতে পারলে। যা ঘরে যা।

আমি আর সন্ধি আপুর কথার কোনো জবাব দিলাম না। মাথা নত করে দুজনেই ঘরে চলে আসলাম। ঘরে এসে সন্ধি আর আমি শুধু ভাবতে লাগলাম এসব কি হচ্ছে আমাদের সাথে কেন হচ্ছে। খানিকক্ষণ পর আপু আসলো পা টা হেঁচরে হেঁচরে।আমি আর সন্ধি গিয়ে আপুকে ধরে বললাম

– কি হয়ছে পায়ে?

আপুকে জিজ্ঞেস করার পরও ভাবতে লাগলাম এটা কি মতিভ্রম নাকি বাস্তব। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর দেখলাম এটা আপু আর পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।আপু আস্তে করে আমাদের কথার জবাবে বলল

– হুট করে রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলাম হালকা।তেমন কিছুই হয়নি তোরা ঘরে যা।

আমি আর সন্ধি আপুকে শুইয়ে দিয়ে ঘরে আসলাম। ভাবতে লাগলাম গতকাল আমার সাথে ঐসব হওয়ার আগে আমার কল্পনায় কেউ একজন বলেছিল এসব হয়েছে। আজকে আপু পায়ে ব্যাথা পাওয়ার আগে আপু ব্যথা পাওয়ার বিষয়টা চোখে ভাসল। সবকিছু আগে আমাদের চোখে ভাসছে তারপর বাস্তবে হচ্ছে।এমন কেন হচ্ছে এটার উত্তর মিলাতে পারছিলাম না। কাঙ্ক্ষিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়েই পার করলাম কিছুদিন।

আজকে সন্ধিকে নিয়ে হাসপাতাল যাওয়ার পালা। সকাল সকাল উঠে নিজেকে প্রস্তুত করলাম। সন্ধিকে সাহস দিলাম। হাসিবকে কল দিলাম আসার জন্য। হাসিব আর সন্ধিকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম ডাক্তার রাহনুমা পারভীনের কাছে। উনি সবকিছু দেখে সব ফরমালিটি শেষ করে সন্ধিকে নিয়ে গেল গর্ভপাতের জন্য। সন্ধিকে নিয়ে গিয়ে আধ ঘন্টা পর তড়িঘড়ি করে আসলো। উনার অবস্থা দেখে আমি আর হাসিব দুজনেই বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।

চলবে?

কপি করা নিষেধ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here