রাজমহল পর্ব -১২+১৩

#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১২

তারপর জার্নিভা যা বলল তা শোনে বুকটা কেঁপে উঠল। কারণ জার্নিভা বলল

– আমার বাচ্চাটা পরিপূর্ণ ছিল না।

আমি জার্নিভার কথা শোনে কিছুটা অবাক হয়ে বললাম

-পরিপূর্ণ ছিল না মানে? সে কি দেখতে কোনো জানোয়ার বা জীবের মতো ছিল?

জার্নিভার চোখের জল তখন গড়গড়িয়ে পড়তে লাগল। হালকা সুরে বলল

– সে দেখতে অনেক সুন্দর ছিল।

তখন মৃদুমন্দ বাতাস চারদিকে বইতেছিল। হালকা হালকা শীতের শিহরণ লাগতে লাগল। মনে হচ্ছে জার্নিভার শীতল চোখের পানি যেন শীতলতাময় শিহরণ জাগাচ্ছে চারদিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জার্নিভার কথায় অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম

– তাহলে কি সমস্যা ছিল?

জার্নিভা কান্নার ভাঙ্গা ভাঙ্গা আওয়াজ তুলে বলল

– আমার বাচ্চাটা ছিল তৃতীয় লিঙ্গের। সে ছেলেও ছিল না মেয়েও না। তার দোষ হলো সে কেন এভাবে জন্ম নিল। এরকম বাচ্চা জন্ম হওয়াতে রাজ বংশ নাকি কলঙ্কিত হয়েছে।

– তার মানে তোমার বাচ্চাটা হিজরা ছিল?

– হ্যাঁ। কিন্তু এতে তার দোষ কোথায় ছিল বলো? তার জন্মের উপর কি তার কোনো হাত ছিল? ওকে সে সমাজ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। তাকে সবাই অশুভ বলা শুরু করল। কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও আমার বাচ্চাটাকে মরতে হয়েছে। এখনের সমাজও তো তৃতীয় লিঙ্গে যারা আছে তাদের সম্মান দেয় না। কিন্তু তাদের দোষটা কোথায়? তারা কি ইচ্ছা করে এমন হয়? এতটা নির্দয় আচরণ তাদের সাথে কেন করা হয়? এ সমাজ তো তাদের সাথে তাদের জন্ম দাত্রী মায়েদেরও ছাড়ে না। প্রবল ঘৃণা ছুড়ে দেয় তাদের প্রতি। কিন্তু কেন এই বৈষম্য বা ঘৃনা তাদের সহ্য করতে হবে বলো তো? দোষটা কোথায় তাদের?

জার্নিভার কথা শোনে আমি নির্বাক। সত্যিই তো এ সমাজ কেন তাদের এত হেয় করে। আর অবহেলা তো এখন থেকে শুরু না শুরু সেই গোড়া থেকে। সমাজ সবদিক দিয়ে আপডেট হলেও কেন জানি না এ দিক দিয়ে এখনো কারও দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় নি। আমরা হিজরা বলতে বুঝি হাতে তালি দিয়ে “এ টাকা দে” এ কথা বলবে। কিন্তু কখনো কি তাদের মনের কষ্টটা বুঝার চেষ্টা করেছি। বাসে ট্রামে হিজরা দেখলেই কেমন যেন আমাদের নাক শিটকানো আসে। তারা তাদের পরিবার থেকে শুরু করে সব জায়গায় কেমন যেন অবহেলিত। তাদের চোখে পানি দেখা যায় না অথচ তাদের মুখে কিছু অশ্লীল বুলি শোনে আমরা তাদের মহাপাপী খেতাব দিয়ে ফেলি। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তো তারা যে কষ্ট সহ্য করে সে কষ্টের আশপাশে আমরা যাই না। দোষটা কি তাদের? তাদের এমন হয়ে জন্ম হওয়ার পেছনে দায়ী কি তারা? তবে কেন এত বৈষম্য? কেন এত অবহেলা?

প্রশ্নগুলো যেন বারবার মনে বিদ্ধ করছিল। তবে একটা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জার্নিভার এতগুলো প্রাণ নেওয়া ঠিক হবে না। জার্নিভাকে যে করেই হোক আটকাতে হবে। তাই জার্নিভাকে হালকা সুরে বললাম

– আমি জানি তুমি যে দিকের জন্য প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছ সেটা সমাজের একটা ব্যাধি। আমরা চাইলেও সেটা একদিনে পরিবর্তন করতে পারব না। একশ বছর আগে তোমার সন্তানের সাথে যা হয়েছে সেটা সত্যিই অন্যায় হয়েছে। তবে তার জন্য তো আমরা কেউ দায়ী না। যারা তোমার সন্তানকে হত্যা করেছে সে মানুষগুলো অনেক আগেই মৃত। এখন তো প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। আমরা তো আর তোমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়।

জার্নিভা আমার কথা শোনে গম্ভীর গলায় জবাব দিল

– এ বংশধর আমি শেষ করেই ছাড়ব। আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ এভাবেই আমি নিব। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।

– কিন্তু এ বংশধর তো দায়ী না। দায়ী যারা ছিল তারা মৃত। তাদের শাস্তি কেন তুমি আমাদের দিবে? এটা তো অন্যায়। দয়াকরে অন্যায় করা বন্ধ করো। এ প্রতিশোধ নেওয়া বন্ধ করো।

কথাগুলো বলতে বলতেই জার্নিভা আমার গলাটা চেপে ধরে বলল

– আমার প্রতিশোধ নেওয়াতে কেউ আটকাতে পারবে না।

ততক্ষণে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। হালকা কাশি আসতে লাগল। কাশি দিতে দিতে জার্নিভাকে ধরতে নিব ঠিক এ মুহুর্তে জার্নিভা অদৃশ্য হয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সে নেই। কোনো রকম গলায় হাত দিয়ে গলায় হাত বুলিয়ে হালকা কাশি দিয়ে ঘরে আসলাম। ঘরে ঢুকে খেয়াল করলাaম সন্ধি খাটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

আমিও কোনো কথা না বলে সন্ধির পাশে গিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাইরে তাকাতেই চোখটা একটা জায়গায় আটকে গিয়ে থমকে গেল সে সাথে বুকটাও কেঁপে গেল।
#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৩

বাইরে তাকাতেই একটা বিষয় দেখে চোখটা থেমে গেল সে সাথে বুকটা কেঁপে উঠল। লক্ষ্য করলাম অনিক ভাইয়ার লাশটা শূন্যে ভেসে প্রচন্ডরকমভাবে ঘুরছে। সারা শরীর থেকে রক্ত যেন শূন্য থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আকাশটা একবার আলোকময় একবার অন্ধকারময় হচ্ছে। আলো অন্ধকারের খেলায় যেন বেশ ধাঁধায় পড়ে গেলাম। অবাক চোখে অনিক ভাইয়ার লাশের ঘূর্ণণ দেখতে লাগলাম সে সাথে বুকের স্পন্দন বাড়তে লাগল। হুট করেই লাশটা মাটিতে আঁচড়ে পড়ল। মাটিটা যেন ফেটে ছাইয়ের মতো চারপাশে উড়তে লাগল। আর লাশটাও মাটির নীচে গায়েব হয়ে গেল। উড়ে যাওয়া ছাইয়ের মতো মাটিগুলো বেশ ধলা পাকিয়ে এক গোলকের তৈরী করল। গোলকটা ফুটে গিয়ে বাতাসে চারপাশ ঘুরে এক বৃত্তের তৈরী হলো। সে বৃত্ত থেকে আচমকা কিছু একটা যেন আমার চোখে এসে পড়ল। চোখটায় হালকা জ্বলুনি দিল আর আমি বাধ্য হয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করার পর চোখের জ্বলুনি ভাবটা কমে গেল। আমি চোখটা মেলতেই চমকে গেলাম। কারণ এটা তো অন্য একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি। চারপাশে শুধু ঢোলের শব্দ। সামনে তাকাতেই খেয়াল করলাম সন্ধি দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে এক লোক। মনে হচ্ছে সে এই রাজা মেহেদীরাজ। উনার দিক থেকে মুখ সরিয়ে পরক্ষণে সন্ধির দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম কারণ সন্ধি পুনরায় জার্নিভার রুপ ধারণ করেছে। বড় পেট নিয়ে সামনে হাঁটতে যেন তার বেশ কষ্ট হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর জার্নিভা পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ল। জোরে একটা চিৎকার দিল। রাজা মেহেদীরাজ জার্নিভার অবস্থা থেকে সেখানে থাকা একজনকে বলে উঠল

– দীপক তাড়াতাড়ি দায় আনার ব্যবস্থা করো আমার সন্তান আসার সময় হয়েছে।

বুঝতে পারলাম সেই লোকটার নাম দীপক। মেহেদীরাজের কথা শোনে দীপক দৌঁড়ে গেল। এদিকে জার্নিভা ব্যথায় কাতরাতে লাগল। মেহেদীরাজ দাসীদের হুকুম দিল অন্দর মহলে জার্নিভাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দাসীরা জার্নিভাকে অন্দর মহলে নিয়ে গেল। অন্দর মহলের বাইরে থেকে জার্নিভার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল শুধু। এর মধ্যে দীপক দায়কে নিয়ে হাজির হলো। দায় তাড়াহুড়ো করে জার্নিভার রুমে ঢুকল। বাইরে থেকে শুধু জার্নিভার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। সারা রাত পার হলো জার্নিভার চিৎকারে। ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগ মুহুর্তে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনে যেন আমার বুকটা ধক করে উঠল।মনে হলো পাশেই বাচ্চা কান্না করছে। আমার চোখটা বুজে এলো। টেনে টেনে চোখটা খুলে অবাক হয়ে গেলাম। পাশে সন্ধি শুয়ে আছে আর তার পাশেই বাচ্চা চিৎকার দিচ্ছে। তার মানে এতক্ষণে সন্ধি বাচ্চা প্রসব করেছে আর আমি এক মায়ায় ডুবে ছিলাম। এর মধ্যেই সায়রা আপু দৌঁড়ে এসে বলতে লাগল

– বাচ্চার আওয়াজ কোথায় শোনা যাচ্ছে রে?

বলেই সন্ধির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল

– তার মানে সন্ধির বাচ্চা হয়ে গেছে?

বলেই সন্ধির পাশে আসলো। আমি আর সায়রা আপু দুজনেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। বিভৎস এক বাচ্চা জন্ম দিয়েছে সন্ধি। বাচ্চাটা দেখেই আমার মনে প্রশ্ন জাগল এটা কি সত্যিই জার্নিভার বাচ্চা? জার্নিভা তো বলেছিল তার বাচ্চা অনেক ফুটফুটে ছিল তবে এ বাচ্চাটা অনেক ভয়ংকর দেখতে কেন?দেখলেই যেন ভয়ে গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠছে আর শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে।বাচ্চার দু ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। সন্ধি পাশেই অজ্ঞানের মতো শুয়ে আছে। এদিকে আমি আর সায়রা আপু ভয়ে আঁৎকে উঠছি বারবার।

খানিক সময় পর বাচ্চাটা আপুর হাত কামড়ে ধরল। আপু ভয়ে বাচ্চাটাকে সরাতে নিলে বাচ্চাটা যেন আপুকে আরও আঁকড়ে ধরল। আমিও বাচ্চাটাকে কোনরকম ধরে টান দিলাম। বাচ্চাটা আপুর হাতে মাংস খুবলে নিয়ে আসলো। এমন অবস্থায় দেখে আমি বাচ্চাটাকে জোরে ফিকা মারি। বাচ্চাটা দূরে মেঝেতে গিয়ে পড়ে খিল খিল করে হাসতে থাকে। সেই সাথে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বাচ্চাটা দেখতে সুন্দর হয়ে যায় অর্থাৎ আলোর সংস্পর্শে বাচ্চাটার রূপ পরিবর্তন হয়ে যায়। বাচ্চাটার এ রূপটা যেন বেশ মায়াময়। বাচ্চাটার এ রূপটা দেখে কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে যাই। আপুর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আপুর হাত থেকে রক্ত পড়ছে। কিছু অংশ মাংস উঠে এসেছে। আপুর হাতটা ধরে কোনো রকমে ব্যান্ডেজ করলাম। বাচ্চাটাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। একটু আগে বাচ্চাটার যে হিংস্রতা খেয়াল করলাম বাচ্চাটা যদি আর কিছুক্ষণ এমন অবস্থায় থাকত তাহলে সবার প্রাণ যেত। তবে এখন বাচ্চাটা বেশ শান্ত হয়ে আছে। এতটায় মায়া ভরা যে মেঝে থেকে তুলতে বাধ্য হলাম। তবে এখন আশ্চর্যজনক হলে সত্যি যে বাচ্চাটা তেমন কিছুই করল না। বাচ্চাটাকে নিয়ে শুইয়ে দিলাম। তবে মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন জাগতে শুরু করল। সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। সন্ধির মুখে কয়েকবার পানির ঝাঁপটা দেওয়ার পরও সন্ধির জ্ঞান ফিরল না। অপর দিকে হাসিবের কথা ভাবতে লাগলাম সে তো পাশের রুমে ছিল তাহলে সে কোথায় এখন? পাশের রুমে গিয়ে হাসিবকে পেলাম না।সারা বাড়িতে হাসিবকে খুঁজে পেলাম না।হাসিব কোথায় গেল বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম।

অপরদিকে আমি বাচ্চাটাকে নিয়েও চিন্তায় পড়ে গেলাম। অজানা কিছু প্রশ্ন মনে বিদ্ধ করতে লাগল। দৌঁড়ে গেলাম বেলী ফুল গাছটার পাশে। মনে হলো এখানে জার্নিভাকে ডাক দিলে ও আসবে। তাই মনে মনে ওকে ডাকতে লাগলাম। আমার বিশ্বাসটা সত্যি হলো। জার্নিভা হাজির হলো। জার্নিভা আসার সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম

– হাসিব কোথায় আছে? ওকে কোথায় গায়েব করেছ তুমি? আর তুমি তো বলেছিলে তোমার বাচ্চা অনেক সুন্দর ছিল। তবে কেন সে রাতে এত হিংস্র কাজ করল। এর কারণ কি?

তারপর জার্নিভা যা বলল তা শোনে বুকটা কেঁপে উঠল। কারণ এক কাহিনির অবসান ঘটাতে গিয়ে অন্য এক বিভৎস কাহিনির সূচণা হয়েছে।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here