রুপকথার খোঁজে পর্ব -০১

নিজের প্রাক্তনকে ননদের হবু বরের স্থানে দেখে কিঞ্চিত চমকে উঠলো রুহামা। বুকের ভেতর এক অজানা উচাটন শুরু হলো। এই উচাটনের অনুভূতিটা বড্ড নতুন। পৃথিবীটা গোলাকার জানা ছিলো, তবে আনুমানিক সতেরো কোটি মানুষের মাঝে সাঈদকেই আদিবার হবু স্বামী হতে হবে এই আশ্চর্য কাকতালীয় ব্যাপারখানা কিছু্তেই হজম হচ্ছে না তার। সাঈদ রুহানার স্বামীর অফিসে কাজ করে। ভালো ছেলে বলে তার সুনাম আছে। তাই নিজের বোনের সাথে এই বিয়ের সম্বন্ধ করে সে। কিন্তু সেই ভালো ছেলেটি তার স্ত্রীর প্রাক্তন হবে সেটা কে জানতো। একরাশ বিস্ময়, আক্ষেপ, ভয় এবং কিঞ্চিত বেদনাপ্রবণ চোখে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রুহামা। সাঈদ এক অপলক রুহামার দিয়ে চাইলো, বিস্ময়ের সূক্ষ্ণ ছাপ তার মুখে, হয়তো সেও রুহামাকে এখানে আশা করে নি। এর মাঝেই রুহামার শাশুড়ী সুমাইয়া বেগম মৃদু স্বরে বলে উঠলেন,
“বউমা, যাও তো আদিবাকে নিইয়ে এসো”

পা জোড়া নিথর হয়ে আছে রুহামার। অতীতের পৃষ্ঠাটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। কেনো যেনো নড়তেই চাইছে না শরীর। শাশুড়ীর কথাটা শুনেও কেনো যেনো সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। রুহামাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার স্বামী আকরাম তার গায়ে আলতো করে ধাক্কা দেয়। আকরামের ধাক্কায় স্বম্বিত ফেরে রুহামার। আড়ষ্টতার সাথে সে জিজ্ঞেস করে,
“জ্বী?”
“মা, তোমাকে কিছু বলছে। শুনছো না কেনো?”

আকরামের কিঞ্চিত ঝাঁঝালো কন্ঠে বেশ বিব্রতবোধ করলো রুহামা। তারপর কোনো কথা না বলেই আদিবাকে আনতে পা বাড়ালো। তার সাথে আকরামের বিয়ে হয়েছে দু মাস হতে চললো, বর হিসেবে আকরামকে ঠিক কোনো ক্যাটাগরীতে ফেলা যায় বুঝে উঠতে পারে না রুহামা। সর্বদাই একটা গাম্ভীর্য তার মুখশ্রীতে আঠার ন্যায় লেগে থাকে। সামান্য কথাতেও ঝাঁঝালো আভাষ পাওয়া যায়। রুহামার সাথে বিয়েটা তার পারিবারিক ভাবেই হয়েছিলো। বাবা-মায়ের বাধ্য কন্যা হিসেবে এই গম্ভীর মানুষটাকে বিয়ে করার সময় কোনো আপত্তি জানায় নি রুহামা। কারণ সে প্রায় গল্পে পড়তো বর নামক মানুষগুলো গম্ভীর হয়। তারা বাহিরে যেমন নারিকেলের ন্যায় শক্ত ভেতরে শাঁসের ন্যায় নরম। কিন্তু আকরামের ক্ষেত্রে কথাটা প্রযোজ্য নয়, সে ভেতরেও বাহিরের ন্যায় ই কঠিন। তাই তো তার কথাগুলো শুরু টা হয়, “রুহামা তুমি এমন কেনো? কেনো কিছুই কি হয় না তোমার দ্বারা?” আর শেষ হয়, “আমার এগুলো একেবারেই সহ্য হয় না, এজন্য মাকে বলেছিলাম, বয়সে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিও না আমার সাথে”। হ্যা, আকরাম তার থেকে বেশ বড়। সরকারী চাকরীওয়ালা বিধায় বাবা তার বয়সটাকে অগ্রাহ্য ই করেছেন। রুহামাও তাই করেছে। বয়স দিয়ে কি হবে? মানুষটির মনের বয়সের মিল হলেই চলবে।

আদিবা একটি সবুজ শাড়ী পড়েছে, লম্বা চুলগুলো খোঁপার বেঁধেছে। মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। হালকা সাজসজ্জায় একেবারে উপন্যাসের নায়িকাদের ন্যায় ঠেঁকছে রুহামার কাছে। মৃদু হেসে বললো,
“চলো ননদিনী, মা ডাকছেন”
“আমায় কেমন লাগছে গো ভাবী?”
“খুব সুন্দর, পাত্রপক্ষ চোখ সড়াতেই পারবে না”
“তাকে দেখেছো?”

আদিবা ঈষৎ লাজুক স্বরে কথাটা বললো আদিবা। প্রশ্নটা খুব কঠিন নয়, কিন্তু কেনো যেনো রুহামার প্রচ্ছন্ন হৃদয়ে কৃষ্ণমেঘেরা হানা দিলো। হ্যা দেখেছে, সাঈদের প্রসন্ন মুখখানা নজর এড়ায় নি রুহামার। সাঈদের সাথে রুহামার বিচ্ছেদটা ঠিক কবে হয়েছিলো মনে পড়ছে না তার, তবে এটুকু মনে আছে সেদিন খুব কেঁদেছিলো রুহামা। কাঁদবেই না কেনো? প্রথম প্রেম বলে কথা। এখন সাঈদের স্মৃতি গুলো ঝাপসা হলেও তখন জীবন্ত ছিলো। মাংস কাটলেও এতোটা যন্ত্রণা হয় না, যতটা আশায় টুইটুম্বুর হৃদয় ভাঙ্গলে হয়। সূক্ষ্ণ চিনচিনে অসহ্য যন্ত্রণা।
“কি হলো ভাবী, বলো?”
“হু, দেখেছি”
“কেমন দেখতে? ছবির মতোই?”
“ঠিক বলতে পারছি না, কারণ আমি ছবিটি দেখি নি”

মেকি হাসির প্রলেপ লেপ্টে কথাটা বললো রুহামা। আদিবা তখন একরাশ বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
“কেনো?”
“তোমার ভাই এর কাছে চাইতেই কড়া স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি জেনে কি করবে?’ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ছিলো না, তাই দ্বিতীয়বার আর চাই নি। আসলেই তো আমি দেখে কি করবো?”
“বাহ রে! তোমার কোনো মতামত নেই?”
“আছে, তবে প্রযোজ্য কি না বুঝতে পারছি না। বাদ দাও আমার কথা, মা ডাকছেন। চলো, নয়তো মহারাজের হুংকার শুরু হবে”
“ভাইয়াকে খুব ভয় পাও তাই না?”

রুহামা উত্তর দিলো না, কারণ সে উত্তরটি নিজেই জানে না। আকরামকে সে ভয় পায় কি না তার জানা নেই। তবে বেশ শ্রদ্ধা করে সে। আকরামের ছোট তিন বোন, আদিবা ব্যাতীত বড় দুজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একজন থাকে ময়মনসিংহ, ছেলের পরীক্ষা বিধায় আসতে পারলো না। আর আরেকজন দেশের বাহিরে থাকে। প্রতিবছর দেশে আসার কথা থাকলেও এই মহামারীর জন্য সে আসতে পারছে না। বর্ডার এই খোলা তো এই বন্ধ। তাই এই মহামারীর অন্ত হলেই আফিয়া দেশে আসবে। বোনেদের বিয়ে দেবার জন্য নিজের সংসারের কথা সে চিন্তা করে নি, অবশেষে সুমাইয়া বেগমের জোরাজোরির কাছে নতমস্তক হতে হলো তার। বিয়ে করতে হলো নিজ থেকে ন বছরের ছোট রুহামাকে। রুহামার মাঝে মাঝে মনে হয়, লোকটি হয়তো বয়সের ব্যাবধানের জন্য রুহামাকে বুঝতে পারে না। এটা অবশ্য ভুল নয়, সময় পাল্টাচ্ছে। রুহামা নিজেই তার একাদশ শ্রেণীতে পড়া বোনের সাথে নিজের চিন্তাধারার কোনো মিল পায় না।

আদিবাকে তার শাশুড়ী আংটি পড়িয়ে দিলো। রুহামা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাঈদের ঈষৎ বিব্রত মুখোপানে। রুহামাকে দেখবার পর ই তার প্রসন্নতা ঢাকা পড়েছে আড়ষ্টতার আড়ালে। এই ভাবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি একটা সময়ে রুহামাকে দিয়েছিলো সে। সম্পর্কের সময়ে প্রায়ই রুহামা তাকে শুধাতো,
“আমাদের বিয়ে হবে তো? আমাদের রুপকথার ইতি সুন্দর হবে তো?”

সাঈদ হেসে বলতো,
“না হলে আমি তো আছি”

হ্যা সে ছিলো অবশ্য, কিন্তু এখন সব অতীত। এখন রুহামার ভবিষ্যত কেবল গম্ভীর আকরাম।

পাত্রপক্ষ এবার উঠে দাঁড়ালো, তারা বাসার জন্য রওনা দিবে। সাঈদদের বাড়িটি পুরান ঢাকার কাছাকাছি, উত্তরা থেকে বেশ দূরে। তাই সন্ধ্যা নামার আগেই তারা রওনা দিবে। সুমাইয়া বেগমের বয়স হবার কারণে তিনি গেট অবধি এগিয়ে দিতে গেলেন না। তার বদলে আকরাম এবং রুহামাই পাত্রপক্ষকে গেট অবধি এগিয়ে দিতে নামলো। সিএনজি তে উঠার পর সেই সিএনজি চালক গাড়ি ছাড়বে তখনই তাকে থামতে বললো সাঈদ, সিএনজি থেকে নেমে পকেট হাতড়াতে থাকলো সে। আকরাম সাঈদের এরুপ কার্য দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে সাঈদ?”
“ভাই, আমার মোবাইল টা বোধ হয় আপনাদের সোফায় রেখে এসেছি”
“তুমি দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি”

আকরাম লিফটে উঠলো। রুহামা যাইতে চাইলে তাকে গম্ভীর গলায় বললো,
“তুমি এখানে থাকো”

রুহামার অস্বস্তিতে গা গুলোচ্ছে, প্রাক্তনের সাথে দাঁড়িয়ে থাকাটা এতোটা বিশ্রী অনুভূতি আগে জানা ছিলো না তার। একটা সময় ছিলো যখন এই মানুষটার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতো, আড্ডা দিতো। অথচ আজ পাশাপাশি দাঁড়াতেই বিরক্ত লাগছে রুহামার। ঠিক তখনই সাঈদ জড়তা জড়ানো গলায় বলে উঠে,
“কেমন আছো রুহামা?”

রুহামা সরু নজরে চাইলো সাঈদের দিকে, চোখে ক্রোধের ঝলকানি। ‘কেমন আছো?’ এই প্রশ্নটি কি আদোপি সাজে এই লোকটির মুখে। বছর কতক পড়ে কি দরদ উতলে উঠেছে? নাকি সে তলিয়ে দেখছে রুহামা কেমন আছে? এখন ও কি সেই রুহামা আছে সে কিনা তার অপেক্ষে বিভোর থাকতো, তার কষ্ট হলে নিজে ঘুমড়ে মরতো। যখন নির্দয়ের মতো বলেছিলো, ‘রুহামা, তোমার প্রতি ভালোবাসাটা মরে গেছে। আমরা একই সাইকোলোজিক্যাল ফেজে নেই’ তখন তাকে হাতে পায়ে ধরে বলেছিলো ‘আমাকে ছেড়ে যেও না, কিভাবে নিজেকে বদলাবো বলে দাও’ কথাগুলো ভাবতেই একরাশ ক্ষোভে ভেতরটা জ্বালা করতে লাগলো। চোয়াল হয়ে গেলো কঠিন। স্বরে জড়তার বালাই না রেখে প্রচন্ড ক্ষোভে বলে উঠলো,
“আমার কি খারাপ থাকার কথা সাঈদ?”
“সেভাবে বলি নি”
“কিভাবে বলেছো সেটা বুঝানোর প্রয়োজন নেই, আমি বুঝি। শোনো আমি খুব ভালো আছি, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার। তুমি তোমাকে নিয়ে ভাবো। আর একটা কথা, আদিবা আকরামের আদরের বোন, তার সাথে অন্তত সাইকোলোজিক্যাল ফেজটা মিলিয়ে নিয়ো। এবার যদি সেটা না মিলে, তবে কিন্তু আকরাম তোমাকে ছেড়ে দিবে না। সে দেখবে না তুমি তার জুনিয়র কি না”
“তুমি আমায় ক্ষমা করো নি তাই না?”

সাঈদের মুখে এই প্রশ্নটি শুনে আবারো অবাক হয় রুহামা। সে সাঈদকে ক্ষমা করে নি বললে ভুল হবে, ক্ষমা সে বহু পূর্বেই করেছে। কিন্তু প্রাক্তনের সাথে এক অযাচিত তিক্ততা জড়িত থাকে। উপরন্তু লোকটি তার ননদের হবু স্বামী, তাই তিক্ততার সাথে কিঞ্চিত ভয়ও হচ্ছে। আদিবার পরিণতি যদি তার ন্যায় হয়, সাঈদ মানুষটিকে সে খারাপ বলবে না। তাদের সম্পর্কের দিনগুলোতে অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে। শুধু হুট করেই সাঈদ একদিন বললো,
“রুহামা, তোমার প্রতি ভালোবাসাটা মরে গেছে। আমরা একই সাইকোলোজিক্যাল ফেজে নেই। আমাদের কোনো ভবিষ্যত নেই। তুমি আরোও ভালো ছেলে পাবে”

কথাগুলো বেশ উটকো লেগেছিলো রুহামার। সেদিন ভেঙ্গে গিয়েছিলো সে। রুহামা চায় না আদিবার সাথে এমন কিছু হোক। তাই সাঈদের প্রতি তার এমন বৈরী আচরণ। রুহামা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে বলল,
“অতীতে মানুষ ভুল করে, তুমিও করেছো আমিও। সেই ভুল শুধরে নেওয়াই বুদ্ধিমানের। আমি আকরামের সাথে সুখে আছি। তুমি আদিবাকে সুখে রাখার চিন্তা করলেই ভালো। এখানে দুটো মানুষের জীবন নয়, দুটো পরিবার জড়িত। এটা বিয়ে, কোনো প্রেম নামক সস্তা রিলেশন নয়। আশাকরি বুঝেছো”

ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বললো রুহামা। রুহামার কথাগুলো শুনে ঈষৎ অবাক হয় সাঈদ। ছেলেমানুষ রুহামার ঝলক নেই আজ। এ যেনো পূর্ণাঙ্গ রমনী। সাঈদের মনে এক অজানা আক্ষেপ হাতছাতি দিলো। রুহামা কথাগুলো বলেই ঘুরে দাঁড়ালো। আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তখনই নজরে পড়লো আকরাম তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আকরামের চোখজোড়া রক্তিম হয়ে আছে। চোখজোড়ায় চোখ রাখতে ভেতরটা কেঁপে উঠলো রুহামার। কিছু বলবে তার আগেই………………

চলবে???

[

#রুপকথার_খোঁজে
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here