রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -১৪

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৪
#Saiyara_Hossain_Kayanat

ঘুমের মধ্যে আচমকা ‘কাসফি’ বলে জোর চিৎকার দিয়ে উঠলো আরশি। আরশির চিৎকারে আদ্রাফ নীলা আর নীল উত্তেজিত হয়ে কেবিনে ছুটে আসলো। ঘুমের মধ্যে ভয়ে বিরবির করার জন্য আরশিকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দু ঘন্টা পেরুতেই আরশির ঘুম ভেঙে যাবে এটা হয়তো কেউ ধারণা করেনি। আদ্রাফ আরশির কাছে এসে চিন্তিত গলায় বললো-

“আশু কি হয়েছে?? তুই ঠিক আছিস তো??”

আদ্রাফ আরশির কাছ থেকে কোনো প্রতিত্তোর পেল না। আরশি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। চোখে মুখে আতংকের ছাপ। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বার বার আশেপাশে তাকাচ্ছে। নীলা আরশির কাছে এসে ওর শরীরে হাত দিতেই আরশি নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলো। আদ্রাফ আর নীল দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। কাসফিয়া অন্য একটা কেবিনে ঘুমিয়ে আছে। সেখানেই আরশি আর কাসফিয়ার আব্বু বসে আছে। আদ্রাফ আর নীল কাসফিয়ার কেবিনে এসে আরশির আব্বু আদিব হাসানের উদ্দেশ্যে বলল-

“আংকেল আরশির ঘুম ভেঙে গেছে। তবে ও কেমন যেন করছে।”

আদিব হাসান দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন-

“কেন কি হয়েছে আরশির?? এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল কিভাবে!!”

আদিব হাসান উত্তরের অপেক্ষা না করেই আরশির কেবিনের উদ্দেশ্যে অস্থিরতার সাথে ছুটে চলে গেলেন। আর ওনার পেছন পেছন আদ্রাফ আর নীলও চলে যাচ্ছে। কাসফিয়া এতক্ষনে ঘুম থেকে থেকে উঠে বসে আছে। রেজাউল হক ওনার মেয়ের কাছে এগিয়ে আসলেন। কাসফিয়া উদ্বিগ্নতার সাথে বলল-

“বাবা আমি আরশির কাছে যাবো।”

রেজাউল হক ওনার মেয়েকে চোখের ইশারা সম্মতি জানালেন। কাসফিয়াকে ধরে বেড থেকে নামিয়ে দাঁড় করালেন। হাতে প্লাস্টার লাগানোর ফলে নড়াচড়া করতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে কাসফিয়ার। আদিব হাসান কেবিনে এসে মেয়েকে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখে তার চোখ ছলছল করে উঠলো। তার হাস্যজ্বল মেয়ের জীবনটা হঠাৎ করেই একটা ঝড় এসে এভাবে লন্ডবন্ড করে দিয়ে যাবে এমনটা তো সে আশা করেনি। আদিব হাসান আরশির কাছে এগিয়ে এসেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। মেয়েটা আজ কত বড় একটা ঘৃণ্যতম পরিস্থিতির শিকার হয়েছে ভাবতেই তার বুক বার বার কেঁপে উঠছে। একটা মেয়ের জন্য হয়তো এর থেকে ভয়ংকর পরিস্থিতি আর কিছু নেই। আরশি কিভাবে সামলিয়ে উঠবে এই পরিস্থিতি থেকে!! কিভাবে তার মস্তিষ্ক থেকে এই জঘন্য স্মৃতি গুলো মুছে ফেলবে!!

কাসফিয়া কেবিনে আসতেই আরশি মাথা তুলে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো। অপলকভাবে তাকিয়ে আছে কাসফিয়ার হাতের দিকে। আজ তাকে বাঁচাতেই তো কাসফিয়ার হাতের এই অবস্থা হলো। যদি আজ কাসফিয়া না থাকতো তাহলে কি হতো?? একজন ধর্ষিতা হয়ে যেত!! কথাটা ভাবতেই ভয়ে আরশির আঁতকে উঠছে বার বার।

—————————

আজ দশদিন হয়েছে। অথচ আরশির কোনো চিঠি পেলো না রৌদ্রর। অনেক বার ফোন করেছিল আরশির নাম্বারে তবে প্রতিবারই ফোন অফ এসেছে। এমনকি আরশির ফ্ল্যাটে এসেও কোনো খোঁজ পায়নি। কাসফিয়ার কোনো নাম্বারও রৌদ্রর কাছে নেই যে যোগাযোগ করবে। তাই আজ বাধ্য হয়েই আরশির ভার্সিটিতে এসেছে খোঁজ নেওয়ার উদ্দেশ্যে। ভার্সিটিতে এসে কিছু স্টুডেন্টদের কাছে জানতে চেয়েও কোনো খোঁজ পায়নি। রৌদ্রকে প্রচন্ড রোদে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দেখে ভার্সিটির দারোয়ান রহিম মিয়া ভ্রু কুচকে বললেন-

“কাউরে খুজেন নাকি স্যার?? মেলা সময় ধইরা দেখতাছি পোলাপানদের কিছু জিগাইতাছেন।”

রৌদ্র কিছুটা সময় চুপ থেকে। শার্টের হাতায় কপালের ঘাম মুছে ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বললো-

“আসলে আংকেল এখানের দুটো মেয়েকে খুজছিলাম। হঠাৎ করেই ওদের সাথে যোগাযোগ অফ হয়ে গেছে তাই আরকি।”

“যোগাযোগ বন্ধ হইলো কেমনে?? ফোন নাম্বার নাই?? আর মাইয়াগো নাম কি?”

রৌদ্র দারোয়ানের কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে বললো-

“নাম্বার ছিল কিন্তু এখন অফ। ওদের নাম আরশি আর কাসফিয়া। আপনি যদি কোনো ভাবে একটু হেল্প করতেন তাহলে খুব ভালো হতো আংকেল।”

দারোয়ান রহিম মিয়া খানিকটা সময় ভেবে বললেন-

“আপনে কি ওই পাঁচ জনের কথা কইতাছেন সব সময় যে এক লগে থাহে। আর দুইটা তো মনে হয় আবার জমোক পোলাপান। সব সময় দেখতাম আশু আশু কইরা চিল্লায় সব গুলা।”

আশু নামটা শুনেই খুশিতে রৌদ্রর মুখ ঝলঝল করে উঠলো। অস্থির কন্ঠে বললো-

“হ্যাঁ হ্যাঁ… আশু আর কাসফির কথা বলছি। আপনি কিছু জানেন ওদের কথা??”

সাথে সাথেই রহিম মিয়ার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। মলিন মুখে বলল-

“ওরা পাঁচজনেই বইলে ছুটি কাডানের লাইগা গ্রামে গেছিল। বেশি কিছু তো শুনি নাই কিন্তু কয়দিন আগে কয়ডা পোলাপানের মুখে শুনলাম ওরা যাওয়ার পথেই বইলে এক্সিডেন্ট করছে। মনে হয় বড়সড় এক্সিডেন্টই হইছিলো এরপর থাইক্কাই ওগো আর দেহি নাই।”

কথা গুলো শোনার সাথে সাথেই রৌদ্রর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। রৌদ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকটা সময়। মনে হচ্ছে কিছু বলার মতো শক্তি তার মধ্যে নেই। রৌদ্রর কোনো কথা না বলেই চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে ফুটপাত দিয়ে।

————————

নীল, আদ্রাফ, নীলা আর কাসফিয়া মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। ছাদের এক কোণায় নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশি। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হসপিটাল থেকে আসার পর একদমই চুপচাপ হয়ে গেছে। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই কাসফিয়ার সাথে চুপচাপ বসে থেকে কাটিয়ে দেয়। আর সুযোগ পেলেই ছাদে এসে আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নীলা আরশির দিকে তাকিয়ে থেকেই মৃদুস্বরে বলল-

“ডক্টর তো বলেছিল ভয় কেটে গেলেই আরশি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এতদিন হয়ে গেল অথচ আরশি এখনো সব সময়ই মনমরা হয়ে থাকে।”

আদ্রাফ নীলের কাধে হাত রেখে আরশির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল-

“চল আরশির কাছে।”

সবাই এসে আরশির দু পাশের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গেল। কাসফিয়া বাম হাতে আরশির কাধে রেখে বলল-

“এত রাতে এখানে কি করছিস আশু??”

আরশি সব সময়ের মতো এবারও ভাবলেশহীন ভাবে ছোট্ট করে উত্তর দিল-

“কিছু না।”

আদ্রাফ আরশির দু কাধে হাত দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে শান্ত গলায় বললো-

“আশু এটা কিন্তু তুই একদমই ঠিক করছিস না। আমাদেরকে তোর বাসা নিয়ে এসেছিস এভাবে চুপচাপ বসে থাকার জন্য!! শোন আশু যা হয়েছে সব ভুলে যা। এখনো কেন ওইসব নিয়েই মন খারাপ করে বসে আছিস বল তো??”

আরশি চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রাফের পাশ থেকে নীল শক্ত গলায় বললো-

“একে বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই আদ্রাফ। ও ওর মতোই থাকবে। আমাদের কোনো মূল্য আছে নাকি ওর কাছে?? পনেরো দিন ধরে আমরা এখানে আছি অথচ একটা দিনও দেখেছিস ও আমাদের সাথে একটু ভালো মতো কথা বলেছে!! আরশি তুই তোর মতোই থাক আমরা সবাই কালকেই এখান থেকে চলে যাব।”

নীলের কথা গুলো শুনে আরশি মাথা তুলে তাকালো ওদের দিকে। কাসফিয়া নীলের কথায় সায় দিয়ে বলল-

“নীল ঠিকই বলেছে। শুধু শুধু এখানে থেকে কি করবি!! তোরা সবাই না হয় কাল সকালেই ঢাকা চলে যা।”

নীলা আরশিকে বললো-

“আরশি তুই বরং এখানেই থাক আমরা এখন নিচে যাই। সব কিছু গোছগাছ করতে হবে।”

“হ্যাঁ চল সবাই।”

আদ্রাফ কথাটা বলেই ছাদ থেকে চলে গেল। সাথে সাথে নীল আর নীলাও চলে গেলো। আরশি ওদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। কাসফিয়া আরশির কাধে হাত দিয়ে বললো-

“তুই এটা একদমই ঠিক করলি না আশু। ওরা সবাই কত চেষ্টা করে যাচ্ছে তোর সাথে একটু কথা বলার জন্য। তোকে হাসানোর জন্য কত কিছু করেছে এই ক’দিন কিন্তু তুই তো নিজের মতোই মনমরা হয়ে বসে থাকিস। যা হয়ে গেছে তার জন্য শুধু শুধু আমাদেরকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিস কেন!! আমাদের সবাইকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস!! তোকে এইভাবে দেখে আংকেল আন্টি কতটা কষ্ট পাচ্ছে জানিস তুই?? একবারও খেয়াল করেছিস ওনারা তোকে নিয়ে কতটা চিন্তায় থাকে সারাক্ষণ!!”

কাসফিয়ার কথায় আরশি মাথা নিচু করে ফেললো। চোখ পানিতে চিকচিক করেছে। মনে হচ্ছে এখনই চোখ থেকে গড়িয়ে পরবে। কাসফিয়া গম্ভীর ভাবে পা ফেলে নিচে চলে গেল। সাথে সাথেই আরশির গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো। আরশি ঝাপসা দৃষ্টিতে কাসফিয়ার যাওয়ার পথে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সবাই কি তাহলে আরশিকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে?? আরশি মনে মনে কথাটা ভেবেই নিশ্চুপে চোখেরজল ফেলে যাচ্ছে।

————————

রৌদ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাখিগুলোকে খাবার দিচ্ছে। আর মাঝেমধ্যে পাশের বারান্দায় তাকাচ্ছে।আরশিদের ভার্সিটি থেকে আসার পরেই রৌদ্র খুব গম্ভীর হয়ে উঠেছে। সারাদিন হসপিটালে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে যেন আরশির কথা তার মাথায় না আসে। এতো ব্যস্ততার পরেও দিন শেষে চাতক পাখির মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার পাশের বারান্দার দিকে। এখন আর আগের মতো আরশি আর কাসফিয়ার চেচামেচির শব্দ শোনা যায় না। পাখিটাও আর কোনো কথা বলে না। বারান্দায় এখন আর লাল রঙের চিরকুট পাওয়া যায় না। রৌদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিল। এভাবেই কি শেষ হয়ে যাবে সব কিছু?? রুদ্রাণী কি আর আসবে না তার শহরে!! কেমন আছে আরশি?? আরশির কি কোনো ক্ষতি হয়েছে? খুব বড় এক্সিডেন্টই কি হয়েছে?? রৌদ্র প্রশ্ন গুলো ভেবে নিজের মনেই আওড়াতে লাগলো উত্তরের খোঁজে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও নিরাশ হলো।

ভোর সকাল সাড়ে পাঁচ টায় আরশি মাথায় ওড়না পেচিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। দোতালা বড় বাড়ির পাশের পাশের দোতলা বাড়িটাই কাসফিয়াদের। দু বাড়ির মাঝে এক বিশাল দেয়াল। দেয়ালের মাঝখানেই বড় একটা গেইট। এই গেইট দিয়েই দু পরিবারের মানুষ একে অপরের বাসায় আসা যাওয়া করে। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা এই গেইট খোলাই থাকে। আরশি বাগান পেরিয়ে কাসফিয়াদের বাসায় চলে গেল। নীলা আর কাসফিয়া আরশির বাসায় আরশির রুমে ঘুমাচ্ছে। তারা দু’জন আরশির সাথেই থাকে আর কাসফিয়ার বাসায় থেকে আদ্রাফ আর নীল এক সাথে থাকে। আরশি কলিং বেল বাজানোর খানিকটা সময় পরেই কাসফিয়ার আম্মু রাবেয়া বেগম দরজা খুলে দিলেন। ঘুম ঘুম চোখে আরশির দিকে তাকয়ে ওনার ঘুম নিমিষেই চলে গেল। চোখ বড় বড় করে আরশির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে বললেন-

“আরশি মামুনি তুই এই সময় এখানে কি করছিস?? তুই ঠিক আছিস তো??”

আরশি চোখের ইশারা হ্যাঁ বলেই ভিতরে চলে আসলো। রাবেয়া বেগম আরশির পেছন পেছন যাচ্ছে। আরশি ওয়াশরুম থেকে এক বালতি পানি নিয়ে দোতলায় চলে যাচ্ছে। আরশির এমন অদ্ভুত কাজে রাবেয়া বেগম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পেছন থেকে কিছুটা উঁচু গলায় আরশিকে জিজ্ঞেস করলো-

“আরশি কি করছিস এসব! পানি নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস মা??”

আরশি কিছু না বলে নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওনাকে চুপ থাকতে ইশারা করলেন। আরশি নীল আর আদ্রাফের রুমে এসে তাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকেই পুরো বালতির পানি ঢেলে দিল তাদের উপর। রাবেয়া বেগম হতবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আরশির কর্মকাণ্ড। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করেই গায়ে পানি পরায় একপ্রকার লাফিয়ে উঠে গেল আদ্রাফ আর নীল। চোখ ভালো মতো না খুলেই দু হাত দিয়ে আশেপাশে আওড়াতে লাগলো। দু’জনেই চিল্লাচিল্লি করে যাচ্ছে চোখ বন্ধ করে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here