রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -২১

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২১
#Saiyara_Hossain_Kayanat

আরশি সরু চোখে রৌদ্রর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে নিজের শরীরের দিকে তাকালো। রৌদ্র চোখে সানগ্লাস পরে, নীল রঙের শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাজ করে বেশ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইকের সাথে। আরশি ধীর পায়ে রৌদ্রর সামনে এগিয়ে এসে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর শার্টের দিকে। রৌদ্র চোখের থেকে সানগ্লাস খুলে শান্ত গলায় বললো-

“বাহহ.. আপনিও দেখছি নীল রঙের ড্রেস পরেছেন মিস আরু।”

আরশি কোনো কিছু বলছে না শুধু গোলগোল চোখ তাকিয়ে আছে। রৌদ্রর আরশির দিকে খানিকটা ঝুঁকে মুখোমুখি হয়ে বলল-

“কোনো বিশেষ কারণ আছে না-কি নীল রঙের ড্রেস পরার পেছনে??”

আরশি স্থির চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর চোখের দিকে। বাদামি রঙের চোখে সূর্যের তীর্যক আলো পরায় চোখের লেন্স গুলো খুব মোহনীয় লাগছে। আরশি যেন কোনো ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। রৌদ্র আরশির কপালে আস্তে একটা টোকা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল-

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন মিস আরু?”

আরশি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। অন্য দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল-

“অদ্ভুত!!! একটা ছেলের চোখে এতো সুন্দর হয় না-কি!! কই আমার চোখ এমন জ্বলজ্বল করে না কেন মুক্তার মতো!! ছিঃ ছিঃ আমি এসব কি করছিলাম! কেমন করে তাকিয়ে ছিলাম ওনার দিকে। না জানি উনি কি ভাবছেন।”

রৌদ্রর এবারও প্রতিত্তোরে কোনো জবাব না পেয়ে রেগে গেল। মৃদুস্বরে ধমক দিয়ে বলল-

“বোবার মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? কি এতো ভাবেন মনে মনে?? ভাবনার জগৎ থেকে একটু বের হয়ে বাস্তবে ফিরে আসুন মিস আরু।”

আরশি ক্ষিপ্ত হয়ে ভ্রু কুচকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

“আপনি নীল রঙের শার্ট পরেছেন কেন আজ??”

রৌদ্র বাইকে বসে হেলমেট হাতে নিয়ে শান্ত গলায় বললো-

“ঠিক এই একই প্রশ্ন তো আমিও আপনাকে করতে পারি মিস আরু।”

আরশি আর কথা বাড়ালো না। মুখ গোমড়া করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র আরশির দিকে হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বলল-

“এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে হেলমেট পরে বাইকে উঠে বসুন। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“কিইই?? আমি আপনার সাথে বাইকে করে যাবো??”

আরশি চোখ গুলো বড়বড় করে খানিকটা চেচিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করালো। রৌদ্র নির্লিপ্ত ভাবে বললো-

“নাহ বাইকে কেন বসবেন!! আপনি তো আমার ঘাড়ে চড়ে যাবেন।”

আরশি তীক্ষ্ণতার সাথে বলল-

“আপনার মুখ থেকে কি এসব তিতা কথা ছাড়া আর কিছু বের হয় না!!”

“আপনি শুনতে চাইলে অনেক কিছুই বলতে পারি। যাইহোক তাড়াতাড়ি করুন।”

আরশি অবাক হয়ে হেলমেটের দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলল-

“আমি আসলে বাইকে চড়তে পারি না। আজ পর্যন্ত শুধু মাত্র দুএকবার নীলের বাইকে উঠেছিলাম অল্প সময়ের জন্য।”

রৌদ্র আরশির কথায় চোখমুখ শক্ত করে আরশির মাথায় হেলমেট পড়িয়ে দিতে লাগলো। আরশি রৌদ্রর এমন কাজে লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেললো। রৌদ্র শক্ত গলায় বললো-

“চুপচাপ বাইকে উঠে বসুন। কাছাকাছি বসতে অস্বস্তি লাগলে মাঝেখানে ব্যাগ রেখে দিতে পারেন।”

আরশি রৌদ্রর কথা মতোই চুপচাপ বসে পরলো। রৌদ্র হেলমেট পড়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল-

“আমার কাধে ধরে বসুন মিস আরু।”

আরশি ইতস্তত বোধ করলেও অবশেষে রৌদ্রর কাধে হাত রেখে বসল। ভার্সিটির কাছে পৌঁছে রৌদ্র বাইক থামানোর সাথে সাথেই আরশি হন্তদন্ত হয়ে নেমে পরলো। রৌদ্র ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো-

“এতো তাড়াহুড়ো করছেন কেন? আস্তে-ধীরে নামুন।”

“আপনার সাথে বাইকে করে আসতে দেখলে নীল ওরা আমাকে প্রশ্ন করতে করতে জ্বালিয়ে মারবে।”

আরশি কথা গুলো বলেই আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো কেউ তাকে দেখেছি কি-না।

” ক্লাস শেষ করে আমাকে একটা কল করে জানিয়ে দিবেন। আমি যদি ফ্রী থাকি তাহলে আপনাকে এসে নিয়ে যাবো। আচ্ছা আমি তাহলে এখন আসছি। সাবধানে থাকবেন।”

রৌদ্র কথা গুলো বলে আরশির কোনো কথার অপেক্ষা না করেই বাইক নিয়ে চলে গেল। আরশি রৌদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল-

“অসভ্য লোক আমাকে কিছু বলারই সুযোগ দিলো না।”

——————————

রৌদ্র মধ্য দুপুরের সময় নিজের কেবিনে বসে পকেট থেকে আরশির দেওয়া চিঠিটা বের করলো। আসার সময় বারান্দায় চিঠি দেখে তাড়াতাড়ি করে পকেটে নিয়েই বেরিয়ে পরেছিল। চিঠি খুলে পড়ার সুযোগ পায়নি। চিঠি পড়ার জন্য তার মনটা উশখুশ করছিলো তাই এখন সময় পেয়েই চিঠি পরতে লাগলো।

প্রিয় রৌদ্র,

পাখিদের কি আলাদা নাম লাগে না-কি পরিচয় হতে!! আপনি এসব অদ্ভুত কথা কোথায় শুনেছেন?? যাইহোক আপনার পাখির জন্য খুব সুন্দর একটা নাম ভেবে রেখেছি। আগের ময়না পাখিটার নাম যেহেতু আমার নামে রাখা (আরু নাম টা কেন রেখেছেন সেটা অবশ্যই আমাকে জানাবেন) তাই এই নতুন পাখিটার নাম তো আপনার নামেই রাখা উচিত। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম আপনার সাথে এ্যাংরি বার্ড নামটা বেশ মানায়। তাই এই পাখির নামটা এ্যাংরি বার্ডই রাখা ঠিক হবে। আপনার ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই আজ থেকে ময়না পাখির নাম এ্যাংরি বার্ডই ফাইনাল।

বিঃদ্রঃ আপনাকে মাঝে মাঝে আমার ভূত মনে হয়। আপনার জন্য আমি নিজের রুমে একা একা থেকেও শান্তি পাই না মনে হয় এই বুঝি আপনি অদৃশ্য মানব হয়ে আমার উপর নজর রাখছেন। সত্যি করে বলুন তো আমি কখন কি ভাবি, না ভাবি সেটা আপনি কি করে জানেন??

ইতি
রুদ্রাণী

আরশির চিঠি পড়ে রৌদ্র আনমনেই হেসে দিল। রৌদ্র চিঠির দিকে এক নজরে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছে তবে তার খেয়াল নেই তার এই হাসি অন্য একজনও দেখে যাচ্ছে। খুব মনযোগ দিয়েই রৌদ্রর হাসি দেখে যাচ্ছে কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা।

“ভাইইইই তুমি হাসতাছো কেন?? তোমার হাতে কিসের কাগজ এটা?? দেখি আমার কাছে দাও তো আমিও দেখি।”

নির্বান কথা গুলো বলেই রৌদ্রর চেয়ারের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো। আচমকা নির্বানকে এখানে দেখে রৌদ্র হকচকিয়ে উঠলো। নির্বান রৌদ্রর হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তার আগেই রৌদ্রর বিদ্যুৎএর গতিতে চিঠিটা ডান হাতে নিয়েই দূরে সরিয়ে দিল। নির্বান টেবিলে উপর ঝুঁকে রৌদ্রর ডান হাত থেকে চিঠিটা নিতে গেলেই রৌদ্র চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো। চিঠিটা সুন্দর করে ভাজ করে তৎক্ষনাৎ পকেটে রেখে দিল। নির্বার টেবিলের উপর ঝুঁকে দু’হাতে ভর দিয়েই হতাশ হয়ে বলল-

“ভাইই দেখি না ওইটা কিসের কাগজ ছিল। কি এমন ছিল যে তুমি ওটার দিকে তাকিয়ে হাসছিলে!!”

রৌদ্র নির্বানের কাছে এসে পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল-

“সোজা হয়ে দাড়া। আমার টেবিল অগোছালো করছিস কেন??”

নির্বান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল-

“কিন্তু কাগজটা…”

নির্বানের কথার মাঝেই রৌদ্র স্বাভাবিক হয়ে বলল-

“ওটা একটা রোগীর প্রেসক্রিপশন ছিল আর কিছু না।”

নির্বান সরু চোখে তাকিয়ে সন্দেহর গলায় বলল-

“প্রেসক্রিপশন লাল রঙের কাগজে হয় না-কি!! আচ্ছা ধরে নিলাম ওইটা প্রেসক্রিপশন ছিল। কিন্তু তুমি প্রেসক্রিপশন পড়ে পড়ে হাসছিলে কেন?? মানুষ প্রেসক্রিপশন পড়ে হাসে!! তুমি কি কখনো দেখেছো!! আমি তো কখনো দেখি নাই।”

রৌদ্র নির্বানের কথা শুনে ভড়কে গেলো আমতা-আমতা করে বলল-

“আমি অন্য কথা ভেবে হাসছিলা।”

“তোমাকে তো কখনো জোকস শুনে ও হাসতে দেখলাম না। আজ কি-না বিনাকারণেই হাসছো!! ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না আমার।”

নির্বান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথা গুলো বলল। রৌদ্র নির্বানের কথা শুনে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-

“নির্বান তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। বেশি কথা না বলে এখানে কেন এসেছিস তা বল।”

নির্বার রৌদ্রর সামনের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল-

“আম্মু তোমার জন্য লাঞ্চ পাঠিয়েছে তাই নিয়ে আসলাম।”

————————

“আচ্ছা কাসফির প্লাস্টার খুলবে কবে আশু??”

আরশির ফ্রেন্ডরা সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছলো তার মাঝেই আদ্রাফ হুট করে আরশিকে কাসফিয়ার কথা জিজ্ঞেস করে বসলো। নীলা অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফের চোখে কাসফিয়ার প্রতি ভালোবাসা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নীলা। কাসফিকে আজ না দেখে হয়তো আদ্রাফ অস্থির হয়ে পড়েছে।

“কিছুদিনের মধ্যেই হসপিটালে নিয়ে যাবো।”

আরশির কথায় আদ্রাফ কিছুটা মলিন মুখে বলল-

“কাসফিকে ছাড়া আমাদের আড্ডা ঠিক জমছে না আজ।”

নীল আদ্রাফের কাধে হাত রেখে সায় দিয়ে বলল-

“ঠিক বলেছিস দোস্ত। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলটাই এমন। একজনকে ছাড়া পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলটাই ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়।”

আদ্রাফ মলিন মুখে একটা হাসি দিল। আদ্রাফের মলিন মুখ দেখে নীলার চোখ ছলছল করে উঠলো। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই সবার আড়ালে চোখের পানি মুখে ফেললো। নীলার চোখের পানি সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও একজনের চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনি।
“তোর ভালোবাসা পাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয়তো আমার কখনো হবে না আদ্রাফ। খুব বেশিই কি ক্ষতি হয়ে যেত আমার ভালোবাসা একটু বোঝার চেষ্টা করলে?? আমি মুখে কিছু বলিনি তাই বলে কি তুই একটুও বুঝতে পারলি না আদ্রাফ!!” নীলা আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কথা গুলো বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

আরশি আদ্রাফ আর নীলের সাথে কথা বলার মাঝে নীলাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো-

“কিরে নিলু তুই চুপ করে আছিস কেন??”

আরশির কথায় নীলার ঘোর কাটলো। নীলা আরশির দিকে তাকিয়ে একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল-

“কই না তো আশু।”

চলবে…

(হ্যাপি রিডিং। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here