লতাকরঞ্চ পর্ব ১৪

#লতাকরঞ্চ (১৪)

শাড়ি পরে আসলাম। ওটাকে আমি শাড়ি বলেই মানি। এটা তো শাড়ির মতই। সবাই আবার এটাকে কি বলে? লেহেঙ্গা! আমার আবার এই টাইপের ড্রেসের শখ ছিলো বহুদিনের। সিনেমায় পরেনা নায়িকারা?
কি দারুণ লাগে দেখতে…
আমি আবার টিভি দেখলে সারাক্ষন শুধু 9xM চ্যানালটা দেখি। গানের চ্যানেলগুলোই সারাক্ষন দেখি। আমার ফোনটা ভালোনা তাই আর কি করা.. আব্বাতো নতুন ফোন কিনেও দিবেনা।

ওখানের সব লেটেস্ট গানগুলো আমার চোখ ধাঁধায়। কোনোটাই এড়িয়ে যায়না চোখ। সবগুলোই দেখি।
একদিন লিমা আপু এসে বলেছিলো,
– তুই ও যে এসব দেখিস; আমার না বিশ্বাস হয়না।
এই বলে তীব্র নিন্দা হাসি হাসছিলো।

কালুকে চা আনার জন্য পাঠিয়েছিলাম।
কালু দেখতে ভীষণ কালো।
নিগ্রোদের মত সীমাহীন কালো মুখ আর সাদা ধবধবে দাঁতের খিলখিল হাসি দিয়ে বলেছিলো,
~ আফা, লতা আফায় কিন্তু আমারে ও দেখতে দেয়। সাইডে বইস্যা বইস্যা দেহি! আমার আবার হিন্দি গান দেখতে হেব্বি লাগে। হেহ্ হে!

লিমা আপু কালুকে একদম পছন্দ করেনা।
সেদিন বলেছিলো,
– তোরে বলছি না? আমরা যখন কথা বলবো তখন সেই কথার মধ্যে কখনো না ঢুকতে। বেয়াদব। মনিব চিনিস না? কেন যে আম্মা এগুলারে তাড়ায় না। যত্তসব।

অথচ আপু জানেনা.. কালুর আম্মা মৃত্যুশয্যায় ছিলো তখন।

আমার হাতে টাকা থাকলেই তাকে আমি ২০০/৩০০ করে দিয়ে দিতাম। চিকিৎসার খরচটা এমনিতে আব্বাই দিতো।

কালু আমাদের বাড়িতে কাজ করতো রোজগারের জন্য কারণ তার আব্বা নেই। সে বলে আমাদের এই বাড়ি নাকি তার নিজের বাড়ি বলেই মনে হয়। তাই সারাক্ষন এখানেই থাকে। এখানে আমাদের কাজ করে দিতেই নাকি ওর ভালো লাগে। সারাদিন আমাদের বাড়িতেই কাজ করে,
তাই মায়ের সেবা করতে পারতোনা ঠিকঠাক মত। কালুর আম্মা খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন।
অসুস্থতার পর স্ত্রীকে দিয়ে ডাক্তার দেখাতো নিজের মাকে, মাঝেমাঝে নিজেও নিয়ে যেত।

কিন্তু আসলে তার স্ত্রী একটা টাকা ও তার শাশুড়ি মায়ের জন্য খরচ করতোনা। সবটা নিজে গ্রাস করতো আলতা,স্নো,লিপস্টিক কিনে কিনে।
কালুর বউকে নাকি মাঝে মধ্যে কালো চশমা পরেও দেখা যায় রাস্তাঘাটে।
আমি নিজেও দেখছি কয়েকবার।
ঐ মহিলা এই চশমা পরে বাজারেও নাকি যায়.. সবজি কিনতে যায়, মাছ বাজারে যায়.. এই চশমা পরেই। ক্যাটরিনার “কালা চশ্মা” গানটা তার খুব পছন্দের তো তাই।

অথচ কালু কত কষ্ট করে কাজ করে, রোজগার করে। তার মায়ের জন্য কত টাকা যে দেয় তার বউকে। সেটা হিসেবের বাইরে।

মহিলার গ্যাস্ট্রিক আলসার ছিলো। গায়ে গুটি গুটি খোস-পাঁচড়াও উঠেছিলো । যত্ন, ভালো ট্রিটমেন্ট পেলে এই রোগ থেকে কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেরে উঠা যায় সাধারণত। অযত্নে,অনাদরে এভাবেই ছিলো দিনের পর দিন।

অবশ্য কিছুদিন পরেই কালুর আম্মা মৃত্যুবরণ করেছিলো।

লিমা আপু আর মঞ্জু ভাইয়ার এনগেইজমেন্ট পার্টি হচ্ছে। বেশ ধুমধাম করেই করছে মঞ্জু ভাই। আমার বোনটাকেও দারুন লাগছে।

আমাকে আম্মা ডেকে বললো,
– যা তুই তোর আপুর কাছে যা। ওর আন-ইজি ফিল হতে পারে। ওর যা যা লাগবে শুনে আমাকে জানাবি।

আমি আপুর পাশে গেলাম।
গিয়ে দেখলাম প্রান্ত ভাই কি যেন বলতেছে..
আমি যেতেই প্রান্ত ভাই কথা ঘুরিয়ে ফেললো।
আমি অবাক হলাম।
কি এমন কথা থাকতে পারে উনাদের যেটা আমার সামনে বলা যাবেনা?

আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
প্রান্ত ভাই একবার ও আমার দিকে তাকাচ্ছেনা।
এইযে এত কষ্ট করে সাজুগুজু করে আসলাম..

আমি আপুকে বললাম,
– কিছু লাগবে তোর?
আপু মুখে প্রাণবন্ত হাসি রেখে বললো,
– আরে আরে! লতা! তুই এটা পরেছিস! ভালোই লাগছে! আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
আমি বললাম,
– অনেক সুন্দর।
প্রান্ত ভাই বললো,
– নি:সন্দেহে লতার চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে।
আমি বললাম,
– তা জানি। বলা লাগবেনা।

প্রান্ত ভাই গম্ভীর স্বরে বললো,
– সেই তো পরেছিস-ই! তাহলে এতক্ষন এত বাহানা করার কি দরকার ছিলো? পরবিই যখন তখন তো এত ‘না না করার তো দরকার ছিলোনা, তাইনা?
আমি বললাম,
– না। পরতে চাইনি। সবাই মিলে যা শুরু করছিলো, বিশেষ করে আব্বা আর কিশোর ভাই তো….

প্রান্ত ভাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– থাক! হইছে, বুঝছি।

তারপর সে প্যান্টের পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে, হেঁটে যেতে যেতে মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
– আগেই জানতাম পরবে। যতসব ঢং। এমন একটা ভাব মনে হয় যেন.. অবশ্য না পরে যাবে কই, স্পেশাল মানুষ দিয়েছে কিনা…

আমি কথাটা শুনলাম।
কিন্তু কোনো রিএকশনের প্রয়োগ দেখালাম না।

বুঝলাম না, এটা বললো কেন।
আমি এটা পরায় কি তার পাকা ধানে মই পড়লো?
না তো! তাহলে তার সমস্যাটা কি?
_____________
________

আপুর কাছ থেকে এসে আমি একটা মোটামোটি রকমের নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসলাম।
অনেক কিছু মাথার ভিতরে ঘুরঘুর করছে।

অনেক মানুষজন।
মনে হচ্ছে যেন বিয়ে বাড়িতে আসছি।
মঞ্জু ভাই পারেও বটে..
এনগেইজমেন্ট করতেছে একেবারে বিয়ের মত ঘটা করে।
বিয়ে না জানি কেমন করে করে করবে আল্লাহ জানে!

হঠাৎ কারো স্পর্শ পেলাম।

শোভা আপুর ভাই এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।
মানুষটার হাব-ভাব ভালো না।
চোখ-মুখে কেমন যেন একটা শয়তানি শয়তানি ভাব।

আমি তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালাম।
রুডলি জিজ্ঞেস করলাম,
– গায়ে হাত দিলেন কেন?
উনি বললো,
– তোমাকে সেই কতক্ষন পর্যন্ত ডাকতেছি কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছিনা। তাই…

আমি বললাম,
– আমাকে ডাকতেছেন মানে? আপনি আমার নাম জানেন নাকি?
উনি হাসি দিয়ে বললো,
– না মানে… আমি এক্সকিউজ মি,এক্সকিউজ মি করছিলাম একচুয়েলি। এনিওয়েজ, আই এম আবির। ইয়্যু?

– তাই বলে আপনি আমাকে ছুঁয়ে দিবেন? তাড়াতাড়ি বলেন কি বলবেন।

– আই লাভ ইয়্যু।

– কি!
– ওহ্, সরি সরি! আসলে তোমার ড্রেসটা খুব সুন্দর!

– তো আই লাভ ইয়্যু বললেন কেন?
– নোহ্! আই লাভ ইয়্যুর ড্রেস! হিহ হি! আই মিন ইট!
– আচ্ছা। ধন্যবাদ।

– তোমার নামটাও খুব সুন্দর। লতা, তোমার নাম। তাইনা?
– জানিনা।
এই বলে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম।

তখনি উনি আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো।

আমি আশ্চার্যান্বিত হয়ে পড়লাম! থরথর করে কাঁপুনি উঠলো সারা গায়ে।

বিস্মিত চোখে বললাম,
– ছাড়েন। হাতটা ছাড়েন বলছি।
ছেলেটা বললো,
– নাহ্ গো! সারাজীবনের জন্য ধরলাম! হিহ্ হি হি!

আমার কান্না এসে যাচ্ছে।
সহসা আমার চোখে জল আসেনা।
এত জোরে হাতটা ধরে আছে যে মনে হচ্ছে আমার হাতটাকে কেউ বুঝি কুচি কুচি করে কেটে ফেলছে।

– হাত ছাড়েন। হাতটা ছাড়েন বলছি।
– তুমি ভাবছো আমি তোমাকে চিনিনা? তোমার ও তো চেনার কথা! হিহ্ হি হি।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।
লোকটা আমাকে চেনে!
আমারো অবশ্য চেনা চেনা লাগছিলো প্রথম যখন দেখছিলাম।

নিরিবিলি এক সাইডে বসে আছি তাই কেউ দেখছেও না।
চিৎকার করবো যে তাও করতে পারছিনা।
সারা শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে।

প্রচণ্ড ব্যাথা লাগছে হাতে।

চলবে..

(পরবর্তী পর্বে টুইস্ট আসছে..)

#ফারজানা_রহমান_তৃনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here