লাবণ্যর সংসার পর্ব -১২

#লাবণ্যর_সংসার
#পর্ব_12
#কৃ_ষ্ণ_ক_লি

বেশ কিছুক্ষণ দুজন নিরব থাকে। ও আসলেই কি এতোটা আবেগী হয়ে পড়েছিলো! হ্যা একসময় মেঘলাকে ও নিজের প্রাণের থেকেও বেশী ভালোবাসতো। পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ও কে মেঘলা ব্যতীত অন্য একজনকে বিয়ে করতে হয়েছে। নিজের স্ত্রী হিসেবে মেয়েটিকে মেনেও নিয়েছে। বাসর ঘরে এক দৃষ্টিতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কয়েকপলক দেখে মেয়েটিকে বেশ মনে ধরেছিলো নিবিড়ের। নিজের স্ত্রীর মুখটা বেশ মায়াভরা লেগেছিলো। তাই তো ওর কাছে লাবণ্য হয়ে উঠেছিলো লাবণ্যময়ী।
সব কিছুই তো ঠিক ঠাক চলছিলো। মেঘলাকে নিজের হৃদয় থেকে সরিয়ে ওখানে লাবণ্যর নাম খোদাই করতে চেয়েছিলো। ভালোবাসতে শুরু করেছিলো নিবিড়। লাবণ্য থেকে হয়ে উঠেছিলো লাবণ্যময়ী!

লাবণ্য উঠে দরজার কাছে যায়। দরজার লক খুলতে গিয়ে নিবিড়ের ডাকে থেমে যায়।

—“ কোথায় যাচ্ছো? আমার কথা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি লাবণ্যময়ী! ”

নিবিড়ের গম্ভীর কাতর কন্ঠে মুচকি হাসে লাবণ্য। লাবণ্য পুনরায় বিছানার কাছে আসে নিবিড়ের পাশে বসে।

—“ আমার মনে হয়না এরপর আর আপনার কোনও কথা থাকতে পারে! আমি তো চলেই যাবো তাই শেষ কথা না হয় বলেই ফেলুন আমি শুনছি।”

নিবিড় বড়ো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে,,

—“ আমি যখন মেঘলার নাম নিয়েছিলাম তুমি কিছু বলোনি কেনও? আর যখন জানতেই পারলে আমার জীবনে এখনো মেঘলাই আছে তাহলে ও কে ননদ সম্বোধন করলে কেনো? ”

—“ কেনো আপনারা যদি আমার কাছে আপনাদের সম্পর্কের কথা লুকিয়ে রাখতে পারেন। মুখে বলতে পারেন লাবণ্যময়ী! কিন্তু তৃপ্তির মধ্যে মেঘলা আমাকে ছেড়ে কখনো যাসনা! আমি আজ যদি কিছু না বলতাম তাহলে আপনারা তো সব লুকিয়েই রাখতেন। মাঝখান থেকে মেঘলা কষ্ট পেতো। আর আপনি… ”

লাবণ্য আর কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নিবিড় ও কে বুকে টেনে নেয়।

—“ লাবণ্য আমি তোমাকে ভালোবাসি। হয়তো আবেগের বশে তোমার নামের জায়গায় মেঘলা নাম নিয়ে ফেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর যেদিন থেকে তোমাকে আমার জীবনের সাথে জড়িয়েছি , সেদিন থেকে মেঘলা নামক মেয়েটিকে আমি আমার মন থেকে সরিয়ে রাখছি। ”

লাবণ্য নিবিড়ের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে উঠে পড়ে।

—“ মিথ্যা বলছেন আপনি! বড়ো মিথ্যা কথা বলছেন। আপনি যদি সত্যিই মেঘলাকে ভুলতে চাইতেন তাহলে বাসর রাতে আমাকে ইগনোর করতেন না নিবিড় সাহেব! মেঘলা যখন অতো জ্বরে আপনার কাছে এসেছিলো তখন কিন্তু আপনি আমাকে ইগনোর করতেন না। জিজ্ঞাসা করেছিলাম জ্বর কেমন আছে? মুখ ঝামটা দিয়েছিলেন মনে আছে? মেঘলাকে বুকে জড়িয়ে শুয়েছিলেন। আমাকে তার পাশেও জায়গা দেননি। আমি যখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সারারাত জেগেছিলাম তখনও আমার হাত ধরে রুমে নিয়ে আসেন নি। ”

—“ লিসেন লাবণ্য পুরনো কথাগুলো কেনো টানছো? পুরনো কথা কেনো মনে রাখছো?আজ তুমি মেঘলার কথা শুনে এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিচ্ছো? ”

—“ পুরনো কথাতেই তো সব নিবিড় সাহেব! সেদিন কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম। বিয়ের পরদিনেও তো আপনি যখন জেগেছিলেন মেঘলা কফি নিয়ে এসেছিলো আপনার জন্য। বারবার বলছিলো আপনার সব দায়িত্ব দিতে। আপনিও বলেছিলেন সময় হলে সব দায়িত্ব ও কে দিবেন। আমি বলছি তো এবার মেঘলাকে দায়িত্ব দিন। আমি.. আমি আপনার আর মেঘলার চার হাত এক করে দিয়ে যাবো। ”

—“ তুমি নিজেকে কি মনে করো লাবণ্য? তোমার সিদ্ধান্তই সব। আমার কোনও মতামত নেই? ”

—“ আপনি বলেছিলেন তো যেঘলাকে বিয়ে করবেন। ফুপা আর আব্বুর মতের বিরুদ্ধে যেতে পারেন নি। আমি তো বলছি আপনাদের এক করে দিয়ে যাবো। ”

—“ আমি তোমার সাথেই থাকবো। তুমি আমার স্ত্রী , তোমার জায়গা আমি কাউকে দিতে পারবো না। ”

—“ আসলেই কি আমি আপনার স্ত্রী ? সত্যিই কি আপনার মনে আমার জন্য কোনও জায়গা আছে?”

নিবিড় কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। লাবণ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে লাবণ্যকে বুঝতে চেষ্টা করে , আসলেই কি চাইছে লাবণ্য!

সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতেই আতীক সাহেবের মুখোমুখি হন। আতীক সাহেবের মুখটা বেশ গম্ভীর। রুমানিয়া বেগম ও শিউলি বেগম দুজনেই প্রশ্নাতুর চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

—“ আমি শুনছি তুমি না কি চলে যাবে? ”

লাবণ্য উচ্ছ্বাসের সহিত হাসিমুখে বলে,,

—“ হ্যা আপনি ঠিক শুনেছেন আমি চলে যাবো । আমি না গেলে যে মেঘলা আর নিবিড় সাহেব সুখী হতে পারবেন না। আমি তো আপনার সাথে কথা বলতাম। আপনি যখন… ”

—“ কি বলতে তুমি? ”

আতীক সাহেব এই প্রথম লাবণ্যকে ধমকে উঠেন।
লাবণ্য কেঁপে উঠে , তবুও হাজার কষ্টের মধ্যেও মুখের হাসিটা বিদ্যমান রাখে।

—“ এটাই যে আপনি উনাদের এক করে দেন। দুজনকে বিয়ে দিয়ে সুখে থাকতে দিন। দেখুন মেঘলা ও নিবিড় দুজন দুজনকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আজ আপনাদের একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এভাবে ওদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিবেন না প্লিজ। ”

—“ তোমার সাহস দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! তুমি কি নাটক করছো? কোন সাহসে তুমি আমার সিদ্ধান্তকে ভুল বলছো? আর আমি আমার ছেলের বিয়ে কার সাথে দিব না দিব সেটা কি তুমি ঠিক করে দিবে? ”

আতীক সাহেবের গম্ভীরভাবে চিৎকার করে বলা কথায় লাবণ্য বেশ ভয় পেয়ে যায়। হাত পা কাঁপতে থাকে। কিন্তু তাই বলে যে সে ওই বাড়িতেই ওই দুজন ভালোবাসার মানুষের পথের কাঁটা হয়ে থাকবে না। ও যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে চলে যাবে তখন ও যাবেই। মনে অদম্য সাহস সঞ্চার করে পুরোদমে কথাগুলো বলে উঠে লাবণ্য।

—“ দেখুন আপনি কি করবেন না করবেন সেটা আপনার , আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যপার। আমি আমার মত জানাচ্ছি। ”

এই বলে লাবণ্য প্রত্যেকে কে সালাম করে বের হতে চাইলে রুমানিয়া বেগম হাত টেনে ধরে।

—“ তুমি হঠকারীতায় কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ো না লাবণ্য। ভেবে দেখো সারাজীবনের ব্যপার। এখনো তো এক মাস হয়নি বিয়ের। এর মধ্যেই ছেড়ে চলে যেতে চাও। ”

—“ সারাজীবনের ব্যপার বলেই তো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি ফুপ্পিমা। এখনও একমাস বিয়ের বয়স হয়নি বলেই তো এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। বেশী দেরী হলে তো আমি আপনাদের ওই মানুষটার মায়ায় পড়ে যেতাম। ছাড়তে কষ্ট হতো হাজার হোক স্বামী তো। ”

—“ জানো তো লাবণ্য বাঙালি মেয়েরা আর যাই করুক নিজের স্বামীর ভাগ কাউকে দেয়না। তুমি কেনো তোমার অধিকার ছেড়ে দিবে? তুমি ওর বিয়ে করা স্ত্রী। তুমি চাইলেই মেঘলাকে এই বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিতো পারো। ”

শিউলি বেগম লাবণ্যর হাত ধরে করুণস্বরে কথাগুলো বলে উঠে,,,

—“ না মা তাতে করে কারুর অভিশাপের ভাগীদার হতে চাই না মা। মা আপনিও তো চেয়েছিলেন মেঘলার সাথে আপনার ছেলের বিয়ে দিবেন মূলত কথা দিয়েছিলেন। আপনি আপনার কথা রাখুন মা।”

লাবণ্য শিউলি বেগমকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলে চোখের পানিটা মুছে নেয়। মেঘলা কোথা থেকে হুট করে এসে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে কান্নারত অবস্থায় ।

—“ তুমি সত্যিই আমার নিবিড় ভাইয়াকে আমায় ফিরিয়ে দিলে? ”

লাবণ্য মুচকি হাসি দিয়ে বলে,,

—“ হুম দিলাম তোমরা সুখী হও। ভালো থেকো , ভালো রেখো। ”

সকলের উদ্দ্যেশ্য ভালো থাকার বার্তা দিয়ে বের হতে গেলেই নিবিড়ের ডাকে দাঁড়িয়ে যায় লাবণ্য। নিবিড় দ্রুত লাবণ্যর কাছে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়।
হাঁটু মুড়ে জোড়হাত করে নিবিড়।

—“ প্লিজ লাবণ্য ছেড়ে যেও না আমায়। আমি তোমার সাথে সুখী হতে চাই লাবণ্য। ”

শিউলি বেগম এসে লাবণ্যর হাত ধরে বলে উঠে,,

—“ তোমার সংসার ছেড়ে চলে যাবে মা? আমার ছেলেটার কি হবে মা? ”

—“ এটাতো আমার সংসার নয় মা। আপনারা চাইলেই এটা মেঘলা সংসার হতে পারতো। আমি পুনরায় সেই সুযোগ দিলাম। মেঘলার হাতে এই সংসার তুলে দিন। আপনিও তো তাই চেয়েছিলেন। আর চেয়েছিলেন বলেই একদিন আমার খাবার নষ্ট করে দিয়েছিলেন নিজের হাত মুখ ধোঁয়া পানিতে। ”

লাবণ্য যাওয়ার আগে পিছু ফিরে নিবিড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে আসে গন্তব্যহীন কোনও জায়গার উদ্দেশ্যে।

গন্তব্যহীন- ই তো! কোথায় যাবে ও? বাপ – মা আর ঠাঁই দিবে না। হাজার হোক বাপ – ভাইয়ের ঘাড়ে বসে তো আর খাওয়া যায় না। এতো অপমানের পর তো আর ওর নিজেরও ওদের ঘাড়ের বোঝা বানাতে চায় না।

সুখ জিনিসটা চিরটাকাল যেনো ওর সাথে লুকোচুরি খেলে এসেছে। ধরা দেয়নি কখনোই। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছে জীবনের আসল মানে।
ওর জীবনে সুখ কখনোই আশা করা যায় না। আর আশা করাটাও যেনো বোকামী।

আজ এতো চোখের পানি কেনো ফেলতে হচ্ছে ও কে! হয়তো অতীতের করা পাপের ফল। মানুষটাও তো এভাবে হাতজোড় করে ফিরে আসার কথা বলেছিলো। তার চোখেও পানি ছিলো এমনিই যতোটা আজ লাবণ্যর চোখে!

পিচ ঢালা রাস্তার মধ্যে হেঁটেই চলেছে লাবণ্য। চারপাশে গাড়ি, মানুষজনের ঢলকে ফেলে রেখে লাবণ্য এগিয়ে চলেছে নাম না জানা উদ্দ্যেশ্যে। কোথায় যাবে ও! অবশ্য সে নিয়ে ওর কোনও মাথাব্যাথা নেই। এই পৃথিবীতে কারুর থাকার জায়গার অভাব হয় না। কোথাও না কোথাও ঠিক একটা জায়গা হয়ে যাবে লাবণ্যর।

মাথার মধ্যে সরাসরি রোদ পড়ায় লাবণ্যর মাথার মধ্যে দপদপ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বেলা হয়তো বারোটা বাজে। তাই মাথার মাঝখানে রোদের তেজটা বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে লাবণ্যকে।

গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত পেটে দানা পানি পড়েনি লাবণ্যর। ক্ষুধার থেকে পানির তৃষ্ণাই বেশি প্রখর মনে হচ্ছে লাবণ্য।

চারদিকে ভালোভাবে তাকিয়ে নিজের তৃষ্ণা নিবারণের উৎস খুঁজতে থাকে লাবণ্য। কিছুটা হেঁটে সামনে একটা কফি ক্যাফ দেখে সেখানে ধীর পায়ে প্রবেশ করে। মূলত পানি খাওয়ার জন্য যেকোন একটা টেবিল থেকে জলের মগ তুলে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পানি পান করে। একজন ওয়েটার এসে লাবণ্যর সামনে দাঁড়িয়ে অর্ডার দেবে কি না জিজ্ঞাসা করে। লাবণ্য অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলে,,,

—“ আসলে আমার ভীষণ পানি পিপাসা পেয়েছিলো। আমি কোনও অর্ডার করবো না। আমার কাছে টাকা নেই। ”

ওয়েটার কিছু বললো না। লাবণ্য ভেবেছিলো ওয়েটার হয়তো চেঁচিয়ে এতো লোকের সামনে লাবণ্যকে অপমান করবে। কিন্তু তার কিছুই করলো না। ওয়েটার পাশ কাটিয়ে পরের টেবিলে চলে গেলো।

লাবণ্য বের হয়ে আসতে গিয়েও থেমে গেলো চেনা এক কন্ঠস্বরে।

বহু দিন ভাব তরঙ্গে
ভেসেছি কতই রঙ্গে…..

বহু দিন ভাব তরঙ্গে….
ভেসেছি কতই রঙ্গে…..
সুজনের সঙ্গে হবে দেখা শুনা।

তারে আমার আমার মনে করি,
আমার হয়ে আর হইলো না
আমার আমার মনে করি,
আমার হয়ে আর হইলো না

দেখেছি রূপসাগরের মনের মানুষ কাঁচা সোনা….

মনের অজান্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনাপানিদের আগমন হল। খুব চেনা মানুষের কন্ঠস্বর , তবে কি সেই মানুষটাই আবার ফিরে এলো!

কিন্তু তা কি করে সম্ভব! আমার ভাগ্যে এতো সুখ কি আদেও আছে! আর সে যদি ফিরেও আসে আমি কি তার যোগ্য হতে পারি!

নিজের মনেই কথাগুলো ভেবে নিয়ে এগিয়ে যায় মানুষটির উদ্দেশ্যে…

চলবে… ..

(লেখায় ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন 🙏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here