লাবণ্যর সংসার পর্ব -১৮ ও শেষ

#লাবণ্যর_সংসার
#পর্ব_18 (Last Part)
#কৃ_ষ্ণ_ক_লি

অঝোর ধারায় অশ্রুপাত করে চলেছে মেঘলা। যা ও কে সাজানো পার্লার থেকে আগত মেয়েগুলোদের বিরক্তি এবং অসুবিধার কারণ হচ্ছে। বিশেষত মেঘলার চোখটা রাঙাতে ওদের অনেকখানি বেগ পেতে হচ্ছে। চার – পাঁচবার মুছতে হয়েছে কিন্তু মেয়েরা বিরক্তি প্রকাশ করতে পারছেন না। কিছু বলতেও পারছে না তার কারণ অভ্রের নিষেধ এবং মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে। অভ্র জানে মেঘলা সাজানোর সময়টাতেও কান্না করবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তার জন্য অনেক সময় ধরেই মেঘলাকে সাজানো শুরু হয়েছে। পাঁচ ঘন্টা পর মেঘলার সাজ কমপ্লিট হয়। পার্লারের মেয়েগুলো যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

ও কে ছেড়ে রুম থেকে সবাই বেরিয়ে গেলে মেঘলা বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। লম্বা বড়ো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের আপাদমস্তক দেখতে থাকে মেঘলা। কি হচ্ছে ওর সাথে এসব! ও যে নিজেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এমনটা তো হবার কথা ছিলো না! এই সাজেই তো ও সাজতে চেয়েছিলো! কিন্তু সেটাতো নিবিড়ের জন্য। অভ্র নামক কোনও মানুষের জীবন যে ওর জীবনের সাথে জুড়ে যাবে তা যে ওর কল্পনারও অতীত।

এতোক্ষণ দূর থেকে মেঘলাকে পর্যবেক্ষণ করছিলো অভ্র। ব্লু কালারের ল্যাহেঙ্গায় অতীব মোহনীয় লাগছে মেঘলাকে। এইরকম সাজেই তো ও লাবণ্যকেও দেখতে চেয়েছিলো! হয়তো লাবণ্যও এমন সাজবে তাকেও অন্য কেউ দেখবে!

নিজের মনেই কথাগুলো আওড়িয়ে হেসে উঠে অভ্র। নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীর কথা ভাবছে সে এটা অন্যায়। আর লাবণ্য তো ওর ভাইসম বন্ধু নিবিড়ের স্ত্রী। সম্পর্কে ওর ভাবী, কিসব ভাবছে ও! ঘোর কাটিয়ে মেঘলার দিকে মনোযোগ দেয় অভ্র। গলা খাঁকরানি দিয়ে বলে উঠে,,,

—“ হাসি মুখে নীচে চলো দাদী সহ গেস্টরা সবাই অপেক্ষা করছে তোমার আমার। রিসেপশন পার্টির শেষে যতো ইচ্ছা কেঁদো বাঁধা দিবো না তোমায়। আপাতত এখন চলো। ”

মেঘলা ঝড়ের বেগে অভ্রের পরণে পড়ে থাকা শেরওয়ানীর কলার্ট টেনে ধরে চিৎকার করে বলে,,

—“ আপনি কেনোও আমার সাথে এমন করলেন? কেনোও আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন? ”

অভ্র সাবধানে মেঘলার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাসিমুখে বলে উঠে,,,

—“ আমি তোমার জীবন নষ্ট করিনি। বরং তোমায় একটা ভালো সুস্থ জীবন দিতে চেয়েছি। তোমার ভালো থাকার দায়িত্ব নিয়েছি। তুমি যাতে ভালো থাকতে পারোও এবং সুখী হও। ”

—“ সুস্থ জীবন মানে! আমি কি অসুস্থ না কি? আর তাছাড়া আপনি আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নেওয়ার কে? আমি নিবিড় ভাইয়াকে ভালোবাসি। আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না। ”

—-“ তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। নিবিড় কে ভুলতে চেষ্টা করো। ও কে ওর স্ত্রীর সাথে সুখে সংসার করতে দাও। আর তুমিও নিজের সংসারে মন দাও। ”

—-“ আমি করবোনা আপনার সাথে সংসার বুঝতে পেরেছেন। আর আমি নিবিড় ভাইয়াকে কখনোই ভুলবো না আর আপনিও পারবেন না আমাকে ভুলাতে। ”

অভ্র মেঘলাকে ধরে নেয়। মেঘলাকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,,,

—“ কাম ডাউন মেঘলা! পাগলামি কোরো না। নিবিড় যদি তোমায় ভুলে লাবণ্যকে নিয়ে সংসার করতে পারে তাহলে তুমি কেনো পারবে না। আমি তো তোমাকে সাহায্য করবো। স্বামীর প্রতিটি দায়িত্ব পালন করবো কথা দিচ্ছি। ”

কিছুক্ষণের জন্য মেঘলার কান্না থেমে যায়। অভ্রের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হয়তো সত্যিই ও পাগলামি করেছে। নিবিড় তো সবটা ভুলে লাবণ্যকে আঁকড়ে ধরেছে। তাহলে ওর ও তো উচিৎ নিবিড় কে ভুলে অভ্রকে আঁকড়ে ধরা। অভ্রতো নিজেই সে কথা বলছে।

চমক ভাঙ্গে অভ্রের ডাকে। অভ্র হাত বাড়িয়ে ইশারায় মেঘলাকে ওর হাতে হাত রাখতে বলছে। মেঘলা বাধ্য মেয়ের মতো নিজের হাতটা অভ্রকে ধরিয়ে দেয়। অভ্র মুচকি হেসে মেঘলাকে নিয়ে নীচে আসে।

মেঘলাকে নিয়ে নিচে নামার সাথে সাথেই অভ্রের দাদী সালমা বেগম মেঘলাকে ধরে এনে স্টেজের ওপরে থাকা সিংহাসনে বসিয়ে দেন। মেঘলার চিবুক উঁচু করে সালমা বেগম মৃদু হাসেন।

—“ চাঁদের টুকরো বউ এনেছিস একটা। মুখটা দেখলেই সমস্ত ক্লান্তি অনায়াসেই কেটে যাবে। ”

—“ তোমার পছন্দ হয়েছে তো দাদী! ”

—“ তুমি এমন সেরা জিনিস এনেছিস আর আমার পছন্দ না হয়ে পারে বলতো! ”

সালমা বেগম নিজের দুটো হাতে থাকা কাঁকন খুলে নিয়ে মেঘলাকে পড়িয়ে দেয়।

—“ আমার নাতি একটা চাঁদ এনেছে। আমি চাই এই চাঁদের আলোয় আমার বাড়ি , নাতির জীবনটা আলোয় রাঙিয়ে দিতে। তুই রাঙাবি নাতবৌ। আমার নাতির জীবনটা আগের মতোই রংহীন করে দিতে পারবি নাতবৌ!”

মেঘলা যেনো দো ঠেলায় পড়ে যায়। আসলেই ওর কি করা উচিৎ। অভ্র চাইছে ওর জীবনটা সুন্দর করতে। এদিকে দাদী চাইছেন অভ্রের জীবনটা রঙীন করতে!

গাড়ি ড্রাইভ করছে নিবিড়। নিবিড়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছে লাবণ্য। লাবণ্যকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গাড়িতে বসিয়েছে নিবিড়। লাবণ্য প্রশ্ন করে চলেছে তারা কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু নিবিড় কিছুই বলছে না মুচকি হাসছে আর একটু একটু করে গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে ড্রাইভ করছে। নিবিড়ের এমন কাজে লাবণ্যর রাগ হয় তাই গাল ফুলিয়ে নিবিড়ের থেকে মুখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে থামে অভ্রের বাড়ির সামনে। লাবণ্য গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে যায়। ওর মনে প্রশ্নের ঝড় উঠে নিবিড় কেনো ও কে এখানে নিয়ে আসলো! অভ্রের বাড়িটাই বা এতো আলোয় সাজানো হয়েছে কেনো!

নিবিড়ের হাত ধরে ভিতরে ঢুকছে লাবণ্য। মনে প্রশ্নের ঝড় কেনো ও এখানে আসলো! মনের মধ্যে জড়তা কাটিয়ে বলেই ফেলে,,

—“ আপনি আমায় এখানে কেনো আনলেন নিবিড় সাহেব? অভ্রের বাড়িতে কি কোনও অনুষ্ঠান চলছে। ”

—“ রিসেপশন পার্টি চলছে অভ্রের। ”

—“ অভ্রের রিসেপশন মানে! অভ্র বিয়ে করেছে? ”

—“ কেনো তুমি কি ভাবলে অভ্র সারাজীবন চিরকুমার রয়ে যাবে! ”

নিবিড় বাঁকা হেসে লাবণ্যকে কথাগুলো বলে। লাবণ্যর কাছে নিবিড়ের বলা কথাগুলো তাচ্ছিল্যের মনে হয়। লাবণ্যর বুকের ভিতরটা ছ্যাঁক করে উঠে।
কাঁপা গলায় বলে উঠে,,,

—“আ.. আমি কখনো এমন ভাবিনি। কাল অভ্রের এই বাড়িতেই ছিলাম , তখনোও তো বুঝতে পারিনি ওর বিয়ে হয়েছে বলে। আজ হঠাৎ রিসেপশন পার্টি তাই বলছিলাম। ”

লাবণ্যর মনমরা কন্ঠ শুনে নিবিড় বুঝতে পারে ও পুনরায় নিজের অজান্তেই লাবণ্যকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। খেয়াল করলে দেখবে হয়তো লাবণ্যর চোখের কোণে নোনা পানিদের আগমন।

নিবিড় সবকিছু উপেক্ষা করে লাবণ্যকে একটা জায়গায় নিয়ে এসে থেমে যায়। লাবণ্য চারপাশটা দেখছে , হঠাৎ একজনকে দেখে ওর চোখ আটকে যায়। বধূ বেশে বসে থাকা মেঘলার দিকে। এবার যেনো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছায় লাবণ্য।

নিবিড়কে দেখে অভ্র একছুটে এসে জড়িয়ে ধরে।
নিবিড় হাসিমুখে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অভ্রকে।

—-“ আজ তুই ছিলি বলে আমি নিজের জীবনটা সাজাতে পারছি। তুই সাহায্য করেছিলি বলেই আমি লাবণ্যকে নিয়ে সংসার করতে পারছি। ”

—“ শালা তুই ছিলি বলেই আমার জীবনে আবার কোনও রমণীর আগমন হয়েছে , আমিও সংসারী হয়েছি। ”

—“ হুম তবে যাই বল ভাই তোর এলেম আছে। তা না হলে আমায় শালা বানাতেও তুই ছাড়লি না। ”

অভ্র আর নিবিড় নিজেদের মধ্যে কথায় মশগুল হয়ে পড়ে। লাবণ্য গুটিগুটি পায়ে মেঘলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেঘলা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দুজন দুজনের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। মেঘলা লাবণ্যর চোখে নিজের ব্যর্থতা দেখতে পায়। আর লাবণ্য মেঘলার চোখে নিজের ব্যর্থতা দেখতে পায়। কারণ দুজনেই দুজনের চোখে নিজেদের প্রেমের ব্যর্থতা খুঁজে পায়। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘলা লাবণ্য একসাথেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কেঁদে ফেলে।

নিবিড় অভ্র ওদের দুজনকে কাঁদতে দেখে হেসে উঠে দুজনেই ঠিকি। কিন্তু তাদেরও চোখের কোনে পানি চিকচিক করতে থাকে।

সময় বহমান , কেটে যায় এক বছর। লাবণ্য – নিবিড় , মেঘলা – অভ্র প্রত্যেকের জীবন চলতে থাকে। তবুও যেনো কোথাও একটা প্রত্যেকের মনের কোণেই প্রত্যেকে রয়ে যায়। কিন্তু চারজন দম্পতি ভালো থাকে সারাজীবন। আর তারা এভাবেই ভালো থাকুক।

সমাপ্ত….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here