প্রিয় প্রহর ২ পর্ব -০১

#প্রিয়_প্রহর২
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১
এয়ারপোর্টে বসে আছে আরোহী। চারপাশে বহু মানুষের সমাগম। তাও আজ সে একা! বড্ড একা। চেনা শহর, চেনা সবকিছু ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে কোনো এক অচেনা ভবিষ্যতের পথে। বাহ্যিকভাবে সে একা। তাও তাকে একা বলা কি চলে? না। একদম না। আরোহীর শরীরের অভ্যন্তরে বেড়ে উঠছে তার একাকিত্ব কাটানোর সঙ্গী। হ্যাঁ, আরোহী প্রেগনেন্ট। এখনো সেটি একটি মানব ভ্রূণ যা ধীরে ধীরে মানব শিশুতে পরিণত হবে।
একটু পর সবার মতো আরোহীর নাম এনাউন্স করলে আরোহী একবার পেছোন মুড়ে দেখে চলে যায়। চোখ গড়িয়ে অশ্রকণারা ঝরছে। আজ তার যাত্রা এক অচেনা দেশে। যেখানে তার চেনা কেউ থাকবে না। অচেনার ভীরে নিজের অনাগত ভবিষ্যতকে স্বাগত জানাবে।

আরোহী যাচ্ছে কিছু সুন্দর প্রিয় অনুভূতিকে সাক্ষি নিয়ে আর কিছু কুৎসিত অপ্রিয় অনুুভূতিকে সাক্ষি নিয়ে।

________এবার জেনে আসি কি হয়েছিলো? কি কারনে আরোহীর নিজের চেনা সবকিছুকে দূরে ফেলে যাচ্ছে!

৮ মাস আগে থেকে,,
ফ্ল্যাশব্যাক______________________________________

আরোহী ও শুভ্র দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীর পরেরদিন সকালে আরোহীর ভোরের শুভ্র আলোয় ঘুম ভেঙে যায়। ভোর ৫.৩৩ বাজে। আরোহী নিজেকে শুভ্রর বাহুডোরে দেখে নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। এর আগেও সে সকালে ঘুম থেকে যেদিন শুভ্র আগে উঠতে পারতো সেসব দিন শুভ্র বাহোডোরে নিজেকে পেতো। কিন্তু আজকে সেটা আলাদা। কারন কাল রাতে তারা একে অপরের কাছাকাছি এসেছিলো। দুজন দুজনের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলো। দুই বছরের বৈবাহিক সম্পর্কে তারা প্রথমবার কাছাকাছি এসেছিলো।

আরোহী চাদর ঠিক করে শরীরে পেঁচিয়ে উঠার চেষ্টা করছে কিন্তু শুভ্র আরো শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। আরোহী চাচ্ছে না শুভ্র এখন উঠুক। তাহলে সে লজ্জা পেয়ে যাবে।
মিনিট তিনেক চেষ্টা চালানোর পর নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে চাদরটা শুভ্র গায়ে দিয়ে নিচের থেকে শাড়িটা নিয়ে গায়ে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে যায়।

ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় এরপর আয়না দিয়ে ঘুমন্ত শুভ্রকে দেখে তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপে। আরোহী বিছানায় শুভ্রর পাশে বসে। শুভ্রর চুলগুলো কপালে এসে পরে আছে। আরোহী সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে নিজের চুলের ডগা দিয়ে ভেজা চুলের পানি শুভ্রর বন্ধ চোখের পাতায় দিতে থাকে।
চোখে পানি পড়ায় শুভ্রর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে আরোহীকে মিটিমিটি হাসতে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে এরপর তার বোধগম্য হবার পর আরোহীকে ধরতে নিলে আরোহী উঠে পরে। আর বলে,

–উহুম। আগে আপনি শাওয়ার নিন। ৬ টা বেজে গেছে। নামাজের সময় শেষ তাই একত্রে কাজা নামাজ আদায় করবো।

শুভ্র মুচকি হেসে ফ্রেশ হতে চলে যায়। আরোহী ব্যালকনির খোলা অংশ দিয়ে সকালের সদ্য ফোঁটা আলোর ছটা দেখছে। শুভ্র আকাশে রোদের মেলা। অপরূপ লাগছে। সকালের রোদে তীব্রতা না আদ্রতা থাকে। প্রকৃতির এই অপরূপ সংমিশ্রণ দেখার মাঝে শুভ্রর ডাক পরে আরোহীর।

_____নতুন বউয়ের মতো সবাই মিলে আরোহীকে ঘিরে ধরেছে। আরোহীর মনে হচ্ছে তার গতকালকে বিয়ে হয়েছে। সবাই অনেক কথা বলছে। সামিরা ও জেসিকাও সেখানে আছে। ওদের এসব ভালো লাগছে না কিন্তু মুখে হাসি নিয়ে তাও বসে আছে। তারা আস্তে আস্তে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সেজন্য।

আরোহীর খালাতো বোন ইরা বলে,
–আরুপু, তুমি শুভ্র ভাইকে কবে থেকে ভালোবাসো?

ইরার কথায় বাকিরা উৎসুক হয়ে তাকায়। তবে আরোহীর মনটা কিছুটা বিষণ্ণতায় আঁকড়ে ধরে। আয়ানা বুঝে সেটা কারন সে তো সবটাই যানে। আরোহী লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে সবটা সবাইকে। সবাই ব্যাথিত হয়।
“নিজের ভালোবাসার মানুষটার মনে যখন নিজেরই বোনের প্রতি ভালোবাসা আছে তা জানতে পারে তখন কেমন লাগে তা সত্যি অজানা তাদের।”

তবে সামিরার চোখ চকচক করে উঠে। সে তার পরিকল্পনার মূল ও মূক্ষম চালটা পেয়ে গেছে। সামিরা জেসিকাকে ইশারা করে। জেসিকাও বাঁকা হাসে।

সবাই চাইছে শুভ্র ও আরোহী কোথাও একান্ত সময় কাটাতে ঘুরতে যাক। শুভ্রও সেটাই চায়। তবে শুভ্র এটাও চায় আরোহীর জন্মদিনে আরোহীকে নিয়ে সেন্টমার্টিন যাবে তারপর সেখান থেকে সাজেক। আরোহীর যেহেতু সমুদ্র ও পাহাড় দুটোই পছন্দ। এই ট্যুরে ওদের পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগবে। তাই ফেব্রুয়ারি মাসকেই প্রিফারেবল মনে করেছে। শুভ্ররও কিছু ব্যাস্ততা আছে আর আরোহীরও।
ডিসেম্বর মাস আর ইন্টার্ন ডাক্তারদেরকে ক্যাম্পিং করা হয়। শীতার্তদের সু্বিধা অসুবিধা দেখার জন্য। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অনেক কাজ থাকে ইন্টার্নদের। আরোহীর ইন্টার্নির ৯ মাস শেষ।

_____
দেখতে দেখতে ব্যাস্ততা কাটিয়ে এসে গেছে ফেব্রুয়ারি মাস। জেসিকা শুভ্রদের বাড়িতে থাকছে। সেও সরোয়ার্দিতে জয়েন করেছে হুট করে। সবাইকে এটাই বলেছে যে, “এতো বছর নিজের জন্মভূমির থেকে দূরে ছিলো তাই এখন নিজের জন্মভূমিতে কয়েকমাস থাকতে চায়। জন্মভূমির মানুষগুলোর সেবা করতে চায়। ”

সবাই জেসিকার এমন ভাবনায় খুশি হয়। কিন্তু কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে জেসিকার এরকম ভাবনার পেছোনে পরিকল্পনা। জেসিকা সবাইকে বলেছিলো সে হোটেলে উঠবে। কিন্তু শুভ্রদের বাড়ির সবাই তাকে এখানেই থাকতে বলে। তাদের ফ্লাটটা তো বড় আছে। রুমও বেশি। জেসিকা এই কথারই অপেক্ষা করছিলো যেনো। কিছুক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে পরে হ্যাঁ করে দেয়। জেসিকা জয়েন করেছে জানুয়ারিতে। সে ও তার বাকি সঙ্গীরা এখনো নিজেদের পরিকল্পনার কাজ শুরু করেনি। শুভ্র ও আরোহী হানিমুন থেকে ফিরে এলেই তারা আস্তে আস্তে কাজ শুরু করবে।

________সাগড় পাড়ের উত্তাল ঢেউ দুই যুগলকে প্রেমময় আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত করছে। ভোরের সূর্যদয় দেখতে সাগড় পাড়ে এসেছে শুভ্র ও আরোহী। সাগড় পাড়ে ভোরের সূর্য রক্তিম বর্ণে উদিত হচ্ছে। শুভ্র আরোহীকে নিয়ে একটু দূরে এসেছে যেখানে কেউ নেই। পুরো বিচে মানুষ সংখ্যাও বেশি না।

শুভ্র তীরে আসা কিছু সুসজ্জিত প্রবাল ও ঝিনুক কুড়িয়ে আরোহীর হাতে দেয় আর বলে,

” ভোরের রক্তিম আলোয়,
রৌদ্রিতার জন্য প্রবাল ঝিনুক। ”

আরোহী হেসে ফেলে। চোখে তার মুগ্ধতা। এই সাগড় পাড়েই আজকের দিনে দশ বছর আগে মনের ঘরে এই শুভ্র মানবের নামে অনুভূতিরা কড়া নেড়েছিল। সেদিনটা ভয়ানক ছিলো তবে তার কোমল স্পর্শে ছিলো ভরসান বাণী। শুভ্র অপলক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরোহীর দিকে। তারপর বলে,

–জানো রুহি। সময় অনেক কিছু পরিবর্তন করে মানুষের হীতের জন্য। এই দেখো, দশ বছর আগে আজকের দিনে কাউকে নিয়ে অনুভূতি জন্মেছিলো কিন্তু আজকে তা নেই। নেই বলতে আমি তাকে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে মেনে নিয়েছি সেই সাথে তোমার প্রতি আমার অনুভূতিরা তীব্র হচ্ছিলো। আমিও বুঝতে পারি আমি তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমি সময়ের পরে অনুভূতির প্রকাশ করি আর তা তখন অর্থহীন হয়ে যায়। কিন্তু এবার আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই সময়ের একটু পরে হলেও ভুল সময়ে প্রকাশ করিনি। তুমি আমার। আমার মনের রানী এখন। একান্ত এক মহারানী।

আরোহী শুভ্রর হাত শক্ত করে ধরে শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
–জানেন। আজ থেকে দশ বছর আগে আমারো কারো প্রতি প্রথম ভালোলাগা, প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি হয়েছিলো।

শুভ্রর বুকে ধক করে উঠে। জানে না কেনো! তবে তারও কষ্ট হচ্ছে। নিজের অর্ধাঙ্গিনীর মুখে অন্যকারো প্রতি অনুভূতির কথা শুনে তার কষ্ট হচ্ছে। শুভ্র ভাবে, তাহলে আরোহীর কতটা কষ্ট হয়েছে এই দুই বছর! আর সে একদিন কিছু সেকেন্ড আগে শুনে দমবন্ধকর লাগছে। কিছু সেকেন্ড সহ্য করতে পারছে না তাহলে আরোহী ২ টা বছর কিভাবে সহ্য করলো!

আরোহী শুভ্রর চোখে ভয় দেখে। এতো কষ্টের পর ভালোবাসা পেয়ে সেটা হারানোর ভয়। আরোহী মুচকি হেসে বলে,

–জানতে চান না সে মানুষটা কে?

শুভ্র ঢোক গিলে বলে,
–কে?

–আপনি!

শুভ্র অবাক হয়ে আরোহীর দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যাঁ, তার মনে যেনো শীতল স্রোত বয়ে গেলো। অবাকের সাথে সাথে প্রশান্তি অনুভব করছে সে। আরোহী বলতে লাগে।

–সেদিন আপনি আমাকে যথাসময়ে বাঁচিয়েছিলেন। আমি আরোহী সবার সামনে স্ট্রং থাকলেও সেদিন যদি খারাপ কিছু হতো তাহলে আমি এই সমুদ্র গর্ভেই নিজেকে বিলীন করে দিতাম।

শুভ্র আরোহীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বুকে আগলে নেয়। আর বলে,
–এসব বলবে না। ওগুলো মনে করবে না। তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি কারো না কারো মাধ্যমে। আর সেই ব্যাক্তিটা ভাগ্যবশত আমি।

আরোহী শুভ্রর হৃদস্পন্দন শুনছে। দশ বছর আগে যেভাবে শুনতো সেভাবে। আরোহী বলে,
–সেদিনও আপনি আমায় এভাবে আগলে নিয়েছিলেন। আমার অনুভূতির শুরু সেই মূহুর্ত থেকে যেই মূহুর্তে আপনি আমার জন্য ভরসাস্বরূপ হয়ে এসেছিলেন।

আরোহীর বলা শেষে শুভ্র সগতোক্তি করে বলে,
” ভালোবাসি রুহি। এই সাগড় পাড়ে সূর্যদয়ের ক্ষণে বলছি, এ হৃদয়ে তুমি একমাত্র প্রিয় প্রহর হয়ে আছো ও থাকবে।”

চলবে ইনশাল্লাহ,

একটু ঝটকা হয়তো লাগবে। তবে ৮ মাসের কাহিনী দুই-তিন পর্বে শেষ করবো। কেমন হয়েছে জানাবেন।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here