#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৫
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
সন্ধ্যায় পড়তে বসার পর থেকে প্রিয়া অস্বস্তিতে ডুবে আছে। অস্থির চিত্তে বার বার আয়নায় নিজের মুখশ্রী দেখে যাচ্ছে সে। সৌরভের প্রস্তাব মত কি সে ছাদে যাবে? একচিত্ত তার না বোধক উচ্চারিত হলেও অন্যচিত্ত তার চিৎকার করছে। কেনো যাবো না। আনমনে সে লজ্জায় হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। পড়ার থেকে সৌরভের বলা সেই বাক্যেই বার বার তার মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনি হচ্ছে।
বিয়ের রাতের শাড়িটি বের করে বিছানায় রাখে। আলতো হাতে শাড়িতে হাত রেখে আপনমনে সে বিড়বিড় করে,
কি আছে এই শাড়িতে? যার জন্য সৌরবিদ্যুত তাকে পরতে বলেছে। অবচেতন মনে যখন সে নিজ কল্পজগতে ভ্রমণ করছে প্রত্যুষ এসে তার ভাবনা থেকে তাকে জাগ্রত করে।
আপু তোমাকে শোভা আপু ডাকছে।
আচম্বিত ভাইয়ের গলা শুনে প্রিয়া রাগে গজগজ করতে লাগলো। রুষ্ট হয়ে বললো,
কি ব্যাপার! ছাগলের মত ম্যা ম্যা করছিস কেনো? প্রত্যুষ বোনের কথা শুনেই মেজাজ চটে গেলো। বোনকে মুখ বাঁকিয়ে বলল আমি ছাগলের মত ম্যা ম্যা করছিনা তোর ননদ ছাগলের মত ম্যা ম্যা করে তোকে ডাকছে। প্রিয়া প্রথমে ভাইয়ের কথা বুঝতে পারেনি। পরে যখন শোভার কথা শুনলো সে চমকে উঠলো। শোভা তাকে এই সময় কেনো ডাকছে? দ্রুতই সে বের হয়ে গেলো শোভার কথা শোনার জন্য।
শোভা দরজার সামনে ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁসফাস করছে প্রিয়া কখন আসবে?
প্রিয়া দরজার অভিমুখে শোভাকে দেখে প্রথমে ইস্ততঃবোধ করছিল। পরে শোভার ভীতিত্রস্ত মুখশ্রী দেখে থমকালো। আচমকা শোভা তাকে কেনো ডাকলো। কি কারণ হতে পারে তার বোধগম্য হলো না। সে পায়ের কদম বাড়িয়ে শোভার দিকে এগিয়ে যায়।
শোভা প্রিয়াকে দেখে প্রসন্ন হলো। তার হাত টেনে করিডোরের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেলো। প্রিয়া হতচকিত হয়ে গেলো শোভার আকস্মিক হেঁচকা টানে। প্রিয়া ভালো করে লক্ষ্য করলো শোভার মুখে কেমন দুশ্চিন্তার বলিরেখা উদীয়মান। ভয়ার্ত অক্ষিযুগল আর অস্থির বদনে এলোমেলো কদমে মেয়েটাকে বড্ড অশান্ত দেখাচ্ছে। প্রিয়া ব্যগ্রকন্ঠে বললো,
কি হয়েছে আপু? তোমাকে এত অস্থির লাগছে কেনো?
শোভার নিষ্প্রভ ছাউনি সে ইতিউতি করছিলো। লম্বা দীর্ঘশ্বাস টেনে ক্ষীণ স্বরে বলল,
সাফিন এসেছে।
প্রিয়ার কৌতুহলী জবাব, কোন সাফিন?
আমার বয়ফেন্ড সাফিন।
প্রিয়া কিয়ৎক্ষন ভাবলো। সে আধো সাফিন নামে কাউকে চিনে কিনা? পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
সাফিন, কোন সাফিন?
শোভার মলিন মুখে তখন বিষাদের ছায়া। সে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
একদিন তুমি আমাকে যে ছেলের সাথে দিঘির পাড়ে দেখেছো, সেই ছেলের নাম সাফিন। সে আমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রিয়া হতবিহ্বল শোভার কথায়। সে কি উত্তর দিবে সেটাই বুঝতে পারছে না। সাফিন তাদের বাসার নিচে আসলে সে কি করবে? তার করণীয় কি এখানে? তার সন্ধিহান দৃষ্টি এবার শোভার দিকে।
এখন আমাকে কেনো ডেকেছো সেটা বলো?
শোভার মুখে করুণ অসহায়ত্বের সুর। সে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
সাফিনের সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে। কিন্তু সে এখন আমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে? তার সাথে আমি কথা বলি না আজ এক মাস। আমার ভয় করছে প্রিয়া। সাফিন এখানে কি চাইতে এসেছে। আম্মু-আব্বু যদি জানে আমাকে মেরে ফেলবে। আমার প্রচন্ড ভয় করছে। প্রিয়া আমি কি করবো এখন বলো?
প্রিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে লম্বা করে শ্বাস টানলো। সে কিছুক্ষণ ভাবলো শোভার বলা কথায়। তারপর বিচক্ষণতার সাথে বলে উঠলো,
চলো আপু, দেখে আসি কেনো আসছে তোমার এই সাফিন। চিন্তা করো না, আমি আছি তো। যদি কোনো কু-মতলব থাকে তো ব্যাটাকে ঝাটা পিঠা করবো?
প্রিয়ার মজাচ্ছলে বলা কথায় শোভা হেসে উঠলো।
দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। কিন্তু এদিক ওদিক খুঁজেও আর সাফিনকে পাওয়া গেলো না। প্রিয়া হতাশ হলো সাফিনকে না পেয়ে। শোভা তখনো ভয়ার্ত নজরে এদিক ওদিক তাকালো। যদি আবার সাফিন ফিরে আসে। প্রিয়া আলগোছে শোভার একহাত ধরলো। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি তার কিন্তু মুখে কাঠিন্যে ভাব,
আপু একদম ভয় পেয়ো না। আমি আছি তো। তোমার কিছু হবে না। ঐ সাফিন-টাফিন তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না।
প্রিয়ার এমন আশস্ততায়ও শোভার মুখে মলিন হাসি। সে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠল,
বিয়ে করে তুই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস। তবে ভাবী হিসেবে তোকে পেয়ে আমি অনেক ধন্য। আমার ভাই সত্যিই জিতে গেছে’রে তোকে পেয়ে।
শোভার এহেন বাক্য শুনে প্রিয়া লজ্জায় বিগলিত হলো। কিন্তু তার মুখেও আত্মতুষ্টির হাসি। সেও তো জিতেছে তার সৌরবিদ্যুৎকে পেয়ে।
রুমে এসে আবার বই নিয়ে বসলো প্রিয়া। কিন্তু পড়ায় আর মনোযোগ দিতে পারলো না। মন তার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। এক সৌরভের জন্য দুই শোভার সেই উদ্বিগ্ন মুখশ্রীর জন্য। তবে সাফিনের সাথে তার ব্রেকাপের ব্যাপার টা ভাবাচ্ছে বেশ। তাদের মধ্যে ব্রেকাপ কি নিয়ে হয়েছে?
_______________________
সৌরভ চেয়ারে হেলান দিয়ে দুই চোখ মুদে আছে। তার কল্পনার রাজ্যে আজ হাজারো প্রজাপতির মেলা। বদ্ধ আঁখিতে সে তার প্রিয়তমার আদুরে মুখখানি খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার চঞ্চলতা, চপলতা আর লাজুকতায় আজকাল ভীষণ নেশা ধরে গেছে। মেয়েটা দিন দিন তার মস্তিষ্কে ঘাঁটি গড়ে তুলছে। সময়গুলো কিভাবে কাটবে তার, সেই দুশ্চিন্তায় সে অস্থির। ইচ্ছে করে মেয়েটার মাঝে ডুবে থাকতে। কি এক মায়াময়ী মুখশ্রী তার প্রিয়ার। মেয়েটার হাসি যেনো নেশাময় সরোবর। যা দেখতে দেখতে তার সময় ফুরিয়ে যায় কিন্তু দেখার শেষ হয় না। আনমনে প্রিয়ার কথা ভেবে সে মিট মিট করে হেসে উঠে।
আহারে! তোর বিরহে আমার কলিজা ফেটে যায়। আয় ভাই আয়, আমার বাম কাঁধ তোকে পুরাই দান করলাম। তুই সেখানে মন চাইলে ইচ্ছেমত ঠুকরে ঠুকরে কাঁদতে পারিস। আমার কোনো সমস্যা নেই’রে ভাই।
গৌরবের রসিকতার স্বরে বলা কথায় চমকে উঠে সৌরভ। যদিও তার ভাই তার মজা উড়ানোর জন্য বলেছে। কিন্তু সত্যিই তার ইচ্ছে করছে তার ভাইয়ের কাঁধে গিয়ে ঠুকরে ঠুকরে কাঁদতে। তার বেহায়া মনটা বড্ড বউ বউ করে আজকাল। সত্যিই তার মনটা নিলর্জ্জ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
ঘড়ির কাটায় রাত ১১টা ৩০।
প্রিয়ার গায়ে লাল পাড়ের কালো শাড়ি জড়ানো। সিঁথিহীন বাঁকানো চুলগুলোকে অর্ধবেণী করে পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে। মুখে হালকা প্রসাধনী মেখেছে সে। অধরযুগলও সাজিয়েছে হালকা গোলাপি লিপজেলের আবরণে। তার সাজ একদম শেষ। কিন্তু বক্ষস্থলে ঢিপঢিপ শব্দের গতি বেড়েই চলেছে। দুরুদুরু বুকে সে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বাবা-মায়ের রুম অন্ধকারের অপেক্ষা করছিলো এতক্ষণ। তাদের ঘুমানোর পরেই সে এতক্ষণে বেরিয়েছে।
ধীরে ধীরে দরজার হাতল খুলে সে বেরিয়ে পড়ে।
মারিয়া মেয়ের কান্ড দেখে নিঃশব্দে হেসে উঠে। আনোয়ার মারিয়াকে হাসতে দেখে অবাক হয়ে গেলো। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
এত রাতে তোমাকে ভূতে ধরলো নাকি?
মারিয়া জামাইর দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছে। রসকষহীন কাঠখোট্টা জামাই একটা পেয়েছে সে। পুরাই খচ্চরের খচ্চর।
সিঁড়ি বেয়ে প্রিয়া যতই ছাদের নিকটে যাচ্ছে ততই তার হৃদকম্পনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আর দু’কদম বাড়ালেই তার পা ছাদ স্পর্শ করবে। উষ্ণ নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার মুখের চারপাশে। চোখ বন্ধ করে সে লম্বা শ্বাস ছাড়লো। তারপর সাহস সঞ্চার করে ছাদের দরজায় প্রবেশ করলো। মুহুর্তে কি হলো তার কিছুই সে বুঝলো না। অতর্কিত তার মাথায় ফুলের বর্ষণ হলো। এই ফুলের উৎপত্তি খুঁজতে মাথার উপরে তাকালো। সেখানে কোনো মানবের ছায়া খুঁজে পেলো না। সে যারপরনাই অবাক হলো। তাহলে তাকে ফুল বর্ষণ কে করছে। আরও দু’কদম পা বাড়াতেই এক অনন্য সৌন্দর্যের সাথে সে পরিচিত হলো।
দু’পাশে ক্যান্ডেল, মাঝে গোলাপের পাঁপড়ির প্রশস্ত রাস্তা তার জন্য। কিছুদূর যেতেই চমকে উঠলো গাছে ঝুলন্ত এক প্লাকার্ড দেখে।
Welcome to you into My Life.
My Queen.
লাজুকতায় মূর্ছিত হলো বার বার সে। কিন্তু মুখে তার তৃপ্তিময় এক প্রজ্জ্বলিত হাসি। চারপাশে চোখ বুলালো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দর্শন করতে। কিন্তু তার দৃষ্টি ফেরানোর আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত এক কন্ঠস্বরে সে থমকালো।
এসো প্রিয়ারানী তোমার আপন ঠিকানায়। সৌরভ তার এক হাত মেলে দিয়েছে প্রিয়ার দিকে। প্রিয়ার বিস্ময়কর দৃষ্টি তখন সৌরভের দিকে। সে ভেবেই পাই না সত্যিই সৌরভ তার জন্য এগুলো করেছে। বিশ্বাসই করতে পারছে না।
সৌরভ নিজ থেকেই প্রিয়ার কম্পিত হাতখানা ধরে নিলো। তারপর তাকে বাগানের মাঝে ফুল সজ্জিত দোলনায় নিয়ে বসালো। প্রিয়া বিস্মিত নয়নে সৌরভের কান্ড দেখেই যাচ্ছে। সৌরভ দৈবাৎ প্রিয়াকে তার বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে জড়িয়ে নিল। প্রিয়ার ললাটে আচমকা একটা চুমু খেয়ে নিলো। তারপর তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
সেই প্রথম দিনের মত অনূভুতি হচ্ছে আমার।
প্রিয়া কিঞ্চিৎ অবাক হলো। কম্পিত গলায় বললো, মানে।
সৌরভ মিট মিট করে হাসলো। তারপর প্রিয়ার মুখে নিজের দু’হাত আঁকড়ে ধরে বললো,
জানো, প্রথম যেদিন তুমি আমাকে কামড় দিয়েছিলে। সেদিন ঠিক এমন একটাই অনূভুতি হয়েছিলো আমার। সারারাত আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। তোমার ছোঁয়ায় যে শিহরণ আমি অনুভব করেছি তা আর কখনো কারো ছোঁয়াতে পায়নি। তাই তো তোমাকে খুব করে চেয়েছি। তোমার দু’আঁখিতে আমি নিজের সর্বনাশ দেখিছিলাম সেদিন। সত্যিই আমার জীবনের মহা সর্বনাশ করে দিয়েছো প্রিয়ারানী।
প্রিয়া লাজুকতায় আরও একবার মূর্ছিত হলো। কিন্তু তার মন ছিল ব্যকুলতায় পরিপূর্ণ। কিছু না পাওয়ার হতাশা। সে আক্ষেপের সুরে বললো,
তাহলে কখনো প্রপোজ করেন নি কেনো?
সৌরভ বিস্মিত হলো প্রিয়ার কথায়। এই মেয়েকে প্রপোজ করলে আধতে কি সে গ্রহণ করতো। কিন্তু তার শ্বশুর যে তাকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কোনো প্রেম-টেম করা যাবে না। তাই তো সে বাধ্য হয়ে প্রিয়ার থেকে দূরে থাকতো। তার মুখেও হতাশার সুর। সে প্রিয়াকে কোমল গলায় বললো,
আমার শ্বশুর মশায়ের কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল আমার উপর। মেয়ের সাথে কথা বলা যাবে না। তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া যাবে না। তার থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। তবে মেয়েকে নজরবন্ধি রাখা যাবে। তাই তো তোমাকে প্রপোজ করেনি।
প্রিয়ার মনে দুষ্টবুদ্ধি চাপলো। সে শান্ত আর গম্ভীর গলায় বললো,
ঠিক আছে। আপনার কথা মানলাম। কিন্তু এখন আমাকে প্রপোজ করেন।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
দুঃখিত দু’পর্ব দেয়ার কথা থাকলেও দিতে পারলাম না। অনেকগুলো সর্যি(–_–)#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৬
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
প্রপোজের কথা শুনে সৌরভ ঈষৎ হাসলো। মেয়েটা তার প্রপোজাল চাইছে। এ আর এমন কি? নিজেকে স্থির করলো কিভাবে প্রপোজ করা যায়। সে প্রিয়ার চিবুক ধরে তার মোহময় দু’আঁখিতে নিজের পূর্ণদৃষ্টি রেখে নেশালো কণ্ঠে বলে উঠল,
ভালোবাসি বউ তোমার মায়াবিনী দু’আঁখি। ভালোবাসি তোমার সরু গলির পাতলা অধরখানি। যার হাসিতে আমি মুগ্ধ বারংবার। ভালোবাসি তোমার সেই ঢেউ খেলানো এলোকেশ। ভালোবাসি তোমার মনগহীনের অব্যক্ত ইচ্ছে সমারেশ। ভালোবাসি তোমাকে আর তোমার পুরো রাজ্যেকে। যেখানে সম্পূর্ণ আমার বসবাস। অনেক ভালোবাসি তোমাকে প্রিয়ারানী। দয়া করে এই অধমের ভালোবাসা’টা গ্রহণ করো। তাহলে যে আমি ধন্য হয় ‘বেগমসাহেবা’।
সৌরভের নিতান্ত সাধারণ প্রপোজ দেখে প্রিয়ার মেজাজ রুক্ষমূর্তি ধারণ করলো। সে সৌরভকে নিজের থেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো। তারপর রুক্ষ ভাষায় দুটো বাক্য শুনালো,
আপনি স্কুলের প্রিন্সিপালকে পত্র দিচ্ছেন। এভাবে কেউ প্রপোজ করে। দু’হাটু গেড়ে বসবেন তারপর দু’হাতের মুঠিতে আংটি রেখে ঐ হাত উঁচিয়ে আমাকে প্রপোজ করবেন।
প্রপোজের ধরন শুনে সৌরভ প্রথমে চমকালো। পরে প্রিয়ার হাত টেনে বলল আরে বাহ! আমার প্রিয়ারানী দেখছি আজকাল অনেক রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে। তা কোথায় দেখেছো এইভাবে প্রপোজ করা। প্রিয়া সৌরভের কথার জবাব দিলো না। মুখে তার লাজুক হাসি। কিন্তু অন্তরণে দুষ্টুমি চেপেছে তার। আজকে সে এই সৌরবিদ্যুত এর ক্লাস নিবে। তাকে প্রনয়ের দংশনে দংশিত করার জন্য। তাকে এত অপেক্ষা করানোর জন্য। ভালোবেসেও ভালোবাসি না বলার জন্য। নিজের প্রিয় মানুষ হয়েও তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য। দিনের পর দিন তাকে এড়িয়ে চলার জন্য। সবকিছুর প্রতিশোধ নিবে সে। চরম প্রতিশোধ।
সৌরভ ত্বরিত প্রিয়ার সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে। বাম পকেটে থাকা তার প্রিয়ারানীর জন্য সদ্য কিনে আনা আংটিটা বের করে দু’হাতের মাঝে রেখে তা উঁচিয়ে ধরে প্রিয়ার দিকে। মুখে প্রশস্ত হাসি তার।
কিছু ভুল কিছু শিহরণ।
বসন্তের এক সন্ধ্যোয়
মোহময়ীর উত্তোরণ।
মধুময় সেই সন্দিক্ষণে
স্বপ্নচারিণীর আগমন।
আমার শহরে থাকুক
তার পদচারণ।
সে হোক আমার একমাত্র
বেঁচে থাকার কারণ।
ভালোবাসি যে তোমাকে বড্ড প্রিয়। প্লিজ এবার তো গ্রহণ করো প্রিয়রানী।
প্রিয়া তো পুরাই ঘোরের মধ্যে ছিলো। এ কোন সৌরভকে দেখছে সে। সত্যিই অসাধারণ লেগেছে তার কাছে। কিন্তু তাতে কি? সে তো এত সহজে ধরা দিবে না। সে সৌরভের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর কোপিত কন্ঠে বললো,
ওহ, হ্যালো’ কখনো নিজেকে আয়নায় দেখেছো? কোথায় আমি আর কোথায় তুমি। কোন সাহসে তুমি আমাকে প্রপোজ করো। লজ্জা করে না তোমার। মেয়ে দেখলে তোমার হুঁশ থাকে না, ছ্যাচড়ামী শুরু হয়ে যায় তাই না? বাবা-মা কত কষ্ট করে পড়াশোনা করায় মানুষ হওয়ার জন্য ছ্যাচড়ামী করার জন্য নয়। যাও এখান থেকে।
এক দমে কথাগুলো বলে প্রিয়া টুপ করে বসে পড়ে লুকানোর জন্য। সৌরভ তো বাকরুদ্ধ প্রিয়ার মুখে এমন প্রত্যাখান দেখে। সে দ্রুতই প্রিয়ার কাছে যাই। তারপর দু’বাহু ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
সত্যিই আমি দেখতে খারাপ। আর অনেক ছ্যাচড়া তাই না।
প্রিয়া আর মাথা উঠায় না লজ্জায়। সে তো ইচ্ছে করে বলেনি। তার তো সৌরভের উপর অনেক অভিমান জমে আছে। তাই মুখ ফসকে বলে ফেলেছে।
সৌরভ নির্বাক বসে আছে। তার তো মনটায় বিষিয়ে গেছে প্রিয়ার কথা শুনে। কতটা উচ্ছ্বসিত ছিল সে আজকের রাতের জন্য। কত কিছু ভেবে রেখেছে সে প্রিয়ার সাথে কি করবে না করবে? কিয়ৎক্ষন নিরাবতা বিরাজমান তাদের দু’জনের মধ্যে। সৌরভ দৈবাৎ মলিন মুখে বললো,
তুমি হয়তো অনেক কিছুই জানো না। আমিই বলে’নি তোমাকে। তোমার বাবাও বলতে চাইনি তোমার ভালোর জন্য। ছাদে যেদিন তোমার সাথে আমার ধস্তাধস্তি হয়েছিল তারপর আমরা দু’জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে ছবিটা তোমাকে দেখিয়ে ছিলাম সেটা আসলে ঝুমুর চাচী তুলেছিল। এ ছবির কথা তোমার পরিবার আমার পরিবার সবাই জানে। আমার মা’ যেদিন এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলো আমি সম্পূর্ণ মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এ ছবিটার রেশ অনেকদিন ছিল। আমি ঝুমুর চাচীকে গিয়ে ধমক দিয়ে আসি যাতে এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করে।
এরপর দীর্ঘদিন কেটে যায় সবাই অনেকটাই নিশ্চুপ। হঠাৎ একদিন ডাক পড়ে তোমার বাবা থেকে। তিনিও আমাকে এই ছবি নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি সত্যিটাই বলি। কিন্তু তিনি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করলেন না। তখন তোমার বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে তোমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। আমি তখনও আমার অনূভুতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলাম। কিন্তু তোমার বিয়ে অন্যখানে কেনো যেনো মানতে পারছিলাম না। তাই তোমার বাবাকে সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে দেয়।
আমি যদি আপনাকে আঙ্কেল থেকে শ্বশুর হিসেবে বাবা ডাকি তাহলে কি খুব অন্যায় হয়ে যাবে? আমি আপনার মেয়ে জামাই হিসেবে খুব খারাপ নাকি আমাকে পাত্র হিসেবে চোখেই পড়ছে না আপনার।
তখন তোমার বাবা আমার দিকে বিস্ফোরিত নয়নে তাকালেন। তবে তার মুখে ছিল আত্মতুষ্টির হাসি। আমাকে পরখ করার জন্যই তোমার বিয়ের নাটক সাজিয়েছিল। ভাবা যায়। তবে কঠিন কতকগুলো শর্ত দিয়ে দিলেন মেয়ে জামাই হওয়ার জন্য। প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে তোমার ভালোর জন্যই আমি নিজেকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ প্রেমিক পুরুষে পরিণত করি। তোমার ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব তো আমার। সেই থেকে আমি হলাম তোমার অন্তরালের প্রেমিক।
হয়তো আজও তোমাকে ভালোবাসি বলা হতো না। সেদিন যদি ঝুমুর চাচী ছবিটা না তুলতো। তোমার বাবা-মাকে না দেখাতো। কত অদ্ভুত না ব্যাপার টা। মাঝে মাঝে কিছু খারাপের মধ্যেও আমাদের ভালো কিছু নিহিত থাকে।
প্রিয়ার দৃষ্টি জোড়ায় সৌরভের জন্য মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হলো। আরো একবার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলো তার প্রতি। অথচ সে এই লোকটাকে কত ভুল বুঝতো। তার ভালোবাসাকে সে কতটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন তবুও থেকে যাই। সে ব্যগ্রকন্ঠে বলল,
আপনি কি পিউ আপুকে এখনো ভালোবাসেন?
সৌরভের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো প্রিয়ার কথা শুনে। এত লম্বা সময় ধরে এতক্ষণ সে কি বুঝালো তাকে। মনের মাঝে তীব্র দহনে দগ্ধ হলো সে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি সে রাখতে চাই না। তাই পুনরায় বললো,
ভালো যদি পিউকে বাসতাম তাহলে তুমি আমার বউ হতে না। আর না তোমার বাবার কাছে নিজে গিয়ে প্রস্তাব দিতাম।
প্রিয়ার উত্তর পছন্দ হলো না। সে জানে সৌরভ তাকে ভালোবাসে কিন্তু তাহলে আজকে সকালে কেনো তাকে আনতে যাইনি? কেনো পিউর সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো তাকে ভুলে? প্রিয়ার মনে হাজারো জমানো অভিমান। কিন্তু মুখ খুলে বলতে পারছে না। তার জিগ্যেসু নজর এলোমেলো হয়ে বার বার সৌরভের দিকে চাইছিলো।
সৌরভ কেনো যেনো প্রিয়ার মনোভাব চট করে বুঝে গেলো। সে প্রিয়ার সম্মুখে বসে তার দু’হাত নিজের হাতের মুষ্টিতে আবদ্ধ করলো। তারপর এক মায়াবী ছাউনিতে তার দিকে তাকালো। মৃদুস্বরে বলল,
তুমি কি সকালের সেই বিষয় নিয়ে রেগে আছো? তার জন্যই ভাবছো আমি পিউকে এখনো ভালোবাসি। তারপর কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে সৌরভ মিষ্টি করে হেসে উঠল। প্রিয়ার দু’হাতে নিজের অধর ছুঁয়ে বললো পিউর সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই দেখা হয়েছে। আমি কথা বলতে চাইছিলাম না। কিন্তু সে আমাকে অনুরোধ করলো আজকে শেষবারের জন্য আমার সাথে কথা বলতে চাই। হয়তো এটাই তার শেষ দেখা। আমি প্রথমে অবাক হলাম তার কথা শুনে। কি এমন কথা আছে যার জন্য সে আমাকে শেষবারের জন্য কথা বলতে চাই। তার বারবার অনুরোধে আমি ওর সাথে কথা বলতে রেষ্টুরেন্টে প্রবেশ করি। তবে তার আগে তোমাকে ফোনকল করি কিন্তু তুমি রিসিভ করনি তাই ছোট একটা ক্ষুদেবার্তা পাঠায় তোমাকে।
“আমার আসতে একটু দেরি হচ্ছে যদি পারও বাসায় চলে যাও। নয়তো আমার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি আসছি।”
আমি প্রবেশ করার দশমিনিটের মধ্যেই তুমিও রেষ্টুরেন্টে প্রবেশ করেছো। তাই তোমাকে সেভাবে কিছুই ভেঙে বলা হয়নি। কিন্তু তুমি নিজেই তো দেখলে পিউর হাতে বিয়ের কার্ড। এবার বলো এখনো রেগে আছো আমার উপর। আচ্ছা, সরি’ বউ আর কখনো এমন ভুল হবে না। অ্যাই প্রমিজড।
প্রিয়ার নেত্রকোণে অনুশোচনার জলে টইটম্বুর। সে দিগবিদিক ভুলে দৈবাৎ সৌরভকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সে তো মুঠোফোন চেকই করেনি। তারও তো ভুল ছিল।
সৌরভের অধরকোণে বিজয়ের হাসি। অবশেষে তার প্রিয়ারানী তার একান্ত নিকটে এসেছে। সৌরভও তার বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো। প্রিয়ার চোখের জল মুছে সেখানে তার অধর ছোঁয়ালো। মিট মিট করে হেসে প্রিয়াকে রাগানোর জন্যই বলে উঠল,
একটু আগে কে জেনো আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। এখন সে এসেই আবার আমার বক্ষস্থলে লুটিয়ে পড়লো। ছিঃ! কি নির্লজ্জ মেয়ে’রে বাবা। প্রিয়া লজ্জায় হেসে উঠল। কিন্তু মাথা তুলে আর তাকালো না। সৌরভ প্রিয়াকে উঠিয়ে দোলনার মাঝে বসালো। তারপর পাশে রাখা ঝুঁড়ি থেকে বেলীফুলের গাঁজরা তার মাথায় পরালো। আবার কানের মাঝে দুটো গোলাপ গুজে দিলো। গলায় গাঁদা ফুলের মালা আর হাতে শিউলিফুলের মালা পরিয়ে দিলো। মালা পরানো শেষে প্রিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
প্রিয়ারানী মনে আছে তোমার? আমি তোমাকে একদিন আমার ইচ্ছের কথা বলেছিলাম। আমার বউকে এভাবে বাগানের ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিবো। প্রিয়া লাজুক মুখে মাথা নাড়ালো। সৌরভ প্রিয়াকে পাছাকোলে করে ছাদের রেলিং-এ গিয়ে বসায়। প্রিয়া লজ্জায় আর ভয়ে সিটিয়ে আছে। সৌরভ তাকে কোনো রেলিং-এ বসালো। সৌরভ মিট মিট করে হেসেই যাচ্ছে প্রিয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে। সে প্রিয়াকে ক্ষীণস্বরে বলল,
একটা ম্যাজিক দেখবে?
প্রিয়া হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ালো।
সৌরভ হাতের মুঠোফোন নিয়ে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো। প্রিয়া অবাক হয়ে শুধু দেখে যাচ্ছে। কিছু সময় পর ডায়ালকৃত নাম্বারটির ব্যক্তি কল রিসিভ করলো। সৌরভ সালাম দিলো প্রথমে। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
কেমন আছেন চাচী?
ঝুমুর যেনো আকাশ থেকে পড়লো সৌরভের কল দেখে। ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো। তারপর ভালো আছি বললো। তার মনে দুশ্চিন্তার বহর বয়ে যাচ্ছে। সৌরভ তাকে আচমকাই কেনো কল দিলো। সে ইস্ততঃবোধ করছিল কিভাবে জিজ্ঞেস করবে। তার মধ্যেই সৌরভ বলে উঠল,
চাচী আপনি বারান্দায় একবার আসবেন?
ঝুমুর বিস্মিত হলো। ঘোর কাটতেই চাইছে না। কি এমন কারণ যার জন্য তাকে বারান্দায় ডাকছে। সে তড়িঘড়ি ছুটলো বারান্দার দিকে। কিন্তু এসে যা দেখলো তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। ঝুমুর ভীষণ লজ্জা পেলো। কিন্তু সেখান থেকে আসতেও পারলো না। সৌরভ ঝুমুরকে বলল,
চাচী ধন্যবাদ। আপনার অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য প্রিয়া আজকে আমার বউ। এর জন্য আপনি আমার কাছে অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। তারপর বলেন এই খুশিতে আপনাকে কি উপহার দেওয়া যায়?
ঝুমুর জীবনে প্রথমবার শুনলো তার দ্বারা কারো উপকার হলো। খুশি হবে নাকি রাগ করবে বুঝতে পারছিলো না। তবে কোথাও যেনো সৌরভের বলা কথায় তার ভালো লাগলো। সে তড়িৎ বলে উঠল,
মাশাআল্লাহ তোমাদের দু’জনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। দোয়া করি সামনের বছর যেনো তুমি ফুটফুটে বাচ্চার বাবা হয়ে যেতো পারো।
সৌরভ মুচকি হেসে ফোনকল কাটলো।
প্রিয়াকে আরো কাছে টেনে তার কানে কানে বললো,
প্রিয়ারানী রাজি হলে আমি তো আজকেই বাপ হতে এক পায়ে খাঁড়া।
বাচ্চার কথা শুনে প্রিয়া শুকনো ঢোক গিলল। লজ্জায় মূর্ছিত হলো তার কম্পিত বদন।
চলবে,,,,,,,,,,,