শরতের শুভ্র মেঘের ভেলায় পর্ব- ০১

বাসর ঘরে বসে কলেজের সবথেকে আনস্মার্ট, হাবাগোবা ছেলেটাকে নিজের বর হিসেবে দেখতে হবে এ যেন আমার কল্পনারও অতীত।কিন্তু বর্তমানে আমার সামনে যে পুরুষটি দন্ডায়মান কলেজের সেই হাবাগোবা ছেলেটির সাথে তার বিস্তর ফারাক।তবুও আমার মনে হচ্ছে এই সেই ছেলে শুধুমাত্র সময়ের জাতাঁকলে সে নিজের বাহ্যিক পরিবর্তন এনেছে কিন্তু চেহারা সেই একই আছে।তেল চিপচিপে সিঁথি কাটা চুলগুলোতে এসেছে শ্যাম্পু,জেল,হেয়ার স্প্রের ছোঁয়া।গড়নের শুভ্ররঙা ধবধবে পাঞ্জাবি পরিবর্তীত হয়ে সেখানে হয়েছে ধূসর-নীলে আচ্ছাদিত ফুল হাতা শার্ট।দুহাতের ভাঁজে থাকা মোটা মোটা সায়েন্সের বইয়ের স্হানে এসেছে আইফোন নামক যোগাযোগ যন্ত্র।সবকিছু মিলিয়ে সেই নব্বই দশকের হাবাগোবা ছেলেটি এখন হ্যান্ডসাম সুদর্শন যুবক।ছেলেটির দৃষ্টি ফোনেই নিবদ্ধ। সে ছাড়াও এই কক্ষে যে অন্য কারও অস্তিত্ব আছে সেটা তার কার্যকলাপে মনেই হচ্ছে না।হঠাৎ ফোন কানে নিয়ে কারও সাথে কথা বলতে বলতে লোকটি কক্ষের বাহিরে পদার্পণ করল।আমি এখনও বধুবেশী মূর্তির ন্যায় চেয়ে আছি লোকটির পদার্পণকৃত কক্ষের দ্বারপ্রান্তে…….

……এতক্ষণ কী বললাম কিছুই বুঝতে পারলেন না তো। তাহলে চলুন স্মৃতির পাতা উল্টে দেখে আসি সেখানে কী আছে।চার বছরের শিশু থেকে চব্বিশ বছরের যুবতী নারী হওয়ার মধ্যমূহুর্ত সময়ে কী কী ঘটেছে আমার সাথে সবটাই জলন্ত হয়ে আছে স্মৃতির পাতায়।সে যেন এক জলন্ত নীহারিকা………………

____________________________

নীহারিকার জীবনের অতীতাংশ……

আমি নীহারিকা।বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে।ছোট থেকেই খুব আদরের।আমার নামটা আমার মা নিজে পছন্দ করে রেখেছিলেন। নীহারিকা হলো একটি নক্ষত্রের নাম যার অর্থ কুয়াশা,ধূলিকণা কিংবা বাষ্প। আমার নামের অর্থের ন্যায় সাদৃশ্যপূর্ণ আমার জীবনটাও।কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কপালে সুখ সয় না। আমিও ঠিক তেমনই।

বাবা,মা,আমি আর আমার দাদু চারজনের সুখের সংসার আমাদের।গ্রামের বাড়ি খুব সুখেই দিন কাটত।বাবা সারাদিন চাষবাস করে আমাদের জন্য খাবার যোগাত।চারজনের সংসারে স্বল্প আয়েই দিন চলে যেত।হঠাৎ এক কালবৈশাখী ঝড়ে আমাদের জীবনটা তছনছ হয়ে গেল।

সময়টা তখন বৈশাখ মাস।প্রায়শই ছোট-খাটো ঝড় হয়।গ্রামের বাড়ি হওয়ায় বাতাসের গতি তুলনামূলক বেশিই থাকে।কারণ গ্রামাঞ্চলে গাছপালা বেশি তাই বাতাসের প্রবাহ বেশি।এমনি একদিন মা বলল,,

_নীহুর বাপ অনেকদিন বাপের বাড়ি যাই না চলো না একদিন একটু বেড়াইয়া আসি

বাবা_আরে এইডা কী কও তুমি এহন হইলো বৈশাখ মাস। ঝড় ছুটে যহন-তহন। তুমার বাপের বাড়ির পথ তো অনেক লম্বা।লঞ্চে গেলে অনেক সময় লাগবো। শেষে কোনো বিপদ হইলে তহন কী হইবো

মা_আরে কোনো বিপদ হইবো না তুমি দেইখো।তুমার মনে নাই বিয়ার পর্থম,পর্থম(প্রথম) তুমি আর আমি এই বৈশাখে বেড়াইতে যাইতাম আর জৈষ্ঠ্যমাসে আম,কাডাল(কাঁঠাল)খাইয়া তারপর আইতাম

বাবা_তহনকার কতা(কথা)আলেদা। তহন তো নীহু ছিল না। আমার মাইয়াডা লইয়া অনেক ডর করে রে বউ

মা_তুমি যে কী কও না। আমি মা হইয়া ডর পাইতাছি না আর তুমি বাপ হইয়া ডরাও

বাপ_হ ডরাই এইডা লইয়া আর কোনো কথা হইবো না

বাবা,মায়ের কথার মাঝেই আমি দৌড়ে চলে এলাম।বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,,

_আব্বা মায় তো ঠিকই কইছে তুমি এতো ডরাও কেন?তুমরা তো আছো আমার লগে দেখবা আমার কিচ্ছু হইবো না। চলো না আব্বা(মিনতি করে)

আব্বা সেদিন আমার কথা ফেলতে পারেননি।পরদিনই আমরা রওনা দিলাম নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে।দাদু একা বাড়িতে থেকে গেলেন।বয়স্ক মানুষ অতদুর জার্নি করতে পারেন না।পাশের বাড়ির এক চাচির বাসায় খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে তারজন্য আর রাত সেখানেই থাকবে।

সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলাম আমরা।আমার সে কী আনন্দ। কতোদিন পর নানাবাড়ি যাবো।বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ভ্যানে করে লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত গেলাম তারপর সেখানে থেকে লঞ্চে করে আমরা যাত্রা শুরু করলাম।লঞ্চে কত্তো মানুষের সমাগম। আমি ছোট ছোট চোখ করে সবকিছু উপভোগ করছি।আব্বা লঞ্চের মধ্যে ঝালমুড়ি, চানাচুর মাথা কিনে আমাকে আর মাকে দিলেন।চানাচুর মাখাটা খুব মজাদার কিন্তু ভীষণ ঝাল। আমি ঝাল সামেলাতে না পেরে কেঁদেই দিলাম। আব্বা আমার চোখে পানি দেখে উতলা হয়ে উঠলেন।তাড়াতাড়ি করে পানি এগিয়ে দিলেন।পানি খাওয়ার পর ঝাল অনেকটা কমে এসেছে। মা আমার মাথাটা তার কোলের পরে নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে বললেন।রাত নেমে এলো। নানাবাড়ি যেতে যেতে পরদিন দুপুর হয়ে যাবে।রাতে লঞ্চেই সবাই ঘুমিয়ে গেল।আমিও আব্বা,মায়ের সাথে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পরলাম।

প্রচন্ড রকম কাপুনির সাথে আমার ঘুমটা ছুটে গেল।আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আব্বা,মা আমার থেকে অনেকটা দুরে ছিটকে পরে আছে।লঞ্চের সবাই চিৎকার, চেঁচামেচি করছে। সবার মধ্যে ভয়ের আশঙ্কা।আমি আব্বা বলে জোরে ডেকে উঠলাম।আব্বা আমার ডাক শুনে তাড়াতাড়ি উঠে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।আমি আব্বার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।আব্বা আমাকে ভীতু কন্ঠে বললেন,,

_ডরাইস না মা তোর বাপ বাইচ্চা থাকতে তোর কিচ্ছু হইতে দিবো না।কালবৈশাখী ছুটছে রে মা। আল্লাহ রে ডাক মা আল্লাহ রে ডাক

মা এসে আমাকে জাপটে ধরে কেঁদে দিলেন।লঞ্চ ক্রমাগত দুলছে। প্রবল বেগে বাতাসের দাপটে লঞ্চের ভারসাম্য ক্ষুন্ন হচ্ছে।চারপাশে শুধু ভয়,হতাশা, চিন্তা, আর্তনাদ।লঞ্চ ইতিমধ্যে একপাশে হেলে পরেছে।সবাই জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল। আব্বা আমাকে নিয়ে ছাদের সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। আব্বা হন্তদন্ত হয়ে আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলেন।মাও পেছন পেছন চলে এসেছে।আমাদের লঞ্চের কিছুটা দুর থেকে একটা ছোট্ট ট্রলার যাচ্ছিল।ট্রলারটা তাড়াতাড়ি করে আমাদের লঞ্চের কাছাকাছি চলে এলো।কিছুলোক লঞ্চের জানালা দিয়ে ট্রলারে লাফ দিয়ে পরল।ট্রলারটা ছোট হওয়ায় বেশি লোক উঠতে পারল না। ট্রলার পুরো ভরে গেছে আমার আব্বা তখন আমাকে ছাদের ওপর থেকে ছুড়ে মারলেন ট্রলারের মধ্যে।আমি গিয়ে পরলাম ট্রলারের মধ্যে। কিছুক্ষণের ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক পুরোই হতবাক।আমার কথা বলার শক্তি লোপ পেয়েছে মনে হচ্ছে।ট্রলারটা কিছুদুর যেতেই আব্বা-মার অবস্থানকৃত লঞ্চটির আরেকপাশও ডুবে গেল।লঞ্চটি মুহূর্তেই নদীর পানির সঙ্গে বিলীন হয়ে গেল। আমি তখন আব্বা বলে এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালাম।

#শরতের_শুভ্র_মেঘের_ভেলায়
#থ্রিলার_রোম্যান্টিক
#সুচনা_পর্ব
#Sadia_afrin_nishi

চলবে,
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here