শালিক পাখির অভিমান পর্ব -১৩

#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_১৩
#অধির_রায়

“শালিককে আমার ছেলের বউ করে বাড়িতে তুলতে রাজি। আমার খুব পছন্দ হয়েছে৷ আমরা চাই, কালই ঘরোয়াভাবে বিয়ে শালিককে আমাদের বাড়িতে তুলতে৷”

ভদ্র মহিলার কথা শুনে মাথা ঘুর ঘুর করছে৷ আফসানা চৌধুরী সোফার এক কোণে বসে আছেন৷ জোর করে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলেছেন। বিয়ের কথা শুনে বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো৷ আমার স্বপ্ন এখানেই চাপা পড়ে যাবে৷ আমি আর লেখাপড়া করতে পারব না৷ বুকের কোণে সূক্ষ্ম ব্যথায় চোখ চিকচিক করছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করলাম৷ মলিন আহত কন্ঠে বললাম,

“আমার শরীর খারাপ লাগছে৷ আপনারা কথা বলেন আমি আসছি৷ বড়দের কথার মাঝে না থাকাই ভালো৷ ম্যাডাম যা মনে করেন তাই হবে৷ আমি ম্যাডামের সিদ্ধান্ত সম্মান করি৷”

আমি মুখ মলিন করে সেখান থেকে রান্না ঘরে আসতেই কানে ভেসে উঠল টাকার কথা৷ ভদ্রমহিলা আফসানা চৌধুরীকে বলল,

“পাঁচ লক্ষ টাকার এক টাকা কম হলেও এমন কালো মেয়েকে আমার বাড়ির বউ বানাব না৷ এমন কালো মেয়েকে কে বিয়ে করবে? আমি শালিককে বাড়িতে নিচ্ছি না৷ আমি শালিক নামের টাকা বাড়িতে বরণ করে তুলছি৷”

আফসানা চৌধুরীর চোখ টলমল করছে। কোন কথা বলছেন না৷ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ইমন ভাইয়ার দিকে৷ উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি আমার থেকে বেশি আঘাত পেয়েছেন। ইমন ভাইয়া ভয়ে ভয়ে বলল,

“টাকা নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমরা পাঁচ লক্ষ টাকাই দিতে রাজি৷”

মায়া ফুপি চা, বিস্কুট দিয়ে আসলেন৷ আমি মন খারাপ করে বসে আছি৷ রান্নার প্রতি কোন মনোযোগ নেই৷ চা খেয়েই ভদ্র মহিলা ও তার স্বামী চলে গেলেন৷ আফসানা চৌধুরী নিজের ছেলের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন৷ গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“ছি ইমন! তোমার চরিত্র এতোটা খারাপ আমি ভাবতেই পারিনি৷ তোমাকে নিজের ছেলে ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে৷ তোমার মতো ছেলেকে নিজের গর্ভে ধারণ করে নিজের পৃথিবীতে ছোট মনে হচ্ছে৷ আমার চোখ খুলে গেছে৷ আমি শালিককে ছাঁদ থেকে দৌড়ে আসতে দেখে ছাঁদে আসি৷ তোমার নোংরা চরিত্র দেখতে পাই৷”

ইমন ভাইয়া আফসানা চৌধুরীর পায়ে পড়ে যান৷ কান্না জনিত ভেজা গলায় বলল,

“মা আমাকে ক্ষমা করে দাও৷ প্লিজ এসব কিছু শ্রুতিকে বলবে না৷ শ্রুতি কাল বাড়িতে ফিরে আসবে৷ শ্রুতি এসব কিছু জানতে পারলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে৷ আমি শ্রুতিকে খুব ভালোবাসি। শ্রুতিহীন আমি একা হয়ে যাব৷”

আফসানা চৌধুরী এদিকে ওদিক তাকিয়ে ইমন ভাইয়ার হাত ধরে রুমে নিয়ে যান৷ আমি রান্না ঘর থেকে কান পেতে সব শুনতে পেলাম৷ এখানেও যৌতুক প্রথা চালু আছে৷ গ্রামে যৌতুক প্রথা চালু কারণ হলো নিরক্ষরতা৷ শিক্ষিত সমাজেও যৌতুক প্রথা৷ তবে যৌতুক নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই৷ আমার মাথা ব্যথা হলো ইমন ভাইয়াকে নিয়ে৷ ম্যাডাম সব কিছু জানার পরও নিজের ছেলেকে কিছু বলল না৷ নিজের ছেলে বলে সাত খু*ন মাফ করে দিলেন৷ কি অদ্ভুত দুনিয়াতে বাস করি? আমি দৌড়ে মায়া ফুপির হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলাম৷ রাগে কাঁপতে কাঁপতে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কিছুটা রাগী স্বরেই বললাম,

“আপনি আমার মায়ের সমতুল্য। আমি জানি আপনি আমাকে মিথ্যা কথা বলতে পারবেন না৷ আমি সবকিছু জানতে চাই৷ কেন হুট করেই আমাকে বিয়ে দিতে চান?”

আমার এমন রুপ দেখে মায়া ফুপি রীতিমতো অবাক। আমাকে এমন অবস্থায় মায়া ফুপি কখনও দেখেননি৷ ফুপির হাত ধরে নিজেকে শান্ত করে আস্তে আস্তে বললাম,

“ফুপি আমার খুব জানা দরকার৷ গতকাল আমি রুমে আসার পর কি হয়েছে? ফুপি চুপচাপ থাকলে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে৷ ফুপি আমাকে দয়া করে সব খুলে বলেন৷”

ফুপি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল৷ হঠাৎ করেই ফুপিয়ে কান্না করা দেখে বুকের কোণে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলাম৷ অভয় বানী দিয়ে বললাম,

” ফুপি আমি যদি আজ আপনার নিজের মেয়ে হতাম৷ আপনি চুপ থাকতে পারতেন৷ আপনার মেয়ের জন্য কি আপনি প্রতিবা করতেন না৷ মুখ বুজে সব সহ্য করতেন৷”

ফুপি চোখের অশ্রু মুছে বলল,

“গতকাল তুই যখন ছাঁদ থেকে দৌড়ে চলে আসিস৷ আমি আর ম্যাডাম ছাঁদে যায়৷ সেখানে ইমনকে পড়ে থাকতে দেখতে পাই৷ ইমনের হাতে তোর জামার টুকরো৷ দেখে বুঝার বাকী নেই ইমন তোর সাথে অস’ভ্য’তা’মী করেছে। আমাদের দেখে মাথা নিচু করে ফলে ইমন। ম্যাডামের পা ধরে অঝোরে কান্না করতে থাকে৷ ম্যাডামের কাছে সব স্বীকার করে। ম্যাডাম নিজের মান মর্যাদা বজায় রাখার জন্য তোর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এমনকি যৌতুক দিতেও পিছপা হননি৷ তাছাড়া তোর নামে একটা বাসা করে দিবে৷”

ফুপির কথা শুনে মনের অজান্তেই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ এতো ভালোবাসা সব লোভ দেখানো ছিল৷ পা ধরেছে বলে নিজের ছেলের সব দোষ ক্ষমা করে দিল৷ আমি আজ অন্য মেয়ে বলে আমার কোন দাম নেই৷ আমি আজ কোন বিচার পেলাম না৷ আমার ভালো দিক একবারও বিবেচনা করল না৷ আমার স্বপ্ন গলা টি*পে মে*রে ফেলল৷ আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিল না৷ আমি কি আর গ্রামে মাথা উঁচু করে ফিরতে পারব না? আমি ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম৷ ফুপি মাথায় হাত ভুলিয়ে বলল,

“আমার কাছে কিছু টাকা আছে৷ তুই এই বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাহ মা৷ তোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না৷ বড়লোকেরা যতই ভালোবাসা দেখাক৷ সব লোভ দেখানো। নিজের সম্মান বাঁচাতে তোকে মে*রে ফেলতেও এক মিনিট ভাববে না৷”

নিজের সাথে যুদ্ধ করে বললাম,

“না ফুপি। আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব না৷ যুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে তখন যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যাওয়ার লোক শালিক নয়৷ আমি এ বিয়ে কিছুতেই হতে দিব না৷ আমার স্বপ্ন পূরণে যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তাকে আমার সাথে মোকাবেলা করতে হবে৷”

মায়া ফুপি চিন্তিত কন্ঠে বলল,

“তুই কি করতে চাস? তোর মনে কি চলছে? আমি তোর মনের কিছুই বুঝতে পারছি না৷ এমন কিছুই করিস না যেন এই বাড়ির মান সম্মান তলানিতে চলে আসে৷”

চোখের জল মুছে শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,

“সা’পও ম*রবে লাঠিও মজবুত থাকবে৷ কোন সম্মান হানী হবে না৷”

ফুপি কান্না করতে করতে রান্না ঘরে চলে গেলেন৷ আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মালী কাকার কাছে গেলাম। কিভাবে মালী কাকাকে সবকিছু বলব ভেবে পাচ্ছি না? নিস্তব্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে শুধু হাত কাচুমাচু করছি৷ কাকা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“শালিক তোমাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন? বাড়ির কথা মনে পড়ছে৷ তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে৷”

আহত কন্ঠে আস্তে আস্তে বললাম,

“না কাকা৷ আমি বাড়িতে কারোর সাথে কথা বলতে চাইনা৷ আমার শুধু শাকিলার জন্য একটু খারাপ লাগে৷ কবে থেকে শাকিলাকে দেখি না৷ শাকিলার মায়াভরা মুখটা খুব মিস করি৷”

মুখ থেকে আর কথা বের হচ্ছে না৷ সব কথা তালগোল পাকিয়ে ফেলছি৷ মনের ভিতর সাহস জুগিয়ে বললাম,

“কাকা ইহান ভাইয়ার ফোন নাম্বার আছে আপনার কাছে৷ আপনি সব সময় আমার বিপদে দাঁড়িয়েছেন৷ আজ আমার সম্মুখে সব থেকে বড় বিপদ৷ আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন৷ আমি একা এই বিপদ মোকাবেলা করতে পারব না৷”

মালী কাকা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“তোমার কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো তো। ইহানকে কি দরকার? আমাকে বলো! আমি তোমার জন্য সবকিছু করতে পারি৷ তোমার কিছু হলে তোমার বাবাকে কি জবাব দিব?

“তেমন কিছু করতে হবে না৷ আপনার ফোনটা শুধু দরকার৷ ইহান ভাইয়ার সাথে একটু কথা বলব৷”

মালী কাকা ফোনটা আমার হাতে দিলেন৷ আমি ফোন নিয়ে কিছুটা সদূরে চলে গেলাম৷ আমাদের কথোপকথন কেউ যেন শুনতে না পারে৷ ইহান ভাইয়া ফোন রিসিভ করতেই কান্না জনিত ভেজা গলায় বললাম,

“ভাইয়া আমাকে বাঁচান৷ আমার সম্মুখে অনেক বড় বিপদ। আমি তিলে তিলে মা*রা যাচ্ছি৷ নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে৷ আমি কারোর সাথে নিজের অনুভূতি শেয়ার করতে পারছি না৷”

ইহান ভাইয়া উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“তোমার কি হয়েছে? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো৷ কিসের অনুভূতির কথা বলছো?”

“বাড়িতে কিছুই ঠিক নেই। সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে৷ বাড়ি থেকে জোর করে আমাকে বিয়ে দিচ্ছে৷ আমি এই বিয়ে কিছুতেই করব না৷ বিয়ের দিন নিজের জীবন উৎসর্গ করতে রাজি৷ কিন্তু বিয়ের পিরিতে বসতে রাজি নয়৷ আমার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে৷ ভাইয়া কিছু একটা করেন৷ শালিক সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়।”

আমার কথা শুনে ভাইয়া স্তব্ধ হয়ে গেলে৷ ভাইয়ার কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না৷ ভাইয়া যেন মূর্তি হয়ে গেছেন৷ ভাইয়া মলিন কন্ঠে বলল,

“আমি আগামীকাল ১২ টার মাঝেই আসতেছি৷ আর কেউ জেনে জানতে না পারে আমি বাড়ি আসছি৷ কেউ বাড়িতে যাওয়ার কথা জানতে পারলে অন্য কিছু করতে পারে৷ তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করব। স্বপ্ন পূরণে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না৷”

ভাইয়া ফোন কেটে দিল৷ আমার আর কষ্ট করে বলতে হলো না কথাটা কাউকে না জানাতে। ভাইয়া নিজ থেকেই বললেন৷ ফোন রেখে ৯৯৯ এ ফোন দিলাম৷ ফোন রিসিভ করতেই বললাম,

“কাল চৌধুরী ভিলাতে বাল্যবিবাহ হচ্ছে৷ তার উপর যৌতুক দিয়ে শালিক নামে একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে৷ শালিকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা করেন৷”

ব্যাস আমার কথা হয়ে গেছে৷ মুচকি হেঁসে মনে মনে বললাম,

“ইমন ভাইয়া আপনার অপরাধের ক্ষমা নেই৷ আমি আপনার অপরাধ কখনও ক্ষমা করব না৷ আমার সাথে এমন হলে ক্ষমা করে দিতাম৷ আপনি শুধু আমার সাথে নয় আমার মতো অনেক অসহায় মেয়ের সাথে অন্যায় করেছেন৷ আমি বেঁচে থাকতে আপনার পা*পের কোন ক্ষমা হবে না৷”

রাতে বসে খাবার খাচ্ছি৷ ইমন ভাইয়া আমার সামনে এসে বসলেন৷ মুচকি হেঁসে বলল,

“শালিক পাখি তোমার স্বপ্ন এখানেই শেষ৷ আমার কথা মেনে নিলে তোমার ভাগ্য খুলে যেত। তোমাকে এমন জায়গায় পাঠাবো তুমি চাইলেও বেরিয়ে আসতে পারবে না৷”

ইমন ভাইয়ার কথার মাঝে রহস্যের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছি৷ বিয়ের কথাটা ইমন ভাইয়ার মাথায় প্রথম আসছে৷ ভাইয়ার ভাব ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছি৷ এখানেও ভাইয়ার কোন স্বার্থ আছে৷ ভাইয়া কখনও স্বার্থ ছাড়া কিছুই করেন না৷ আমি ভ’য়া’র্ত কন্ঠে বললাম,

“ভাইয়া প্লিজ আমার সাথে এমন করবেন না৷ আমি আপনার বোনের মতো৷ কোন আমাকে আপনি দাবার গুটি বানাচ্ছেন। শ্রুতি ভাবী আপনি বলতে পা*গল৷ আপনি শ্রুতি ভাবীকে ঠকাতে পারেন না৷”

পিশাচের মতো মুচকি হেঁসে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

“আমার কিছুই করার নেই৷ অনেক দেরি হয়ে গেছে শালিক পাখি৷ তোমার ভাগ্য তুমি নিজে ঠিক করেছো৷ নিজের ভাগ্যের উপর বিশ্বাস রাখো৷”

ভাইয়া চোখ টিপল দিয়ে চলে যান। ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করছে৷ ইচ্ছা করতে ইমন ভাইয়াকে খু*ন করতে৷ আমিও মুচকি হেঁসে মনে মনে বললাম,

“ভাইয়া দাবার গুটি এবার ভুল চালছেন৷ আমি আপনার য*ম হয়ে ফিরছি৷ আমাকে দাবার গুটি বানানো এতো সহজ নয়৷ দাবার চাল আমিও কম দিতে পারিনা৷ আমার রাজা, মুন্ত্রী, নৌকা সব জীবিত আছে৷ এবার খেলা উল্টে গেছে৷”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here