শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব -১৫+১৬+১৭

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই(১৫)

আজ আফিফার বিয়ে। বিয়ে বাড়ির সকল আনন্দ চাপা পড়ে আছে সবার মন খারাপের আড়ালে।
সবাই কেমন রোবটের ন্যায় চলছে।
হাসি মুখে বেদনার চাপ।বুকে লুকায়িত গোপন ব্যথা।

আকাশে মেঘের আনাগোনা, যেনো আকাশের ও মন খারাপ। আদনান সকাল থেকে নিজের রুমে বসে আছে দরজা আটকে।
কি করেছে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
সে তো শালুককে হারাতে চায় নি।বরং আজীবনের জন্য শালুককেই চেয়েছে। কিন্তু কি হয়ে গেলো এটা!

শাপলা কাঁদছে ভীষণ। ছোট বোনটাকে এতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলবে সে কখনো ভাবে নি। আশা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না আদনান কেনো এমন করছে।তার সব কিছু বিরক্ত লাগছে।
আজ যদি শালুকের বদলে শাপলা যেতো ওই ঘরে তাহলে কি হতো?
ধ্রুবর তখন কি করার থাকতো?
সে কি শাপলাকে বিয়ে করতো?তাহলে তার ভালোবাসার কি হতো? যাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে এসেছে তাকে কিভাবে ভুলে যেতো?উত্তর পায় না আশা।

খুব সাদামাটাভাবে আফিফার বিয়ে হলো। বিয়েতে কোনো সানাই বাজে নি,কেউ কান্না করে নি।আফিফা বিয়েতে একটুও কাঁদে নি।পুরোটা সময় রোবটের মতো ছিলো অনুষ্ঠানে।
আদনান বের হলো আফিফার বিদায়ের সময়। আফিফা সবার থেকে বিদায় নিলো কিন্তু আদনানের সামনে ও গেলো না। ফিরে ও তাকালো না আদনানের দিকে।

আফিফা চলে যাবার পর সবাই আদনানকে নিয়ে বসলো। হাসনা বেগম নিরবে কেঁদে চলেছেন।ছেলেটার তো এমনিতেই কপাল পোড়া এখন সেই সাথে জুটেছে নিজের মেয়ের কপাল।
শালুক যে বড় অবুঝ, সে কিভাবে সংসার করবে?
ধ্রুব কোথায় আছে এখন?কয়েকবার কল দিয়েছেন কিন্তু ফোন বন্ধ ছিলো ধ্রুবর।

আদনান উসখুস করছে কেমন। নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেছে। সবার সামনে খারাপ হয়েছে।সবার কাছে খারাপ হলেও আদনানের এতো কষ্ট হতো না যতোটা কষ্ট হচ্ছে শালুককে হারানোর জন্য।
বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করছে শালুকের জন্য তা কাকে বুঝাবে আদনান?

আদিবা বেগম সবচেয়ে ক্ষিপ্ত হলেন ছেলের উপর। আদনানের শার্টের কলার চেপে ধরে বললেন, “কেনো এমন করলি তুই?
আমার ছোট মেয়েটাকে কেনো এভাবে তাড়ালি তুই?যার চঞ্চলতায়,হাসিতে মুখরিত হতো আমাদের পুরো বাড়ি সেই মেয়েটা আজ কই?
আজীবন যেই ছেলেটা কষ্ট পেয়ে এসেছে, সেই ছেলেটা একেবারে আজ বাড়ি ছেড়েছে।কেনো তুই এমন করলি?

আদনান মাথা নিচু করে বসে রইলো। কি জবাব দিবে সে?কিভাবে বলবে কেনো এমন করেছে সে?

নুরুল ইসলাম সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন, ” তোর সমস্যা কি আদনান ক্লিয়ার করে বল?”

আদনান কিছু বলতে পারলো না। বুকের ভেতর দুরুদুরু করে কাঁপছে তার।জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার বুকটা।

আদিবা বেগম স্থির থাকতে পারলেন না।সপাটে দুই থাপ্পড় বসালেন ছেলের গালে।তারপর হিংস্র বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন আদনানের উপর।
অপ্রকৃতস্থর মতো চিৎকার করে বলতে লাগলেন,”আজ আমার মেয়ের বিয়েটা তোর কারণে এরকম নিরানন্দভাবে হয়েছে। আমার বাড়ির হাসির উৎস হারিয়ে গেছে। ঘরছাড়া ছেলেটা ঘরে ফিরে এসেছিলো, তোর জন্য একেবারে হারিয়ে গেলো। খু/ন করে ফেলবো তোকে আমি।তোর মতো ছেলের আমার দরকার নেই।
সব শেষ করে দিলি তুই।সব শেষ হয়ে গেলো তোর জন্য। ”

ফরিদা টেনে আদিবা বেগমকে সরিয়ে আনলেন আদনানের উপর থেকে।
সবার সব কথা আদনান মাথা নিচু করে শুনে গেলো। তবুও স্বস্তি পেলো আশা সামনে না থাকায়।আশা,শাপলা,দিবা আফিফার সাথে গিয়েছে আফিফার শ্বশুর বাড়িতে।

————–

ধ্রুব শালুককে নিয়ে ঢাকায় চলে গেলো। শালুকের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার বিয়ে হয়েছে ধ্রুব ভাইয়ের সাথে। ধ্রুব ভাইয়ের হাত ধরে সে বাড়ি ছেড়ে এসেছে।

কেনো এরকম হলো তার সাথে? সে তো ধ্রুব ভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলো,তবে কেনো ওরা এভাবে খারাপ কথা রটালো?
ধ্রুব ভাই কেমন মানুষ তা অন্তত সবাই জানে বাড়ির।তবে কেনো কেউ প্রতিবাদ করলো না?ধ্রুব ভাইয়ের জীবনটা কেনো এভাবে নষ্ট করে দিলো তারা?ধ্রুব ভাইয়ের কেশবতীর কি হবে তাহলে? শালুকের কান্না এলো ভীষণ।
আহারে ধ্রুব ভাই! আজীবন শুধু সব হারিয়ে এলো।এবার শেষ পর্যন্ত বুঝি ধ্রুবর কেশবতীকে ও হারাতে হলো তার জন্য।

ধ্রুব শালুকের হাত শক্ত করে মুঠোয় পুরে বললো, “শালুক!”

শালুক চমকে উঠলো। তারপর জবাব দিলো ধ্রুবর ডাকের।

ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “ভয় লাগছে তোর?”

শালুক কেঁদে উঠলো। তার কেমন বুক ধড়ফড় করছে।ধ্রুব শালুকের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “আমাকে তুই চিনিস না শালুক?মনে কর আমি তোর বন্ধু।আমাকে স্বামী ভেবে ভয় পেতে হবে না।বন্ধুর মতো থাকবি।আজ থেকে তোর সব দায়িত্ব আমার। আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে তোর সবাই থাকলেও,তুই ছাড়া আমার আর কেউ নাই শালুক।আমাকে ভয় পেয়ে তুই দূরে চলে যাস না কখনো।আজ থেকে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ তুই শালুক। ”

শালুক কেঁদে উঠে বললো,”তোমার সেই কেশবতীর কি হবে? কেনো আমাকে বিয়ে করলে?কি হতো এমন বিয়ে না করলে?তোমার ভালোবাসা তো অপূর্ণ রয়ে গেলো।”

ধ্রুব হাসলো। তারপর বললো, “আমার ভালোবাসা হারায় নি শালুক।আমার ভালোবাসা তো আমার কাছেই আছে।”

শালুক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিভাবে?”

ধ্রুব হাসলো। কিছু বললো না।

ঢাকায় এসে ধ্রুব শালুককে নিয়ে তার একটা ক্লাসমেটকে কল দিলো। ১৫ মিনিট পর একটা মেয়ে এলো শালুকদের কাছে।এসে শালুককে জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি শালুক না?কতো শুনেছি তোমার গল্প আমি।”

শালুক বুঝতে পারলো না কিছু।ধ্রুব শালুকের হাত ধরে বললো,”শালুক,তুমি রিমার সাথে যাও ওর বাসায়।আমি একটা বাসা ঠিক করেই তোমাকে নিয়ে যাবো।”

শালুকের ভীষণ ভয় করলো। এই অচেনা শহরে, অচেনা একটা মেয়ের সাথে থাকার জন্য ধ্রুব শালুককে রেখে যাচ্ছে! এই মেয়ে কে?একে তো শালুক চেনে না।ধ্রুব ভাই যদি আর না আসে?

শালুক ধ্রুবর হাত চেপে ধরে রাখলো। কেঁদে উঠলো শালুক ধ্রুবকে ধরে। তারপর বললো, “আমি কোথাও যাবো না ধ্রুব ভাই। আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।আমার ভীষণ ভয় করে। ”

শালুকের হাউমাউ করে কান্না দেখে ধ্রুবর ভীষণ মন খারাপ হলো। কি করবে সে এখন?
শালুককে সে কোথায় রাখবে?সে নিজেই তো থাকতো হলে।এখন তো তার নিজের ও থাকার জায়গা নেই। ধ্রুব ভেবেছে রাতটা কোনো মসজিদের সামনে শুয়েই কাটিয়ে দিবে।

শালুকের কান্না থামে না দেখে ধ্রুব বুকে চেপে ধরলো। তারপর কোমলস্বরে বললো, “ভয় পাচ্ছিস?আমি আছি না শালুক?আমি থাকতে আমার বউয়ের কিচ্ছু হবে না।নিশ্চিন্তে থাক তুই।”

রিমা শালুককে নিয়ে গেলো তাদের বাসায়।চার বান্ধবী মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকে তারা।নিপা,সুমি,লিমা,ফ্ল্যাটের সবাই একই ভার্সিটিতে পড়ে। শালুক ভয়ে ভয়ে বসে রইলো এক পাশে বিছানার।

রিমা ডাইনিং রুমে বিছানা করে নিলো নিজের জন্য। নিজের বিছানায় শালুককে ঘুমাতে দিলো নিজের রুমমেট নিপার সাথে।

রাত ১২ টা বাজে।ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে রিমাদের ফ্ল্যাটের উল্টোপাশে রাস্তার উপর।
ধ্রুব শালুককে রিমার সাথে পাঠিয়ে ও নিশ্চিন্তে থাকতে পারলো না।মন আনচান করছে তার কেমন শালুকের জন্য।

শালুক নিজেও ঘুমাতে পারছে না।ভয় লাগছে তার কেমন। এখানে কাউকে সে চিনে না সে।কিভাবে থাকবে সে এখানে তাহলে?

ভয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো সে।এসে দেখে ধ্রুব রাস্তার পাশে আছে।
শালুকের হঠাৎ করেই কান্না পেলো। জীবন কেমন করে বদলে গেলো একটা ঘটনায়।
দায়িত্ব কি একেই বলে!
যেই দায়িত্বের জন্য ধ্রুব এই রাতে এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছে।

————–

রাতে আশার মা রাদিবা কল দিলো আদনানের মা’কে। তারা আগামী বুধবার দেশে আসছে।আশার বিয়ে দিয়ে দ্রুতই মেয়ে এবং জামাইকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যেতে চায় তারা।আশার বাবা মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারছে না।

আদিবা বেগম শুনলেন।অন্যসময় হলে যেমন উৎফুল্ল হতেন আজ আর সেটা হলেন না।বুকের ভেতর ভারী হয়ে আছে তার।
ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত হয়তো বানাতে পেরেছেন কিন্তু মানুষ বানাতে পারেন নি তিনি।তার ছেলেটা মানুষ হয় নি।আজ এতো দিন পরে তিনি উপলব্ধি করলেন একটা স্বার্থপর, নিচ মনের ছেলের মা তিনি।

কাকে নিয়ে মিথ্যে অহংকার করতেন এতোদিন!

সকালে উঠে নয়নার হাত ধরে বললেন, “আমার আফিফা যখন জহিরকে ভালোবাসে বলে জানালো,ভেতরে ভেতরে চুরমার হয়ে গেলো মেয়েটা সেদিন আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমি তোর সাথে অন্যায় করেছি।
আর আজ কি মনে হচ্ছে জানিস,আজ মনে হচ্ছে তোর সবচেয়ে বড় উপকার করেছি আমি।অন্তত এরকম নোংরা মানসিকতার একটা ছেলে তোর জীবন সঙ্গী হয় নি।

নয়না মামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। কেউ বুঝতে পারছে না এখনো কেনো আদনান এরকম করলো। কি লাভ হলো তার এতে করে!

একটা হাসিখুশি পরিবারের শান্তি একটা ঘটনার জন্য বিলীন হয়ে গেলো। একটা ছন্নছাড়া ছেলে আবারও সব কিছু হারিয়ে ফেললো। একটা ফুলের মতো মেয়ের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে এলো।
কোথায় আছে তারা,কেমন আছে,কেউ জানে না।

ধ্রুবর রাত কাটলো রাস্তার পাশে বসে বসে। আর শালুকের রাত কাটলো অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধ্রুবকে পাহারা দিয়ে।

সকাল হতেই ধ্রুব চলে গেলো। প্রথমে একটা ছোট বাসা নিতে হবে আর তারপর একটা ছোট চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।এতো দিন টিউশনি করে নিজের একার খরচ খুব ভালো করে চলতো,উপরন্তু আরো থাকতো ব্যাংকে।
কিন্তু এখন শালুক আছে।

যতোবারই ধ্রুব ভাবে তার বোকা ফুল আজ থেকে তার হয়ে গেছে আজীবনের জন্য,চাইলেই সে ফুলটাকে দেখতে পারবে,আলতো করে ছুঁয়ে দিতে পারবে।
একটা ছোট বাসায় দুজন ছোট একটা সংসার সাজাবে।ঘরের বাহিরে থাকা ছেলেটা কারো টানে সময়মত ঘরে ফিরে যাবে,ভাবলেই ধ্রুবর ভীষণ আনন্দ লাগে।

কখনো কি ভেবেছে এরকম সিনেম্যাটিকভাবে সে তার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে যাবে?
ভাবে নি কখনো। ভেবেছে কতো কাঠখড় পোড়াতে হবে কে জানে।
আল্লাহ হয়তো জুটি বেঁধে রেখেছিলো তার ভালোবাসার মানুষের সাথে,তাই এভাবে পেয়ে গেছে।

সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরে ধ্রুব বাসা খুঁজতে লাগলো। আর রিমার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শালুকের দুই চোখ খুঁজতে লাগলো ধ্রুবকে।

সবার কথা মনে পড়ছে শালুকের।মা,বাবা,বড় চাচা,বড় চাচী,মেজো চাচী,নিজের ভাই বোন,চাচাতো ভাই বোন সবাইকে মনে পড়ছে।আর বুঝি কোনো দিন স্কুল যাবার সময় দাদার থেকে টাকা নেওয়া হবে না।
দাদীর পানের বাটি থেকে জর্দা দেওয়া পান খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাবে না।
বড় চাচী,মেজো চাচী কেউ চুলে তেল দেওয়ার জন্য সারা বাড়ি পিছু পিছু ছুটবে না।শাপলার ব্যাগ থেকে টাকা চু/রি করা হবে না।
শান্তর জন্য স্কুল থেকে ফেরার সময় চকলেট নিয়ে আসা হবে না।
মায়ের হাতের মাইর খেতে হবে না।বাবা,চাচাদের গলা ধরে আদুরে ভঙ্গিতে কোনো আবদার করা হবে না।

বুকের ভেতর কেমন জ্বলেপুড়ে যেতে লাগলো শালুকের।
কিভাবে থাকবে শালুক?কেমন করে বাঁচবে?
ধ্রুবর সাথে তো চলে এসেছে রাগ করে, বাড়িতে থাকলে আদনানকে দেখলে রাগ উঠবে বলে চলে এসেছে। ফেলে এসেছে নিজের সবকিছু, সব আপন মানুষ।
এই অচেনা শহরে,অচেনা মানুষের সাথে ভীতু শালুক কিভাবে থাকবে?

ধ্রুব কল দিলো দুপুর দেড়টার দিকে। রিমা এনে ফোন দিয়ে যেতেই ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “খেতে যাস নি কেনো তুই?এক্ষুনি গিয়ে খেয়ে আয়।ভয় পাচ্ছিস কেনো?
তোর মনে আছে,ছোট বেলায় কিছু হলেই তুই আমার কাছে ছুটে আসতি।আজ ও তো আমি আছি তোর পাশে।আমি তোর জীবন সঙ্গী শালুক।আমাকে ভরসা কর।জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আছি তোর সাথে। ”
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (১৬)

দিগন্ত জুড়ে মেঘ জমেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ভীষণ। এই বুঝি বর্ষণ শুরু হবে।
শীতল হাওয়া ছেড়েছে প্রকৃতি।
শালুকের মনটা উদাস হয়ে গেলো। দুপুরে নামমাত্র কিছুটা খেয়েছে সে।আজ তো আফিফার বৌভাত হবে।সবাই নিশ্চয় গিয়েছে। খুব আনন্দ করছে নিশ্চয় সবাই মিলে।
নিজের অদৃষ্টকে নিজেই জিজ্ঞেস করলো, “কি দোষ ছিলো আমার? আমার আনন্দময় জীবনে কেনো এভাবে নেমে এলো অন্ধকার? যে জীবন ছিলো বসন্তের উৎসব সেই জীবনে কেনো আজ শীতের রিক্ততা? ”

রিমা এনে তার ফোন দিয়ে গেলো শালুককে।শালুক হ্যাঁ বলতেই ধ্রুব বললো, “এদিকে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে শালুক।ওদিকে ও হয়তো বৃষ্টি নামবে যেকোনো মুহুর্তে। তুই খবরদার বারান্দায় এসে দাঁড়াবি না কিছুতেই।বৃষ্টির পানি যাতে কিছুতেই না লাগে তোর গায়ে।সাবধানে থাকবি শালুক।কোনো চিন্তা করবি না।আমি আছি তো।”

শালুককে উত্তর দিতে না দিয়ে কল কেটে দিলো ধ্রুব। শালুক একটা নিশ্বাস ফেলে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নেমেছে।
রিমা ফোন নিতে এসে জিজ্ঞেস করলো, “লেবু মাখা খাবে শালুক?”

শালুক মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো।রিমা শালুকের হাত ধরে বললো, “কি হয়েছে তোমাদের শালুক?এভাবে ভেঙে পড়েছ কেনো?এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিলে কেনো?ধ্রুব দেখলাম আমাকে টেক্সট দিয়ে বললো শালুককে বিয়ে করে নিয়ে এসেছি, তোর বাসায় এক-দুই রাত থাকবে।এরপর এতো জানতে চাইলাম কিছুই বললো না কি হয়েছে। ”

শালুক একবার ভাবলো বলে দিবে কিভাবে কি হয়েছে। পরমুহূর্তে মত পাল্টালো।যেখানে ধ্রুব কিছু বলে নি সেখানে শালুক বলে দেওয়া ধ্রুবর অপমান। তাই আস্তে করে জবাব দিলো, “কিভাবে কি হলো আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না আপু।আপনি ধ্রুব ভাইয়ের থেকে জেনে নিয়েন।”

রিমা হেসে বললো, “এখন তো হাজব্যান্ড হয়ে গেছে শালুক,এখন আর ভাই বলছ কেনো?শুধু ধ্রুব বলো।”

শালুক আঁতকে উঠলো সে ধ্রুব ভাইকে শুধু নাম ধরে বলবে!মরেই যাবে তাহলে। এটাও কি সম্ভব কখনো!

রিমা হেসে ফেললো শালুকের লজ্জা দেখে।তারপর বললো, “আচ্ছা থাক,লজ্জা পেতে হবে না।তোমাদের টোনাটুনির ব্যাপার সেটা। নিজেদের সংসার হলে তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রিমা চলে যেতেই শালুক ভাবতে লাগলো। নিজেদের সংসার! কাকে নিয়ে সংসার করবে শালুক!
সে তো সংসার বলতে জানে মা বাবা ভাই বোন,চাচা,চাচী,দাদা,দাদী,ফুফু সবাই মিলে একসাথে এক বাড়িতে থাকা।
সংসার মানে সকালে সবাই মিলে চায়ের আড্ডা,সন্ধ্যা বেলায় ছোট চাচীর হাতের ঝালমুড়ি, মায়ের হাতের নুডলস, বড় চাচীর হাতের পাকোড়া ভাজা।

সংসার মানে দুপুরে ঝেতে বসলে মুরগির রান না পেলে কেঁদেকেটে সব একাকার করে ফেলা।
বড় চাচার হুমকি-ধমকি শুরু হয়ে যাওয়া। মুরগির রান দুই পিস একসাথে শালুককে দিতে হবে বলে আদেশ জারি করা।
পুকুরে সবাই মিলে দাপাদাপি করে গোসল করা।সংসার মানেই তো যৌথ পরিবারে সবাই মিলে থাকা।

দুজন মিলে কি সংসার হয় না-কি?

বৃষ্টিতে ভিজে ধ্রুব বাসা খুঁজতে লাগলো। কিছুতেই পছন্দসই বাসা পাচ্ছে না।আবার বাসা পছন্দ হলে সেখানে ভাড়া বেশি। ধ্রুবর ব্যাংকে মোটামুটি ৫০ হাজারের উপরে টাকা আছে।

সকাল থেকে ঘুরতে ঘুরতে ধ্রুব বাসা পেলো আসরের নামাজের পর।
রোডের সাথেই ছোট একটা বাসা,তিনতলা পর্যন্ত। বাড়ির বাহিরের দিকে থেকেই দেখে বুঝা যায় এই বাসার ভেতরটা তেমন সুবিধাজনক নয়।বাহিরের দেয়ালে শ্যাওলা ধরা,বাড়ির নীল রঙ উঠে জায়গায় জায়গায় সাদা সিমেন্ট দেখা যাচ্ছে।বাসার সামনে একটা বাগানবিলাস গাছ আছে সাথে একটা কামিনী গাছ।অন্যপাশে দুটো নারিকেল গাছ। ধ্রুব আল্লাহ আল্লাহ করে ভেতরে গেলো। বাহির থেকে যেমন দেখাচ্ছে ভেতরটা তেমন নয়।
ভেতরে রঙ ঠিক আছে যদিও দেয়াল খুব মসৃণভাবে ঘষে নি রঙ করার সময়। অফ হোয়াইট কালার রঙ দেওয়া দেয়ালে।এক তলায় দুটো করে ফ্ল্যাট। এক ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুম, দুটো ওয়াশরুম একটা কমন আর একটা এটাচড মাস্টার বেড রুমের সাথে।
একটা ডাইনিং আর একটা কিচেন। স্বস্তির ব্যাপার হলো দুই রুমেই বারান্দা আছে।
উপরের তলায় ও ভাড়াটিয়া আছে,নিচের তলায় ও আছে,শুধু এই দ্বিতীয় তলায় এই ফ্ল্যাট খালি গত মাসে ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ায়।তাছাড়া উপরের তলার ভাড়া ১২ হাজার,দুই তলার ভাড়া হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। এজন্য উপরের তলার ওরা নিচের তলায় আসে নি।

ধ্রুবর পছন্দ হলো বাসা।শালুককে কল দিলো আবারও ধ্রুব।শালুক রিসিভ করতেই জিজ্ঞেস করলো, “শোন,একটা বাসা পেয়েছি বুঝলি।একটু ছোট রুম,দুই বেডরুম,একটা ডাইনিং ড্রয়িং, একটা কিচেন,দুইটা ওয়াশরুম,দুইটা বারান্দা। গ্যাস,পানি বিদ্যুৎ সব আছে।যদিও বিদ্যুৎ বিল আমাদের। ১৫ হাজার টাকা ভাড়া।
এখন তুই কি বলিস,নিবো?
সারাদিন অনেক তো খুঁজলাম।কিন্তু এরকম পেলাম না।বড় বাসা নিতে হলে ভাড়া আরো বেশি, আবারও খুব ছোট দুই রুমের বাসাও নিতে ইচ্ছে করছে না।”

শালুক অবাক হলো ধ্রুবর কথা শুনে।তারপর সেই অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেনো তুমি?আমার অনুমতির কি আছে?তোমার যেটা ভালো মনে হয় তাই করো।”

ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বললো, “বাসা কি আমার জন্য নিচ্ছি?আমার একার সংসার হবে এখানে?বাসা তো তোর জন্য,দিন শেষে এই সংসার তোর,তুই ঘরের কর্ত্রী হবি।তোকে জিজ্ঞেস করবো না আমি?তোর পছন্দ না হলে আমি আরো হাজারটা খুঁজবো বাসা।ছোট বাসা শুনে রাগ করেছিস না?আমি রিমার মেসেঞ্জারে ছবি পাঠাচ্ছি বাসার তুই দেখ আগে।”

ধ্রুব কল কেটে দিলো। শালুক কিছুই বুঝতে পারলো না মাথামুণ্ডু। এসব ব্যাপারে শালুককে জিজ্ঞেস করার কি আছে তাই ভেবে পাচ্ছে না শালুক।
ধ্রুব ছবি পাঠাতেই শালুক দেখতে লাগলো। কিন্তু তার মাথায় ঢুকলো না এখানে ভালো খারাপের কি আছে?এসব ব্যাপার সে কিভাবে বুঝবে?

ধ্রুব এবার ভিডিও কল দিলো। শালুক ভিডিও কল দেখে কল কেটে দিলো। ভিডিও কলে কথা বলতে লজ্জা লাগবে তার এখন ধ্রুবর সাথে।
ধ্রুব অডিও কল দিলো আবার। তারপর জিজ্ঞেস করলো, “পছন্দ হয়েছে? ”

শালুক বললো, “হ্যাঁ হয়েছে পছন্দ।”

ধ্রুব মুচকি হেসে বললো, “মন খারাপ করিস না শালুক।আমি তোকে আরো বড় বাসায় রাখবো ইনশাআল্লাহ। আমাদের এই দুরবস্থা থাকবে না শালুক।সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।একদিন তোকে আমি একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি করে দিবো।আমাদের সংসার জীবনের শুরুটা একটু কষ্টের হবে হয়তো, আমি প্রমিস করছি শালুক তোর সেই কষ্ট আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে দূর করে দিবো।”

শালুক ভীষণ লজ্জা পেলো এই কথা শুনে।ধ্রুব ভাই এভাবে কথা বলছে কেনো?শালুকের কান লাল হয়ে যাচ্ছে লজ্জায়।কেমন একটা অদ্ভুত শিহরণ জেগেছে শরীরে। দেহের প্রতিটি লোমকূপ পর্যন্ত শিহরিত হলো।

ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “আজ রাতটা রিমার সাথে থাক,সকালে বাসায় নিয়ে আসবো তোকে।”

শালুক রাজি হলো না কিছুতেই এখানে থাকতে। ভেজা গলায় বললো, “আমি এখানে থাকবো না ধ্রুব ভাই,আমি এখানে থাকলে তুমি এই বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সারারাত মশার কামড় খাবে আর মশা মারবে।আমার তা সহ্য হবে না।ঢাকা শহরের মশারা মনে হয় খাবার পায় না বহু বছর ধরে। কাল সারারাত তোমার দুই হাত থামে নি এক মুহূর্তের জন্য।”

ধ্রুব অবাক হয়ে বললো, “তুই সারারাত জেগে ছিলি কেনো শালুক?আমার তো এসবে অভ্যাস আছে।তোর তো নেই।তুই কেনো জেগে ছিলি!”

শালুক উত্তর দিলো,”যেই কারণে আমাকে এখানে রেখে তুমি অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারো নি,পাহারা দিতে চলে এসেছ তেমনি আমিও পারি নি তোমাকে রাস্তার পাশে এভাবে বসে থাকতে দিতে একা।তোমাকে পাহারা দিয়েছি আমিও।”

ধ্রুব ইমোশনাল হয়ে গেলো শুনে।তবে অতি দ্রুত নিজেকে সামলে বললো, “আমি আসছি তোকে নিয়ে আসতে।এটাই প্রথম আর এটাই শেষ রাত শালুক।এরপর থেকে আর তোকে একটা রাত ও আমি একা থাকতে দিবো না।”

ধ্রুব এলো মাগরিবের সময়। মিষ্টি নিয়ে এলো রিমাদের জন্য।বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থেকে রিমাকে কল দিলো শালুককে নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য।
রিমার হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে বললো,”আসি রিমা।অনেক উপকার করেছিস।সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আমি তোর কাছে। ”

রিমা হেসে বললো, “তোর বউয়ের জন্য তো কিছুই করতে পারলাম না।ভালো থাকিস দুজনে।”

একটা রিকশা ডেকে শালুককে নিয়ে উঠে গেলো রিকশায়।প্রথমে গেলো শালুকের জন্য জামা কাপড় কিনতে।তিনটি জামা,এক জোড়া জুতা, তেল,সাবান,শ্যাম্পু নিলো।নিজের জন্য দুটো লুঙ্গি আর দুটো টিশার্ট,একটা তোয়ালে একটা গামছা নিলো,এক প্যাকেট কয়েল,দেশলাই,দুটো লাইট নিলো বাসার জন্য।হোটেল থেকে রাতের খাবার নিয়ে নতুন বাসায় গেলো।

জামাকাপড় দেখে শালুকের মনে হলো আজ সারাদিন সে গোসল করে নি।সারা শরীর ঘামে চটচটে হয়ে আছে।বাথরুমে ঢুকে শালুক গোসল করে এলো।শালুকের পর ধ্রুব গোসল করতে গেলো।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনা শালুক ভাবতে লাগলো জীবন নিয়ে।
এক জীবন এভাবে রঙ বদলাবে তা কি কখনো জানতো শালুক!
————–

আদনান বৌভাতে গেলো না। বাসায় রয়ে গেলো। কেউ তাকে যাবার জন্য সাধলো না।একা বাড়িতে আদনান রয়ে গেলো। নিরব নিস্তব্ধ বাড়িটিকে আদনানের কাছে পোড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে,যেনো এই বাড়ির প্রাণ শালুক ছিলো।
বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করতে লাগলো। রাতে আশা কল দিয়ে আদনানকে জানিয়েছে তাদের বিয়ের কথা। আশার কাছে বিয়ের কথা জানার পর থেকে আদনানের বুকের ভেতর অস্থিরতা আরো বেড়ে যাচ্ছে। কি হতো বিয়েটা আরো কিছুদিন আগে হয়ে গেলে।তাহলে তো শালুককে হারাতে হতো না।

বউ নিয়ে সবাই ফিরলো সন্ধ্যা বেলায়। আফিফা আদনানের সামনে দিয়ে চলে গেলো একটা বার আদনানের দিকে ফিরে তাকালো না।আদনানের মনে হচ্ছে নিজেকে জড় পদার্থ একটা। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আদনানের দিকে কেউ ফিরে ও তাকাচ্ছে না।
বিশেষ করে শালুকের মা হাসনা আদনানের ছায়া ও মাড়ায় না।

আদনানের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো।
দাদীর কাছে গিয়ে আদনান বসলো। সিতারা বেগম নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,”কি কাজ করলি ভাই,সবার মনে কষ্ট দিলি।ধ্রুব তো তোর ভাই,শালুক তোর বোন।ওগো বদনাম কইরা কি সুখ পাইলি তুই?”

আদনান জবাব দিতে পারলো না। দাদীর পা চেপে ধরে বললো, “আমি যা চেয়েছি তা হয় নি দাদী।আমার বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। কষ্ট আমার ও কম হচ্ছে না দাদী।”

সিতারা বেগম বললেন, “কি চাইছিলি তুই?”

আদনান মাথা নিচু করে বললো, “তা বলা যাবে না দাদী।এই দুনিয়ায় কেউ জানে না তা,আমি নিজেই হেরে গেছি দিনশেষে। ধ্রুব তো জিতে গেছে দাদী,সবাই ওকে ভালোবাসে।পোড়া কপাল তো আমার। ”

সিতারা বেগম আদনানের কথার মানে বুঝতে পারলেন না।
————–

রাতে ঘুমাতে গিয়ে শালুক বিপাকে পড়ে গেলো। বালিশ নেই,বিছানা নেই,তোশক নেই।কিভাবে ঘুমাবে এখানে?শালুকের বালিশ তিনটা লাগে।দুটো মাথার নিচে আর একটা কোলবালিশ।ধ্রুব কোমল গলায় বললো, “আজকের রাতটা একটু কষ্ট কর শালুক,আগামীকাল সব পেয়ে যাবি।আগামীকাল গিয়েই খাট,তোশক,বালিশ সব নিয়ে আসবো।”

জামা কাপড়ের ব্যাগে মাথা দিয়ে শালুক শুয়ে পড়লো। ফ্যান না আনায় ভ্যাপসা গরমে শালুকের ঘুম এলো না।গ্রামে নিজেদের বাড়িতে আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে ঘুমানো মেয়েটাকে এভাবে কোনোদিন ফ্লোরে শুয়ে ঘুমাতে হবে তা কি ভেবেছে কেউ কখনো?
ধ্রুবর ভীষণ খারাপ লাগলো। আরাম,আয়েসে,বিলাসিতায় যেই মেয়ে থেকেছে তাকে এভাবে রাখতে ধ্রুবর বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে শালুককে নিজের বুকের উপর নিয়ে শুয়ে থাকতে যাতে শক্ত ফ্লোরে শালুকের কষ্ট না হয়।কিন্তু চাইলেও তা সম্ভব না।শালুক ছটফট করছে গরমে।ধ্রুব উঠে বসলো, তারপর শালুকের জন্য আনা জামার ক্যাটালগের কাগজ তিনটা বের করে শালুককে বাতাস করতে লাগলো।

কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করার পর শালুক ঘুমিয়ে গেলো। আজকের রাত ও ধ্রুবর কাটলো নির্ঘুমভাবে।
শালুকের মুখের দিকে তাকিয়ে ধ্রুব ভাবতে লাগলো একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে,আগামীকাল থেকে চাকরি খুঁজতে হবে।শালুককে বই খাতা সব কিনে দিতে হবে।শালুকের পড়াশোনা করাতে হবে।
মাথায় এতো চাপ থাকার পরেও ধ্রুবর ভালো লাগছে এই ভেবে যে শালুক তার কাছে আছে।আজীবনের জন্য শালুক শুধু তার হয়ে গেছে।
শালুককে ভালো রাখার জন্য দরকার হলে কলুর বলদের মতো পরিশ্রম করবে ধ্রুব,তবুও ভালোবাসা ভালো থাকুক।

শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। শীতল বাতাস বইতে লাগলো। ধ্রুব শালুকের মাথাটা নিজের বুকের উপর টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো। এক হাতে তবুও শালুককে বাতাস করতে লাগলো।
এভাবেই ঘুমিয়ে গেলো ধ্রুব ফজরের নামাজের কিছুক্ষণ আগে।ভালোবাসার মানুষকে পাশে নিয়ে মানসিক শান্তিতে রাত কাটলো ধ্রুবর।
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (১৭)

আজান হতেই ধ্রুবর চোখ খুলে গেলো আপনাতেই।ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছে সে।বাহিরে এখনো অন্ধকার।পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে।শালুক ধ্রুবকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ধ্রুবর ডান হাতের উপর মাথা রেখে এক পা ধ্রুবর গায়ের উপর তুলে দিয়ে ঘুমাচ্ছে শালুক।একটা হাত ধ্রুবর গলা পেঁচিয়ে ধরে আছে।
শালুকের হাত নিয়ে হাতের উল্টো পিঠে ধ্রুব আলতো করে একটা চুমু খেলো। তারপর কি মনে করে নিজের ফোনটা নিয়ে একটা ছবি তুললো।
ঘুমন্ত শালুকের গালে দুটো ব্রণ লাল হয়ে আছে,কি যে ভীষণ সুন্দর লাগছে এই ব্রণ দুটো ধ্রুবর কাছে!
ভালোবাসা বুঝি এরকমই হয়?ভালোবাসার মানুষের সবকিছুই বুঝি মানুষের ভাল্লাগে!
উত্তর পায় না ধ্রুব।

আলগোছে শালুকের হাত পা সরিয়ে ধ্রুব উঠে গেলো। শালুকের গায়ের ওড়নাটা ঘুমের ঘোরে শালুক সরিয়ে রেখেছে পায়ের পাশে। ওড়না নিয়ে শালুকের গায়ে জড়িয়ে দিলো ধ্রুব।যাতে ঘুম থেকে উঠে শালুক বিব্রত না হয় গায়ে ওড়না না পেলে।
ওজু করে এসে শালুককে ডাকলো।শালুকের ঘুম ভীষণ ভারী ধ্রুব জানে।চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ধ্রুব আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলো শালুককে।১৫-২০ মিনিট ধরে তপস্যার পর অবশেষে শালুক চোখ খুলে তাকালো।

ধ্রুবকে পাশে দেখে চমকে উঠলো শালুক।ধ্রুব এখানে কেনো?ওর রুমে কিভাবে এলো ধ্রুব?তাড়াতাড়ি নিজের ওড়না ঠিক করতে গিয়ে দেখে ওড়না গায়েই আছে ঠিকঠাক। স্বস্তি পেলো শালুক।তারপর হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখানে কেনো?আমার রুমে কিভাবে এলেন?”
শুনে ধ্রুব হাসলো।তারপর বললো, “আপনার রাজ্যের এক নিরীহ প্রজা আমি, আপনার ঘুম ভাঙ্গাতে এসেছি মহারানী সুলতানা শালুক।আর হ্যাঁ, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন এটা আপনার পিতার প্রাসাদ নয়,এটা শুধু আপনার রাজ্য।এখানে আমি আপনার নিয়োগ দেওয়া এক প্রজা।এই রাজ্যের অধিবাসী শুধু আপনি আর আমি। ”

শালুকের কয়েক মুহুর্ত লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। তারপর হঠাৎ করেই মনে হলো তারা এখন ঢাকায় আছে। এটা তাদের নতুন বাসা।
ভাবতেই শালুকের মন খারাপ হয়ে গেলো। বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো। আর বুঝি দেখা হবে না কারো সাথে!

শালুককে অজু করে আসতে বললো ধ্রুব।গামছা দিয়ে ফ্লোর মুছে নিয়ে নামাজে দাঁড়ালো শালুককে পাশে নিয়ে।
নামাজ শেষ করে শালুকের ডান হাতটা টেনে নিয়ে বললো,”জীবনের সেরা প্রাপ্তি আমি পেয়ে গেছি শালুক।আল্লাহর কাছে এটুকুই চাইবো আজীবন যেনো দুজন একসাথে থাকতে পারি।”

শালুকের মন খারাপ হলো। ধ্রুব কি তাহলে তার কেশবতীকে ভুলে গেছে শালুককে বিয়ে করে। আহারে! সেই মেয়েটা নিশ্চয় শালুককে অনেক গালাগাল দিচ্ছে যেমন করে শালুক একসময় আশাকে দিয়েছিল।

মনে মনে শালুক বললো, “কেশবতী মেয়ে,তুমি আমাকে মাফ করে দিও।আমি চাইনি এভাবে তোমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে।”

অন্ধকার কেটে বাহিরে আলো ফুটতে শুরু করেছে।সেই সাথে বেড়ে গেছে পাখিদের কলকাকলী।বাহিরের কামিনী গাছে অসংখ্য পাখি বসে কিচিরমিচির শব্দ তুলছে।

শালুককে দরজা বন্ধ করতে বলে ধ্রুব বের হলো নাশতা কিনে আনার জন্য। যাবার আগে ভালো করে বলে গেলো, “আমার গলার শব্দ না পাওয়া পর্যন্ত দরজা খুলবি না।এই পীপহোল দিয়ে তাকিয়ে দেখবি আগে কে এসেছে। আমি ছাড়া অন্য কেউ এলে কিছুতেই দরজা খুলবি না। বাহিরের মানুষটা মরে গেলে মরে যাবে তুই খবরদার দরজা খুলবি না কারো জন্য একা বাসায় থাকলে।এটা আমাদের গ্রাম নয় শালুক।এটা ঢাকা শহর। এই শহরের লোকেদের ভালো মানুষি মুখোশের আড়ালে অন্য চেহারা লুকিয়ে থাকে। কার মনে কি আছে তা কেউ জানে না।সাবধানে থাকবি কিন্তু তুই। ”

শালুক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। তারপর বললো, “এমনভাবে সব উপদেশ দিয়ে যাচ্ছো যেনো তুমি বিদেশে চলে যাচ্ছো আমাকে বাসায় রেখে।”

ধ্রুব মুচকি হেসে বললো, “আমার জায়গায় তুই থাকলে বুঝতি নিজের প্রাণটা এভাবে কোনো অচেনা জায়গায় একা রেখে যাওয়া কতোটা যন্ত্রণার।তুই দেখছিস আমি এই বাসায় শালুককে রেখে যাচ্ছি আর আমি দেখছি আমার প্রাণপাখি রেখে যাচ্ছি। ”

শালুক নাক ফুলিয়ে বললো, “ছাতার মাথা কি বলছো তুমি এসব?তোমার কথার কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না।”

ধ্রুব হেসে বললো, “না ঢুকলেই ভালো। যা আমি আসছি নাশতা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর বের হবো তোকে নিয়ে সব কেনাকাটা করার জন্য।”

শালুক দরজা বন্ধ করে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ওপাশের বারান্দায় তাকিয়ে দেখলো একটা লুঙ্গি,একটা সেলোয়ার-কামিজ,বাচ্চাদের জামাকাপড়, কাঁথা দেওয়া। রাতের বৃষ্টিতে সব ভিজে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে।নিশ্চয় ওখানে কোনো বাচ্চার আব্বু আম্মু থাকে।শালুকের নিধির কথা মনে পড়ে গেলো।
ভেজা মাটির ঘ্রাণ আসছে নিচ থেকে। সামনের রাস্তায় লোকজন হাটছে,একটা দুইটা রিকশা আসা যাওয়া করছে।
শালুকের ভীষণ অবাক লাগছে এসব দেখে।এই শহরের জীবন শালুকের কাছে একেবারে অজানা ছিলো। এর আগে কখনো শালুক শহরে আসে নি।
যাই দেখছে নতুন লাগছে তার।
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে। শালুক অবাক হলো। এতো সকালে এরা পড়তে যাচ্ছে!
ছ্যাঁ ছ্যাঁ ছ্যাঁ!
শালুকের মন বিষিয়ে গেলো। কি দরকার এতো ভোরে পড়তে যাবার?এই সময় কোথায় বাসায় বসে আরাম করবে তা না এরা পড়তে যাচ্ছে। বাড়িতে থাকলে শালুক এখন চা খেতো। দাদীর রুমে গিয়ে গল্প করতো। শাপলার সাথে মারামারি করতো।ধরে বেঁধে ও কেউ পড়তে বসাতে পারতো না।

এখানে শালুক ভীষণ একা।কান্না পাচ্ছে শালুকের খুব।লজ্জায় ধ্রুবর সামনে কান্না করে না বাড়ির কথা মনে করে। কিন্তু প্রতিনিয়ত বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় শালুকের।

আর বুঝি নয়না আপার মেয়েটা শালুককে তাতুক বলে ডাকবে না।
মতির মা তার আর মতির বাপের বিয়ের সেই পুরনো গল্প বারবার বলে কান ঝালাপালা করে দিবে না।
আফিফা আপার শ্বশুর বাড়িতে বুঝি শালুকের আর যাওয়া হবে না।বিয়েতে আফিফা আপা কেমন করে সেজেছে? জহির ভাইয়ের জন্য কান্না করেছে কি?
কবুল বলতে কতো সময় নিয়েছে?

শালুককে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন সে কি করেছে?
তখন শালুকের মনে হয়েছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী শব্দ এই কবুল শব্দটা।কোনোমতে মুখ থেকে বের হচ্ছিলো না।বুকের ভেতরটা কেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো সেই সময়।
তবুও শালুককে কবুল বলতে হয়েছে। দাদা এসে শালুকের হাত ধরে কেঁদে দিয়ে বলেছিলেন,”কবুল বল বোইন আমার।চুপ কইরা থাকিস না বোইন।”

শালুক দেখেছে তার বাবা মাথা নিচু করে বসে আছে। চাচারা দুজনের চোখ টলমল করছে।
মা মুখে আঁচল গুঁজে দিয়ে কাঁদছে অন্যদিকে ফিরে।
কি যন্ত্রণা, কি যন্ত্রণা!

শালুক কবুল বলেছে তারপর।

আর ধ্রুব!এক দৃষ্টিতে শালুকের দিকে তাকিয়ে থেকে যন্ত্রের ন্যায় কবুল বলে দিলো।

কি অসহ্য লাগছে৷ শালুকের এসব মনে পড়লেই।না এসব আর ভাববে না শালুক।এসব ভাবলেই শালুকের ভীষণ যন্ত্রণা হয়।

শালুক এসব মন থেকে সরিয়ে কামিনী গাছের ফুলের দিকে নজর দিলো।কি মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে এই ফুল থেকে।ছোট ছোট থোকা থোকা সাদা ফুলগুলো।

ধ্রুব বাসা থেকে বের হয়ে ফোন বের করলো। আগের টিউশনি ছিলো চারটি, ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে চলে গিয়েছিলো তখন।
কল দিয়ে নিরাশ হলো ধ্রুব।তিনজনই নতুন টিচার রেখেছে।সবাই ধ্রুবকে বললো এই মাসটা অপেক্ষা করতে।তারা নতুন টিচারকে বাদ দিয়ে দিবে মাস শেষ হলে।কিন্তু ধ্রুব তাতে রাজি হলো না। যারা ওদেরকে পড়াচ্ছে তারা নিশ্চয় শখ করে পড়াচ্ছে না,প্রয়োজনের তাগিদেই টিউশনি করছে।ধ্রুব ওদের কাছ থেকে এভাবে টিউশনি ছিনিয়ে নিতে পারবে না।তার বিবেকে বাঁধছে ব্যাপারটা।

শুধু একজন ছাত্রর এখনো টিচার রাখা হয় নি।ধ্রুব এসেছে শুনে স্টুডেন্টের মা ভীষণ খুশি হলো। যদি পারে তবে আজকে থেকেই যেনো ধ্রুব পড়াতে যায় বলে অনুরোধ করলো।ধ্রুব জানালো আগামীকাল থেকে পড়াতে আসবে।

রাস্তার দুই পাশের দেয়ালে,পিলারে নজর বুলাতে বুলাতে গেলো ধ্রুব।কয়েকটা বিজ্ঞপ্তিতে কল দিলো। কল দিয়ে একটা টিউশনি মোটামুটি ঠিক হয়ে গেলো। বিকেল ৫টায় গিয়ে কথা বলে কনফার্ম হবে বাকিটা।
ধ্রুব হিসেব করলো, আগের টিউশনিতে পেতো ৪ হাজার টাকা,নতুন টাতে কতো পাবে?৩-৪ হাজার।
এখনো অনেক টাকা লাগবে।মিনিমাম ২০-২৫ হাজার টাকা উপার্জন করতে হবে মাসে।নয়তো শালুককে ভালো রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
ধ্রুব আর শালুক একই বাড়িতে জন্ম নিলেও,শালুক বড় হয়েছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে। কোনোদিন অভাব দেখে নি শালুক।সেখানে ধ্রুব?বাবার সাথে দূরত্ব হবার পর থেকেই তো নিজের খরচ নিজে চালানো শুরু করেছে।বাবা,চাচা,দাদা শত চেষ্টা করে ও ধ্রুবকে এক টাকা দিতে পারে নি। ধ্রুব কখনো নেয় নি কারো থেকে।

ধ্রুবর তো এসব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার অভ্যাস আছে।কিন্তু শালুক তো তা পারবে না।হোটেল থেকে মুরগির গিলা-কলিজা ভুনা,মুগ ডাল আর ভাজি, পরোটা, পানি নিয়ে ধ্রুব বাসায় গেলো।
নিচ থেকেই দেখতে পেলো শালুক বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুবর মাথা থেকে সব চিন্তা বের হয়ে গেলো মুহুর্তেই।
এই যে বাসায় ফিরতেই শালুক দরজা খুলে দিবে,এই সুখ কি ধ্রুব লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে ও কিনতে পারতো কখনো?
এই মানসিক শান্তির কাছে সব কষ্ট, পেরেশানি তুচ্ছ হয়ে যাবে।দরকার হলে ধ্রুব সারাদিন পরিশ্রম করবে শালুককে ভালো রাখার জন্য। বিনিময়ে বাসায় ফিরলেই শালুকের চাঁদমুখ দেখতে পাবে।এটুকু পাওয়ার জন্য সব করতে পারে ধ্রুব।

শালুক চুপচাপ হোটেলের প্যাকেটে করে খেতে বসলো। ধ্রুব খাচ্ছে আর শালুকের খাওয়া দেখছে।শালুক মাথা নিচু করে খাচ্ছে বসে বসে।
খাওয়া শেষ হতেই ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “মন খারাপ শালুক?”

শালুক জবাব দিতে পারলো না। দুচোখ জুড়ে বর্ষণ শুরু হলো শালুকের।ধ্রুব শালুককে কাছে টেনে নিয়ে একটা হাত ধরলো। তারপর বললো, “কান্না করছিস কেনো?বাড়িতে যাবি?তাহলে বল,আমি তোকে বাড়িতে দিয়ে আসবো।”

শালুক মাথা নাড়িয়ে বললো, “যেই বাড়িতে আমাদের এতো বড় আঘাত দেওয়া হয়েছে সেই বাড়িতে আমি কখনো যাবো না ধ্রুব ভাই। যেই বাড়িতে আদনান আছে সেই বাড়ির আশেপাশে ও আমি যাবো না।
আমার বুকের ভেতর কেমন করছে ধ্রুব ভাই। আমি সামলাতে পারছি না নিজেকে।”

ধ্রুব হেসে বললো, “সব ঠিক হয়ে যাবে শালুক।সব ব্যথা ধীরে ধীরে কমে যাবে,ক্ষত শুকিয়ে যাবে।প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগবেই।সব ঠিক হয়ে যাবে আবার। ”

এরপর দুজন বের হলো নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে। গৃহস্থালির যাবতীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য। এতো বড় মার্কেট, এতো লোকজন শালুক এর আগে আর দেখে নি।হতবাক হয়ে শালুক তাকিয়ে দেখতে লাগলো সবকিছু। বাজার বলতে শালুক ভাবতো এলাকায় তাদের বাজার যেমন তেমনই বুঝি সব।এখন দেখছে যে না,তার ভাবনা ভুল।হরেক রকম জিনিসপত্র এখানে।শালুকের মাথা ঘুরতে লাগলো এসব দেখে।

মার্কেট ঘুরে ঘুরে কাঠের একটা খাট,চারটি বালিশ, একটা কোলবালিশ, বিছানার চাদর,হাড়ি পাতিল, কড়াই,প্লেট বাটি,গ্লাস জগসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালির সব কিছু কিনলো।এক ফাঁকে শালুকের জন্য বই,খাতা,কলম কিনে নিলো ধ্রুব।একটা বাটন ফোন কিনলো,নতুন একটা সিম কার্ড কিনলো।
চাল,ডাল,তেল,মশলা,আলু,পেঁয়াজ,রসুন,মাংস সব কিনে দুজন যখন বাসায় ফিরলো তখন চারটে বেজে গেছে ।

খাট বসিয়ে সেখানে তোশক বিছিয়ে, বিছানার চাদর বিছিয়ে দিলো ধ্রুব।বাহিরে থেকেই দুজন খেয়ে এসেছিলো। ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজতেই ধ্রুব বের হয়ে গেলো নতুন টিউশনিতে।

যাবার আগে আবারও শালুককে বলে গেলো কোনোমতেই যেনো বাসার দরজা না খোলে শালুক।শালুক একা বাসায় বসে কি করবে ভেবে পেলো না। তাই কিচেনে গিয়ে হাড়িপাতিল,প্লেটবাটি সব কিচেন কেবিনেটে সাজিয়ে রাখলো।
কার্টুন ছিড়ে নিচে বিছিয়ে সেখানে আলু,পেঁয়াজ,রসুন,আদা এসব রাখলো।

ধ্রুব টিউশনিতে গিয়ে কনফার্ম হয়ে এলো।ক্লাস সেভেনের দুটো ছেলেকে পড়াতে হবে।বেতন আট হাজার টাকা দিবে।সপ্তাহে চারদিন পড়াবে সন্ধ্যায়।

ধ্রুব রাজি হলো। আগেরটা বিকেল সাড়ে চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা। নতুন টিউশনি ছয়টা থেকে সাতটা।
হিসেব করলো ধ্রুব,একাউন্টে ছিলো ৫৬ হাজার টাকা।আজকে খরচ হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া অগ্রিম দিতে হিয়েছে ১৫ হাজার টাকা।আছে আর ২৫ হাজার টাকা একাউন্টে।
দুইটা টিউশনি মিলিয়ে মোট বারো হাজার টাকা হয়।বাসা ভাড়া যেখানে পনের হাজার টাকা।

তবুও নিরাশ হলো না ধ্রুব।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। আল্লাহ নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।

বাসায় ফিরে নিজের ফোনটা ধ্রুব শালুককে দিলো।একা বাসায় থাকলে শালুকের মন খারাপ হবে বেশি। ত্নুও ফোনে গান শুনে,নাটক দেখে কিছুটা সময় কাটাতে পারবে।বাটন ফোনে নিজে সিমকার্ড লাগিয়ে নিলো।তারপর গেলো কিচেন রুমে রান্না করার জন্য। চাল,ডাল,আলু,মুরগির মাংস মিক্স করে খিচুড়ি রান্না করে নিলো ধ্রুব।

অবাক হয়ে শালুক জিজ্ঞেস করলো, “তুমি রান্না ও জানো?”

ধ্রুব হেসে বললো, “হ্যাঁ,বিয়ের পর বউয়ের কষ্ট কমানোর জন্য শিখে রেখেছিলাম।এখন কাজে লেগে গেলো। না জানলে এখন কেমন বিপদ হতো বল তো!
তুই তো রান্না করতে পারতি না।এজন্য সব কাজ শিখে রাখা উচিত। কোনো কাজ ছোট নয়,তুচ্ছ নয়।”

খিচুড়ি খেতে বসে শালুক টের পেলো ধ্রুব ভীষণ ভালো রান্না করে। কি সুন্দর ঝরঝরা খিচুড়ি। তৃপ্তি নিয়ে শালুক খাবার খেলো।
টোনাটুনির সংসার শুরু হলো এভাবেই।

চলবে……

রাজিয়া রহমান
চলবে…

রাজিয়া রহমান
চলবে…..

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here