শিশিরের বিন্দু
১৪ তম পর্ব
ট্রেনে উঠেই ওরা যার যার সিট খুজতে লাগল। এসি এ ক্লাসের ছয়টা টিকিট বুকিং করা ছিল আর ট্রেনটা পুরোটাই স্লিপার কোচ তাই আর সমস্যা হল না। একপাশে চার সিট অন্য পাশে দুই সিট। সবাই যার যার ব্যাগ রেখে বসতেই বিপ্লব হতাশ হয়ে বলল,
___ ” কেবিনের জন্য অনেক ট্রাই করেছিলাম রে হল না “।
___ ” নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। এত পথ বাসে যাওয়া পসিবল ছিল না “।
আবির সান্ত্বনা দিয়ে বলল বিপ্লবকে। শিশিরে উপরের বাংকে উঠতে উঠতে বলল,
___ ” কতক্ষন লাগবে দিল্লী পৌঁছাতে “।
___ ” ট্রেন অন টাইমে থাকলে ১৭ বা ১৮ ঘন্টায় পৌঁছে যাব দিল্লী “।
বিপ্লব টিকিট চেক করতে করতে উওর দিল। বিন্দুও পাশের উপরের বাংকে উঠতে উঠতে বলল,
___ ” যতটুকু জানি রাজধানী ট্রেনটা অন টাইমেই থাকে। ”
ওদের কথাই সত্যি হল। ট্রেনটা ঠিক ৪ঃ৫০ এ প্লাটফর্ম ছাড়ল। ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথেই ওদের বিকালের নাস্তা দেওয়া হল। সবাইকে এক একটা ট্রেতে এক প্যাকেট ডাল ভাজা,একটা মাফিন কেক এক প্যাকেট ছোট একটা কচুরী যেটা অনেকটা দেখতে বাংলাদেশের পুরির মত আর চায়ের জিনিস পত্র। বিন্দু আর শিশির নিচে নেমে এসে জানলার পাশে বসে বসে চা আর নাস্তা খেতে লাগল। বাইরের সূর্যটা তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে অস্ত যাচ্ছে। পৃথিবীটা যেন দিন আর রাতের সন্ধিক্ষণে এসে ডুবন্ত সূর্যের লাল আলোয় রক্তিম হয়ে উঠছে। এমন সময় চায়ের কাপ হাতে প্রিয়জনের সাথে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করার মত মধুর জিনিস বোধহয় পৃথিবীতে আর নেই। শিশির কতক্ষন ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরে দেখছে কতক্ষন বিন্দুর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ওর যে কি লাগছে ও যেন বুঝাতেই পারছে না। সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত গেল বাইরে অন্ধকার হয়ে আসলে ওরা সবাই বসল গল্প করতে। নিনা আবিরের কাছে বলল,
___ ” কত করে পড়েছে তোমার এই ডাব্বার ভাড়া? ”
___ ” ডাব্বা কও আর আব্বা কও কত সুন্দর দেখেছ সাথে তিনবেলা খাবারও দিচ্ছে। ”
আবির ফোঁড়ন কেটে বলল। বিন্দু হেসে নিনাকে বলল,
___ ” ভাবি মে বি ১৭০০ রুপি করে পড়েছে পার পারসোন খাওয়া সহ।”
___ ” এত টাকা? ”
নিনা চোখ বড় বড় করে বলল। তখন তুলি বলল,
___ ” তিনবেলা খাওয়া দিচ্ছে নাস্তা দিচ্ছে সব মিলিয়ে কমই তো “।
শিশির তখন বলল,
___ ” বিয়ের পরে হানিমুনে যাওয়ার জন্য বেষ্ট উপায় হল ট্রেন। ”
___ ” গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। বিয়েরই খবর নাই উনি আছেন হানিমুনে যাওয়ার তালে “।
বিন্দু মুখ বাঁকিয়ে বলল। শিশির তখন ঘুরে বিন্দুর দিকে তাকালো। মোটামুটি একদম বিন্দুর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
___ ” বিয়ে করতে সবাই পারে কিন্তু মনটা জয় করতে কয়জনে পারে? বিয়ের আগে মনটাকে জয় করে নিজের করে নিতে চাই”।
এই বলে বিন্দুর দিকে তাকিয়ে ও চোখ টিপ দিল। তুলি আর নিনা হাসতে হাসতে হাত তালি দিল জোরে জোরে। আবির হাসতে হাসতে বলল,
___ ” তিনবছর ডেনমার্ক থাইক্কা দোস্ত আমার প্রেমের উপরে পি এইচ ডি করছে রে!”
বিন্দু গাল লাল টকটকে হয়ে গেল। এত লজ্জা আগে কখনও পায় নি ও। শিশির ওর গালের দিকে চেয়ে বলল,
___ ” থাক থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। যে পরিমান লাল হয়েছে কখন জানি টাস করে ফেটে যায় গালটা।তখন আরেক বিপদ।”
শিশিরের কথা শুনে আরেক চোট হাসির বন্যা বয়ে গেল। অন্যান্যরা ওদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল ছয়টা ছেলে মেয়ে কতটা আনন্দের সাথে তাদের জার্নি করছে। আড্ডা দিতে দিতে রাতের খাবার চলে এলো। নিনা নাক সিটকিয়ে বলল,
___ ” আবার সেই চিনি দেওয়া তারকারি”।
___ ” আরে আগে খেয়ে তো দেখবে নাকি? ”
আবির বিরক্ত হয়ে বলল। শিশির আর বিন্দু এক সিটে,নিনা আর আবির এক সিটে আর বিপ্লব তুলি ওরা এক সিটে। এমন করে জোড়ায় জোড়ায় খেতে বসল। ছোট ছোট বক্সে ফয়েল পেপার মোড়ানো গরম গরম খাবার। ওরা সবাই নন ভেজ নিয়েছিল তাই দুটো করে রুটি,ভাত সবজি, চিকেন মাসালা আর ডাল। হেব্বি খাওয়া যাকে বলে। যে নিনা ইন্ডিয়ান খাবার একদমই পছন্দ করে না সে পর্যন্ত তারিফ করতে বাধ্য হল। খাওয়া শেষে সবাই আর কিছুক্ষন গল্প করে যে যার জায়গায় গেল ঘুমাতে। শিশির আর বিন্দু উপরের বাংকে শুয়েছিল পাশাপাশি। বিন্দু মাথার কাছের লাইট জ্বালিয়ে বই মেলে শুতেই শিশিরের মাথায় দুষ্টু একটা বুদ্ধি আসলো। শিশির মেসেঞ্জারে মেসেজ দিল বিন্দুকে,
___ ” এত শীতেও বুঝি কারো নাক ঘামায়? ”
ম্যাসেজের শব্দে বিন্দু বই রেখে ফোন হাতে নিয়ে দেখল শিশিরের মেসেজ। চোখ গরম করে শিশিরের দিকে তাকাতেই শিশির দেখেও না দেখার ভাব করল। বিন্দু মেজাজ খারাপ করে ঊওর দিল মেসেঞ্জারে,
___ ” নাক ঘামলে আপনার কি? ”
___ ” নাক ঘামলে আমারই লাভ! ”
___ ” কি লাভ শুনি একটু? ”
___, ” যাদের বেশি নাক ঘামে তাদের জামাই তাদের বেশি আদর করে “।
শিশিরের রিপ্লাই পেয়ে বিন্দু চোখ বড় বড় করে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। না পেরে একটা রাগের ইমোজি দিয়ে নেট অফ করে শুয়ে রইল। শিশির ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হেডফোন কানে গুজে ল্যাপটপ নিয়ে বসল। বেশ কিছুক্ষন পরে শিশির কাজ সেরে যখন ল্যাপটপ বন্ধ করল তখন পাশের বাথে চেয়ে দেখে আবছা আলোতে বইটাকে বুকের উপর রেখেই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথায় যেন পড়েছিল
কাউকে ঘুমালে নাকি অসম্ভব সুন্দর লাগে। আর মেয়েদের তো আরো বেশি। বিন্দুকে এত এত কিউট লাগছিল যে বলার মত না। একগুচ্ছ চুল এসে পড়েছে মুখের উপরে। গলা পর্যন্ত কম্বল টানা হাত একটা বের করে রাখা। শিশিরে মনে হল হাতটা একটু ভেতরে ঠেলে দিলে ভাল হত। না হয় হাতটা ঠান্ডা হয়ে যাবে। কোন মতে একটু টানা দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল বিন্দুর হাতটা কম্বলের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু দুই বাথের মাঝে অনেক ফারাক ইচ্ছা করলেও পারছে না যেই শরীরটা একটু ছেড়ে বিন্দুর হাত ঢুকেতে গেল অমনি ধুড়ুস করে নিচে পড়ল শিশির। পড়বি তো পড় সামনের বাথের নিচে ঘুমিয়েছিল আবির একদম ওর বুকের উপরে পড়ল যেয়ে ও। আবির গভীর ঘুমে ছিল শিশির বুকের উপর পড়তেই ও হুক করে একটা শব্দ করেই চেঁচিয়ে উঠলো। বাবা গো মা গো বলে স্বশব্দে চেঁচিয়ে উঠলো। রাতের বেলায় সবাই ঘুম ছিল সাতগে সাথে লাইট জ্বলে উঠলো। আবির তখনও কাঁতরাচ্ছে। শিশির বলল,
___ ” দোস্ত বুঝতে পারি নি পড়ে গেছি”!
___ ” ওরে বুকে হাড্ডি সব গুঁড়ি হয়ে গেছে। এই গুঁড়ি দিয়ে পিঠা বানায়ে খাওয়া যাবে!”
আবির কাতরাতে কাতরাতে বলল। বিপ্লব ওর কথা বাদ দিয়ে শিশিরকে বলল,
___ ” শিশির তুই নিচের বার্থে ঘুমা। যদি আবার পড়িস “।
শিশির তখন কাউকে বুঝাতেই পারছে না যে কেন ও পড়েছে। বিন্দু মাথা নিচু করে নিচের কাহিনী দেখছে। পরে সব শান্ত হলে আবার যে যার জায়গায় চলে গেল ঘুমাতে। শিশিরের মনে মনে নিচের চুল নিজেই ছিঁড়তে লাগল। এমন করতে করতে ঘুমের রাজ্যে কখন যে হারালো সেটা নিজেও জানে না।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাংতেই দেখে বিন্দু নেই পাশের বার্থে। তাড়াতাড়ি নিচে তাকিয়ে দেখে সবাই উঠে পড়েছে। বিন্দু চোখে চশমা দিয়ে পেপার দেখছে ইংরেজি পত্রিকা। শিশির কিছু না বলে নিচে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিল। মুখ মুছতে মুছতে সিটে বসতেই আবির চোখ মুখ অন্ধকার করে বলল,
___ ” বনের রাজা টারজান এসেছে “।
শিশির কিছু না বলেই আরেকটা পেপারে চোখ বুলাতে লাগল। বিন্দু আড় চোখে শিশিরের দিকে তাকিয়ে দেখলো শিশির পেপারের আড়াল থেকে ওকে দেখছে। বিন্দু তুলির দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” ভাবি পেপারের অক্ষর কি আমার মুখে ফুটেছে নাকি?”
তুলি অবাক হয়ে বলল,
___ ” মানে কি? ”
শিশির বিন্দুর কথা শুনে তাড়াতাড়ি পেপার দিয়ে নিজের মুখ ডাকলো। এর একটু পরেই নাস্তা দিয়ে গেল সকালের। পাউরুটি ডিমের অমলেট আর চা আর সাথে চকলেট। শিশির বিন্দুকে চকলেটটা দিতেই বিন্দুও বাচ্চাদের মত চকলেটটা নিয়ে নিল। এটা দেখে শিশির হেসেই ফেলল। খাওয়া শেষে আধাঘন্টা পরই ট্রেন চলে এলো দিল্লির পাহাড়গঞ্জ স্টেশনে। ওরা সবাই নেমে পড়লো তারপর মেইনগেট থেকে বেরিয়ে ফুটওভার ব্রিজ পার হয়ে দুটো ট্যাক্সি নিল পাহাড়গঞ্জের কাছেই আরাকাশন রোড়ে যাওয়ার জন্য। ওখানে হোটের আউরাতে ওরা চারটা রুমের বুকিং আগেই দিয়ে রেখেছিল। এখানে ওরা দুটো ডাবল রুম বুকিং দিয়েছিল ২৫০০ রুপি করে আর দুটো সিঙেল রুম ১৫০০ রুপি করে। হোটেলে চেকিং করেই সবাই যে যার রুমে চলে গেল। শিশির নিজের রুমে ঢুকেই আগে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিল। কেন জানি না ওর খুব ইচ্ছা করছিল বিন্দুকে এক নজর দেখার কিন্তু কি বলে যাবে বিন্দুর কাছে। ঠিক এমন সময়………
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর