শিশিরের বিন্দু পর্ব ৯+১০

শিশিরের বিন্দু
৯ ম পর্ব

ঠিক এমন সময় শিশির মাথা মুছতে মুছতে বের হল ওয়াশরুম থেকে। শিশিরকে দেখেই আবির দৌড়ে যেয়ে ওকে ঝাপটে ধরে বলল,
___ ” হারামী করছত টা কি? ”
___ ” মানে? ”
শিশির অবাক চোখে প্রশ্ন করল। বিপ্লব চোখের ইশারায় খাটের উপরে দেখালো। শিশির খাটের দিকে চেয়েই যেন জমে গেল। এই পা জোড়া কার। হঠাৎই মনে পড়ল এটা তো বিন্দু তারমানে বিন্দু এখনও ঘুমাচ্ছে। শিশির মুচকি একটা হাসি দিয়ে বিছানার কাছে যেয়েই কম্বলটা আস্তে করে সরিয়ে দিল মুখের উপর থেকে। বিন্দুর মুখের উপরে চুল গুলো এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। আবির আর বিপ্লব দুজনে গলা টানা দিয়ে বিন্দুকে দেখে থ হয়ে গেল। বিপ্লব শিশিরকে বিছানার কাছ থেকে টেনে নিয়ে এসে বলল,
___ ” বিয়ের আগেই হানিমুন পর্ব শেষ “।
___ ” সবাইকে এক পাল্লায় মাপিস কেন? ”
শিশির টিশার্ট বের করে পরতে পরতে বলল। আবির শিশিরকে ঘুরিয়ে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল,
___ ” সত্যি কথা বল কিন্তু সালা না হলে জানে মেরে ফেলবো।”
ঠিক এমন সময় বিন্দু আড়মোড় ভেঙে উঠে বসেই দেখলো সামনে আবির শিশির আর বিপ্লব একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এই সাত সকাল বেলা ওরা এই রুমে আসলো কি করে। তার চেয়েও বড় কথা দরজা খুললো কে। বিন্দুকে উঠে দেখেই আবির সরে গেল শিশিরের কাছে থেকে। বিপ্লব বিন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” শুভ সকাল ”
বিন্দু কিছু না বলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আবির শিশিরকে ফিসফিসিয়ে বলল,
___ ” দোস্ত হেতি এখনও ঘোরের মধ্যে আছে তারে ঘোরের থন টাইন্না বাইর কইরা রেডি কইরা লইয়া আয়”।
এই বলেই দুজনেই চলে গেল। বিন্দু এই প্রথম শিশিরকে বলল,
___ ” আপনারা আমার রুমে ঢুকলেন কি করে? ”
___” ও ম্যাডাম আমি আপনার রুমে না আপনিই আমার রুমে “।
শিশিরের কথা চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখে বিন্দুর সব মনে পড়লো। রাতে কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল এই রুমে পরে মনে হয় ঘুমিয়েই পড়েছিল। লজ্জায় বিন্দু লাল হয়ে গেল। শিশির আবার বলল,
___ ” রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেও বের হব “।
বিন্দু কথা না বাড়িয়ে একটা চাদর টেনে গায়ে জড়িয়ে রওনা হল নিজের রুমের দিকে। বিন্দু যখন একেবারে রেডি হয়ে নিচে নেমে আসলো তখন কম্পাউন্ডে সবাই দাঁড়ানো। শিশিরের দিকে চোখ পড়তেই বিন্দু চোখ নামিয়ে নিল। আবির বলল,
___ ” নাস্তা করে বের হই কি বলো “।
সবাই সায় দিল এতে। নাস্তা করতে করতে ওরা প্লান ঠিক করল এখন বের হয়ে আগে ঝুলন্ত সেতুতে যাবে তারপর বৌদ্ধ মন্দির আর চাকমা রাজার বাড়িতে যাবে। নাস্তা সেরে সবাই হৈ হৈ করে বের হল। ঝুলন্ত সেতুতে যেয়ে শিশিরের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ছবির চেয়েও সুন্দর এই জায়গাটা। নিচে কাপ্তাই লেকের সচ্ছ পানি আর উপরে ব্রিজটা। পুরোটাই কাঠের পাটাতন আর উপরে লোহার আংটা গলিয়ে ব্রিজটাকে পানির উপরে ধরে রেখেছে। ব্রিজের উপরে বেশ কিছুক্ষন ছবি তুলল ওরা। যেহেতু সকাল বেলা ভীড়ও তেমন বেশি না তাই ছবি তোলায় কোন সমস্যা হল না। গ্রুপ ছবি তোলার পরে হঠাৎ তুলি বলল,
___ ” বিন্দু আর শিশির ভাই এক সাথে দাঁড়াও পিক তুলবো।”
বিন্দু আমতা আমতা করলেও শিশির হাত ধরে বিন্দুকে দাঁড় করিয়ে দিল ওর পাশে। বিন্দু বেশ রাগি একটা লুক নিয়ে শিশিরের দিকে তাকালেও শিশির যেন দেখেও দেখলো না ওর সেই চাহনী। ব্রিজের ও পারে যেয়ে ওরা উঠলো বেশ উঁচু এক টিলার উপরে যেখান থেকদ পুরো ভিউটা দেখা যায় ব্রিজের। আসলে প্রকৃতি এত সুন্দর হয় যে সেটা পার্বত্য জেলাগুলোতে না আসলে বোঝা যায় না। নিনা আবিরকে জিজ্ঞেস করল,
___ ” আচ্ছা এ পাশের ওই দিকে কি? ”
আবির উওর দেওয়ার আগেই বিন্দু বলল,
___ ” নিনা ভাবি ওই পাশে চাকমা গ্রাম। আমাদের এই মোটেল দুইটাই ওদের জায়গায় করা হয়েছে। ওই পাশে বেশ বড় একটা গ্রাম আছে। কিন্তু ওদিকে আসলে ওতটা কেউ যায় না কারন ওরা নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে তাই আর কি “।
নিনা বেশ পরখ চোখে ওদিকে দেখতে লাগল। সাথে তুলিও যোগ দিল। দশটার দিকে ওরা দুইটা সিএনজি নিল বৌদ্ধ মঠে যাওয়ার জন্য। পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মঠ এটা। আজকে ওদের চিবর দান অনুষ্ঠান তাই দূর দূরান্ত থেকে অনেক অনেক মানুষ আসিছে আজকে। সেই মানুষের স্রোতে ওরাও মিশে গেল। শিশির হাঁটছে আর খেয়াল করছে এখানে চারপাশে প্রচুর বানর। নিনা হিজাব বেধে মাথায় চাদর জড়িয়ে এসেছিল কিন্তু মঠের মধ্যে ঢোকার আগে একজন সন্নাসী নিনাকে আটকালো। নিনার সাথে আবিরও দাঁড়িয়ে পড়লো। আদিবাসী টানের বাঙালি ভাষায় উনি যেটা বুঝালো তা হল, নিনা মাথায় হিজাব বা ঘোমটা দিয়ে প্যাগোডায় ঢুকতে পারবে না। এটা তাদের ধর্ম পরিপন্থী। যদি ভেতরে যেতে চায় মাথার কাপড় ফেলে তারপর ঢুকতে হবে। ওরা সবাই তো থ। এমন নিয়ম আগে জানত না ওরা। আর নিনাও গোঁ ধরেছে মাথার হিজাব খুলবে না। অগত্য নিনা আর আবির বাইরে বসল আর বাকিরা ভেতরে ঢুকলো। স্থপত্যের এক অপূর্ব কারুকার্য খচিত এই বৌদ্ধ মঠ গুলো। কোথাও ফুল কোথাও ড্রাগনের কারুকাজ। মূল মন্দিরে বৌদ্ধের বিশাল এক সোনালী মূর্তি। পাশে তাদের ধর্মগুরুর মমিকৃত লাশ। অবাক হয়ে বিন্দু দেখতে লাগল সেই মানুষটাকে। এতদিন হয়ে গেছে তাও মনে হচ্ছে মানুষটা যেন মারা যায় নি চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে।

নিনা আর আবির বসে বসে বাদাম খাচ্ছে আর আশেপাশের মানুষ দেখছে। এতদিন ঢাকায় কোন আদিবাসী দেখলে সবাই মিলে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতো আর আজকে চারদিকে এত আদিবাসীদের মধ্যে ওরা কয়েকজন বাঙালী আর বাকিরা ওদের দেখতে। কেমনই জানি একটা ফিল হচ্ছে। নিনা মুখ নামিয়ে বলল,
___ ” আর কখনও রাস্তায় কারো দিকে তাকাবো না? ”
___ ” তুমি রাস্তায় কার দিকে তাকাও? ছেলেদের দিকে নাকি?”
আবির অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। নিনা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল,
___ ” ফালতু জোক কম মারবা,বলে দিলাম। মেজাজ এমনিতেই খিঁচে আছে।”
আবির কোন কথা,না বলে এক প্যাকেট বিস্কিট বের করে নিনার হাতে দিতে যাবে এমন সময় কোথা থেকে জানি একটা বানর এসে থাবা দিয়েই বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে দৌড় দিল। আবির আর নিনা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল বানরের যাওয়ার পথের দিকে। শিশির আর বিন্দু দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল আর বিপ্লব তুলির হাত ধরে হাঁটছিল। মঠের মধ্যে একজায়গায় যেয়ে দেখলো অনেক গুলো মোম জ্বলছে আবার অনেকেই মোম জ্বালিয়ে রাখছে। পরে শুনে দেখলো এতে নাকি মবের ইচ্ছা,পূরন হয়। শিশিরকে মোম জ্বলাতে দেখে বিন্দু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বিন্দুর অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে শিশির হেসে বলল,
___ ” পেয়েও হারিয়েছি যাকে,
পাইতে আবার ফিরিয়া তাকে।
মনের মধ্যের জ্বালায়ে মোম,
খুঁজি যে তাকে সারাটি ক্ষন।”

শিশিরের মিলানো ছন্দ শুনে বিন্দু কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। সারা মঠ ঘোরা শেষে ওরা চলল চিবর প্রদানের অনুষ্ঠান দেখতে। কিন্তু এত এত মানুষের সারি দেখে ওরা আর ভেতরে ঢুকলো না। বাইরে থেকে একটু দেখেই চলে আসলো। ওরা যখন ফিরে আসলো নিনা আর আবির তখন ঝগড়ায় ব্যস্ত। বিপ্লব বিরক্তির স্বরে বলল,
___ ” সারাদিন বাচ্চাদের মত ঝগড়া করে কি মজা পাইস তোরা একটু বলবি আমারে।”
বিপ্লবের ঝাড়ি শুনে দুজনেই ঝগড়া বন্ধ করে দুদিকে ফিরে বসে রইল। শিশির বলল,
___ ” বারোটা বাজতেছে নেক্সট প্লান কি আমাদের? ”
___ ” চাকমা রাজার বাড়ি দেখতে যাব?”
আবির উওর দিল। বিপ্লব বলল,
___ ” লাঞ্চের জন্য লেট হয়ে যাবে না রে?”
___ ” ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দেখা হয়ে যাবে। একটা দেড়টার মধ্যেই লাঞ্চ করতে পারব।”
শিশির উঠতে উঠতে উওর দিল। সবাই আস্তে আস্তে এগোলো বিশাল এক বট গাছের দিকে। গাছটা একদম কাপ্তাই লেকের ধার ঘেসেই। গাছের গোঁড়া দিয়ে নিচে নামলেই খেয়া পাওয়া যায়। ছোট ছোট উপজাতিদের ছই ওয়ালা নৌকা। ওতে কইরেই ও পারে যেতে হয় চাকমা রাজার বাড়ি। নৌকায় উঠতে যেয়ে বিন্দুর পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল। পিছনেই ছিল শিশির একদম সময় মত বিন্দুর হাত চেপে ধরে। বিন্দু টাল সামলাতে শিশিরের বুকের কাছের জ্যাকেট খামচে ধরে। শিশির তাড়াতাড়ি ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
___ ” বিন্দু ঠিক আছো তো? ”
___ ” হুম “।
উওর দিয়েই বিন্দু বড় বড় করে শ্বাস নিতে লাগল। বাকিরা আগেই নৌকায় উঠে বসে ছিল। ওরা ডাকতে লাগল ওদের। তখন শিশির বিন্দুকে বলল,
___ ” আমি আগে উঠে হাত দিচ্ছি তুমি আমার হাত ধরে ওঠো “।
তারপর শিশির শক্ত করে হাত ধরে বিন্দুকে টেনে তুললো নৌকায়। সারাপথ নৌকায় শিশিরেএ হাত ধরে ভয়ে ভয়ে বসে রইল বিন্দু। পাতলা নৌকা একটু পর পরই নড়ে ওঠে। বিন্দু যে পানিতে বিশাল ফোবিয়া আছে এটা হয়ত শিশির জানেই না। নৌকা যখনই দুলে ওঠে বিন্দু শিশিরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। কি যে এক অবস্থা।নৌকা যখন ওপারে পৌঁছাল তখন……..

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর
শিশিরের বিন্দু
১০ ম পর্ব

ওপার পৌছানোর পরে বিন্দু কোন মতে চোখ কান বুজে শিশিরের হাত শক্ত করে ধরে নিচে নামল। শিশিরের বারেবার মনে হচ্ছিল যাক না এই সময়টুকু থেমে থাকুক না বিন্দুর হাত ওর হাতে অনন্ত কাল ধরে। বিন্দু হাঁটছে আর ভাবছে এই মানুষটাকে এত বছর ধরে এত ঘৃণা করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সামনে আসলে এত তালগোল কেন পাকিয়ে যাচ্ছে। চাকমা রাজার বাড়ি বেশ বড় সড়ই।এখন এখানে কেউ থাকে না জাদুঘর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সবাই কেমন জানি আপনা আপনিই জোড়া বেঁধে ঘুরতে লাগল। বিন্দু _ শিশির, আবির__নিনা, আর বিপ্লব__তুলি। রাজার বাড়ির ঘোরা শেষে বাড়ির সামনে বিশাল দুই সিংহের মূর্তি নিনা বাহানা করল ও মূর্তির উপরে বসে ছবি তুলবে। আবির ঢোক গিলে বলল,
___ ” জান বেচারাদের উপরে একটু দয়া খাও “।
___ ” মানে? এই কি বললা তুমি? দয়া খাবো মানে কি।”
নিনা চোখ মুখ খিচিয়ে জিজ্ঞেস করল। আবির আশপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ শোনে কি না তারপর নিনার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল,
___ ” সিংহ গুলো অনেক বছরের পুরোনো তো তাই বুড়ো হয়ে গেছে। তোমার ভার সইতে পারবে না আর কি “!
আবিরের উওর শুনে নিনা যেন রাগে ফেটে পড়ল। আবিরকে কিছু বলবে তার আগেই তুলি আর বিপ্লব এসে হাজির। নিনা আপাতত ঝগড়া বাদ দিল। কারণ রাত তো আছেই তখন চান্দুরে ছাই দিয়ে ধরবে। বিন্দু পাশেই সারি দেওয়া অনেক গুলো আদিবাসীদের স্টল আছে ওখান থেকে শাল দেখছিল বাসার সবার জন্য। শিশির পকেটে হাত দিয়ে বিন্দুকে দেখছে অপলক দৃষ্টিতে। মনে হচ্ছে বিন্দুর মুখ থেকে মায়া চুয়ে চুয়ে পড়ছে আর সেই মায়ায় ও ভিজে যাচ্ছে। বিন্দু হঠাৎ বলল,
___ ” আচ্ছা দেখেন তো আমার আম্মু আর আপনার আম্মুকে মানাবে এই শালে?”
বিন্দুর কথা শুনে শিশির অবাক হল এই ভেবে যে, ওর আম্মুর কথা এখনও ভাব্দ বিন্দু। শিশির ভাল করে দেখদ বলল,
___ ” নীলাম্বরী কালারটা খুবই সুন্দর দুজনকেই মানাবে।”
তখন বিন্দু ওখান থেকে ছয়টা শাল নিল। শালের ব্যাগ হাতে নিতে যাবে এমন সময় শিশির ব্যাগ ধরে বলল,
___ ” শপিং করা মেয়েদের কাজ কিন্তু শপিংয়ের ব্যাগ টানা ছেলেদের কাজ।”
বিন্দু কিছু বলবে তার আগেই শিশির ওর হাত থেকে শপিং ব্যাগ টেনে নিয়ে নিল। পাশের এক দোকানে চাকমাদের হাতে বোনা থ্রিপিস আছে ওরা তাই দেখতে লাগল। শিশিরের চোখে পড়ল কাঠ গোলাপ কালারের এক থ্রিপিসের উপরে। মনে হল এই থ্রিপিসে বিন্দুকে খুব মানাবে। কিন্তু এটা বিন্দুকে দেবে কি করে? বিন্দু তো কিছুতেই নেবে না। শেষ মেষ একটা উপায় বের করল ও। বিন্দুর কাছে যেয়ে বলল,
___ ” বিন্দু শোনো”।
___ ” বলেন কান খোলা আছে”।
বিন্দু থ্রিপিস দেখতে দেখতে বলল। শিশির গলা খাকারি দিয়ে বলল,
___ ” আম্মু, আন্টি, চমক, কনা আর তোমার জন্য থ্রিপিস দেখো তো “।
বিন্দু এবার ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাতে শিশির ওই দোকানের মেয়েটার সামনেই বিন্দুর হাত শক্ত করে চেপে ধরল। বিন্দু আশ্চর্য হয়ে গেল ওর অবস্থা দেখে।বিন্দু চুপ হয়ে গেল আসলে এক অজানা ভাল লাগায় মন আক্রান্ত হয়ে গেল ওর। বিন্দু কিছু না বলে মুখ নিচু করে রইল। দোকানী মেয়েটা হেসে বলল, ওদের দুইজনকে খুব ভাল মানিয়েছে। কেনাকাটা শেষ করে ওরা সবাই যখন এক হল তখন শিশির দেখলো, বিপ্লব আর আবির দুইজনই শপিংয়ের ভারে কাত হয়ে যাচ্ছে। বিপ্লব নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,
___ ” দোস্ত আমরা না হয় বিয়াইত্তা মানা যায় যে হাতে এই বোঝা কিন্তু তোর এই পালা কেন?”
শিশির চোখ গরম করে তাকালো ওর দিকে। বিন্দু লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলো। সবাই মিলে চলল ওরা দুপুরের লাঞ্চ করতে। আজকে সব মেয়েরা বায়না ধরেছে দেশী লাঞ্চ করবে মানে সব দেশীয় খাবার খাবে তাই রাস্তার পাশের ছোট একটা হোটেলে ঢুকলো ওরা। যেয়ে বসতেই ছোট একটা ছেলে এলো ওদের খাবারের অর্ডার নিতে। কাপ্তাই লেকের সুস্বাদু মাছ গরুর মাংস, ডাল আর ধোঁয়া উড়া ভাত খেয়ে যখন ওরা বের হল তখন আসরের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে প্রায়। ছেলেরা তো ভালই এমনকি মেয়েরাও রান্নার প্রশংসা করল। মোটেলে ফেরার পথে ওরা প্যাকেট বিরিয়ানী কিনে নিল আজকে আর রাতে ডিনারের জন্য কেউ বের হবে না। কালকে সকালের প্লান হল সারাদিন শুভলং ঝর্না আর বরকল উপজেলাটা ঘুরে দেখবে ওরা।

ওরা মোটেলের সামনে নামতেই হঠাৎ আবিরের ফোনে কল আসলো। কথা বলতে বলতে আবিরের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ফোন রেখেই বিপ্লবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
___ ” দোস্ত ডিল ফাইনাল হয়ে গেছে দিল্লীর পার্টির সামনে সপ্তাহে ইন্ডিয়া যেতে হবে।”
আবিরের কথা শুনে সবাই খুশি হয়ে গেল। বিপ্লব শিশিরকে বলল,
___ ” দোস্ত যাবি ইন্ডিয়াতে চল ঘুরে আসি’।
___ ” হঠাৎ ইন্ডিয়া? ”
শিশির অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। আবির হেসে বলল,
___ ” ইন্ডিয়ায় হঠাৎ না ওখানে আমাদের চারজনের যাওয়ার প্লান আগে থেকেই আর রাঙ্গামাটি এসেছি হঠাৎ! এখন দশ কথার এক কথা তুই যাবি “।
___ ” কিন্তু ভিসা নেই আমার ইন্ডিয়ার।”
শিশির বলে উঠলো। বিপ্লব তখন বলল,
___ ” ডেনমার্কের পাসপোর্ট আছে তোর ভিসায় আটকাবে না “।
তখন তুলি হঠাৎ বিন্দুকে বলল,
___ ” তুমিও ব্যাগ প্যাক করবে আমাদের সাথে ইন্ডিয়া ট্রিপে তুমিও যাচ্ছ।”
___ ” না ভাবি হঠাৎ ইন্ডিয়া কেমনে কি? আমি বরং অন্য সময় যাব “।
___ ” কোন কথা না তোমাকে ট্রিপটা আমি স্পন্সার করব। আর আমি এটাও জানি তোমার ইন্ডিয়ার ভিসা আছে গত বছরই তো গিয়েছিলে তুমি!”
বিন্দু একপ্রকার না ই করে দিচ্ছিল কিন্তু ওদের ট্যুর প্লান শুনে আর রাজি না হয়ে পারল না। সেদিন সন্ধ্যার পরে সবাই শিশিরের রুমে হাজির হল। বিপ্লব বুঝিয়ে বলল ওদের ট্যুর প্লানটা। প্রথমে ওরা যাবে বাসে করে কলকাতা তারপর ওখান থেকে ট্রেনে করে দিল্লী। দিল্লীর কাজ শেষ করে আগ্রার তাজমহল আর দিল্লী ফোর্ট দেখে আবার ট্রেনে করে জাম্মুর শ্রী নগর যাবে। ওখান থেকে কাশ্মীর ঘুরে তারপর প্লেনে করে শ্রীনগর থেকে কলকাতা। আর কলকাতা থেকে ঢাকা। প্লান শুনে সবাই লাফিয়ে উঠলো। আবির আর বিপ্লব ওখানে বসেই মোটামুটি ফোনে সব বুকিং আর ট্রেনের টিকেটের ম্যানেজ করে ফেলল।

শিশির যেন খুশিতে উড়তে লাগল।ইসস বিন্দুর সাথে আরো কিছু দিন একত্রে ঘুরতে পারবে। এর চেয়ে আর বেশি কি লাগে লাইফে। বিন্দুও বেশ খুশি এই ভেবে যে কাশ্মীর দেখার শখ ওর অনেক দিনের। হুট করে এমন চান্স চলে আসবে সেটা ও বুঝতেই পারে নি। প্লানিং করা শেষে ওরা যে যার রুমে চলে গেল। আগামী শুক্রবারই ওরা রওনা দেবে ঢাকা থেকে। তাই বাসায়ও জানিয়ে দিল। সবাই যখন রুমে যাচ্ছিল আবির পিছন থেকে বিন্দুকে ডাক দিল,
___ ” বিন্দু শোনো “।
___ ” জি ভাইয়া “।
___ ” বড় ভাই হিসাবে কিছু কথা বলি শোনো। আমি জানি শিশির যেটা করেছে সেটা মহা অন্যায়। কিন্তু জানো গত তিনবছর প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে ও। যদি পারো ওকে আর একটা সুযোগ দিও।”
___ ” কিন্তু ভাইয়া বাসায়….. ”
___ বিন্দু মাঝে কোন কিন্তু এনো না। আর হ্যাঁ বাসায় বলো না যে শিশির ইন্ডিয়ার ট্যুরে আমাদের সাথে যাচ্ছে। যদি পারো ওই পাগলটাকে আর একবার সুযোগ দিও।”
এটুকু বলেই আবির চলে গেল ওর রুমে বিন্দুর চোখ থেকে টপটপ করে পানির ফোঁটা গুলো গড়িয়ে বুকের উপরে পড়তে লাগল। এ কোন কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে ও। কেন উপরওয়ালা বারেবারে এমন পরীক্ষা নিচ্ছে।

বিন্দু শালটা জড়িয়ে নিচে নেমে এলো। এদিকে আটটার পরে সব শুনশান হয়ে যায়। বিন্দু মোটেল কমপাউন্ডেই হাঁটতে লাগল। শিশির বের হয়েছিল আবিরের রুমে যাবে তাই কিন্তু হঠাৎ দাঁড়িয়ে দেখলো বাইরে কার পার্কিংয়ের ওখানে চুপ করে বসে আছে কে যেন। ভাল করে তাকাতেই দেখলো ওটা বিন্দু শিশির তাড়াতাড়ি লিফটে করেই নিচে নেমে আসলো। বিন্দু তখনও চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। শিশির কোন কথা,না বলে বিন্দুর পাশে বসতেই বিন্দু চোখ তুলে ওর দিকে তাকালো। কিন্তু সে চাহনিতে কোন প্রান নেই। শিশিরের মনে হচ্ছি ও যেন আজ নিজের কাছেই নিজে মৃত্য। একটা মেয়েকে ও জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছে। শিশির বিন্দুর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
___ ” বিন্দু আমি জানি আমার ক্ষমা নেই তারপরও বলছি আর একবার সুযোগ দেও আমাকে প্লীজ।”
বিন্দু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। শিশির চুপ করে বসে সেই কান্না দেখতে লাগল। কারণ ওর যে বলার কিছুই নেই আজ এই কান্নার বীজ যে ও নিজের হাতে লাগিয়েছিল তিন বছর আগে। বিন্দু ওর কাঁধে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতে লাগল। সেই কান্না যেন কষ্ট গুলোকে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে।……….

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here