শুকনো বকুলের মালা গাঁথিব পর্ব -০২+৩

#শুকনো_বকুলের_মালা_গাঁথিব
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_২ ও ৩

নুর বেডে পড়ে যেতেই মুখে আচল চেপে ডুকরে কেদে ওঠেন খালিদা বেগম। নুর এসব কি বলে গেল। কি ভাবল মেয়েটা। এরকম ধারনা কি করে করল৷ আমি ওর চাচি হলেও তো ওর মায়ের মতো। আর ও কীভাবে ধারণা করল আমি ওকে…। ছি ছি। আর ভাবতে পারছেন না তিনি। পরক্ষণেই রশিদ সাহেব এর করা অপকর্মের কথা স্মরনে আসে খালিদা বেগমের। তারপর ভাবে যেখানে নিজের বাবা এমন নোংরা খেলায় মেতে উঠতে পারল সেখানে আমার সম্পর্কে ধারণা করে ও ভুল করেনি। তারপর আস্তে নুরের পা উপরে উঠিয়ে দিয়ে বুক অবধি একটা পাতলা চাদর টেনে দিলেন৷ জানালা বন্ধ করে এসিটা অন করে দিলেন। আচলে চোখ মুছে বেরিয়ে যান তিনি। যাওয়ার সময় দরজাটা বাহির থেকে লক করে যান।



যখন নুরের ঘুম ভাঙে তখন চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে আছে। জানালার পর্দা টানা না থাকায় জানালার কাচ ভেদ করে বাহির থেকে আলোর রেখা রুমের মধ্যে প্রবেশ করেছে। এই আলোটুকু রুমের অন্ধকার কা’টাতে পারেনি বরং এই আলোটুকু চোখে পড়ায় রুমটা আরো বেশি অন্ধকার মনে হচ্ছে। নুর হাত বাড়ায় টেবিল ল্যাম্প জ্বালানোর জন্য। হাত দিতেই হাত কারো চুলে স্পর্শ হয়। দ্রুত হাত সরিয়ে নেয় নুর। হাতে যতটুকু বাজল তাতে মনে হলো লম্বা চুল তার মানে কোন মেয়ে কিন্তু কে সেটা অনুমান করতে পারে না তাই আরেকটু এগিয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয়। দেখে এক পাশে চাচাতো বোন নবনী আর অন্য পাশে বড় চাচি শুয়ে আছে। রুমের মধ্যে চোখ যেতেই দেখে ফ্লোরে বেডশিট বিছিয়ে যে যেভাবে পেরেছে শুয়ে পড়েছে। কাল রাত থেকে সবাই জেগে আছে তাই আজ সবাই ঘুমে কাতর অবস্থা।

এতক্ষণে আস্তে আস্তে নুরের সব মনে পড়ে কীভাবে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার মানে…….

নুরের মস্তিস্ক জানান দেয় ওর মা আর নেই ওদের মাঝে। ওকে না বলেই চলে গেছে। মন চাইলেও আর কোন দিন দেখতে পারবে না মা কে। চারদিক কেমন শুন্য শুন্য লাগে। সবথেকে প্রিয় জিনিস হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনায় বুকের ভিতর ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। ডুকরে কেদে ওঠে নুর।

কান্নার একটু শব্দ কানে যেতেই জেগে যান খালিদা বেগম। উঠে বসেন তিনি। নুরকে এভাবে কাদতে দেখে মাথায় হাত রাখেন। নুরও একটা অবলম্বন খুজে পায় ওমনি ঝাপিয়ে পড়ে চাচির বুকের মধ্যে। চাচির বুকে পড়ে পড়ে কান্না করতে থাকে আর মায়ের জন্য কথা জমিয়ে রাখছিল সব বলতে থাকে। খালিদা বেগম ও মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। ওমনি চোখসম্মুখে ভেষে ওঠে এক ভয়ানক দৃশ্য। তিনি দেখেন তিনি মা’রা গেছেন আর নবনীর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন ওইদিন ই। নবনীর দুরবস্থার কথা ভেবে তার বুকে কেমন চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়। তিনি নুরকে আরো শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরেন কেদে ফেলেন তিনিও।

নুরের পানির পিপাসা পায়। কিন্তু রুমের মধ্যে পানি নেই। এখন চাচিকে বলতেও মন চাচ্ছে না তাই নিজেই রুমের বাহিরে পা বাড়ায়। ডায়নিং এ যাওয়ার জন্য বাবা মায়ের রুম ক্রস করে যেতে হয়। নুর দেখতে পায় বাবার রুম ভেতর থেকে বন্ধ করা। পরোয়া না করে সামনের দিকে পা বাড়ায় তখন শুনতে পায় ভেতরের রুমে কেউ কথা বলছে। হাটার গতি কমায় নুর। দুজন মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নিশ্চয়ই বাবা ওই নতুন মহিলার সাথে কথা বলতেছে। একটা কথা নুরের মবে হলো বুকের এপাশ ফুড়ে ওপাশে বেড়িয়ে গেল এত জঘন্য ছিল। ঝর্না বেগম বলতেছে

– ওই বুড়িটা মা’রা গেছে ভালোই হয়েছে। এমনি তো অসুস্থ মুরগির ঝিম মে’রে বিছানায় পড়ে ছিল অথচ আমার জায়গা দখল করে ছিল নয়ত কবে চলে আসতে পারতাম এ বাড়িতে।

– ঝর্না ভালোভাবে কথা বলো সেও কিন্তু আমার স্ত্রী ছিল।

– স্ত্রী না ছাই। এতদিন তো ঝিম মে’রে পড়ে ছিল। স্ত্রীর অধিকার কি পালন করেছিল বলো। করেনি বলেই তো আমাকে বিয়ে করেছ তাই নয় কি।

– তা ঠিক। আগে মা’রা গেলে তুমি আরো আগে এই বাড়িতে আসতে পারতা। কষ্ট করে অন্যের বাসায় বাড়া দিয়ে থাকতে হতো না।

আর দাড়িয়ে থাকতে পারল না নুর। এটা কি ওর সেই বাবা। নুর যেন চিনতে পারছে না এই মানুষ টাকে। বাবা এত পরিবর্তন কীভাবে হতে পারে। ওর মাকেও তো একসময় কত ভালোবাাসত আর নতুন বউ আসতেই..। ছিঃ।

এই মানুষ টাকে বাবা বলতেও গা ঘিনঘিন করছে। মানুষের এত অধঃপতন কীভাবে হয়। নুর দৌড়ে কিচেনের দিকে চলে যায়। সেখানে হাটুমুড়ে বসে পড়ে। মুখ চেপে ধরে বসে পড়ে। হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।এত কস্ট যেন সহ্য হয়না আর। ওর মা কেন ওকে একা করে চলে গেল। এই অভিযোগ এখন কার কাছে করবে ও। বেশ অনেকক্ষণ ওখানে ওভাবে কান্না করতে করতে মাথা ব্যাথা শুরু হয়। হঠাৎ নুরের মনে পড়ে

আজ কবরে ওর মায়ের প্রথম রাত। সাওয়াল জবাব ও নিশ্চয়ই হয়ে গেছে। কি উত্তর দিতে পেরেছে তা তো তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। এসব ভাবতেই কেমন একটা ভয় ঢুকে যায় শরীরে। বাবার বলা কথা গুলো যেন মস্তিষ্ক থেকে রিমুভ হয়ে যায়। মনে মনে প্রার্থনা করে আল্লাহ আমার মাকে আপনি শান্তিতে রাইখেন। তার করা ভুল গুলো ক্ষমা করে দিয়েন। আমিন।

উঠে দাড়ায় নুর। পানি নেয়। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে আসে। ফ্লোরের এক কর্নারে জায়নামাজ বিছায়। নফল নামাজ আদায় করে। দু হাত তুলে মোনাজাত ধরে। দোয়া করতে থাকে ওর মায়ের জন্য। ওর মা একবার ওকে বলেছিল

পিতামাতার জন্য সন্তানের দোয়া নাকি কবুল হয়। তাই মন ভরে দোয়া করতে থাকে মায়ের জন্য।




দেখতে দেখতে দুটো দিন কেদে গেছে। সবার কান্না কা’টিও কমে এসেছে। আসলে মানুষ এমনই। যখন বেচে থাকে তখন খুব মায়া, আদর, ভালোবাসা থাকে। মা’রা যাওয়ার পরে দু থেকে তিন দিন আত্মীয় স্বজনরা কাঁদে। এরপর ধীরে ধীরে সবাই ভুলে যায়। ব্যাস্ত হয়ে পড়ে যার যার ব্যাস্ত জীবনে। হয়ত যখন অবসরে একা একা বসে থাকে তখন সেই হারিয়ে যাওয়া ব্যাক্তির কথা মনে পড়ে। দু ফোটা জ্বল গড়ায় চোখের কর্নিশ বেয়ে। হাতের উল্টো পিঠে তা মুছেও নেয়। এভাবেই একটা মানুষ হারিয়ে যায় চিরতরে। জায়েদা বেগমের মৃত্যুর আজ তিন দিন হয়ে গেল। আজ অনেকেই চলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে। বাড়িটা কেমন ফাকা ফাকা হয়ে যাচ্ছে। এ দুদিন এত মানুষের ভীড়ে একবারও বাবার মুখোমুখি হয়নি নুর। ইচ্ছে করেই হয় নি। বাবার মুখ দেখতে মন চাচ্ছে না ওর। যে সময় মেয়ের পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার কথা ছিল সেসময় তিনি মেতে উঠেছেন এক জঘন্য খেলায়। তাকে বাবা বলে ডাকতেও মন চাচ্ছে না নুরের।

খালিদা বেগম আর রায়হান সাহেব নুরকে অনেক চেষ্টা করে ও বোঝাতে পারেনি। তারা চাচ্ছেন নুর যেন তাদের সাথে তাদের বাসায় গিয়ে থাকে। কিন্তু নুর যাবে না। নুর নিজের বাসা ছেড়ে যেতে চায় না। এখানে যে ওর মায়ের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাই এ জায়গা ছেড়ে কোথাও যাবে না নুর।

অবশেষে ব্যার্থ হন তারা। নবনীও অনেক করে বলেছিল। কিন্তু নুর কোথাও যাবে না। মুখে যতই বলুক এখানে অনেক মেমোরি জড়িয়ে আছে তাই যাবে না কিন্তু অন্তর বলছে অন্য কথা। মন বারবার বলছে – অন্যের ওপর বোঝা হয়ে থাকবে না ও। নিজের শান্তির জন্য কারো কষ্ট বাড়াতে চায় না ও।
অবশেষে বাধ্য হয়ে তারা নুরকে ছাড়াই ফিরে যান।
সবাই যেতে যেতে এখন পুরো বাসা একদম খালি। ওর বাবা সেই নতুন মা আর ও ছাড়া আর কেউ নেই।

বাবা বা ওই মহিলা কারোই মুখোমুখি হতে মন চাইছে না নুরের। তাই নিজের রুমে এসে দরজা লক করে দিছে। একা একা যত সময় যাচ্ছে ততই যেন মাকে বেশি করে মনে পড়ছে। তবে এখন আর চোখ থেকে পানি ফেলতে চায় না নুর। অজু করে পবিত্র হয়ে কোরআন পড়ে। মায়ের জন্য দোয়া করে অনেক। একসময় চোখটা লেগে আসে। তাই কোরআন শরীফ তুলে রেখে শুয়ে পড়ে।

ঘুম যখন ভাঙে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে। অনেক ক্ষুধা পেয়েছে নুরের। মনে হচ্ছে ইদুর পেটের মধ্যে চো চো করতেছে। দরজা খুলে বের হয় নুর। কিচেন এ গিয়ে দেখে সেখানে কোন খাবারই রাখা নেই। যেগুলোতে রান্না করেছিল সেগুলো খালি পড়ে আছে। একপাশে দুটো এটো প্লেট পড়ে আছে। তার মানে তারা দুজন খেয়ে নিয়েছে। বাাবাও খেয়ে নিয়েছে। বাবা খেয়ে নিল আর নুরকে একটা বার ডাকলও না। এর আগে তো কখনো এমন হয়নি। ওরা সব সময় এক সাথেই খাবার খেত। নুর আসতে দেরী করলে ওকে জোর করে নিয়ে আসত রশিদ। কিন্তু আজ বাবা একবার ডাকতেও গেলনা। মুহূর্তেই মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলেই বা কি। কাকে বলবে নিজের মনের কথা। ওর নিজের বলে যে আর কেউ রইল না।

একটা বাটায় ময়দা দেখতে পায় নুর। তা দিয়ে দুটো রুটি বানিয়ে নেয়। এটা দিয়েই এখন চালিয়ে দিতে হবে। কি আর করার। রুটি দুটো নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে নুর। খাওয়া পুরোপুরি শেষও হয় নি এর মধ্যে রুমে আগমন ঘটে ঝর্না বেগমের। তিনি কি বলতে চায় তা জানার জন্য নুর মাথা উচু করে।

– এই ঢ়ে নবাবের বেটি তা বসে বসে যে গিলছ এসব এটো বাসন কে ধুবে শুনি।

– আমিই ধুইতাম।

– কিচেনে গিয়ে যে দেখলি বাসন পড়ে আছে সেগুলো পরিস্কার করলি না কেন। কে করবে ওগুলো তোর মা এসে করে দিয়ে যাবে?

– মাকে কেন টানছেন।

– এত কিছু জানি না। মুখে মুখে কথা একদম ভালো লাগে না। খেয়ে তাড়াতাড়ি বাসন পরিস্কার কর।

এই বলে বেড়িয়ে যান তিনি। নুর রুটি দুটো শেষ ও করতে পারেনি। খাবার আর গলা দিয়ে নামে না। এসব কাজ কখনো করতে হয় নি। মা ই করত সবসময়। তারপর রেনু খালা এসব করত। আজ নুরকে এসব ধোয়ার জন্য কত কথা বলে গেল। সব কথা হজম করে নিয়ে কিচেনে গিয়ে সবগুলো বাসন পরিস্কার করতে শুরু করে। বাসন প্রায় মাজা শেষ তখন কলিং বেল বেজে ওঠে। কলিং বেল বাজার সাথে সাথে ঝর্ণা বেগম ছুটে আসেন। নুরকে সরিয়ে দিয়ে ওর হাত মুছিয়ে দিয়ে বলে যা দরজা টা খোল। তারপর তিনি সেই বাসন গুলো পরিষ্কার করা শুরু করে। এমন একটা ভাব করছে যেন তিনি কাজ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছে। মনে মনে একটা হাসি দেয় নুর। তারপর দরজা খুলতে এগিয়ে যায়।

#চলবে

#শুকনো_বকুলের_মালা_গাঁথিব
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_৩

দরজা খুলে দেখে সামনে রশিদ সাহেব দাড়িয়ে আছে।

– কিরে তোর মা কোথায়?

– আমার মা নেই সেটা বোধহয় ভুলে গিয়েছেন?

– না মানে ঝর্ণা কোথায়?

– আছে কিচেনে।

– ওহ।

তারপর নুর সেখান থেকে চলে আসে। রশিদ ভিতরে গিয়ে কিচেনে উকি দেয়। দেখে ঝর্ণা বেগম একা হাতে সব পরিস্কার করতেছে। রীতিমতো হাপিয়ে উঠেছে তিনি।

– কি ব্যাপার এসেই কাজ শুরু করে দিছ?

– করব না কি করব। কি অবস্থা করে রেখেছে। এর মধ্যে মানুষ থাকতে পারে। তাইত সব পরিস্কার করছি। কখন থেকে কাজ করছি তোমার মেয়েটা একটু উকি দিয়েও দেখল না।

– কি বল। দাড়াও আমি দেখতছি।



– এই নুর। নুর।

– ডাকছেন?

– হ্যা। ঝর্না একা একা কাজ করছে দেখছিস না তুই। যা এখনি যা কিচেনে। আরেকবার যেন বলা না লাগে তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।

বাবার এমন ব্যাবহারে মন খারাপ হলেও হাসিমুখেই বলে

– জ্বি যাচ্ছি।

এরপর এগিয়ে যায় কিচেনে। ওকে দেখতেই ঝর্ণা বেগম সরে আসেন। আর ওকে বলেন সেগুলো পরিস্কার করতে। নুর জানত এমন কিছুই হবে তাই টু শব্দ না করে কাজ শুরু করে। ঝর্না বেগম বেড়িয়ে যান সেখান থেকে।

চোখ থেকে দুফোঁটা জ্বল অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে। বা হতের পিঠে সেটুকু মুছে নেয় সযত্নে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় এই মানুষের সাথে এভাবে নরম ভাবে চললে হবে না। আজ কি নাটক টাই না করল। মা যেহেতু একা করে চলেই গেছে সেহেতু বেচে থাকার লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। মনকে শক্ত করে নুর। বাস্তবতা মানুষকে অনেক সময় অনেক কিছু শিখিয়ে যায়।



রাতে রুমে বসে ছিল নুর। তখন ঝর্না বেগম ডেকে বলে একটু চা দেয়ার জন্য। নুরও কিছু না বলে চলে যায় চা বানাতে। চা বানিয়ে নিয়ে যায় ঝর্ণা বেগমের রুমে। ঝর্ণা বেগম পায়ের উপর পা তুলে ফোন স্ক্রল করতেছিল। নুর চা নিয়ে তার সামনে যায়। চায়ের ট্রে একটু বাকা করতেই কাপ কাত হয়ে পড়ে যায় ঝর্না বেগমের পায়ের উপর। চা টা মাত্র তৈরি করা বিধায় বেশ গরম ছিল। ব্যাথায় কুকড়ে ওঠেন তিনি। সাধের ফোনটাও হাত থেকে ফ্লোরে পড়ে যায়। অত উপর থেকে ফোনের যা অবস্থা হওয়ার তাই হয়।

– স্যরি আসলে আমি বুজতে পারিনি।

ব্যাথা দিয়ে স্যরি বলাটা যেন সহ্য হলো না ঝর্ণা বেগমের। তার রাগ হলো খুব। সে ব্যাথা পা নিয়েই নুরের সামনে দাড়িয়ে নুরের চুলের মুঠি ধরতে চায়। কিন্তু হাত সে অবধি আর পৌছায় না তার আগেই নুর ধরে ফেলে সেই হাত।

– দেখুন তখন বাবার সামনে আপনি নাটক করেছেন কিছু বলিনি তার মানে এই নয় যে আপনি যা ইচ্ছে তাই করবেন।

– এই মেয়ে তুমি কিন্তু বেয়াদবি করছ।

– আদবি করব বলে কথা দিয়েছিলাম নাকি কখনো।

এরপর নুর আর কোনো কথা না বলে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। আর ঝর্না বেগম ছুটলেন আইস প্যাক লাগাতে।

কিছুক্ষণ পরে রশিদ সাহেব বাসায় আসে। নুর ই গিয়ে দরজা খোলে। দরজা খুলে বাবার গলা জড়িয়ে কান্না করে দেয়।

– কি ব্যাপার নুর।

– বাবা আমি কি তোমার মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে কোনো অপরাধ করেছি।

– এটা কেমন কথা।

– আমার তো মনে হয় নতুন মা আসার পর তুমি আর আমাকে দেখতেই পার না৷ আর মা তো আমাকেই আজই মা’রা শুরু করছে।

– কি বলছ মা’রছে মানে?

– হ্যা। চা চেয়েছিল দিতে দেরি হয়েছে বলে সেই কাপসহ আমার দিকে ছুড়ে দিয়েছে। মুখে এসে কাপ লেগেছে। দেখ কেমন কালো হয়ে গেছে।

রশিদ সাহেব দেখতে পেলেন সত্যিই জায়গাটা কেমন কালচে হয়ে গেছে। রক্ত জমাট বেধে গেছে মনে হচ্ছে।

মেয়ের মুখের এমন অবস্থা দেখে এবার বেশ রাগ হয় রশিদ সাহেব এর। তিনি হনহন করে রুমের দিকে হেটে যান৷ গিয়ে দেখেন ঝর্ণা বেগম ফোন হাতে নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। রশিদ সাহেব গিয়ে রেগে ফোনটা নিয়ে বিছানার দিকে ছুড়ে মা’রে।

হঠাৎ এমন আচরনে ঝর্ণা বেগম ও ক্ষিপ্ত হন। তিনি চোখ বড় বড় করে স্বামীর দিকে তাকান। তারপর বলে তোমার এত সাহস তুমি আমার ফোন ছুড়ে মা’রলা।

ঝর্ণা বেগমের এহেন রুপ দেখে রশিদ সাহেব এর রা’গ তড়তড় করে বেড়ে যায়। তিনি ঝর্না বেগমের গালে একটা চড় লাগিয়ে দেন।

– তুমি আমার গায়ে হাত তুললা। তোমাকে তো আমি-

এই বলে তিনি রশিদ সাহেব এর কলারের দিকে হাত বাড়াতে গেলে রশিদ সাহেব হাত ধরে ফেলেন। হাত পিছনে মুচড়ে ধরে বলেন

– ঝর্ণা তোমাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসছি মানে এই নয় যে যা ইচ্ছে তাই করবে। তুমি জায়েদাকে নিয়ে বল সেটা মানি। সে সম্পর্কে সতীন হয় তোমার। আর কোন মেয়েই তার সতীনকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু নুর এর গায়ে হাত তোলার অধিকার নিশ্চয়ই আমি তোমাকে দেই নি৷ সে আমার মেয়ে। আমার রক্ত তার শরীরে। রক্তের টান বিষয় টা বোঝো তো। রক্তে যদি টানই লাগে তখন তুমি কে সেটাও আমি ভুলে যাব। মাইন্ড ইট।

এই বলে রশিদ সাহেব ঝর্না বেগমের হাত ছেড়ে দেয়।

ঝর্ণা বেগম দেখে তার হাত লাল হয়ে গেছে। সে সেসব পরোয়া না করে আবার রশিদ সাহেব এর সামনে গিয়ে বলে ওই থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য আমার গায়ে হাত তুললে আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।

– ঝর্না ফালতু বকা বন্ধ কর। নয়ত আবার হাত তুলতে দু বার ভাবব না। হ্যা এটা সত্যি যে জায়েদাকে আমার শুরু থেকে পছন্দ ছিল না তবুও বাবার জন্য ওকে মেনে নিতে হয়েছিল। তাই ওর থেকে তোমাকে বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছি। কিন্তু তার মানে এই না তুমি আমার মেয়ের সাথে কঠোর হবে৷ আমার মেয়ে মানে আমার মেয়ে। একবার দেখেছ কেমন স্পট পড়েছে ফেইস এ। তোমার মেয়ের সাথে যদি এমন হতো। যাই হোক বাহির থেকে আসছি ফ্রেশ হব। আর কথা বাড়াবা না একটাও।

এই বলে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় তিনি। এদিকে ঝর্ণা বেগম রাগে ফুস ফুস করছে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। মেয়ে বাবাকে কি এমন বলল যে তার গায়ে হাত তুলল। রাতে রশিদ সাহেব বাসায় থাকায় কিছুই বলতে পারে না তিনি।

সকালে রশিদ সাহেব অফিসের উদ্দেশ্য বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে একবার নুর এর রুমের৷ সামনে যায়। দরজা ভিতর থেকে চাপানো দেখে ভাবে ঘুমায় হয়ত তাই আর ডাক দেয় না।

কিন্তু নুর তো সেই সকালে উঠেছে। উঠে থেকে রুমের মধ্যে পায়চারি করছে। কিন্তু সময় যেন কোন ভাবেই যাচ্ছে না। তাই ঠিক করেছে একটু ভার্সিটি যাবে। সেখানে গেলে হয়ত তুসির সঙ্গে দেখা হলে মনটা একটু হালকা হতে পারে। রশিদ সাহেব যাওয়ার একটু পরেই নুর বেরিয়ে আসে। নুরকে আসতে দেখেই পথ আগলে দাড়ায় ঝর্ণা।

– গেম খেলা শুরু করেছ আমার সাথে?

– স্যরি গেমটা আপনি শুরু করেছেন। আমি শুধু পরবর্তী চালটা দিয়েছি। দাবা কিন্তু বুদ্ধির খেলা জানেন। বুঝে শুনে চাল না দিলে কিস্তিমাত। সো…

যাই হোক এখন ভার্সিটি যাচ্ছি। এসে আবার দেখা হবে।

নুর ঝর্ণা বেগমকে আর কথা বলতে না দিয়ে বেরিয়ে যায়।

এদিকে নুর বেরিয়ে যেতেই ঝর্ণা বেগম কাকে যেন ফোন করে। ফোন করে বাসার ঠিকানা দিয়ে বাসায় আসতে বলে।


তুসি আজ ভার্সিটি আসেনি। তাই একা একা বোর হচ্ছিল নুর। নিজেকেই নিজেকে বকা দেয়। কেন যে আসার আগে তুসিকে ফোন করে আসল না। দুইটা লেকচার এর পরেই বেরিয়ে আসে নুর। পথে আর কেথাও না দাঁড়িয়ে সরাসরি বাসায় আসে। বাসায় আসতেই দেখতে পায় বাসার মেইন ডোর খোলা। একটু অবাক হয়েই ভিতরে ঢুকে নুর। ভিতরে ঢুকে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছায় নুর। তার রুম থেকে তার বই খাতা সব ড্রেস বাহিরে ফ্লোরে ফেলে রেখেছে। ভিতরে গিয়ে দেখে সেখানে ওর এক ব্যাচ সিনিয়র স্টুডেন্ট এর বই রাখা। নুর ভেবে পায়না এমন কে আছে যে ওর থেকে এক ব্যাচ সিনিয়র। আবার ওর রুমই দখল নিয়েছে।

#চলবে

( অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। টেস্ট এক্সাম চলতেছে। আজও এক্সাম ছিল। তার জন্য গল্প দিতেও দেরী হল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here