শুকনো বকুলের মালা গাঁথিব পর্ব -০৪

#শুকনো_বকুলের_মালা_গাঁথিব
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_৪

নুর রুমে ঢুকে দেখল তার সমস্ত কিছুতে কেউ ভাগ বসিয়েছে। এমনকি দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিং গুলো পর্যন্ত চেন্জ করে ফেলেছে। নুর শব্দ শুনতে পায় ওয়াশরুমে পানি পড়ছে। তার মানে কেউ নিশ্চয়ই ওয়াশরুমে আছে। ওয়াশরুমের দরজায় নক করে নুর। এরপর ভেতরে এসে বসে। প্রতিদিনকার জীবন এখন এতটা বিভীষিকাময় হয়ে উঠছে যে এখন জীবনের উপর বিরক্ত নুর। কত সুন্দর সাজানো গোছানো একটা সংসার কীভাবে ধুলোয় মিশে গেল সেটাই ভাবছে নুর।

তার ভাবনার মধ্যেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে একটি মেয়ে। নুর প্রথম অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েকে তো ও চিনে। এই আপুটার সাথে তো ওর ভার্সিটিতে পরিচয় হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে ভালো একটা সম্পর্ক ও গড়ে ওঠে। কিন্তু এই মেয়েকে নিজের রুমে দেখে অবাক না হয়ে পারছে না নুর।

– এই নুর তুমি৷ তুমি এখানে কি করছ?

– প্রশ্নটা তো আমারও জেরিন আপু। তুমি এখানে আমার রুমে কি করছ?

– তোমার রুম মানে?

– হ্যা এটা তো আমারই রুম।

– কি বলছ। কিন্তু মা যে বলল এখানে একটা বাহিরের মেয়ে ইয়ে মানে… না থাক।

– থাকবে কেন। বল তুমি। আর তোমার মা কে। ওই মিস ঝর্না বেগম তোমার মা।

– হ্যা। আমার বাবা তার প্রথম হাসব্যান্ড ছিল। এরপর বাবার সাথে ঝামেলা করে তিনি চলে আসেন তার বাবার বাড়িতে। আমি এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম কার সাথে থাকব ডিসাইড করতে পারতেছিলাম না। পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আমি বাবা মা উভয়ের কাছেই থাকতে পারব। এজন্যই কখনো বাবার কাছে থাকি। আবার মা যখন নানু বাড়িতে থাকে তখন মায়ের সাথে থাকি। কিন্তু মায়ের সাথে তার দ্বিতীয় হাসবেন্ড এর বাসায় কখনো আসি নি। কিন্তু এবার সে ফোন দিয়ে রীতিমতো কান্নাকা’টি করে আমাকে রাজি করিয়েছে তার সাথে এখানে থাকার জন্য। তারপর বলল এখান থেকে আমার কলেজ অনেক কাছেও হবে। তাইত এখানে নিয়ে আসল। কিন্তু এ রুমে যে কেউ থাকে সেটা আমাকে বলেনি। বলছে এ রুমে কেউ থাকে না। তাই জিনিসপত্র গুলো স্টোর রুমে রেখে দিবে। আ’ম স্যরি নুর।

– আপু এখানে তোমার ভুল নেই। কিন্তু তোমার মায়ের সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার মায়ের গোছানো সংসার। আমার মা মা’রা গেছে কয়টা দিন হতে পারল না এর মধ্যে সে এই বাসায় রাজত্ব শুরু করে দিছে।

ওদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝর্ণা বেগম রুমে ঢোকেন।

– কি রে তোর গুছানো হলো?

রুমে ঢুকে ওদের দুজনকে কথা বলতে দেখে অনেকটা অবাক হয় ঝর্না বেগম। তারপরও নিজের বিষ্ময় চেপে রেখে কঠিন গলায় বলেন

– ও মহারানী তাহলে এসে পরেছেন।

– এসব কি। মিথ্যা বলে জেরিন আপুকে এখানে কেন এনেছেন আর আমার জিনিস পত্রগুলো নিচে কেন রেখেছেন।

– কিচেনের পাশে যে রুমটা পড়ে আছে ওটা ক্লিন করে নাও। আজ থেকে তুমি ওখানেই থাকবে।

– আপনি কি একটু বেশি বেশি করছেন না। আপনি এমন করতে থাকলে আপনাকে ওই স্টোর রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিব আমি বলে দিলাম।

ঝর্না বেগম রেগে নুরকে চড় দেয়ার জন্য অগ্রসর হতেই জেরিন এসে হাত ধরে নেয় তার। তারপর ঝর্না বেগম রেগে বলেন

– তোর এত দরদ কেন এই দুই দিনের মেয়ের জন্য।

– এই বাসায় দুইদিনের মেয়ে ও নয়। তুমি। তুমি এসে সব কিছু নিজের মনে করছ যেন ও এখানে কিছুই নয়। কিন্তু ব্যাপারটা পুরো উল্টো।

– তুই কি আদৌ আমার মেয়ে জেরিন?

– তা তোমার যা মনে হয়। কিন্তু কোন অন্যায় কাজকে তো সমর্থন করতে পারিনা।

– এর ফল ভালো হবে না কিন্তু।

– সে পরে দেখা যাবে। আমি এখনই পাপার কাছে চলে যাব। তোমারও বোঝা উচিত ছিল তোমার মেয়ে যেখানে থাকে সেখানেও তার একজন স্টেপ মাদার রয়েছে। তিনি যদি তোমার মতো এমন আচরণ আমার সাথে করত তখন তোমার কেমন লাগত? আমি আর এক মুহুর্ত ও থাকব না।

– জেরিন আপু চলে কেন যাবে। তুমি চাইলে আমরা রুম শেয়ার করতে পারি। (নুর)

ওদের কথা বলার মধ্যেই ঝর্না বেগমের দরজার সামনে চোখ যায়৷ তিনি দেখেন যে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে খালিদা বেগম।

– আপা আপনি কখন আসলেন?

– তোমাদের কথা বলার মধ্যেই চলে এসেছি। সবই শুনলাম। তা ঝর্না ভালো ব্যাবহারই তো করছ তুমি মেয়েটার সাথে। এগুলো কি রশিদ জানে?

– জানলেই বা কি। সে কি তার মেয়েকে মাথায় তুলে নাচবে নাকি আজব।

– সেটা সময় হলেই দেখা যাবে। আমি এখন রশিদকে একটা ফোন দেই কি বলো। সে এসে দেখুক তোমার কান্ড কারখানা।

কাল রাতের থাপ্পড় এর কথা ঝর্ণা বেগম এখনো ভুলেনি। যে জোড়ে চড় দিয়েছিল যে কয়েক সেকেন্ড এর জন্য কান মনে হয় স্তব্ধ হয়ে ছিল। এখন যদি বাসায় এসে দেখে তাহলে না জানি কি করে। তাই তার নিজের সব রাগ চেপে রেখে একটু হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বলল

– না বড় আপা এখন তাকে ফোন দিয়েন না। আমি সব গুছিয়ে দিচ্ছি।

– শুধু গুছিয়ে দিলে হবে না।

– তাহলে।

– নুরের প্রয়োজনীয় সব জিনিস প্যাকিং করে দাও। ওর ড্রেস। বুকস। সব কিছু।

– কেন আপা?

– আমি আজই ওকে নিয়ে যাব। সেদিন ওর জোড়াজুড়িতে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলবে এত তাড়াতাড়ি তা বুজতে পারি নি।

নুর এবার আর চেয়েও না করতে পারে না। বাসায় যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে এভাবে লড়াই করে করে কোন সুস্থ মানুষ বাঁচতে পারে না।

ঝর্না বেগম মোচড়াতে থাকেন। তিনি নুরের জিনিস গুছিয়ে দিতে পারবেন না। তা দেখে নুরের চাচি রশিদ সাহেবকে ফোন করতে গেলে অবশেষে বাধ্য হয়ে সেই নিচে ফেলা জিনিস পত্র গোছাতে থাকে। নুর সেখান থেকে চলে আসে। পেছন পেছন আসে জেরিন ও।

এসে নুরের পেছনে দাড়িয়ে হাত কচলাতে থাকে। কথা কীভাবে শুরু করবে সেটা বুজতে পারছে না। নুর দেখতে পেয়ে জিগেস করে

– কিছু বলবা আপু।

– হুম।

– বলো।

– নুর আসলে আ’ম স্যরি। আমার জন্যই তেমাকে চলে যেতে হচ্ছে। এর থেকে আমি চলে গেলেই ভালো হতো।

– না আপু তা কেনো হবে। আর আমি বড়মার সাথে গেলে আমারই ভালো হবে। আর তুমি স্যরি কেন বলছ। তোমার তো দোষ নেই তাই না।

– আসলে-

– গিল্টি ফিল করার কিছু নেই। তুমি থাক। মাঝে মাঝে আসব আমি। তোমার সাথে, বাবার সাথে দেখা করে যাব এসে। আর আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

নুর সেখান থেকে চলে যেতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জেরিন এর ভিতর থেকে। নুর মেয়েটাকে ওর দারুণ লাগে। মেয়েটা দেখতে যেমন কিউট তেমনি সবার সাথে মিশুক ও। আবার যখন রেগে যায় তখন একদম অগ্নিমূর্তি ধারন করে। যেমন জেরিন আর নুরের পরিচয় হয়েছিল এরকম একটা ফাইটিং মোমেন্ট এর মধ্যে দিয়ে।

জেরিন সেদিন ভার্সিটি চেন্জ করে নতুন এডমিশন নিয়েছিল নুরদের ভার্সিটিতে। সেদিন জেরিনকে নতুন দেখে নুরদের এক ব্যাচমেট সিনিয়র সেজে জেরিন এর সাথে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করছিল। নুর সেটা লক্ষ্য করে এসে ছেলেটার নাক বরাবর দিয়েছিল। নাক দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল। এরপর নুর বলে গিয়েছিল

– আপু এই সমাজে বাস করতে হলে ফাইট করেই বাসতে হয়। এদের ভয় পেলে এরা আরো চেপে বসতে চায়।

এরপর থেকে এই সিনিয়র জুনিয়র এর মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু জেরিন এখনো ভয়ে আছে সেই ছেলেগুলোকে নিয়ে। যাদের সাথে নুর ফাইট করেছিল। তারা থ্রেট দিয়ে গিয়েছিল যে নুরকে তারা দেখে নিবে। কিন্তু এখনো তো কিছু বলে নি। না জানি কি হয় এই ভয়ে থাকে জেরিন সব সময়৷ কিন্তু নুরকে দেখ। সে এসব ভুলে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জেরিন এর এসব ভাবনার মাঝেই নুর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে।

– কি ব্যাপার জেরিন আপু। তুমি এখনো এখানে দাড়িয়ে আছো।

– এইতো যাচ্ছি।

– এখন আর যাওয়া লাগবে না অনেক ক্ষুধা লেগেছে চলো খেয়ে নেই।

এরপর জেরিন এর হাত টানতে টানতে ডায়নিং এ নিয়ে যায় নুর। গিয়ে দেখে টেবিল এর উপর বিরিয়ানি রাখা আছে। বিরিয়ানি দেখেই জোরে জোরে ডাকতে শুরু করে –

– বড়মা, বড়মাাা, ও বড়মা

– কিরে চেচাচ্ছিস কেন?

– বিরিয়ানি কি তুমি আনছো?

– কে বলল আমি এনেছি।

– বিরিয়ানির ঘ্রাণই বলে দিচ্ছে। কেমন বড়মা বড়মা ঘ্রাণ পাচ্ছি।

– হাহা। পা’গলি মেয়ে। খেয়ে নে। আমি তোর চাচ্চুকে ফোন দিচ্ছি। সে এসে আমাদের নিয়ে যাবে।



খাওয়া শেষে নুর ঝর্না বেগমের রুমের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। তখন ভিতরে কিছু কথোপকথন শুনে থমকে দাড়ায় নুর। যেখানে ঝর্ণা বেগম কারো সম্পত্তি নিজের নামে নেয়ার প্লান করতেছিল।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here