শুকনো বকুলের মালা গাঁথিব পর্ব -০৯

#শুকনো_বকুলের_মালা_গাঁথিব
#নীহারিকা_নুর
#পর্ব_৯

দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হলো কিন্তু নুরকে বাসায় পেলনা তখন খালিদা বেগমের মাথাায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার মন বারবার বলছিল যে কোনো অঘটন নিশ্চয়ই ঘটেছে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন নুর কেমন মেয়ে। নুর যে এত দেরী করে বাসায় আসেনা কখনো সেটাও জানে। তবে কি নুর বাসার অবস্থা সম্পর্কে টের পেল। ওর অজান্তে বিয়ে দিচ্ছি বলে কি ইচ্ছে করে বাসায় ফিরছে না। নুরের যে কি হয়েছে তিনি হিসেব মিলাতে পারছেন না। তিনি তাড়াতাড়ি করে স্বামীর রুমে গেলেন। গিয়ে রায়হান কে বললেন একটু নুর এর ভার্সিটি তে গিয়ে খোজ নিতে। রায়হান সাহেব ও তেড়ামি করে বলেন যে তিনি যেতে পারবেন না। রায়হান সাহেব এর এমন তেড়ামি করা কথায় মাথায় যেন ধপধপ আগুন জ্বলছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর গলায় বললেন

– যাও না একটু দেখ গিয়ে। মেয়েটা একা একা কোথায় যাবে।

নিজের স্ত্রী এত বছরের বিশ্বাস ভঙ্গ করে এখনো কত সুন্দর নাটক চালিয়ে যাচ্ছে তা দেখে অবাক না হয়ে পারে না রায়হান সিকদার। তবুও এই মুহুর্তে চুপ করে থাকতে হচ্ছে তাকে। তাই তিনি স্ত্রীকে আরেকটু চিন্তায় ফেলানোর জন্য বলেই দিলেন

– দেখ তোমার কুমতলব বুজতে পেরে নুর আবার কারো সাথে পালিয়ে গেল না তো।

– কিহহহহহ ( চিল্লিয়ে)

– চেঁচাচ্ছ কেন। বাড়ি ভর্তি মানুষ তার মধ্যে এভাবে চেচানোটা কী ঠিক বলো।

খালিদা বেগম বুজতে পারলেন না তার এখন কি করা উচিত। তিনি দৌড়ে আলমারির কাছে গেলেন। সেখানে থাকা ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন। তখন মনে হলো খোজার গতি দ্বিগুণ হয়ে গেল। সব গুলো ফাইল আবার উল্টে পাল্টে দেখলেন। ফাইলগুলো ফেললেন বিছানার উপর। দৌড়ে গিয়ে রুমের দরজা আটকালেন। বাসা ভর্তি মেহমান। কে কখন চলে আসে বলা যায় না। এবার এসে আলমারিতে থাকা শাড়ীগুলো সব নিচে নামাতে লাগলেন। কিন্তু কাঙ্খিত জিনিসটা খুজে পেলেন না। ব্যাস্ত হাতে আবার সব কিছু উঠিয়ে আলমারিতে রাখলেন। রায়হান এতক্ষণ শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে তাকিয়ে সবটা অবলোকন করলেন। তার দৃষ্টির নড়চড় নেই। যেন সবকিছু স্বাভাবিক এগুলো যেন হওয়ারই ছিল।

সব তুলে রেখে খালিদা দৌড়ে এসে রায়হান সাহেব এর পাশে বসলেন। রায়হান সাহেব শান্ত ভঙ্গিতেই বললেন

– কি হয়েছে এত তাড়াহুড়ো করছ কেন?

– দেখছ যা ভেবেছিলাম তাই। তেমার ভাতিজি চুরি করে পালিয়েছে।

– ছি খালিদা এরকম একটা ওয়ার্ড বলতে তোমার মুখে বাদল না। এই তুমি নাকি ওকে মায়ের স্নেহ দেও।

– দিতেই তো চেয়েছিলাম কিন্তু এক গাছের ছাল অন্য গাছে কোন দিন লাগে না জানো না। সে তো ঠিকই পালিয়েছে তাও আমার ফাইল নিয়ে পালিয়েছে।

– এইত আসল কথা বেরিয়েছে। এক গাছের আবরণ অন্য গাছে কখনোই লাগবে না। কিন্তু তুমি কিসের ফাইল এর কথা বললে তুমি খালিদা?

খালিদা বেগম এবার চুপ হয়ে যায়। মনে মনে নিজেকেই কয়েকদফা কথা শুনিয়ে দেয়। বেকার মতো কথা বলার জন্য। এরপর কথা ঘুরাতে বলে

– যাও গিয়ে দেখ মেয়েটা কোথায়।

রায়হান সাহেব ঠিকই বুজে যায় খালিদা কিছু লুকাচ্ছে তবুও কথা না বলে চুপচাপ বেরিয়ে যায়।

সেই থেকে একটা থমথমে পরিবেশ হয়ে রয়েছে। নবনী আর রায়হান সিকদার যেন অনেক কষ্ট পেয়েছেন এমন একটা ভাব ধরে আছেন। তবে খালিদা বেগমের চোখ থেকে রীতিমতো পানি পড়ছে। প্রতিবেশিরা বলাবলি করছে

– নুর মেয়েটার কপাল খারাপ। নয়ত এমন একটা চাচি পায় যে দেবর এর মেয়ের জন্য চোখের জল ঝরায়।

অথচ ভেতরের গল্প যে সবার অজানা। সবাই বাহির দেখেই বিচার করছে।





ইরহামকে দেখা মাত্রই এরিম দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা রীতিমতো কাদছে ভয়ে। ইরহাম এরিমের মাথায় হাত বুলায়। মাথায় ভরসার হাত পেয়ে আরো জোড়ে কেঁদে দেয় এরিম৷

– আরে পা’গলি কাদছিস কেন। তুই আমার বোন হয়ে কাদিস হাউ ফানি। দেখ ওই মেয়েটা কি সুন্দর প্রতিবাদ করল আর তুই চোখ থেকে ঝর্না ধারা নামিয়েছিস। গাঁধি কোথাকার।

নুর এতক্ষণ চোখ গোল গোল করে এদের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ এরিম এই ছেলেকে জড়িয়ে ধরায় কিছুটা ভেবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল নুর। এতক্ষণে বুজতে পারে এই ভদ্রলোক তাহলে এরিম এর ভাই।

আস্তে আস্তে সামনে আগায় নুর। নুরকে দেখে এরিম ভাইয়ের থেকে সরে দাড়ায়। তারপর নুরকে থ্যাংকস বলে সারারাত সঙ্গ দেয়ার জন্য। আর বলে কথা হবে। নুর বলে

– যখন এখানে এসেছি তবে আমাদের আবার দেখা হবে।

এরিম মুচকি হাসি দেয় বিপরীতে। নুরকে ইনভাইট করে তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু নুর বলে অন্য কোন দিন দেখা হলে যাবে।

ইরহাম এতক্ষণ ব্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিল। মেয়েটাকে যেন ওর চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে। তাকিয়েছে তো তাকিয়েছে এদের যে কথা বলা শেষ হয়ে গেছে সেটাও খেয়াল করেনি। এরিম গলা খাকরি দিতেই হুশ আসে ইরহাম এর। মাথা চুলকে অন্য দিকে তাকায় ও। এরিম হেসে ফেলে। তারপর বলে

– ইরহাম খান এটা আমার নিউ ফ্রেন্ড। পরিচয় হও। আর তুমিও যে এভাবে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকো আজ না দেখলে তো জানতামই না।

ইরহাম এবার আরো লজ্জা পায়। ইরহাম খান কারে দিকে এমন ব্যবলাকান্তের ন্যায় তাকিয়ে ছিল ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। তবে ও তো তেমন নজরে তাকায় নি। এটা এখন এই গাঁধি এরিমকে কে বেঝাবে। তাই এরিমের মাথায় একটা গাট্টা মে’রে বলে

– হইছে পাকনি বুড়ি চল এবার।

এরিম নুর এর কাছে জানতে চাইছিল পৌছে দেয়া লাগবে কিনা কিন্তু নুর না করে দেয়। কিন্তু ইরহাম এবার বলে

– এই মেয়ে আমরা দাড়াচ্ছি তুমি রিক্সা নাও কুইক।

অপরিচিত লোক হয়েও কেমন ধমক দেয় ফালতু লোক। বিড়বিড় করতে করতে নুর সামনে আগায়। একটু আগাতেই একটা রিক্সা পেয়েও যায়। রিক্সাচালককে ঠিকানা বলে রিকশাওয়ালা মামা তার পান খাওয়া দাত কেলিয়ে বলে আফা আমনে মাহফুজ স্যার এর বাসায় যাইবেন?

– চিনেন আপনি?

– চিনুম না। হেরে এহানকার হগোলে( সবাই) চিনে। জনগনের নেতা তিনি তারে চিনুম না এইডা হয়।

– ওহ আচ্ছা চলেন তাহলে।

রিক্সায় বসে নুর মামাকে জিজ্ঞেস করে

– মামা এত সকাল সকাল রিক্সা নিয়ে বের হয়েছেন যে?

– আম্মা অভাব এর সংসার। দুইডা টেহা পাইলে তাই লাভ। এই টাইমে ট্রেন থামে এহেনে। যদি যাত্রী পাই হেই আশায় আমনেগো মামি এই কাকভোরেই ডাইকা দেয়। আমিও রিক্সা নিয়া বাইর হই।

– ওহ আচ্ছা।

আচ্ছা বলে পাশ ঘুরতেই দেখে পাশ থেকে একটা ব্লাক কালার কার যাচ্ছে। এত ভোরে উঠে মানুষ ভেবে অবাক হয় নুর। আর ওরে তো ওর মা ডাকতে ডাকতে উঠাইত তাও কলেজে প্রোপার টাইমে যাইতে পারত না। সব কিছুতেই শুধু কেন যে অতীত এর স্মৃতি মনে পড়ে।

এর মধ্যেই জানালার কাচ নামায়। মাথা বের করে এরিম। নুরকে বলে সাবধানে যেও। নুর ও বিপরীতে মুচকি হাসি দেয়।





রিক্সায় প্রায় বিশ মিনিট এর মতো লাগল। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে বাসার সামনে আসল নুর। বাসায় প্রবেশ করতেই যেন দুচোখ জুড়িয়ে গেল। দুপাশে বাগানবিলাস লাগানো। এই সকালে যা দেখতে মনেরম লাগতেছে। গেট থেকে শুরু করে বাসার মেইন ডোর অবধি মধ্যে একটা রাস্তা আর পাশে সারি সারি অনেক গুলো গাছ লাগানো। সব গাছেই কোন না কোন ফুল রয়েছে। ফুল গুলো দেখতে দেখতেই নজর গেল ফুলগাছগুলোর গোড়ার দিকে অনেক গুলো বকুল ফুল রয়েছে। কিছু কিছু ফুল শুকিয়ে রয়েছে। কিছু কিছু ফুল একদম সতেজ। নুর দেখল কর্নারের দিকে একটা বকুল গাছ রয়েছে। যেটা বেশ বড় হয়েছে। সেটা থেকেই এই ফুল ঝড়ে পড়ছে। নুরের ইচ্ছে হলো এখান থেকে কিছু ফুল তুলে নিতে। কিন্তু এই মুহুর্তে তা মোটেও শোভনীয় নয়। তাই ইচ্ছেকে ধামাচাপা দিয়ে এগিয়ে গেল।কলিং বেল দিতে গিয়প কতক্ষণ দোটানায় ভুগল নুর। এত সকালে কারো বাসায় এসে ডিস্টার্ব করাটা ভালো দেখায় না। অবশেষে কলিং বেলে চাপ দিয়েই ফেলল নুর। একবার দিয়েই থেমে গেল। আর দিবে না। প্রয়োজনে অপেক্ষা করবে তবুও এত সকালে কাউকে ডিস্টার্ব করবে না। নুরের ভাবনার মাঝেই দরজা খুলল এক মধ্যে বয়স্ক মহিলা। নুরকে দেখে প্রথমে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর নুর বলতে নিছিল যে ওকে রায়হান সিকদার পাঠিয়েছেন। কিন্তু তার আগেই ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন
– তুমি কি নুর?

– জ্বি আন্টি। আপনি আমাকে চিনেন?

– জ্বি। রায়হান ভাই বলেছিল তোমার কথা। তোমার ফটোও দেখেছিলাম।

– ওহ আচ্ছা। সকাল বেলা ডিস্টার্ব করে ফেললাম সো স্যরি আন্টি।

– বোকা মেয়ে। ডিস্টার্ব কেন হবো। আমরা সবাই জেগেই ছিলাম। আমার ছেলেমেয়ে দুটোও মাত্র বাসায় ফিরল।

তারপর ভদ্রমহিলা নুরের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন নুর আমি তোমার আঙ্কেলকে বলে আসি তোমার কথা তুমি বরং ততক্ষণে ফ্রেশ হও।

– কোন রুমে আন্টি?

– উফফ আমার মেয়েটাও না। এসেই মনে হয় ঘুম৷ সারা রাস্তাও মনে হয় ঘুমিয়েছে এখন আবার এসেই ঘুম৷ নয়ত তোমাকে ওই নিয়ে যেতে পারত। আচ্ছা মামনি তুমি দোতলার কর্নারের রুমটায় যাও ফ্রেশ হও।

নুর আচ্ছা বলে চলে আসল। ভদ্রমহিলাও চলে গেলেন সেখান থেকে। নুর দোতলায় এসে ডান দিকের কর্নারের রুমে ঢুকল। রুমে ঢুকে যা দেখল তাতে নুরের দুই ঠোট ফাকা হয়ে গেল। আআআআআ বলে দিল এক চিতকার।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here