~ আমার বোনটাকে ভালোবাসলে খুব বেশী ক্ষতি হতো রাশিদ ভাই?
ছেলেটা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাসলো। একপলক বধূ সাজে সজ্জিত রমনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
~ ক্ষতি খুব একটা মনে হয় হতো না, তবে তোমাকে ভালোবাসার স্বাদ আর পেতাম না!
ঈষৎ কাঁপুনির সাথে মুখশ্রী কঠোর হয়ে উঠে আনতারা’র। জবাব দিতে পারে না, মনের ভেতর লুকায়িত দাবানল টা ভেতরেই দাফন করে হাসি, ঠাট্টা, নানান রকম আলোকসজ্জায় ঘেরা বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এই ছেলের সাথে কথা বলাটাই তার ভুল হয়েছে, যে ভুল সে বার বার করে ফেলে। না চাইতেও হয়ে যায়, তাই হয়তো রাগ টাও বেশী হয়। এত জমজমাট পরিবেশ আনতারা’র গাঁয়ে কাঁটার মতো বিঁধে মনে হয়। ঘরকুনো, কম কথা বলা মেয়েটা এসব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলতেই ভালোবাসে। তবে এই ভালোথাকা’টা যে বেশিক্ষণ টিকবে না সে জানে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ডাকতে চলে আসবে। বড় চাচাতো বোনটার যে খুব আদরের সে। তাকে ছাড়া কবুল বলবে?
রাশিদ বাড়িতে ঢুকে যাওয়া মেয়েলি অবয়বের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। বুকে চিনচিনে ব্যাথার সৃষ্টি হয়। ধরা ছোঁয়ার বাইরে মেয়েটা তার বড্ড আপন। একতরফা তারই আপন, মেয়েটা যে তাকে দেখলেই চোখ মুখ কুঁচকে নেয়, কঠিন হয়ে যায় মুখশ্রী। দৃষ্টি বাঁচিয়ে তড়িঘড়ি করে বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে। যাকে দেখার আশায় ছিল সেই তো এখন আঁধারে ডুব দিয়েছে, তার থেকে কাজ কি?
নিজের অন্ধকার রাজ্যে প্রবেশ করতেই আনতারা’র মুখে হাসি ফুটে। স্বস্তির শ্বাস নিয়ে ধীর পা ফেলে এগিয়ে যায়, বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মনটা বড্ড পুড়ছে। তার গুটিকতক ভালোবাসার মানুষের মধ্য থেকে আরো একজন দূরে চলে যাচ্ছে। যদিও তার জীবনে হারানোর সংখ্যা ঢের বেশী, এখন আর এসবে কাঁদে না সে। বাইশ বছরের জীবনে অনেক কিছুই তার জানা, সমাজ যে দেখাতে ভালোবাসে!
…
শরৎকালের সুনীল রাতে মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্নার ফুল ঝরে। চাঁদের আলোর শুভ্রতায় চারপাশ কল্পনার রাজ্য মনে হয়। বিস্তীর্ণ স্বচ্ছ জলরাশির ওপর ভেসে বেড়ানো কয়েকটা আগাছা, উপরে নীলাকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। স্বচ্ছ স্থির পানিতে সেই চাঁদের প্রতিবিম্ব। কি মায়াময় লাগছে পুকুরটাকে। পুকুরের ধার ঘেঁষে ইট দিয়ে বাঁধানো বসার জায়গাটাই দাঁড়িয়ে আছে রাশিদ। দৃষ্টি তার পুকুরের পানিতে ভেসে থাকা আগাছা’র উপর। রুপালি থালার মতো ঝলসানো রূপের অধিকারী চাঁদ টার দিকে তার নজর নেই। এই আগাছা গুলোকে দেখে মনে হয় সেও হয়তো আগাছা, আবার ভাবে আগাছা কেন হবে? সে তো কারো জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি বা জোর করে কারো জীবনে ঢুকতে যায়নি। শুধু ভালোবেসেছে। এতটাই ডুবে গেছে কৃষ্ণবর্ণের মায়াময়ী মেয়েটার প্রতি, হাজার উপেক্ষাতেও কষ্ট হয় না। শুধু মন বলে অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে জ্যোৎস্নায় আলোকিত ভাদ্রের আকাশের দিকে তাকায় রাশিদ। পায়ের জুতোটা খুলে পাশে রেখে পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে বসে। গানের গলা ততটা ভালো না হলেও মাঝে মাঝে ভিষণ ইচ্ছে করে গান গাইতে। রংচঙ মেশানো গান না, পূর্বের গান গুলো বড্ড টানে তাকে। পানিতে ভাসমান চাঁদের দিকে তাকিয়ে খোলা গলায় গেয়ে উঠে,
~ “বাড়ির পাশে মধুমতী, পুবাল হাওয়া বয়রে।
বন্ধু মনে রং লাগাইয়া , প্রানে দিলো জ্বালারে।
ভাদ্র মাসের আকাশ আমার
সাদা মেঘের বেলা
কোথায় রইলা প্রান বন্ধুয়া
রাখিয়া একেলা।
বাড়ির পাশে….”
~ রাশিদ ভাই!
থেমে যায় রাশিদ, ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। লাল লেহেঙ্গা, বাহারি গহনায় সজ্জিত বিয়ের কণে ফারাহ কে দেখে একটুও বিচলিত হয় না সে। বরং আবার মাথাটা সামনের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। ভাবালেশ কন্ঠে বলে উঠে,
~ তুমি এখানে কি করছো ফারাহ। তোমার না বিয়ে!
~ শেষবারের মতো আবারো আপনার কাছে ছুটে এসেছি রাশিদ ভাই। বড্ড অন্যায় হয়ে যাচ্ছে আজ, একজন কে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করছি। এই অন্যায়ের ক্ষমা কোথায়?
ফারাহ’র এই কথাতেও রাশিদ কে ভাবালেশ দেখাই। যেন নিয়মিত কথাগুলো শুনে এসেছে, তাই বেশী ইন্টারেস্ট নেই। অথচ সে বুঝতে পারছে না কবুল বলার ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগে মেয়েটা তার কাছে এসেছে, কতটা পুড়ছে! রাশিদ বললো,
~ ফিরে যাও ফারাহ, কেউ দেখে ফেললে তোমারই ক্ষতি।
~ এতটা নিষ্ঠুর তো আপনি ছিলেন না রাশিদ ভাই, তবে আমার ক্ষেত্রেই কেন এত নিষ্ঠুরতা। আমি কি একটু ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়?
কান্না ভেজা কন্ঠে কথাটা শুনে রাশিদের বুক কেঁপে উঠে, ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট হয়তো তার থেকে ভালো কেউ জানে না। তবে সে যে অপারগ। মুখটা কঠোর করে বলে উঠে,
~ আমি চাচ্ছি না আর এক সেকেন্ড সময় তুমি এখানো থাকো।
শব্দ করে কেঁদে উঠে ফারাহ। বুকটা ফেটে যেন চৌচির হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার পর ভাদ্র এসেছে অসহনীয় গরম ও হঠাৎ বৃষ্টির ছলকা নিয়ে। ভাদ্রের গরমে ভারী ড্রেসে মেয়েটা ঘামছে, হাঁসফাঁস লাগছে তবুও পাত্তা দিচ্ছে না। যেন তার একমাত্র কাজই এখন সামনের নিষ্ঠুর পুরুষটাকে মানানো। তবে এতটা সহজ কি? ফারাহ’র কান্নাতেও মন গলে না রাশিদের। নির্বাক চিত্তে বলে উঠে,
~ আমি জলন্ত এক অগ্নিকাঠ প্রিয়, স্ফুলিঙ্গ একবার ছড়িয়ে গেলে পুড়তেই থাকবে, ঘা হবে, দগ্ধ হবে কিন্তু প্রতিষেধক নেই!
কিছুক্ষণ চুপ করে রয় রাশিদ। আবার অসাধারণ বচনভঙ্গিতে বলে উঠে,
~ বলেছিলাম কথাটা? শুনোনি! পুড়েছো, দগ্ধ হয়েছো। প্রথম ভুল হয়তো এটাই। ফের প্রতিষেধক চেয়ে যে বড্ড ভুল করে বসলে!
কান্না থেমে যায়। নাক টানার শব্দ ভেসে আসে। ফারাহ উঠে দাঁড়ায়। চোখ মুখ মুছে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সামনের পুরুষ টির দিকে। মুখ দেখার সাধ্য হয়ে উঠে না। তবুও কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলো। চাপা সুরে বললো,
~ আপনি আমার সর্বপ্রথম ও শেষ আফসোস রাশিদ ভাই, যাকে পাবোনা জেনেও ভালোবেসেছি; আবার না পেয়েও, হারিয়েছি!
যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যায় ফারাহ। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ ভেসে আসে রাশিদের কানে। মৃদু হাওয়ায়, নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দটা হয়তো কোনো প্রেমিকের বুকে ঝড় তুলে দিত তবে রাশিদ প্রেমিক নয়। রাশিদ এক ব্যর্থ প্রেমিক। যার শুরুতে ছিল একজন, সমাপ্তিতেও সেই। মাঝখানে কেউ আসবে না। রাশিদ আবারো পানিতে দৃষ্টি ফেলে। আচানক কিছুটা শব্দ করে হেসে উঠে। হাসিটা খানিক সময় স্থায়ী হয়। নিজের মতোই বলে উঠে,
~ আমার মন থেকে আমার শুচিস্মিতা কে তাড়াতে যে প্ল্যান তুমি করেছিলে, সেই প্ল্যানের বলি তুমিই হলে। বড্ড বোকা তুমি ফারাহ। রাশিদ তাজওয়ার কখনোই নিজের পছন্দের জিনিসকে কাছ ছাড়া করে না, সেখানে মনের অধিকারীনীকে তো নয়ই!
…
সবে মাত্র চোখ টা লেগে এসেছিলো আনতারা’র। এর মধ্যে দরজায় টোকা পড়তেই বন্ধ চোখের পাতা কেঁপে উঠে, আবার সেই বিদ্রুপের মুখোমুখি হতে হবে। উঠে বসে, ফোনের ফ্লাস লাইট জ্বালিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে নেয়। চোখ দুটো বার কয়েক হাত দিয়ে কচলে নেয়। দরজা খুলতেই ভেসে আসে তীক্ষ্ম কন্ঠের কিছু বুলি,
~ মহারানী কি ঘুমিয়েছিলেন নাকি? আপনার কি সময় হবে বোনের কাছে যাওয়ার? যত্তসব! এতক্ষণ ডাকছি কই ছিলি? দরজা বন্ধ করে মুখে ফাউন্ডেশন মাখছিলি নাকি?
মুখশ্রী কঠোর করে তাকায় আনতারা। ছেলেটা তার চাচাতো ভাই। বড় চাচার একমাত্র ছেলে ফাতিন, ফারাহ’র ভাই। কিসের কোম্পানিতে যেন চাকরি করে আনতারা জানে না, মূলত জানার প্রয়োজন ই পড়ে না। অফিসের সময়ের পর বাকি সময়টা যেন এই লোক আনতারা কে কথা শুনাতে কাজে লাগায়। আনতারা’র কঠোর মুখশ্রীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ফাতিন হাঁটা ধরে। একটা কথা যেন না বললেই নয়, আনতারা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
~ আমার মতো আঁধারিয়াদের সাজার প্রয়োজন পড়েনা ফাতিন ভাই, মুখশ্রীতে অন্যরকম মায়া থাকে যা তোমাদের মতো ধবধবে ফর্সাদের মুখে থাকে না!
চোখ মুখের বিকৃতি ঘটিয়ে ফাতিন কিছু বলবে, তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আনতারা নিচে চলে যায়। অপমানে থমথমে হয়ে যায় ফাতিনের মুখশ্রী। বিড়ডিড় করে কিছু বলে নিজেও নিচে চলে যায়। হয়তো গালি দিচ্ছে! আবারো ভিড়ভাট্টার মাঝে এসে আনতারা দাঁড়িয়ে যায়, খুব করে চাইছে কেউ এসে তাকে আটকে দিক। হয়তো উপর ওয়ালা তার মিনতি শুনেছে তাইতো বোনের কাছে যাওয়ার আগেই কেউ হাত ধরে থামিয়ে দেয়। বাবার কঠিন মুখশ্রী দেখে মুচকি হাসে সে। কঠিন মুখশ্রী যেন তাকে বলছে, ‘কোথায় যাচ্ছিস? ওদিকে তোর যাওয়া বারণ। আমি চাইনা কোনো দুই কথা হোক!’ মুখে না বললেও বুঝতে পারে আনতারা। হাত ছাড়িয়ে আবার ফিরে আসে পেছনের দিকে। এভাবেই তাকে পেছন সরে আসতে হয়, যাবে যাবে বলেও সামনের দিকে যাওয়া হয় না।
বাবা মেয়ের এমন নিরব সংঘর্ষ দেখে আনতারা’র ছোট চাচি মিসেস কামরুন্নাহার গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বারবার মেয়েটাকে এভাবে দেখতে তার কষ্ট হয়, কান্না পায়। সে তো মা! মানুষ সেই করেছে। যৌথ পরিবার আনতারা’র। আনতারা’র বাবা আহনাফ তালুকদার, বড় চাচা ফরিদ তালুকদার, ছোট চাচা আমির তালুকদার। আনতারা’র বয়স যখন সাড়ে তিন, দুরারোগ্যে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন আনতারা’র মা আয়েশা। এরপর থেকেই আনতারা বড় চাচি সেলিনা ও ছোট চাচি কামরুন্নাহারের কাছেই মানুষ। বড় চাচি খুব একটা সমীহ না করলেও ছোট চাচি অন্ত প্রাণ সে। বড় চাচার ঘরে সন্তান দুজন, ফাতিন তালুকদার ও ফারাহ তালুকদার। যার মধ্যে একজনের খুব প্রিয় সে, আরেকজনের খুব অপ্রিয়। ছোট চাচার ঘরে দুজন, মেয়েটা তার থেকে তিন বছরের ছোট, ছেলেটা এইবার ফাইভে পড়ে। যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠা মেয়েটা যৌথ পরিবারের মানেটা এখনো বুঝতে পারেনি। মায়ের শোকে বাবার যে আফসোসের শেষ নেই, তারউপর যার ঘরে তার মতো একটা মেয়ে রয়েছে তার আফসোস থাকবে না?
মিসেস কামরুন্নাহার আশেপাশে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটান। পারিবারিক মনোমালিন্য বাইরের মানুষের সামনে প্রকাশ করে হাসির খোরাক হতে কেই বা চাই! ফারাহ’র পাশে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। বিয়ের কণে তখন সব ভুলে দুঃখ বিলাসে ব্যস্ত। চারপাশ কি হচ্ছে না হচ্ছে যেন দেখার বিষয় না। আপন ভাবনায় ব্যস্ত ফারাহ কে আগলে নেন মিসেস কামরুন্নাহার। ফারাহ মলিন হাসে, মনের ব্যাথার কাছে সব আদরই ফিঁকে লাগছে।
আওয়াজ আসে বর এসেছে, বর এসেছে। ধ্বক করে উঠে ফারাহ’র বুক, তবে কি আর শেষ রক্ষা হলো না? হয়তো হবে না, নিয়তি তার সাধ যে দেয়নি!
আনতারা কে ফিরে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় ফাতিন। কঠোর দৃষ্টি ফেলে আনতারা’র সামনে দাঁড়ায়। না চাইতেও কিছুটা কেঁপে উঠে আনতারা। এরকম দৃষ্টি মানেই যেন কোনো ঝড় নিয়ে আসবে। ঠিক তাই হলো। ফাতিন কড়া কন্ঠে বললো,
~ আমার কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমার বোন। আর আমার বোনের কাছে তুই। তাই তোর এসব নাটক অন্য কাউকে দেখাবি। এখন চল ফারুর কাছে যেতে হবে।
বিয়ে বাড়িতে আনতারা চায়না কোনো ঝামেলা হোক, তাই নিঃশব্দে ফাতিনের হাতের মুঠোয় থাকা নিজের হাতটার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। তাদের এভাবে দেখলে কেউ কিছু বলবে না সে জানে, তবুও অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু কেন? মন যেন বলতে চাইছে, তোর দেওয়ানা পুরুষটার বুক যে পুড়ে, সইতে পারে না। নিজের ভাবনা নিজের কাছেই ঝেড়ে ফেলে সে, মস্তিষ্ক মানতে চাইনা, জোরও খাটায় না। অনুভূতি শূণ্য হয়ে হেঁটে ফারাহ’র সামনে গিয়ে দাঁড়ায়!
প্রিয় বোন কে দেখে ফারাহ না চাইতেও মুখে হাসি ফুটায়, আনতারা’র চোখ জ্বলছে যেন। বার কয়েক পলক ফেলে বোনের পাশে বসে। ফারাহ মলিন হেসে বলে,
~ আমার সামনে কঠিন খোলস নিয়ে বসে থাকলেই কি আমি বুঝবো না? মন খারাপ করিস না তারা, আমি তোকে আমার সাথেই নিয়ে যাবো।
হেসে উঠে আনতারা, ফারাহ’র মা মিসেস সেলিনা যেন আতকে উঠেন কথাটা শুনে। কি বলে এই মেয়ে? বোন কে কেউ সাথে করে শশুড় বাড়ি নিয়ে যায়? চোখ পাকিয়ে মেয়ের দিকে তাকায় সে, ফারাহ খেয়াল না করলেও আনতারা’র দৃষ্টিতে ঠিক ধরা পড়ে। বোন কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
~ কি যে বলো না আপায়, আগে নিজে যাও, সংসার শুরু করো। আমি তো যাবোই আমার আপায়ের কাছে, যখন মন চাইবে তখনই চলে যাবো।
ফারাহ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে আনতারার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠে,
~ বিয়ের পর সব মেয়েরাই পর হয়ে যায় রে তারা। মেয়ে তখন অন্যকারো বউ, যেন তাদের সব দায়িত্ব একদম চুকিয়ে দিয়েছে। সময় হলে খোঁজ নিবে, নাহলে নাই। দরকার কি?
মেয়ের কথায় মিসেস সেলিনা মাথা নিচু করে ডুকরে কেঁদে উঠেন। মেয়ে যে তাদের উপর অভিমান করেই এসব বলছে তিনি জানেন। তারই বা কি করার? মেয়ের ইচ্ছে কে প্রাধান্য তিনি দিতে চেয়েছিলেন, তবে স্বামীর উপর কথা তো বলতে পারবেন না। কি করে জোর খাটিয়ে বলতেন, মেয়েকে তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে বিয়ে দাও, মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে; যেখানে তিনি জানেন মেয়ের বাবা অপারগ! বড় চাচির কান্না শুনে আনতারা তড়িঘড়ি করে আকড়ে ধরে বড়চাচিকে। আদুরে গলায় বলে উঠে,
~ কেঁদ না বড়চাচি, তুমি কাঁদলে আমার আপায়ের বেশী কষ্ট হবে।
মিসেস সেলিনা কিছুটা সময় আনতারা’র দিকে তাকিয়ে রয়। মেয়েটা কালো তবে মুখশ্রীতে যেন মায়া উপচে পড়ে। মেয়েটাকে সে ভালোবাসে, তবে কিছুসময় তার কি হয়ে যায় সে বুঝেনা খারাপ ব্যবহার করে ফেলে। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে তিনি ভেতরে চলে যান, কাজ অনেক বাকি। এবার আনতারা আশেপাশে তাকালো, সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে। প্রবল অস্বস্তি ঘিরে ধরলো তাকে। অদূরে কাজিন দের নিয়ে বরের গেইট ধরেছে ফাতিন। কণের বড় ভাই সে হয়তো খেয়াল করেনি, তার এসব সাজে না। আনতারা সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে বলল,
~ আপায়, এখন আমি যাই? আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। একটু পর তোমার বর ও চলে আসবে।
ফারাহ চোখ রাঙালো, কর্কশ কন্ঠে বললো,
~ একদম না, চুপচাপ আমার পাশে বসে থাকবি। বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথেই থাকবি, নাহলে বিয়ে আমি করবো না।
আতকে উঠার মতো মুখশ্রী হলো আনতারা’র। এক দন্ডও সে থাকতে চায়ছে না, সেখানে শেষ পর্যন্ত কিভাবে সম্ভব? শেষ হতে নিম্নে আরো ঘন্টাদুয়েক লাগবে। তবুও কিছু বললো না, কথায় কথা বাড়বে। ভিড়ের এক ফাঁকে সে চলে যাবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে রইলো। বর কে নিয়ে আসা হলো, ফারাহ আনতারা’র এক হাত শক্ত করে ধরে আছে। আনতারা উঠছে না দেখে ফাতিন কটাক্ষ করে বলে উঠলো,
~ কিরে তোরও বিয়ের শখ জাগছে নাকি? সং সেজে বসে আছিস কেন? উঠ তাড়াতাড়ি, ভাইয়া বসবে।
ফারাহ ভাইয়ের দিকে বিতৃষ্ণা নজরে তাকালো। কিন্তু আনতারা’র মুখশ্রী কঠিন। যদিও সে চাইছিল চলে যাবে, তবে এখন যাবে না। নিজেও কটাক্ষ করে বলে উঠলো,
~ চোখের ডাক্তার দেখান ফাতিন ভাই, নিজেকে দেখুন আর আমাকে দেখুন। কে সং সেজেছে নিজেই বুঝতে পারবেন। বিয়ের শখ হলে বোনের পাশে বসার দরকার হতো না, কণে সাজে বসে পড়তাম। দেখতে আঁধারিয়া হলে কি হবে, পাত্রের কিন্তু অভাব হতো না ফাতিন ভাই!
কথাটা বলে ফারাহ’র হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে আনতারা। চারদিক থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসে। ফাতিন একদম বিব্রত পরিস্থিতির মুখে পড়ে যায়, এভাবে বলা ঠিক হয় নি বুঝতে পারে অপমানিত হওয়ার পর। মুখ গোমড়া করে ফাতিন খাবারের প্যান্ডেলের দিকে চলে যায়। ফারাহ’র বর ইতিমধ্যে ফারাহ’র পাশে স্থান করে নিয়েছে, চোখ মুখে উপচে পড়ছে খুশিরা। এত সুন্দর মেয়ে তার বউ, ভাবতেই সুখী মনে হচ্ছে তার। নানান রকম হাসাহাসি, ছবি উঠা, বর-কণে পক্ষ ঝগড়া নিয়ে আধা ঘন্টা কেটে গেল। আনতারা সবটা সময় চুপচাপ, মাথা নিচু করে বসে আছে। মাথা নিচু থাকলেও সে বেশ বুঝতে পারছে কয়েকটা চোখ তার দিকেই নিবদ্ধ, এতে যেন আনতারা আরো অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মাথা উঁচিয়ে একপলক পরিবারের কাউকে খোঁজার চেষ্টা করে। অদূরে ছোট চাচার মেয়ে কেয়া সেলফি তুলতে ব্যস্ত, ফাইভে পড়ুয়া কিয়ান কে খোঁজা বোকামো ভেবে নিরাশ হলো আনতারা। চোখ বুজে চাপা শ্বাস ফেললো। মাথা টা টনটন করছে। মন চায়ছে তখনের মতো এখনও বাবা নামক মানুষ টা এসে বাঁচিয়ে নিক তবে এটা হবে না সে জানে। মন তো অনেক কিছুই চায়, সব কি পায়? এই কথাটাও যেন ফলে গেল, সকল অস্বস্থি থেকে বাঁচাতে কেউ তার নাম ধরে ডেকে উঠলো,
~ শুচিস্মিতা, এদিকে আয় তো।
চমকে মাথা তুললো আনতারা। এই নাম টা তার মায়ের দেওয়া। ছোট চাচির কাছে শুনেছে, কালো মেয়ে হয়েছে বলে প্রতিবেশীরা যখন সমবেদনা দিতে ব্যস্ত; আনতারার মা আয়েশা তখন সবাইকে উপেক্ষা করে তার নাম দিয়েছিল শুচিস্মিতা। মায়াবী হাসির অধিকারীনী! মা মারা যাওয়ার পর এই নামে আর কেউ ডাকে নি, একজন ছাড়া! এই একটা মানুষ ই তাকে বার বার মায়ের কথা স্মরণ করায়। কিন্তু মানুষ টা জানে আনতারা তার সামনে পড়তে চায় না, তবুও মানুষটা সবটা সময় এমন করে। ভাবনায় ব্যস্ত আনতারা কে ধাক্কা দিল ফারাহ। কিছুটা দূরে রাশিদ দাঁড়িয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে। মেয়েটাকে ডেকে যেন যার পর নাই বিরক্ত সে। ফারাহ’ও হাত ছেড়ে দিয়েছে, আনতারা উঠে চলে যায়। রাশিদের সামনে দাঁড়ায় শক্ত মুখশ্রী নিয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
~ আপনাকে যে বলেছি এই নামে ডাকবেন না রাশিদ ভাই। তারপরেও কেন?
~ সবটা তোমার মর্জি মতো হবে আশা করা বোকামো নয় কি?
ফুস করে নিশ্বাস ছাড়ে আনতারা। রাশিদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি। বিরক্তি কন্ঠে আনতারা বললো,
~ কিসের জন্য ডাকতে হলো?
লোকচক্ষুর আড়ালে রাশিদ আনতারা’র আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালো। চোখ মুখ খিচে নিলো আনতারা। রাশিদ নিঃশব্দে হাসলো। বললো,
~ তুমি আমার এমন একজন, যার মুখশ্রী দেখেই বুঝতে পারি মনে কি চলছে। এই যে এখন তোমার মন প্রহর গুনছে কখন আমি দূরে সরে দাঁড়াবো।
যাইহোক, মাথা ব্যাথা করছিলো তবুও বসেছিলে কেন? যাও ভেতরে যাও, খাবার, ঔষধ রাখা আছে, খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে।
….
সময় তখন নয়টা বাজতে চললো। বিয়ে বাড়ির আসল মজা তো এখনি। বিয়ে পড়ানো হবে। কাজিকে নিয়ে আসছে রাশিদ। কথাটা শোনার পর ফারাহ’র মনে হলো কলিজা টা কেউ দুভাগ করে দিয়েছে। অসহনীয় যন্ত্রনায় বারংবার চোখ ভিজে আসতে চাইছে তার। কাঁদতে আজ মানা নেই, এই আত্মচিৎকার কেউ টের পাবে না। ভেবে নিবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাই মন পুড়ছে। অথচ মন তো তার আগেই পুড়া। ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো ফারাহ। পাশে বসা নিয়ন কিছুটা চমকালো, করুণ হলো তার দৃষ্টি। বউয়ের কান্নায় যেন সে খুব ব্যথিত। একবার চাইলো হাত ধরবে, ধরতে গিয়েও ফিরিয়ে নিলো। আজ একটু কাঁদবেই!
কবুল বলার আগ মুহূর্তে ফারাহ হুট করেই উঠে দাঁড়ালো। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজলো। না দেখতে পেয়েই মুখটা আবার মলিন হয়ে উঠলো তার। মেয়েটা কে স্বাভাবিক করতে চেয়েও ব্যর্থ সে। ঘরকুনো মেয়েটা তার বিয়ে পড়ানোর সময় টুকুতেও থাকলো না?
ফাতিন এগিয়ে এলো, বোন কে ধরে বসালো। কটমট চোখে একবার আনতারা’র বেলকনিতে তাকালো। কতটা রেগে আছে যদি প্রকাশ করতো, তাহলে হয়তো মেয়েটি জ্বলে পুড়ে যেত।
সময় এলো কবুল বলার। নিজেকে পুরোপুরি অন্যের নামে লিখে দেওয়ার, বৈধ এক সম্পর্কে জড়ানোর। নিয়নের চোখ মুখে খুশিরা উপচে পড়লেও ফারাহ অনুভূতি শূণ্য। কাজি যখন বলে উঠলো, বলো মা কবুল; ফারাহ একপলক রাশিদের দিকে তাকালো। লোকটি নির্বাক হেসে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। পর পর তিনবার কবুল উচ্চারণ হলো, তিন কবুলে ফারাহ যেন প্রিয় মানুষটার দিকে তাকানোতেও অপরাধ খুঁজে পেল। চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। চোখ বুজে কার্ণিশে জমা জল টুকু গড়িয়ে পড়তে দিলো। আনমনে বিড়বিড় করে বলল,
~ আপনি নামক আফসোস বুকে ধারণ করে অন্য পুরুষের হলাম প্রিয়, এই জ্বালা যদি একটু বুঝতেন!
চলবে..?
#শুচিস্মিতা -১
Tahrim Muntahana
(নতুন গল্প নিয়ে হাজির হলাম। নামানুসারে হয়তো মনে হবে প্রধান চরিত্র আনতারা। তবে আমি গল্পটাই সব চরিত্রেরই দোষ গুণ উল্লেখ করবো। ভুমিকা কম বেশী সবারই থাকবে। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন। শুকরিয়া)