শুচিস্মিতা পর্ব -১৬

#শুচিস্মিতা -১৬
Tahrim Muntahana

হেমন্তের প্রকৃতি দেখতে দেখতে নিজের সেই ছোট্ট গ্রামের সরু পথ ধরে হাঁটছে আনতারা! সময় কিভাবে চলে যায় বুঝা বড়‌ই মুশকিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রিয় মুখটা দর্শন করা, নাস্তা বানানো, ঝটপট রেডি হয়ে কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে র‌ওনা হ‌ওয়া, আবার ফিরে পড়াশোনা, মাঝরাতে বেলকনির গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রিয়জনের সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত; এভাবে করেই আনতারা’র জীবন থেকে একটা মাস চলে গেল। যোগ্যতা অনুযায়ী ভার্সিটি পরীক্ষা’র পাঠ চুকিয়েই গ্রামে ফিরছে না। আজ বেলা বাড়ার সাথে সাথেই হয়তো জীবন তাকে নতুনত্ব দিবে নাহয় তিরষ্কার। আজ যে তার স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণা হবে! আজকের দিনটাই তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে; আবার সেই পরিচিত-অপরিচিত শহরে প্রিয় মানুষটার পাশে ফিরে যেতে পারবে নাকি তাকে এই গ্রামেই ফিরে আসতে হবে! ফসলের গন্ধে মাতোয়ারা শালিকের কিচিরমিচিরের শব্দ শুনে আনতারা’র মনটাও খানিক নেচে উঠে। প্রাণভরে শ্বাস নেয় সে, মনে হচ্ছে কতজনম পর গ্রামটা দেখছে। মাথায় বোঝা নিয়ে ক্ষেতের আইল দিয়ে এঁকেবেঁকে হাঁটছে কৃষক, ফসলগুলো ঘরে তুলতে হবে তো। কেউ কেউ আবার ক্লান্ত হয়ে ধানক্ষেতেই বিশ্রাম নিচ্ছেন। মন জুড়ানো দৃশ্য! শহুরে আচরণ গ্রামে ছড়ালেও, কৃষকদের মাঝে যেন তা নেই। তারা নিজেদের জগতেই যেন ভালো আছে। নতুন ফসল ঘরে তোলার ক্ষণে কৃষকের চোখে মুখে যে হাসি প্রকাশ পায়, তা হাজার খুঁজেও পাওয়া যাবে না। দেখা হয় দেলোয়ার কৃষকের সাথে, আনতারা থামে। বিনীত স্বরে সালাম জানিয়ে বলে উঠে,

~ কেমন আছেন চাচা? চাচি, আপু, আঁখি ওরা সবাই ভালো আছে?

~ আলহামদুলিল্লাহ মা, ভালাই আছি। বড় মেয়েডার কথা তো জানোই, কি আর বলমু। তোমার চাচি, আঁখি ওরা ভালো আছে। তুমি ভালা আছো মা? বাড়িতে যাইয়ো।‌

~ আলহামদুলিল্লাহ। পরে একসময় যাবো, এখন আসছি চাচা!

পথে আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলে আনতারা। কারো কারো বাঁকা দৃষ্টির সম্মুখীন হয় আবার কারো কারো স্বচ্ছ। অবশেষে তালুকদার বাড়ির দেখা মেলে। শিউলি তলা টা যেন খা খা করছে। খানিক ইমোশনাল হয়ে যায় আনতারা! এই শিউলি তলায় তার প্রথম প্রেমের স্বীকারোক্তির সাক্ষী আবার বিরহের সাক্ষীও! গেইটের কাছে পা রাখতেই কোনো এক মমতাময়ী স্পর্শ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো আনতারা কে। মা মা গন্ধ আসছে মনে হচ্ছে! আনতারা বুঝে, মুচকি হেসে বলে,

~ এখন আবার কান্না শুরু করো না ছোটচাচি। আমার খুব খিদে পেয়েছে!

মিসেস কামরুন্নাহার প্রাণভরে তৃপ্তি নিয়ে মেয়েকে দেখে নেয়, বারবার চোখ ভিজে আসে তার। কেয়া তার নানা বাড়ি গিয়ে থাকলেও, এই মেয়েটাকে সে কখনো কাছ ছাড়া করি নি। বাবা’র বাড়ি গেলেও আনতারা কে আগে রেডি করাতো! অনেকের কাছেই অনেক কিছু শুনতে হয়েছে, তবে সে কান দেয় নি। আজ একমাস পর মেয়ে কে দেখছে, চোখ ভিজে আসবে না? মিসেস সেলিনা’ও আদুরে ভঙ্গিমায় ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেন। তালুকদার বাড়ির পুরুষ’রা কেউ ই কাজে যায় নি আজ; আহনাফ তালুকদার বাদে! হয়তো মেয়ের সাথে চোখ মেলাতে পারবে না বলেই, এমন পালিয়ে যাওয়া। বাড়ির ভেতরে গিয়ে সবার সাথেই খানিক ক্ষণ কথা বলে নিজের ঘরে যায় আনতারা। মানুষ টাকে জানাতে হবে! ফ্রেশ‌ না হয়েই ফোন লাগায় পরিচিত সেই নম্বরে, রিং হয়ে কেটে যায় রিসিভ হয় না। আবার চেষ্টা করতেই সাথে সাথে রিসিভ হয়। আনতারা ইতস্তত করে কিছু বলবে তার আগেই রাশিদ অবাক কন্ঠে বলে উঠে,

~ তুমি আমাকে নিজে থেকে ফোন দিয়েছো শুচিস্মিতা?

লজ্জা পেল নাকি অস্বস্তি তে পড়লো আনতারা বুঝলো না। এই একমাসে তাদের ফোনে কথা হয়নি কখনো, তাই বলে ফোন দিতে পারবে না? আনতারা’র মনোভাব হয়তো রাশিদ বুঝতে পারে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,

~ বাড়িতে পৌঁছেছো?

~ হ্যাঁ!

~ অসুবিধা হয়নি?

~ আমি একা চলাচল করতে পারি রাশিদ ভাই!

~ তবে আমি যে একা কোথাও মানতে পারি না!

~রাখছি!

~ আরেকটু!

~ কি বলবেন?

~ ভালোবাসি!

শব্দটাই কি থাকে আনতারা জানে না! থমকায়, কেঁপে উঠে শরীর, ধক করে উঠে বুক। যতবার ওই মুখ থেকে তার জন্য এই শব্দ টা বের হয় ততবার নতুন লাগে আনতারা’র কাছে; হয়তো মনগহীনের মানুষ বলেই! বললো,

~ এবার সত্যি সত্যিই রাখবো!

~ তুমি খুব নিষ্ঠুর, শুচিস্মিতা!

~ নিষ্ঠুরতার কারণ আপনারাই রাশিদ ভাই!

বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে রাশিদ। ক‌ই ভেবেছিল বলবে, ‘আপনার জন্য নয়’! তা না আবার সেই এক কথা। অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,

~ আপনারা আর আপনি, আকাশ পাতাল পার্থক্য শুচিস্মিতা! তুমি কি জানো, তুমি সেই আগের শুচিস্মিতাই রয়ে গেছ, একটুও পাল্টাও নি তবে উচিত ছিল! তোমার কাছে এখনো প্রতিবেশীর কথা মেটার করে, আমার নয়!

কেটে যায় ফোন, হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আনতারা। সে চাইলেও এসব ভুলতে পারবে না। মূলত সে চাই ই না; এসব মনে হলেই তো তার জেদ চাপে! বিশ্ব জয় করার জেদ ! ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। অপরদিকে বাস কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাশিদ! ভেবেছিল যাবে না, তবে মায়ের জোরাজুরি তে তার‌ও র‌ওনা হতে হলো। কেয়া’টা একা থাকতে শিখে গেছে, ভয় পায় না! পাশের বাসার ভাড়াটিয়া দের কেউ অনুরোধ করে এসেছে সে‌। না গেলে হয়তো মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাবে, তার মা যে চালাক! ঠিক খোঁজ নিবে লোক দিয়ে। সে চায়ছে না এখনি বিষয়টা সামনে‌ আসুক। হয়তো তার মা রাগে চেঁচামেচি করবে, এক কান দু কান করে পুরো গ্রাম ছড়িয়ে পড়বে। দোষটা যে তার শুচিস্মিতার’‌‌ই হবে! বাস আসতেই নিজের সিট বুঝে বসে পড়ে রাশিদ। অপরূপা কে ছাড়া থাকতে হবে না, এরজন্য যেমন খুশি লাগছে, তেমনি মায়ের এমন জরুরি তলবে চিন্তা হচ্ছে! তার সন্দেহ’ই যদি ঠিক হয়! তাহলে? ভাবতে পারে না রাশিদ, মাথা এলিয়ে দেয় সিটে। বিড়ডিড় করে বলে,

~ তুমি মেয়ে একটু বেশীই মায়াবি, না হলে ভবঘুরে ছেলেটাও এমন গোছালো হবে কেন?

‘ক’ ইউনিটের ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। স্বভাবতই চিন্তায় শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম ছিল আনতারা’র। ফলাফল লিস্টের পঁয়ত্রিশ তম স্থান আনতারা রাইদা নামটি দখল করে নিয়েছে! একবার দুবার নয় বহুবার চোখ মেলে দেখে সে, স্বপ্ন নয় তো?আনতারা অনুভূতি শূণ্য হয়ে ফোন তুলে নেই! তার পর যে মানুষ টার কন্ট্রিবিউশন সবচেয়ে বেশী ছিল তাকে না জানালে যে পাপ হবে! চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো রাশিদ, বাসস্ট্যান্ড বেশী দূরে নয়। বুকপকেটে থাকা ফোন টা বেজে উঠতেই চোখ খুলে সে। শুচিস্মিতা নাম দেখেই ঢোক গিলে, রেজাল্ট কি দিয়ে দিয়েছে? নিজের‌ই কেমন আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে আনতারা ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাশিদ। কান্না টা অর্জনের ঢের বুঝেছে সে! কিছুটা সময় পর নরম সুরে বললো,

~ কাঁদছো কেন? সময় এলো যে আশপাশ দু গ্রাম মিষ্টি বিতরণের!

আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে থামে আনতারা। চোখ মুছে কান্না ভেজা কন্ঠে বলে উঠে,

~ আমি অপ্রাপ্তির দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে এখানে এসেছি, প্রাপ্তির সুখ জ্বালা ধরায় প্রিয়!

রাশিদ চুপটি মেরে যায়। প্রিয়! আহা আজ সে সত্যি সত্যিই প্রিয় হয়ে উঠেছে! বললো,

~ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, কল ব্যাক করছি!

কেটে যায় ফোন। আনতারা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বাড়ির সবাই কে তো জানাতে হবে! রান্নাঘরে দেখতে পায় মিসেস কামরুন্নাহার কে। যে আনন্দ চিত্তে তার পছন্দস‌ই রান্না করে যাচ্ছে। আনতারা’কে দেখে সে হাসতে গিয়েও হাসে না, চোখ মুখ দেখে ভয় হয় তার। কৃষ্ণ নয়ন যুগল কেমন ফুলে আছে। ছোট চাচির দৃষ্টি দেখেই আনতারা একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে। চেঁচিয়ে বলে উঠে,

~ আমি পেরেছি ছোট চাচি। তোমার ভরসার মান রাখতে পেরেছি। পনেরো তম স্থান দখল করেছে তোমার মেয়ে। আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে ছোটচাচি! সত্যিই কি এমন হয়েছে?

মিসেস কামরুন্নাহার কথা বলতে পারেন না।‌ ফ্যালফ্যাল করে কিছু সময় কাটিয়ে দেন। মিসেস সেলিনা খুশিতে চিৎকার করে বাড়ির পুরুষদের ডাকে। আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে তালুকদার বাড়ি। আশেপাশের সবাই একবার হলেও আনতারা কে দেখে যায়। আমির তালুকদার বেরিয়ে পড়েন মিষ্টি কিনতে। ফরিদ তালুকদার আত্মীয় স্বজন দের ফোন করে বলতে থাকেন, যারাই কটু কথা বলে আনতারা কে অবজ্ঞা করে ছে তাদেরকে রসিয়ে রসিয়ে বলতে ভুলেন না তিনি। যেন এই দিনটার জন্য‌ই অপেক্ষা করছিলেন! বাড়িতে কিছূসময় থেকে ছোট চাচার আনা মিষ্টি নিয়ে তাজ‌‌ওয়ার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে আনতারা। সময় হয়েছে জবাব দেওয়ার! আনতারা কে দেখে ঝিনুক দৌড়ে আসে, খবর তার কানেও এসেছে। শুভেচ্ছা জানিয়ে বসতে বলে। আনতারা বসে না, মিসেস মমতা’র হাতে মিষ্টির প্লেটটা তুলে দিয়ে বললো,

~ প্রাথমিক যাত্রার সমাপ্তি চাচি, সফল‌ হয়েছি! খুশি তো চাচি?

মিসেস মমতা মুখ বেজার করেন না বরং তার ঠোঁটের কোণে আলাদা এক হাসি বিরাজ করছে। আনতারা অবাক হয় তবে কিছু বলতে পারে না। তার আগেই কোনো এক বলিষ্ঠ হাত তার হাত ধরে ঘুরতে শুরু করে‌। চেয়ে দেখে সে, রাশিদের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী দেখে বিস্মিত হয়ে যায়। একটু আগেও না কথা হলো‌! বলতে গিয়েও বলতে পারে না। রাশিদ উৎফুল্লের সাথে বলে উঠলো,

~ অনেক অনেক শুভেচ্ছা শুচিস্মিতা। তুই তো আমাদের গ্রামের গর্ব! এরকম একটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ব‌উ থাকলে জীবন ধন্য হয়ে যেত!

আনতারা লজ্জা পায়, লজ্জামাখা হাসি দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসে তাজ‌ওয়ার বাড়ি থেকে। রাশিদ আড়চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মিসেস মমতা’র কোনো ভাবাবেগ না দেখে ভ্রু কুঁচকায়। এই যে ইঙ্গিতে নিজের পছন্দের কথা মা কে বললো, এতক্ষণে মায়ের উচিত ছিলো রেগে ফেটে পড়া নাহয় ভালো করে বুঝানো‌। অথচ মিসেস মমতা কিছুই করছে না, রিলেক্স মুডে মিষ্টি খেয়ে যাচ্ছে! অবাকতা নিয়েই নিজের ঘরে প্রবেশ করে রাশিদ। জলদি করে পোশাক পাল্টে তালুকদার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। হাতে কয়েক প্যাকেট মিষ্টি। সে চায় সারা গ্রামে আজ মিষ্টি বিতরণ করতে, সেও যে খুশি কতটা দেখাতে হবে তো!

ঝিঁঝি ডাকা পড়ন্ত বিকেল। নীল দিগন্তে ঝুলে আছে এক টুকরো সোনালি সূর্য। আভা ছড়াচ্ছে ধরণীতে। ঘরে ফিরছে মেষদের দল। ছোট চাচার পেছন পেছন ছুটছে আনতারা! উদ্দেশ্য ফারাহ’র শশুড় বাড়ি। আনন্দ উল্লাসে সামান্য ভাটা পড়তেই মিসেস কামরুন্নাহার স্বামীর হাতে মিষ্টি ধরিয়ে বলে উঠলেন,

~ যাও কুটুম বাড়ি দিয়ে আসো, তাদের‌ও তো জানতে হবে কামরুন্নাহার করে দেখিয়েছে, তাদের অবজ্ঞা করা মেয়েটা নিজের নাম উজ্জ্বল করতে পেরেছে!

আমির তালুকদার ও মেয়ে কে সঙ্গে নিয়ে চললেন। ক্ষেতের আঁকাবাঁকা সরু পথ দিয়ে হাঁটার সময় ভেসে আসে রবিন পাখির শিসের আওয়াজ, হেমন্তকালের প্রকৃতি জানান দিচ্ছে প্রেমময় শরতের আলাপন। আনতারা হাঁটার গতির সাথে নিজের ভবিষ্যতের‌ও এক ছক কষে। কখন যে বোনের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে টের ই পায় নি। দীর্ঘদিন পর বোন কে দেখে খুশী তে আত্মহারা ফারাহ। ফলাফলের খবর শুনে খুশি টা যেন দ্বিগুন হয়। সাথে সাথেই মিষ্টি নিয়ে ছুটে শাশুড়ির রুমে। মিসেস নাজমা নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে তসবিহ তিলাওয়াত করছিলেন। ফারাহ কে মিষ্টি হাতে নিজের ঘরে দেখে উঠে বসেন। ফারাহ বললো,

~ আমার বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে আম্মা। নিন মিষ্টি খান, আপনি মিষ্টি না খেলে সার্থক হবে না।

মুখ বেঁকিয়ে ‘খাবে না’ এর নিরব সম্মতি দিলেও, কাজ হয় না। জোর করে একটা মিষ্টি শাশুড়ির মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয় ফারাহ। মিষ্টি টা যেন তেঁতোর মতো লাগছে মিসেস নাজমা’র কাছে। সেজ ব‌উ যে কেন এত আহ্লাদ করছে সে বুঝতে পেরেছে। তাই তো মিষ্টিটা তার কাছে মিষ্টি লাগছে না, বরং অপমানে গলা দিয়ে নামছে না যেন। ফারাহ আবার হেসে বলে উঠে,

~ আপনার ছোট পোলার ভাগ্য কত ভালো হতো আম্মা, আমার বোনের মতো মেয়েকে ব‌উ করতে পারলে। যাই হোক এখন তো আফসোস করে লাভ নেই, হীরে কে তো হীরেই চিনবে, কাঁচ নয়!

আহা জবাব। ফারাহ’র আত্মাটা যেন শান্তি পেল। একমাস তো কম শুনতে হয়নি কথা, তালুকদার বাড়ির কথা উঠলেই শাশুড়ি আর মেজ ব‌উয়ের কত কটু কথা শুনতে হয়েছে আনতারা কে নিয়ে; আজ মনের স্বাদ মিটিয়ে নিয়েছে জবাব দিয়ে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ফারাহ’র কথাগুলো শুনে হাসে পারভিন। মেয়েটা কখনোই ছাড় দেয় না, মাঝে মাঝে আফসোস হয় নিজের ছাড় দেওয়ার জন্য। ছাড় না দিলে হয়তো আজকের ভালো থাকার সময়সীমা টা বাড়তো! ফারাহ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বড় জা কে হাসতে দেখে জড়িয়ে ধরে। খুশিতে আটখানা হয়ে বলে উঠে,

~ আজকের সব রান্না আমি নিজের হাতে করবো বড়ভাবী। আমার এত খুশি লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না!

~ একা এত পারবে না, চলো আমিও সাহায্য করছি, সেজ টাকেও ডাকতে হবে, আবার আলসেমি শুরু করেছে।

পারভিনের কথা শেষ হতেই পেছন থেকে রিনু বলে উঠে,

~ আমিও আসছি, চলো। আমার পিন্ডি আর চটকাতে হবে না।

মুখ বেঁকিয়ে চলে যায় রিনু। পারভিন আর ফারাহ একযুগে হেসে উঠে। ড্রয়িং রুমে আমির তালুকদার ফারাহ’র শশুড় আর নাহিদের সাথে আলাপ করছে। আলাপের একপর্যায়ে নাহিদ আনতারা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

~ কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়বে আনতারা?

~ সাইকোলজি, ভাইয়া!

~ এটা কেন? এত ভালো পজিশন পেয়েছো, বেটার সাবজেক্ট চয়েস দিতে পারো।

~ স্বপ্ন ভাইয়া, মানুষের মন পড়বো!

নাহিদ আর কিছু বলে না‌। স্বপ্নের উপর আর কথা চলে না। সাইকোলজিকে অনেকেই আর্টস ফ্যাকাল্টির সাবজেক্ট ভাবলেও সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞান হলো জীববিজ্ঞান অনুষদের সাবজেক্ট। মূলত শেষের প্রার্থী রা এই সাবজেক্ট পেয়ে থাকে। বিজ্ঞান, মানবিক, বিজনেস স্টাডিজ যেকোনো বিভাগের থেকে ই এই সাবজেক্ট নেওয়া যায়। আনতারা যেহেতু ভালো পজিশনে সেহেতু আর কোনো চিন্তা র‌ইলো না সাবজেক্ট পাওয়ার! এখন শুধু কঠোর অধ্যবসায় লাগবে, প্রচুর পড়তে হবে!

~ রেডি হ‌ইয়া নেও, একজায়গায় যামু।

মায়ের কথায় শোয়া থেকে উঠে বসে রাশিদ। সারাটা দিন ছুটোছুটির মাঝে ছিল। সন্ধ্যার গোধূলি লগ্ন, পশ্চিমাকাশে সূর্য মিলেয়েছে, খানিক পর হয়তো বাঁকা চাঁদ টাও আকাশে রাজত্ব ফলাতে চলে আসবে। শুয়ে শুয়ে মনের রানীর কথাই ভাবছিল, এর মধ্যে মায়ের এমন কথাই কিছুটা অবাক হয়। এই ভর সন্ধ্যায় মা ঠিক কোথায় যাবে বুঝতে পারে না রাশিদ, প্রশ্ন করার সাহস ও পায় না মিসেস মমতা’র গম্ভীর মুখশ্রী দেখে। ভাজ করা শার্ট টা গাঁয়ে দিতে লাগলেই বাঁধা দেন মিসেস মমতা,

~ শার্ট না পাঞ্জাবি পড়ো।

~ কোথায় যাচ্ছি মা?

~ প্রশ্ন করবা না, যা ক‌ইছি তাই করো।

মায়ের কথা মতোই পাঞ্জাবি পড়ে বের হয় রাশিদ। রনিও ঝিনুক কে নিয়ে বিকেলে শশুড় বাড়ি গেল। এই সন্ধ্যায় রাজীব তাজ‌ওয়ার ও বাড়িতে থাকেন না। মসজিদে বসে হুজুরের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করেন। বাড়িতে সে আর মিসেস মমতা ছাড়া কেউ নেই। কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারলো না রাশিদ। খচখচ মন‌ নিয়ে মায়ের‌ সাথে অটোতে বসে পড়লো। আরেকবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলো তবে মা কে অটো‌ওয়ালা’র সাথে কথা বলতে দেখে আর কিছু বললো না। সময় গড়িয়ে যেতেই গাড়ি এসে থামলো ছোট খাটো এক বিল্ডিংবাড়ির সামনে। অটো থামতেই দুটো মাঝবয়সী লোক এগিয়ে আসলো। রাশিদ তীক্ষ্ম চোখে বাড়িটা পরখ করলো, কোনো অনুষ্ঠান বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে? মিসেস মমতা হেসেই সবার সাথে কথা বলছেন। রাশিদ কে ইশারা করে তিনি বাড়ির ভেতর গেলেন। ঘরে গিয়ে বসতেই বাহারি‌ খাবারের ঢালা নিয়ে হাজির হলো কয়েকজন। বেশ খাতির যত্ন। রাশিদের আর বুঝতে বাকি র‌ইলো তার মা কায়দা করে তার জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে। বুকের ভেতর শক্তিশালী এক ঝড় বয়ে গেল যেন, দাঁতে দাঁত চেপে বসে র‌ইলো সে। বাড়িতে গিয়েই এক তুলকালাম কাণ্ড করবে, ভেবে চুপচাপ সয়ে গেল। মিসেস মমতা এমন ভাবে ছেলের গুণগান করছেন, মেয়ে বাড়ি লোকের পছন্দ হয়েছে মুখ দেখেই বুঝতে পারা যায়। রাশিদের ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙেচুরে শেষ করে দিতে। তার জীবন নিয়ে তার মা এতবড় ছিনিমিনি খেললো? কি করে পারলো? একজন মা হয়ে ছেলের সুখ বুঝলো না? হুট করেই মিসেস মমতা বলে উঠলেন,

~ পোলার খোঁজখবর তো আগেই নিছেন, আমরাও মেয়ের খোঁজখবর নিছি। এখন মাইয়া পছন্দ হ‌ইলে আজকেই বিয়েডা হ‌ইবো! কি কন?

চলবে….?

(আজকের পর্বটা হয়তো অগোছালো হতে পারে, রোযা থেকে ভাবলে মাথা ব্যাথাটা দ্বিগুন হয়ে যায়!
১৫ দিনের জার্নিতে কালকে ব্রেক নিয়েছিলাম। যদিও এরকম টা ভাবনা ছিল না, কালকে লিখার মুড ই পেলাম না। দুঃখিত তার জন্য।
কাল ১২ টার পর গল্প দিবো! রিয়েক্ট করার অনুরোধ র‌ইলো। শুকরিয়া!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here