#শুচিস্মিতা -৭
Tahrim Muntahana
~ এইভাবে অপমান করলো। জলে ভাসাইয়া দেয় নাই? আমার পোলা কি খারাপ, খানদানি বংশ আমরা। ওমন কালি মাইয়া, তার উপর কত গোমর দেখছো?
সারা রাস্তা রাগে গজগজ করতে করতেই বাড়ি এসে পৌঁছেছেন মিসেস নাজমা। বাড়ি আসার সাথে সাথেই খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। নিবিড়ের চোখে মুখেও স্পষ্ট রাগ, আনতারা’র ব্যবহার তার মুটেও পছন্দ হয়নি। শাশুড়িকে সাথ দিতে রিনু বললো,
~ আম্মা আপনে আর আগাইবেন না। ওই কালি কে কি পায়ে ধইরা নিতে হবে? কোন শেটের কাছে বিয়া হয় দেখমু। আমাদের পোলা যে ওই মাইয়া নিতে চায়ছে তাই ভাগ্য ভালো তালুকদার দের। তারপরেও কেমন কথা দেখছেন?
ঠিক এই কারণেই মেজ বউ কে মিসেস নাজমার পছন্দ। তার সব কথায় সাথ একমাত্র সেই দেয়। মিসেস নাজমা সোফায় বসে ফুঁসতে লাগলেন। এই টুকু কথাতে যে তার বেশ মানে লেগেছে তাই বুঝাতে তৎপর হয়ে গেলেন। বড় বউ পারভিন সবটা সময় চুপ ছিলেন। আনতারা কে তার মনে ধরেছে। ইশ কি মায়া মায়া মুখটা। তাই কালি বলায় তার খারাপ লাগছে। নিজের ঘরে চলে যেতে নিবে ওমনি মিসেস নাজমা বলে উঠলো,
~ বড় বউ শরবত বানাও তো । বরফ দিও, মাথাডা খুব গরম।
ক্লান্তিতে এমনিই শরীর চলছিল না, তার উপর মন টাও বেশ খারাপ। এমন সময় কথাটা তার হজম হলো না। কিছুটা রাগ মনে হয় মনের কোণে জমা হলো। রিনুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
~ রিনু শরবত টা একটু তুমি বানাও না, আমার বেশ খারাপ লাগতেছে।
মিসেস নাজমা’র এটাই পছন্দ না, তার কথা, তার হুকুমের বাইরে কেউ গেলেই তার চোখের কাঁটা হয়ে গেলেন। কাজের কথা শুনেই রিনু মুখটা মলিন করে শাশুড়ির দিকে তাকালেন। পারভিন আবার ঘরে যেতে নিবে মিসেস নাজমা থামিয়ে বললেন,
~ থামো বড় বউ। আমার কথার উপর কথা বলা পছন্দ করি না আমি। যাও শরবত বানাও, সবার জন্যই বানাবা।
পারভিনের রাগ টাও যেন এবার বাড়লো, চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়ে টাকেও জামা কাপড় ছাড়িয়ে ফ্রেশ করিয়ে দিতে হবে। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই কারো। রাগ নিয়েই পারভিন রান্না ঘরে ছুটলো, রিনু বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে শাশুড়িকে তেল মারতে লাগলেন। পুরো বিষয়টা চোখে দেখেও নিরব নিয়ন কিছু করতে পারলো না, শুধু মন খারাপ ছাড়া। নিবিড় তো নিজ ভাবনায় ব্যস্ত। পারভিন শরবত বানিয়ে আনতেই রিনু এক গ্লাস নিয়ে টপাটপ খেয়ে ফেললো। যদিও টক একটু বেশী হয়েছিল, তবে বেশ মজার। টক বেশী হওয়ায় মিসেস নাজমা কথা শুনাতেও ভুললেন না। হুট করেই নিবিড়ের রাগ বাড়তে লাগলো, এমনিই অপমানে তার শরীর জ্বলছিল তার উপর মায়ের এমন আহাজারি, এখন আবার টক শরবত। গ্লাস টা ছুড়ে ফেলে বলে উঠলো,
~ কি শরবত বানিয়েছো এটা। অখাদ্য! বানাতে পারো না বানাতে যাও কেন!
পারভিন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছে। মিসেস নাজমা নিবিড়কে কিছুই বললেন না, বরং পারভিনের দিকে চোখ রাঙানি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন পারভিনের ভুল। এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলেন না। সপাটে নিবিড়ের গালে চড় বসিয়ে দিলেন, তালুকদার বাড়িতে চুপ থাকার শাস্তিটাও যেন একসাথেই দিলেন। স্তব্দ সবাই, বড়বউয়ের এমন রূপ কেউ ই মেনে নিতে পারলো না, নিবিড় রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে পারভিন বললো,
~ খবরদার নিবিড়, খবরদার। আমি তোমাদের চাকরানি নয় যে আমার সাথে এরকম ব্যবহার করবে। সাবধান করে দিচ্ছি। আমাকে নরম পেয়ে যা ভেবেছো সেসব বাদ দাও। বড় ভাবির মতো সম্মান দিতে না পারলে অসম্মান করবে না, এভাবেই চড় পড়বে।
বাকি পড়ে থাকা শরবতের গ্লাস টা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো পারভিন। মেয়েকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নিজের রাগটা লুকিয়ে নিয়ে শরবতের গ্লাস টা এগিয়ে দিলেন। খুশি হলো বাচ্চাটা। অন্যদিকে মিসেস নাজমার রাগ যেন চরমে পৌঁছে গেছে। এতবড় সাহস হয় কি করে বড় বউয়ের? তার ই সামনে তার ছেলের গায়ে হাত তুলে। আজ একটা বিহিত করেই ছাড়বে।
…
~ মাইয়াডার উপর অন্যায় হয়ে গেল ফাতিনের মা। মাইয়া তো পড়তে চাইছিল, আর আমি নিজের মাইয়ার কথা ভাইবা ওর কথা ভাবলাম না। ছোড মনে হইতাছে নিজেরে।
মিসেস সেলিনা চুপ করে রইলেন, এমন টা তারও মনে হয়েছিল, ছোট থেকে কষ্টের মাঝেই বড় হয়েছে। স্বপ্ন আকড়ে যখন বাঁচতে চেয়েছিল তখনই আবার বিয়ের কথা উঠলো। আবার যখন নিজের মেয়ের কথা আসে তখন আর আনতারা’র কথা মনে আসে না। তার উপর ফাতিনের কর্মকাণ্ডে মন টা আরো বিষিয়ে গেছে। যদিও এতে আনতারা’র দোষ নেই। ফরিদ তালুকদার স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়েন। দৃষ্টি ঘরে ছাদের দিকে। মিসেস সেলিনা বললেন,
~ আনতারা তো ভালোয় থাকবো ফাতিনের বাপ। মাইয়া বিয়ে দিতে কম বেশী টেকা খরচ করতেই হয়। আর যদি মাইয়া হয় একটু নিম, তাহলে তো দুইগুণ টেকা লাগে ছাড়াতে। আনতারা শিক্ষিত মানুষ এরকম কিছু মানবো না কিন্তু আমরা তো জানি এখনো টেকা ছাড়া কিছুই হয় না। তার উপর ফারাহ’র শাশুরিরে যেমন দেখলাম, ওই বেডি উঠতে বসতে কথা শুনাইবে আমার মাইয়া রে। নাহার কি ভাবে বললো জলে ভাসাইয়া দিতাছি? আমরা কি আনতারা রে পর ভাবি?
শেষের কথাটা খানিক করুণ শুনালো মিসেস সেলিনার। ফরিদ তালুকদার ও বুঝেন, কিন্তু শিক্ষিত মেয়ে রা যে বুঝতে চায় না। বই পড়ে পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করে তারা শিক্ষিত হয়। কিন্তু তারা জানে না যুগ আপডেট হলেও সমাজ ব্যবস্থা আপডেট হলেও সমাজের মানুষের মনোভাব এখনো পরিবর্তন হয়নি। কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, মেয়েদের পড়তে না দেওয়া, ছেলেদের থেকে মেয়েদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, বিয়ের সময় যৌতুক দেওয়া-নেওয়া এসব এখনো বর্তায়মান। যৌতুক কে না বলি, সচেতন হই এমন স্লোগান দেওয়া মানুষ রাও গোপনে যৌতুক নিয়েই বিয়ে করে। নাহলে যৌতুক দিতে না পারাই এত এত নারীকে নির্যাতনের শিকার হতে হতো না, সংসার ছাড়তে হতো না, মেয়ে বিয়ে না দিতে পারায় মেয়ের বাবাকে কোণঠাসা হয়ে পড়তে হতো না। ‘আমরা কিছুই নিবো না, কিছুই চাই না; আপনারা আপনাদের মেয়েকে যা দেন!’ কথাটা শুনতে কত ভালো লাগে, মেয়েকে যা দেন! অথচ এই একটা কথাতেই মেয়ের বাবার মাথায় কতশত চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তারাও হয়তো জানে, বুঝতে পারে তবে মানতে চায় না। আজকের সমাজ এখনো পরিবর্তন হয়নি, মানুষ যে নিজ নিজ স্বার্থে তৎপর!
…
শরতের বৃষ্টি! ভাদ্রের নীলাকাশে যেমন রোদ্দুর খেলা করে তেমনি মাঝে মাঝে ক্ষণিকের জন্য বৃষ্টিপাত হয়। পূর্ণিমায় আলোকিত আকাশ টা হুট করেই মেঘে ঢেকে গেল, শুরু হলো ঝিরঝির বৃষ্টি। ছন্দ মিলিয়ে আছড়ে পড়তে লাগলো মাটিতে। প্রকৃতি সতেজ হয়ে উঠলো, সূর্যের তাপে ঝরে পড়তে চাওয়া পাতা গুলোয় যেন প্রাণ সঞ্চার হলো। ধুলোবালি মেশানো প্রকৃতি নিপুণ মায়ায় আচ্ছন্ন হলো। কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটি আঁধারে ঢাকা মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেলকনিতে, বৃষ্টি ফোঁটা গুলো পরম মমতায় ভিজিয়ে দিচ্ছে মুখশ্রী, গলা, বুক, দু হাত! মাঝারি বাতাসে কোমরের উপরে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়ছে, ইশশ কি মায়াময় রূপ খানা। কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটির আদল যে এতটা নজর কাড়া লাগবে মেয়েটি যদি জানতো নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে হয়তো পারতো না। আনতারা দৃষ্টি তখন অদূরের ওই ফসলি মাঠে, খানিক পর পর দৃষ্টি টা ঘুরে তাজওয়ার বাড়িতেও যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে সে জানে না, তবে কেন জানি মনে হচ্ছে রাশিদ নামক মানুষ টা আজ থাকলে তাকে এই পরিস্থিতি তে পড়তে হতো না। নিজের ভাবনার উপর নিজেই খানিক বিরক্ত আনতারা, তবে মস্তিষ্ক আজ বেহায়া হয়ে গেছে। তাজওয়ার বাড়ি থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে পাশের পুকুরটাই দৃষ্টি ফেলে আনতারা। বাগানে লাগানো লাইটের আলো পুকুরের অনেকাংশ দৃশ্যমান। পুকুরের স্বচ্ছ পানির বুকে শুভ্র শাপলা’রা লুটোপুটি খাচ্ছে। আনতারা’র মনে হয় শাপলা গুলো হাসছে। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে মন খুলে হাসছে, পাগল করা হাসি! প্রিয়জন দের হৃদয়কাড়া হাসির মতোই মনে হচ্ছে আনতারা’র। প্রিয়জন বলতে যে আনতারা’র মনে রাশিদের কথাটা উদয় হলো, ভেবেই আনতারা বিস্মিত হয়ে গেল। এসব কি ভাবছে সে? এসব ভাবা বারণ, এসব ভাবা অন্যায়! ঝটপট শাপলার উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে। ঝিরঝির বৃষ্টি কমে এসেছে, একটু পর হয়তো থাকবেও না। আনতারা ঘরে চলে গেল। ভিজে একাকার হয়ে গেছে। পোশাক পাল্টে আনতারা বসলো পড়ার টেবিলে। তাকে পড়তে হবে, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পড়তে হবে।
আনতারা যখন একেবারে ডুবে গেছে পড়ায়, টের পেল কেউ তার দরজা ধাক্কাচ্ছে। আনতারা বুঝলো তার আপায় এসেছে। আবার পড়ায় মন দিলো। বড্ড অভিমান হয়েছে যে। তার আপায় কি করে তার সাথে এমন করলো? তাকে একটিবার জিজ্ঞেস করলো না সে কি চাই! বিয়ের পর আনতারা’ও পর হয়ে গেছে। সংসার আপন করে নিতে আপায় তার ‘তারা’ কে ভুলে গেল? কি করে পারলো? সে দরজা খুলবে না কিছুতেই। সত্যিই খুললো না, অনেকটা সময় দরজা ধাক্কা দিয়ে ডেকে ফারাহ চলে যায় ঘরে। আনতারা’র পড়তেই থাকে। রাত সাড়ে দশটা বাজতেই আনতারা’র খুব চা খেতে ইচ্ছে করে, তবে বাইরে যাবে না বলে টেবিল ছেড়ে উঠে খানিক সময়ের জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ভালো লাগছে!
টুং টুং শব্দ করে ফোন বেজে উঠে, আনতারা চমকায়। তার মন বলছে ফোন টা রাশিদ ছাড়া কেউ করে নি, আলসেমি হাতে ফোন তুলে নিতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। ফাতিন ভাই তাকে ফোন দিয়েছে? ঝটপট ফোন তুলে কানে ধরে,
~ পড়ছিলি আনতারা?
~ আমার আর কি কাজ ফাতিন ভাই? ঠিকঠাক পৌঁছেছেন?
~ ঠিকঠাক? হয়তো!
হেয়ালি কথা বুঝতে পারে না আনতারা। এভাবে কথা বলছে কেন ফাতিন ভাই? ফাতিন আবার বললো,
~ আমাকে তোর মনে পড়েনি আনতারা?
~ আপনার যাওয়ায় একটু মন খারাপ হয়েছিল ফাতিন ভাই, এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন কেন?
ফাতিন হাসে। প্রেয়সীর তাহলে তার জন্য মন খারাপ হয়? হয়তো আনতারা’র ভাই বা বন্ধু হিসেবেই মন খারাপ হয়েছে তবে তার যে সুখ লাগছে। হুট করেই আনতারা’র মনে ফাতিন ভাই থাকলে কি আজ নিজেও বোনের সংসারের কথা চিন্তা করতো? হয়তো তাই করতো! সে আর এমনকি,
~ ফাতিন ভাই! আপনিও কি চান যৌতুক দিয়ে আমার বিয়ে হোক?
ফাতিন চমকে উঠে। কি বলে তার কৃষ্ণমায়া? সে তো চায় মেয়েটিকে নিজের করতে। কিছু হয়েছে আজ? চটজলদি বললো,
~ কি হয়েছে আনতারা? তোর বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন?
আনতারা বুঝলো ফাতিন জানে না। তার জানাতে ইচ্ছে করলো, তার বোনের স্বার্থপরতার কথা জানাতে ইচ্ছে করলো। অভিমানী কন্ঠে বললো,
~ আপায় এসেছে আজকে। তার দেবরের সাথে আমার বিয়ের কথা বলতে। যৌতুক দিতে হবে! আপনিও কি এতে সাথ দিবেন ফাতিন ভাই? বোনের সংসার তো বাঁচাতে হবে!
চোখ বুজে নেয় ফাতিন। নিবিড়ের চাহনী দেখে তার মনে হয়েছিল পছন্দ করেছে আনতারা’কে। তবে এই পছন্দে যে স্বার্থ মিশে আছে বুঝতে পারে নি। খুশি হলো ফাতিন। যৌতুক চেয়েছে বলেই প্রেয়সীর বিয়েটা আটকে গেল। সত্যিই কি আটকে গেল? বাবা-মা নিশ্চিত রাজী হবে। তার মা কি তার মনের কথা জেনেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? কি করে পারলো? একটা বার ও তার কথা ভাবলো না? টুট টুট শব্দে ফোন কেটে গেল। আনতারা হুট করেই হাসলো। সবারই স্বার্থ!
নিজ ঘরে পাইচারি করছে ফাতিন। কি করে প্রেয়সীর বিয়ে দেখবে? কি করে মানবে সে? তার মা এমন করতে পারলো কিভাবে? নানান চিন্তা মাথায় নিয়ে দারুণ অশান্তিতে ভুগছে সে। এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে গ্রামে। চোখ বসিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। তার কৃষ্ণমায়া কি আজ কেঁদেছে? চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে? কেমন লাগছে তার কৃষ্ণমায়া কে? মাথা চেপে বসে পড়লো বিছানায়। আফসোস হচ্ছে, চরম আফসোস তাকে ঘিরে ধরেছে। কেন সেদিন থমকে গেল? কেন নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনলো? সে মেয়েটিকে কি সত্যিই ভালোবাসে? না বাসলে বুকে চিনচিনে ব্যাথা হবে কেন? এত হাঁসফাঁস লাগবে কেন? গ্যালারি হাতড়ে ছবি বের করে। ইতিমধ্যে কৃষ্ণমায়া’র একটা ছবি স্থান করে নিয়েছে ফাতিনের ফোনের ওয়ালপেপারে! যখন ই ফোনটা জ্বলে উঠবে তার কৃষ্ণমায়া’র মুখখানা দেখবে, মুগ্ধ হবে চোখ, শান্ত হবে মন! কাশগুচ্ছের শুভ্রতার মাঝে আরেক শুভ্রতা কে দেখে ফাতিন হাসে। মায়া মায়া চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে হিসাব করতে পারে না। সময় যেন কোন ফাঁকে চলে যায় ধরতে পারে না। চোখে ঘুম নেমে আসে, বুজে আসে চোখ, ছোট ছোট চোখ জুড়াতেও কৃষ্ণমায়া’র মুখটা ভাসে। বিড়বিড় করে,
~ ওহে কৃষ্ণমায়া,
আমি তোমায় ভালোবাসি নি, শুধু
খানিকটা সময় থমকে গিয়েছিলাম। এই খানিক সময় টা হয়তো আমৃত্য!
…
~ তুমি মেয়ে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায় না কিন্তু চোখ বুঝলেই কেন দেখতে পাই? তাহলে কি আমি এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি?
কি অনুভুতি তে ঠাসা কথাগুলো, কি মায়ামাখা কন্ঠ! চোখ বুজে নেয় আনতারা। আপনমনে কালকের সকালের কথা ভাবতে ব্যস্ত আনতারা’র ভাবনায় ছেদন ঘটে ফোনের কর্কশ শব্দে। আবার যন্ত্রটি বেজে উঠেছে। চোখ বুলাতেই রাশিদের নম্বর টা চোখে পড়ে। সেইভ করে নি, কেন করেনি সে জানে না। ইচ্ছে হয় নি, মুখস্থ তো আছেই; কি দরকার! দোটানা নিয়েই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। তখনি ভেসে আসে পরিচিত কন্ঠের বুলি। আনতারা’র কথায় যে রাশিদ ফেরত দিলো সে ঢের বুঝতে পেরেছে। উন্মাদনা ছাড়াতে কথাটা বলেও লাভ হয়নি। আনতারা বললো,
~ আর কতদিন ভবঘুরে থাকবেন রাশিদ ভাই। এবার তো গোছানো শুরু করুণ!
~ আমার গোছানো মানেই যে তোমার থেকে দূরে যাওয়া! এই গোছানোতে আমার মরণ লেখা আছে শুচিস্মিতা। এত তাড়াতাড়ি আমি মরতে চাইনা। তোমার সাথে সংসার করা বাকি যে!
মানুষ টার সবকিছু তেই যেন শুচিস্মিতা। কথার পৃষ্ঠে কথা বলার কিছু খুঁজে পায় না আনতারা। চুপ করেই থাকে। রাশিদ আবার বলে,
~ বাবার বেশ টাকা আছে, আমাদের সংসার চলে যাবে বলো?
~ আপনার বাবার টাকা আছে, আমার বাবার আফসোস! তার আমার মতো একজন মেয়ে আছে যে! যাকে অন্ধকারেই মানায়!
থামে আনতারা, অপর পাশের রাশিদ ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এসব কথা তার শুনতে ইচ্ছে করে না। তবুও মেয়েটা বার বার বলে। আনতারা আবার বললো,
~ আপনাকে অন্ধকারে মানায় না রাশিদ ভাই। আপনি আলো তে মানানসই।
বিরক্ত হয় রাশিদ। আর কত রিজেক্ট করবে এই মেয়ে? ইঙ্গিতে কি সুন্দর বুঝিয়ে দিল মেয়েটা তার সাথে যায় না। অথচ তার এই মেয়েটিকেই চায়, এই মেয়েটিই তার আলো। এই মেয়ে হীনা যে সে অন্ধকারে ডুবে যায় মেয়েটা কবে বুঝবে? আদও বুঝতে পারবে? ধমকে বলে উঠে,
~ চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। কথা বলার সুযোগ দিয়েছি বলে ভাষণ দেওয়া শুরু করেছিস। তোকে এত কিছু বুঝতে কে বলেছে? এক চড়ে ভিমরতি সব ছাড়িয়ে দিবো।
আনতারা হেসে উঠে খানিক শব্দ করেই। অনেকটা দিন পর রাশিদের এমন রূপ দেখলো। প্রেমে পড়ে বেচারা তো তুই বলতে আর ধমকাতেই ভুলে গেছে। আনতারা’র কেন জানি শান্তি শান্তি লাগছে হঠাৎ করে। আনতারা’র হাসিতে রাশিদ নিভে গেল। বিরক্তি ভাবটাও কোথায় হারিয়ে গেল টের পেল না। ইশ এই হাসিটা যদি সম্মুখে দেখতে পারতো, মুগ্ধ হতো সে, হয়তো আবার মরতো! একদম বুকে খুদায় করে রাখতো। শুচিস্মিতা নামটা যে আবার সার্থক হতো! সার্থক হতো তার দু নয়ন! পুরো জীবনটাই সার্থক হয়ে যেত! নরম কন্ঠে বললো,
~ তোমাকে এমন হাসিতেই মানায় শুচিস্মিতা। খুশিতে মরে যাই! এমন মরা আমি হাজার বার মরতে চাই! একটু একটু করে সুখ কুড়াতে চাই!
…
“এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে,
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে!”
শরতের অনুপম সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আনমনে সুর তুলেছিলেন। শরতের অপূর্ব ভালো লাগার দৃশ্য, শরতের নজর কাড়া প্রকৃতির বর্ণনা করতে কবি-সাহিত্যিকরা এমন শত শত কবিতা রচনা করেছেন। নিপুণ হাতে কলমের ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন শরতের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য। কাল রাতের বৃষ্টির পর প্রকৃতিতে সকাল এসেছে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া নিয়ে। মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো নেচে উঠছে। স্বভাবতই আজও সকালের আবহাওয়া গাঁয়ে মাখতে বেরিয়েছে আনতারা। প্রকৃতির উপচে পড়া মায়াতে আনতারা’রও কবিদের মতো কবিতা রচনা করতে ইচ্ছে করছে।
‘শরত তুমি এনেছো প্রকৃতির অপার মায়া! শরত তুমি দিয়েছো অপার ভালোবাসা!
শরত তুমি কখনো কাঠ ফাটা রোদ!
শরত তুমি কখনো আঁধার মেঘের ঢোল!
শরত তুমি খুলেছিলে কারো মনের দাঁর!
একটু খানি দিয়েছিলে এই অভাগির স্থান!
শরত তুমি বুঝিয়েছিলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!’
শরত যেন মেয়েটার সকল অনুভূতির স্মারক! শরত তাকে কারো মনে জায়গা দিয়েছিল, আবার এই শরত ই তার জায়গাটা ঠিক কোথায় বুঝিয়েছে। পুকুরের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জোরে শ্বাস নেয় আনতারা। হুট করেই কবিতাটা রচনা করতে পেরে খুশি হওয়ার কথা ছিলো, তবে সে খুশি হতে পারছে না। তালুকদার বাড়ির শিউলিতলায় বাচ্চা দের ভিড় জমেছে। শিশিরভেজা শিউলি ফুলগুলো অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে ঘাসের বুকে হাসছে। মক্তব ঘর থেকে ফেরার সময় বাচ্চারা এখানেই দাঁড়ায়, ছোট ছোট হাতে শিউলিফুল গুলো তুলে নিয়ে বাঁকা দাঁতের হাসি দেয়। কি সুন্দর দৃশ্য। মন, প্রাণ জুড়িয়ে যায় যেন। আনতারা বিষাদ মনেই দৃশ্যটা অবলোকন করলো, একটু হলেও মন খারাপেরা পালিয়ে গেল না। বরাবরের মতো আজ তার পিছু কেউ নেয়নি! আজ কেউ পথ আগলে দাঁড়ায় নি। আজ কেউ মনের কথামালা গুলো তাকে শুনায়নি। আনতারা’র স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার কথা ছিলো। তাহলে কেন হতাশার শ্বাস বের হচ্ছে? তাজওয়ার ভিলাটা একনজর পরখ করে তালুকদার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে সে। এতক্ষণে হয়তো সবাই উঠে পড়েছে। কাজে যাওয়ার আগে হয়তো আবার তাকে নিয়ে আলোচনায় বসবে। আজ তাকেও থাকতে হবে। তাকে কেউ বলেনি, নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার জীবন কেউ এলোমেলো করে দিবে সে তো এটা হতে দিতে পারে না! সবাই সুখের পেছনে ছুটে! সে কেনো জেনে বুঝে দুঃখকে বরণ করে নিবে?
বাড়িতে ঢুকেই টের পেল তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আনতারা কে দেখে ফারাহ এগিয়ে আসতে নিতেই আনতারা মিসেস কামরুন্নাহার কে বলে উঠলো,
~ ছোটচাচি আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিবে? ভিষণ খেতে ইচ্ছে করছে!
কথাটা বলেই কামরুন্নাহারের পিছু নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ফারাহ বুঝলো আনতারা তাকে এড়িয়ে চলছে। মলিন হয়ে গেল মুখ, মিসেস সেলিনা মেয়ে কে কাছে টেনে বসালেন। আনতারা চায়ের কাপ নিয়ে বের হতেই ফরিদ তালুকদার বললেন,
~ তোমার মতামত কি মা? না করে দিবো?
আনতারা নিবিড় চোখে তাকালো বড়চাচার দিকে। ফরিদ তালুকদারের দৃষ্টি নিচু। আনতারা’র খারাপ লাগলো তাই নিচু স্বরে বললো,
~ যৌতুকের বিয়ে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না বড়চাচা। যারা প্রথমেই আমার দিকে আঙুল তুলে বুঝিয়ে দিয়েছে আমি তাদের পরিবারের যোগ্য নয়! তাদের পরিবারে যাওয়ার আগে তো মরে যাওয়া ভালো।
স্পষ্ট ক্ষোভ। ফরিদ তালুকদার আর কিছু বললেন না। মেয়ে হয়তো ঠিকই বলেছে। আবার তারাও ভুল না, কুটুমবাড়িরাও হয়তো ভুল না। সমাজব্যবস্থা ভুল! আহনাফ তালুকদার মানলেন না। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
~ তুমি নিজেও জানো এখন এমনই হয়ে আসছে। তার পরেও জেদ করছো কেন?
তুমি বুঝতে পারছো না তোমার বোনের সংসার জড়িয়ে আছে এখানে?
~ আমি আগেই বলেছি আমি কালো, অন্ধকার আমার এতে কোনো আফসোস নেই। কালো বলে যৌতুক দিয়ে পরের বাড়ি যেতে হবে? তাহলে তাদের বলুন ছেলেকে ঘর জামাই পাঠাতে। মানে কাপুরুষের মতো যৌতুক ও নিবে, আবার রাজার মতো সংসারের কর্তা সাজবে। এসব আমার সাথে চলবে না। আমি পড়ালেখা করতে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, আমার একটা নিজস্ব স্বপ্ন আছে। সংসারে গেলে আমার স্বপ্ন তখন ফাঁকফোকর দিয়েও আমার কাছে ধরা দিবে না। তাই বিয়ের চিন্তা বাদ দিন, আপনাদের কাছে যদি বোঝা হয়ে থাকি তাহলে সরাসরি বলুন, আমার রাস্তা আমি নিজে খুঁজে নিবো। আল্লাহ দুটো হাত আমাকে দিয়েছেন!
থামলো আনতারা। ছোট চাচা চাচির দিকে তাকালো, তাদের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি বিরাজ করছে; আনতারা’র মনটা এক ছলকায় ভালো হয়ে গেল। এই দুটো মানুষ তো তার পাশে আছে, আর কি চাই? আবার বললো,
~ এখন আসি শেষের কথায়, বোনের সংসারের কথা আমি অবশ্যই ভাবতাম যদি বোন আমার কথা ভাবতো! সে ভাবেনি, সংসার তার বড় হয়ে গেছে, দেবরের কথায় বোনের স্বপ্নের কথা জানা সত্যেও তাদের বাড়ি পর্যন্ত এনেছে, যৌতুক দেওয়াতেও সায় দিয়েছে; যা আমার সাথে যায় না। সর্বোপরি আমার আত্মসম্মানে আঘাত দিয়েছে আপায়! আমার আর কোনো দায় থাকার কথা না!
রেগে ফেটে পড়লেন আহনাফ তালুকদার। মেয়ের মুখে বুলি ফুটেছে! এত বড় সাহস তাদের মুখের উপর বড় বড় কথা বলে। মানুষের রাগ আজব। প্রিয় মানুষটা হাজার কথা বললেও রাগ ধরা দেয় না, অথচ একই রকম অথচ কম কথা অপ্রিয় মানুষ টা বললে সহ্য হয়না। আহনাফ তালুকদার গর্জে উঠলেন,
~ তুমি যেহেতু নিজের টাই ভাববে, একটা টাকাও দেওয়া হবে না তোমার পড়ালেখার জন্য। আমিও দেখবো তুমি কি করে পড়ালেখা চালিয়ে যাও। স্বার্থপর মেয়ে।
উঠে চলে যেতে ধরলেন আহনাফ তালুকদার। আনতারা শব্দ করে হেসে বললো,
~ আমি মেয়ে
ভালোবাসতে পারি, তীব্র অবহেলাও সইতে পারি, শক্ত হাতে হাত রেখে অন্যকে চলার সাহস দিতে পারি, অপমান-বঞ্চনা নিয়েও বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু, একবার আত্মসম্মানে একটুখানি দাগ লাগলে আগ্নেয়গিরির থেকেও ভয়ানক উত্তপ্ত রূপ ও ধরতে পারি।
একটা কথায় যেন বাবার বিরুদ্ধে মেয়ের যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে দিল। সাথে দিল আনতারা’র ভিন্ন রূপের খবর। মেয়েটা কেমন শান্ত স্বরে জটিল উক্তি গুলো বলে যাচ্ছে। মিসেস কামরুন্নাহার অবাক না হয়ে পারলেন না। আনতারা কে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলেন,
~ আমার মেয়েকে আমি পড়াবো। সংসারের ভিড়ে যে চাকরি টা ছেড়েছিলাম; দরকার পড়লে আমার বড় মেয়ের জন্য ওই চাকরি টা আবার শুরু করবো। তবুও আমার বড় মেয়ে পড়বে। জয়ী একদিন হবে!
আনতারার কাঁধে থাকা স্ত্রীর হাতের উপর আমির তালুকদার হাত রাখলেন। নিরবে বুঝিয়ে দিলেন এই সংগ্রামে সেও আছেন। আহনাফ তালুকদার রেগেমেগে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন। ফরিদ তালুকদার ও তার স্ত্রী অবাক হয়ে শুধু দেখলেন। কি থেকে কি হলো কিছুই বুঝতে পারলেন নি তারা। ফারাহ একরাশ অনুশোচনা নিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলো। বোনকে নিজের সাথে রাখতে, কাছাকাছি রাখতে একি ভুল সে করে ফেললো! আগে বুঝলে এমন করতো না সে। বাড়ির বাকি দু সদস্য কেয়া কিরণ চুপচাপ শুধু দেখে গেল। তবে তাদের মুখে নিশ্চুপতার হাসি। হয়তো প্রিয় আপায়ের পাশে তাদের মা বাবা কে দেখে তাদের মনেও বাবা-মা’র প্রতি সম্মান বৃদ্ধি পেল। একটা বাড়ি, কয়েকজন মানুষ। কিন্তু অনুভূতি গুলো ভিন্ন। একেক জনের মনে একেক দৃশ্য ভাসছে, একেক ভাবনা খেলা করছে! জীবন বুঝি এমন বিচিত্রময়? হয়তো!
চলবে…?
( রিয়েক্ট করার অনুরোধ রইলো।)