#শুধু_তুই
—-(সিজন২)
#পর্বঃ১৯
#Rifat_Amin
‘ এই রশ্নি, উঠে পর বলছি। ফজরের আজান হয়ে গেছে ‘ (প্রহর)
ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে চোখটা খুলেই সামনে প্রহরভাইয়ের ছোট ছোট একজোড়া চোখ আবিষ্কার করলাম। আমাকে দেখেই ছিটকে সড়ে গেলেন উনি৷ মাথার উপর টিনের চালা। তার একসাইডে সোলার প্যানেলের লাইট জ্বলছে। তাতে রুমের অন্ধকার খুব একটা কমছে না।
‘ তোকে ঘুম থেকে তুলতে একটা লোক রাখা লাগবে, বুঝলি। এভাবে কেউ ঘুমায়? কতক্ষণ থেকে ডাকছি!’ (প্রহর)
‘ একটু আগেই তো ঘুমালাম। তাই সমস্যা হচ্ছে। মাথাটা ধরেছে ভীষণ৷ একটু ঘুমাতে দিন তো। ‘ (আমি)
মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করায় চোখ বন্ধ করে থাকলাম। আমি উনার স্ত্রী! আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে৷ হঠাৎ কথাটা মনে উঠতেই সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। নিউরনে নিউরনে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো জানিয়ে দিলো আমি উনার স্ত্রী। আশ্চর্য! আমার ঘুম পালিয়ে গেলো। চোখখুলে দেখলাম বিছানায় কেউ নেই। কোথায় গেলেন উনি! আমি সব চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম প্রহরভাইয়ের গাড়িতে। চারপাশে দিনের আলো গাঢ় হয়েছে। সকালের মিষ্টি সূর্য কিরণে ঝলমলিয়ে উঠলো গতকালকের বৃষ্টিতে সতেজ হওয়া মেহগনির সদ্য জন্মানো পাতাগুলো। পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভেঙেছে বলেই মনে হলো। গাড়ির ভীতরে উনাকে দেখলাম না। আচ্ছা আমি গাড়ির ভীতর আসলাম কিভাবে!
ড্রাইভিং সিটে আমার ফোনটা দেখতে পেয়ে হাতে নিলাম। সকাল ৮ টা ০৩। বাপ্রে! এতক্ষণ ঘুমালাম কিভাবে। হঠাৎ উনি গাড়ির লক খুলে ভীতরে ঢুকে পড়লেন। ক্লান্ত কন্ঠে বললেন,
‘ ঘুম রাণীর ঘুম হলো? ‘ (প্রহর)
আমি হা হু জবাব না দিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। বিয়েটা হওয়ার পর থেকে নিজের মধ্যে একটা সংকোচ কাজ করছে। না পারছি একটু শান্তিতে কথা বলতে। না পারছি কথা না বলে থাকতে। উনি গাড়ি স্টার্ট করে বললো,
‘ কথা বলছিস না কেন? কালকের ঘটনার জন্য মন খারাপ? ‘ (প্রহর)
‘ জি ‘ (আমি)
‘এখানে মন খারাপ করার কি আছে? তুই আমি দুজনেই এর জন্য দায়ী না। তাই নিশ্চিন্তে থাক। সামনে যা হবে ভালোই হবে। ‘ (প্রহর)
চাইলেই কি নিশ্চিন্তে থাকা যায়? আমি কথা ঘুরানোর জন্য বললাম,
‘ আচ্ছা আমি না রুমের ভীতর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখানে আসলাম কিভাবে। ‘ (আমি)
উনি ইতোমধ্যে গাড়ি চালানো শুরু করেছেন। এটা একটা সরু গ্রাম্য পিচঢালা রাস্তা। তার চারপাশে সোনালী ধানের ক্ষেত। উনি কথার জবাবে বললেন,
‘ এটা ঢাকা না রশ্নি। এটা গ্রাম। ফজরের নামাজ পরে যদি এলাকার মুরুব্বীরা এখানে আমার গাড়ি দেখে তাহলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই তখন আমি ঐ লোকটার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম। উনি ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছিলেন। উনাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে হলো। আর এসে দেখি তুই ঘুমিয়ে আছিস। তাই আর ডাকতে ইচ্ছে হলো না। একটা মোটা হাতিকে কোলে করে গাড়িতে উঠাতে হলো। তবুও তাঁর ঘুম ভাঙলো না। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। এখন একটু ঘুমাতে হবে বুঝলি। শরীর ঢুলছে। ‘ (প্রহর)
উনি আমাকে কোলে নিয়েছিলেন শুনতেই লজ্জায় লাল-নীল হয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে হাতি সম্মোধন করায় চটে গিয়ে বললাম,
‘ আমি মোটেও হাতির মতো না প্রহরভাই। আপনি একটা হাতি। আপনার বউ-বাচ্চা সবাই হাতি। ‘ (আমি)
‘ আমার বউ হাতি সেটা ভালো করেই জানি। কিন্তু বাচ্চা আসলো কোথা থেকে? মাত্র তো বিয়ে হলো। ‘ (প্রহর)
ক্ষেপে গিয়ে আরো কিছু বলবো তার আগেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপসে গেলাম। নিজের গালে কয়টা থা’প্প’ড় মা’র’তে ইচ্ছে হলো। আচ্ছা উনি কি আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলেন!
গাড়িটা এখন মেইনরোড ধরেছে। সামনে একটা বাজার থাকায় উনি গাড়ি থামালেন। পেছনের সিট থেকে কয়েকটা থ্রি-পিস হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ চেন্জ করে নে। আগের পোশাকে থাকলে শরীর খারাপ করবে। ‘ (প্রহর)
‘ ছিহহ! এই গাড়ির মধ্যে কেউ ড্রেস চেন্জ করে। ‘ (আমি)
‘ কেউ না করলেও তুই করবি। আমি গাড়ি লক করে একটু হোটেল থেকে খাবারের ব্যবস্থা করছি। আর বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে কেউ আছে কি না। সো নো প্রবলেম। ‘ (প্রহর)
‘ কিছু ঠিক নেই। আমি পারবো না ‘ (আমি)
প্রহরভাই লক খুলে বের হয়ে বললেন,
‘ তুই না পারলেও সমস্যা নাই। খাবার নিয়ে এসে যদি দেখি তুই চেন্জ করিসনি। তাহলে কিন্তু প্রহরখান নিজেই চেন্জ করার দায়িত্ব নিবে। ‘ (প্রহর)
‘ কি অসভ্য মানুষ! ‘ (আমি)
—
উনি হু’ম’কি দিয়ে খাবার আনতে গেলেও আমি এখনো চেন্জ করার সাহস পাই নি। বারবার মনে হচ্ছে কেউ গাড়ির সামনে এসে যাবে। আমি গাড়ির দরজা চেক করে দেখলাম লক করে গেছেন। ইতিমধ্যে পাঁচ মিনিটও কেটে গেছে। এখন রাত হলেও একটা কথা ছিলো। হঠাৎ উনি লক খুলে ভীতরে ঢুকে বললেন,
‘ আমি জানতাম তোকে দিয়ে হবে না । এখন আমাকেই হেল্প করতে হবে। ‘ (প্রহর)
উনার কথা শুনতেই চিৎকার দিয়ে বললাম,
‘ না প্লিজ! আমি চেন্জ করছি। আপনি বাইরে যান। ‘ (আমি)
উনি কথা শুনেও শুনলেন না। নিজের হোয়াইট শার্টটার বোতাম খুলতে লাগলেন উনি। আমি ভয়ভয় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে পিছিয়ে গেলাম। মনে মনে দোয়া দরুদ পাঠ করতে লাগলাম। পুরো শার্টটা খুলে আমার দিকে নির্লজ্জ মার্কা হাসি দিয়ে বললেন,
‘ গাড়িতে এভাবেই চেন্জ করতে হয়। নিজের মাইন্ড থেকে নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা সামনের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আয় ‘ (প্রহর)
আমার ভয় কাটলো। সাথে সাথে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো আমার। আঁড়চোখে উনার ফর্সা উদম বক্ষের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি পেছন সিট থেকে একটা সাদা টিশার্ট বের করলেন। ওটা গায়ে পড়তেই চোখ সড়িয়ে নিলাম আমি। কি দরকার ছিলো টিশার্ট পড়ার! গাড়িতে আপনার বউ ছাড়া তো আর কেউ দেখার নেই। উহু ঢং! এত কিসের সাদা শার্ট, টিশার্ট, পান্জাবী। সাদা ছাড়া উনার লাইফে কি কিছু নাই!
‘ এভাবে তাকিয়ে আছিস যে? প্রেমে পড়েছিস বুঝি? ‘ (প্রহর)
‘ আপনার মতো মানুষের প্রেমে পড়বে এই রশ্নি আহমেদ? আসতাগফিরুল্লাহ!! আর প্রেমে পড়েই বা লাভ কি? আপনি তো আমাকে ডিবোর্স দিবেন। ‘ (আমি)
উনি কথা বললেন না। হঠাৎ কি হলো জানি না। চেন্জ করার কথা বলে গাড়ির দরজা প্রচন্ড গতিতে বন্ধ করে বেড়িয়ে গেলেন। মহুর্তেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো আমার। কি অদ্ভুত মানুষরে বাবা।
—-
প্রহরভিলায় খুশির বন্যা বইছে। সবার মুখেই তিনদিন পর যেনো হাসির দেখা মিললো। আর প্রহরের মায়ের তো খুশিতে কেঁদে দেয়া অবস্থা। সকাল সকাল কোথা হতে প্রেয়সী হাজির হয়েছে। এখন যে যেভাবে পারছে নানা ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। কিভাবে হারিয়ে গেলো ও। আর ফিরলোই বা কি করে? প্রেয়সী শুধু বলেছে ‘ একতা মামা আমাকে ভাইয়াল কনসাল্ট দেখার জন্য চিতাগং নিয়ে গিয়েচিলো। মামাতা অনেক ভালো। কিন্তু কনসাল্ট দেকাই হয়নি। তাই প্রহরভাইয়া নাকি আমাকে বাসায় ফিরতে বলেছে। তাই মামাতা আমাকে সকালে এখানে এনেছে। ‘
সবার মাথা থেকে চিন্তা খুব একটা কমলো না। ঐশী ওকে কোলে নিয়ে বললো,
‘ কোন মামারে তোর? ‘ (ঐশী)
‘ আমি তো জানি না। তবে মামাতা অনেক ভালো। ‘ (প্রেয়সী)
‘ কেউ ডাকলো আর তুই ওমনেই তাঁর সাথে চলে গেলি! ‘ (ঐশী)
প্রেয়সী না বুঝে হা করে চেয়ে রইলো। তিনদিন পর নিজের মেয়েকে ফিরে পেয়ে চুমুতে ভাসিয়ে দিলেন ওর আম্মু। ওর বাবাও যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তবে চিন্তা খুব একটা কমলো না। সবার মুখে মুখে হাসি থাকলেও সারার এখনও মন খারাপ। প্রেম ঢাকা ফিরেছে বলে সে নিজেও ফিরতে চেয়েছিলো। কিন্তু এসে দেখে প্রেম নাকি আবার চিটাগং রওনা হয়েছে। প্রেম যদি প্রেয়সীকে আনতেই চিটাগং যায়। তাহলে প্রেয়সী কিভাবে আসলো!
—–
ড্রেস চেন্জ করে ফ্রেস হয়ে নিলাম আমি। এখন অনেকটা হালকা লাগছে নিজেকে। মুডটাও ফ্রেস হলো। উনার গাড়িতে তো দেখি সবকিছুর ব্যাবস্থা আছে। খাবার থেকে শুরু করে জামা কাপর । সাথে মিনি সাইজের আয়নারও ব্যবস্থা আছে। মেকাপ বক্স! আর কত কি। উনি গাড়িতে খাবার নিয়ে বসে থাকায় আমিও ভেতরে ঢুকলাম।
‘ খেয়ে নে বিরিয়ানি ‘ (প্রহর)
‘ আপনি খাবেন না? ‘ (আমি)
‘ তোকে প্রশ্ন করতে বলছি? চুপচাপ খেয়ে নে। রওনা হতে হবে। ‘ (প্রহর)
‘ আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন? ‘ (আমি)
উনি মাথার চুলগুলো টেনে ধরে বললেন,
‘ না। ‘ (প্রহর)
‘ তাহলে আমার সাথে খেয়ে নিন। সমস্যা কোথায়? ‘ (আমি)
উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘ আমার খিদে নেই। কথা না বলে চুপচাপ খা। ‘ (প্রহর)
আমি ভয়ভয় কন্ঠে বললাম,
‘ আমি ডিবোর্সের কথা বলায় কি রাগ করেছেন? রাগ করে কি হবে বলুন। একদিন তো সেটা হবেই। আপনার তো বিয়ে হয়ে যাবে একদিন ‘ (আমি)
আমি কথাটা শেষ করতে না করতেই উনি ঠাসস করে আমাকে থা’প্প’ড় মা’রলে’ন। উনার শক্তপোক্ত হাতের চ’ড় খেয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। জিহ্বায় নোনতা অনুভব হতেই বুঝলাম ঠোঁট ফেটে গেছে। এলোমেলো চাহনিতে উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। উনি রক্তচক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ক্ষণকাল পর রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,
‘ ডিবোর্সের কি বুঝিস তুই? খুব বড় হয়ে গেছিস? ‘ (প্রহর)
আমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করা শুরু করলো। তারপর আর কিছু মনে নেই।
#শুধু_তুই
—-(সিজন২)
#পর্বঃ২০
#Rifat_Amin
চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম। মাথার উপর কনক্রিটের সাদা ছাদ। হাতটা নড়াতেই লক্ষ্য করলাম বাম হাতে স্যালাইনের নল ঝুলছে। ব্যাথায় আর নড়াতে পারলাম না। চারপাশে উদ্ভদ ফিনাইলের গন্ধ। মাথা ধরে যাচ্ছে একেবারে। ছোট্ট একটা কেবিনের সিঙ্গেল বেডে শুয়ে আছি। সাইডে এসিও দেখা যাচ্ছে। বাব্বাহ! বিলাসবহুল হাসপাতাল! তখন জ্ঞান হারানোর পর, উনি কি আমাকে এখানে এনেছেন? কেনো আনলেন আমায়? নিজেই মা’র’বেন। আবার নিজেই হসপিটালে নিয়ে আসবেন! হঠাৎ একটা নার্স এসে বললো,
‘ আপনি এখন কেমন আছেন? ‘ (নার্স)
আমি তাকিয়ে দেখলাম সাদা এপ্রোন পরিহিত এক নার্স সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ সড়িয়ে একবার পুরো রুমটায় চোখ বুলালাম। সবকিছুর কালার সাদা। এই সাদা আমার শত্রু। আমি বললাম,
‘ জি এখন ভালো লাগছে। ‘ ( আমি)
নার্সের বয়স আমার মতো। উনি একটু কাছে এসে আস্তে আস্তে বললেন,
‘ আচ্ছা প্রহর খানকে আপনি চিনেন? ‘ (নার্স)
আমি সাত-পাঁচ না ভেবে জবাব দিতে যাবো তার আগেই থেমে গেলাম। কি জবাব দিবো? আমি কি বলবো উনি আমার হাসবেন্ড? আমাকে নিশ্চুপ দেখে উনি আবার বললেন,
‘ আপনার তেমন কিছুই হয়নি। শুধুমাত্র আকষ্মিক ভয়ের কারণেই হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু প্রহর খান এমনভাবে আপনাকে হসপিটালে নিয়ে আসলেন। মনে হলো উনি আপনার বিশেষ কেউ৷ থাক! বলতে না চাইলে বলবেন না। কিন্তু আমি উনাকে দেখে সত্যি’ই অবাক হয়েছি। কত নামি-দামি মানুষ! আমি প্রথমে নিজেকে বিশ্বাস করাতেই পারলাম না। উনি এখনো হয়তো বাইরে বসে আপনার জন্য টেনশন করছেন৷ মাথা থেকে হাত নামাচ্ছেনই না। আমি গিয়ে বললাম স্যার চা কফি খাবেন। ভেবেছিলাম কখনো উত্তর দিবেন না। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে উনি হেসে বললেন খাবেন না। আমি আবার বললাম একটা সেলফি প্লিজ। উনি বললেন, সিওর। কত ভালো মানুষ দেখেছেন! ‘ (নার্স)
আমি উনার কথায় হা করে চেয়ে রইলাম। একজন পেশেন্টের সাথে কোনো নার্স এত কথা বলে জীবনে প্রথম দেখলাম। আবার মাথা ব্যাথা বাড়ছে। উনি নিজেকে স্থির না করে আবার বললেন,
‘ আপনার নাম কি? ‘ (নার্স)
‘ রশ্নি আহমেদ। ‘ (আমি)
‘ মা শা আল্লাহ! অনেক সুন্দর নাম। আমার নাম মাহি। নামটা যতটা সুন্দর। আমি অতটাও সুন্দর না। সুন্দর হলে কি প্রহর খান আমাকে ইগনোর করে! কত চেষ্টা করলাম একটু নাম্বারটা ম্যানেজ করার। কাজ হলো না। ‘ (নার্স)
উনার বকবক এতক্ষণ আমার মস্তিষ্কে বিরক্তির সৃষ্টি করেছিল। এবার বিরক্তির সাথে যুক্ত তীব্র রাগ। এই মেয়ে বলে কি? প্রহরভাইয়ের নাম্বার নেয়ার এত শখ। হসপিটালে না থাকলে এক্ষুনি কয়টা লাগাই দিতাম।
‘ মাহি তুমি আবার বকবক শুরু করছো। যাও এখান থেকে। পেশেন্টকে একা থাকতে দাও ‘ (ডক্টর)
চোখ খুলে দেখলাম একজন মধ্যবয়ষ্ক ডক্টর। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথায় চুলের বংশ নেই। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললেন,
‘ ও আমার মেয়ে। অনেক কথা বলে। ‘ (ডক্টর)
আমি মাথা তোলার চেষ্টা করে বললাম,
‘ আপনার মেয়ে নার্স? ‘ (আমি)
‘ আরে না। কিন্তু ওর খুব নার্স হওয়ার শখ। তাই এখানে একটু আসা যাওয়া করে। মাত্র তো কলেজে উঠলো। ‘ (ডক্টর)
আমি কথা বললাম না। তাই তো বলি। নার্স কখনো এমন হয়?
—
‘এই মাহিম কি খেলা শুরু করেছে বলতে পারবি? আমাদের শুধু নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। এখন, প্রহরভাই না বলা পর্যন্ত কিছু করতেও পারছি না। ধুর! ‘ (প্রেম)
হোটেলে খাবার খেতে খেতে ফারহানকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললো প্রেম। ফারহানের পাশে মিল্লাতও আছে। ফারহান জবাব না দিয়ে খাবারে মনোযোগ দিতেই মিল্লাত বললো,
‘ ছোট বেলা থেকেই মাহিমের সাথে প্রহরের সম্পর্ক খারাপ। কখনো এদের সম্পর্কের মাঝে উন্নতি দেখি নাই। এখন বিষয়টা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ‘ (মিল্লাত)
‘ প্রেয়সী যে বাসায় ফিরেছে। এটা প্রহরভাই জানে? ‘ (প্রেম)
‘ হ্যাঁ। একটু আগে বলেছি। ও এমন বিহেব করছে। যেনো কিছুই হয়নি। আমি এই ছেলের মতলব আজ পর্যন্ত বুঝলাম না। ‘ (মিল্লাত)
‘ এখন ভাইয়া কই? ‘ (প্রেম)
‘ চিটাগংয়েই আছে৷ আমাদের আবার ঢাকা ফিরে যেতে বললো। কিন্তু এখন আমার সত্যি রাগ হচ্ছে। এই ঢাকা থেকে চিটাগং। চিটাগং টু ঢাকা। খুব কি সোজা পথ? আমাদের শরীরের যে বাজে অবস্থা। তাতে বার বার আসা যাওয়া করতে কখন জানি হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়। ‘ (মিল্লাত)
প্রেম একটু নিশ্চুপ থেকে আবার বললো,
‘ আমাকে তো ঢাকা ফিরতেই হবে। সারা বারবার ফোন করে করে মাথা একেবারে আউলাই ফেলছে। আর রেডিওতেও জয়েন করতে হবে। ছুটি শেষ। ‘ (প্রহর)
এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে খাবার খেলেও এবার ফারহান অকপটে বললো,
‘ প্রহর ভাইয়ের সাথে আমার কথা হইছে। আজ রাতে উনিও ঢাকা রওনা হবেন। একসাথে যাওয়া যাবে। ‘ (ফারহান)
প্রেম বামহাত দিয়ে মাথায় চা’টি মে’রে বললো,
‘ এতক্ষণে মুখ ফুটলো তোর! ‘ (প্রেম)
—
দুপুর দুইটা। হসপিটাল থেকে বের হয়ে একটা হোটেলে উঠেছেন প্রহরভাই । রাত পর্যন্ত রেস্ট করার জন্যই মুলত হোটেলে উঠা হয়েছে। তারপর ঢাকা রওনা দিতে হবে। আমার মনটা শুধু বাসা যাই যাই করছে। এখানে আর এক মুহুর্তও ভালো লাগছে না।
প্রেয়সীকে পাওয়া গেছে, এটা স্বস্তির খবর হলেও মনের মাঝে ভয় বসে আছে। উনিও খবরটা শোনার পর থেকে গম্ভীর হয়ে আছেন। কথা বার্তা বলছেন না। এদিকে কথা না বলতে পেরে আমার পেট যেনো ফুলে যাচ্ছে। হসপিটাল থেকে আসার পর থেকে কোনো কথা বলছেন না। এ্যা! মনে হচ্ছে আমি থা’প্প’ড় মে’রে উনাকে অজ্ঞান করেছি। এখন রাগ করে কথা বলছেন না।
শাওয়ার নিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। এতক্ষণে শরীরটা আরাম পাচ্ছে। উনি বিছানায় বসে বসে ফোন চাপছেন তো চাপছেনই। কথাবার্তা বলছেন না। আমি লুকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম কি এত ফোনে। মাথার পিছনে আস্তে করে মাথাটা নিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মেজাজের বারোটা বেজে গেলো। একটা মেয়ের ছবি জুম করে দেখছেন। কই! আমাকে তো কখনো দেখেননি। জুম করে তো দূরের কথা, দূরবীক্ষণ দিয়েও দেখেন নি। আরে এই মেয়েটা তো হসপিটালের নার্সবেশী বকবক করা মেয়েটা। আমি সড়ে যেতেই গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ লুকিয়ে কারো ফোন দেখা কি ঠিক? ‘ (প্রহর)
আমি উনার মুখের কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম,
‘ বউকে বিছানায় রেখে অন্য মেয়েদের নিয়ে মোবাইলে ফষ্টিনষ্টি করা কি ঠিক? ‘ (আমি)
আমার কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন উনি। ফোনটা পকেটে রেখে আমার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
‘ ফষ্টিনষ্টি কি রে? আর তুই কি জেলাস? ‘ (প্রহর)
আসলেই তো। আমি জেলাস হতে যাবো কেন? এই বিয়ের পর থেকে আমার মাথা একদম গেছে! কিন্তু ওনার এসব মেয়েদের নিয়ে রংঢং করা কি ঠিক। উনার পকেট থেকে ফোন বের করার চেষ্টা করে বললাম,
‘ আমি জেলাস হতে যাবো কেন? আপনি যে আম্মির কাছে পবিত্র ছেলে। কিন্তু তলে তলে কতটা চরিত্রহীন, তিনি তো আর জানেন না । আমার উচিৎ আপনাকে দেখে শুনে রাখা। ‘ (আমি)
উনি আমার চেপে ধরে বললেন,
‘ এত সাহস কই থেকে আসে তোর? আমি চরিত্রহীন? বেশী বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আবার থা’প্প’ড় মা’র’বো। ‘ (প্রহর)
আমি আস্তে করে হাতটা সড়িয়ে নিলাম। মনে পড়লো উনি আমাকে থা’প্প’ড় মে’রে অজ্ঞান করেছেন। আমার উচিৎ রাগ করে থাকা। ভীষণ রাগ। তা না করে উল্টা নিজে থেকে কথা বলতে গেলাম কেন। ধুর!!
আমাকে হুট করে পরিবর্তন হতে দেখে ফোনটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,
‘ ফোন চাইছিলি কেন? ‘ (প্রহর)
‘ লাগবে না ‘ (আমি)
‘ এইযে আবার রাগ উঠাচ্ছিস! শান্তিতে একটু থাকতে দিবি আমায়। ‘ (প্রহর)
আমি আর বিছানায় থাকলাম না। বেলকনিতে চলে আসলাম। হোটেলটা কত তলা জানি না। তবে আমরা এখন চার তলায় আছি। নিচে ব্যস্ত শহর। মানুষগুলোকে কেমন পিঁপড়া লাগছে। অথচ তাঁদের কত অহংকার! মাত্র চারতলা থেকেই যদি তাঁদের পিপড়া মনে হয়। তাহলে সাত আসমানের উপর থাকা মহান আল্লাহর কাছে আমরা কতটা নগণ্য! আমি ভেজা চুলগুলোকে শুকানোর জন্য চুলগুলোকে রোদের দিকে বাড়িয়ে দিতেই উনি সামনে এসে হাজির।
‘ হঠাৎ রাগ করলি কেন? রাগ তো আমার করার কথা৷ ‘ (প্রহর)
‘ তাহলে করুন। বাঁধা দিলো কে? ‘ (আমি)
‘ সামনের সপ্তাহে নিউইয়োর্ক চলে যাচ্ছি। মিস করবি আমায়? ‘ (প্রহর)
আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। সাথে সাথেই আহত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। এই প্রথম মনে হলো উনার উপস্থিতি আমার ভীষণ দরকার। অথচ বছরের পর বছর এই মানুষটাকেই ইগনোর করে এসেছি। পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি। ভেবেছি উনি আমার জীবনে অভিশাপ। সারাক্ষণ তো জ্বালিয়ে মা’রে’ন।
‘ কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে আম্মু বিয়ে না করে যেতেই দিবেন না। বল তো কি করি! ‘ (প্রহর)
‘ বিয়ে করুন’ (আমি)
‘ বিয়ে তো করেছি। আর কয়বার করবো? ‘ (প্রহর)
‘ আপনি বোধহয় বিয়েটা মেনে নিয়েছেন? ‘ (আমি)
‘ তুই মেনে নিয়েছিস? ‘ (প্রহর)
‘ জানি না। ‘ (আমি)
উনি চুপ করে থাকলেন। অতঃপর বললেন,
‘ যা ঘুমিয়ে পর। হোটেলটা নিয়েছি ঘুমানোর জন্য। ‘ (প্রহর)
‘ আচ্ছা আমার বাবা-মা বেঁচে নেই কেন? উনারা থাকলে হয়তো এত অবহেলা আমি পেতাম না। তাইনা? ‘ (আমি)
উনি চমকে তাকালেন। অতঃপর আমার হাতদুটো আলতো করে ধরে বললেন,
‘ কে তোকে অবহেলা করে? কার এত সাহস? ‘ (প্রহর,)
—-
বিকালটা ঘুমিয়েই কাটালাম। সঁন্ধ্যায় মাথায় কারো আলতো হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। চোখটা খুলে দেখলাম প্রহরভাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আমাকে দেখে ভূল দেখার মতো চমকে উঠে বললেন,
‘ কারেন্টটা চলে যাওয়ার পর তরতর করে ঘামছিলি। এত বড় হোটেল। তবুও ঠিকঠাক কারেন্ট থাকে না ‘ (প্রহর)
চলবে?
চলবে?