শুধু তোমারই জন্য ২ পর্ব -২৫+২৬

#শুধু_তোমারই_জন্য(২)
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|২৫|

আহিয়ান এক ঘন্টা যাবত ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে। আনিতা আর অনিমার এখনো রেডি হওয়া হচ্ছে না। ফোন বের করে সময় দেখলো আহিয়ান। সাড়ে দশটা বাজে। আহিয়ান আনিতা আর অনিমাকে নিতে এসেছে। তিনদিন পর আনিতা আর আহিয়ানের হলুদ। বিয়ের শপিংয়ে যাবে আজকে ওরা। আনিতাদের বাসার শপিং মোটামুটি সব শেষ। আহিয়ান এখান থেকে আনিতা আর অনিমাকে নিয়ে সোজা ঢাকায় যাবে শপিং করবে তারপর আবার ওদের বাসায় দিয়ে যেতে হবে। আহিয়ান বারবার তাড়া দিচ্ছে ওদের দু বোনকে। ওরা দু মিনিট করতে করতে এক ঘন্টা যাবত ছেলেটাকে বসিয়ে রেখেছে। আহিয়ান ধৈর্য্য হারা হয়ে পা বাড়ালো আনিতার রুমের দিকে। আনিতা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছিলো। আহিয়ান গিয়ে আনিতার খোপা করা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে বললো,
–“অনেক সময় যাবত রেডি হয়ে নিয়েছো৷ এবার সব ঠিক আছে, চলো।”

কথাটা বলে আনিতার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো। অনিমা বিছানা থেকে আনিতার পার্স আর ফোন হাতে নিয়ে দৌড় লাগালো ওদের পিছু। যাওয়ার আগে বাসার সবাইকে বলে বের হলো৷ আহিয়ান বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দিলো। আনিতা ঠেলে আহিয়ানের পিছনে আগে অনিমাকে বসালো তারপর ও বসলো।

শপিংমলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আনিতা ওদের প্রায় আড়াই ঘন্টা সময় লেগে গেলো৷ আনিতা ওরা গিয়ে দেখলো রুহি ওদের সবারই কেনাকাটা প্রায় শেষ। এখন শুধু ওর আর আহিয়ানের শপিং বাকী আছে। রুহি আনিতার কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“তোমরা পছন্দ করতে থাকো, আমরা আমাদের বাকী জিনিসগুলো কিনে জয়েন করছি তোমাদের সাথে।”

প্রত্যুত্তরে আনিতা মুচকি হাসলো৷ রুহি ওরা চলে যেতেই আহিয়ান অনিমার সাথে গল্প করতে করতে সামনে এগোচ্ছে। আনিতাও ওদের পিছু পিছু যাচ্ছে।

একের পর এক শাড়ি, লেহেঙ্গা দেখেই যাচ্ছে কিন্তু কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। খুঁজে খুঁজে আহিয়ান একটা লেহেঙ্গা হাতে তুলে নিলো। মেরুন রঙের লেহেঙ্গাটাতে সিলভার রঙের কারুকাজ। আহিয়ান লেহেঙ্গাটা উল্টেপাল্টে বেশ কিছুক্ষণ দেখলো। তারপর আনিতাকে ওর দিকে ঘুরিয়ে গায়ের সাথে ধরে দেখলো। আনিতারও বেশ মনে ধরেছে লেহেঙ্গাটা। অনিমাও বললো এটাই নিতে। আহিয়ান আরো একবার আনিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“এটা চলবে তো?”

আনিতা মৃদু হেসে বললো,
–“চলবে না একেবারে দৌড়াবে।”

আহিয়ান মৃদু হেসে দোকানীকে ওটা এক সাইডে রাখতে বললো। আরো বেশ কিছু শাড়ি দেখে হলুদের জন্য এ্যাশ কালার পাড়ের কাঁচা হলুদ জামদানী শাড়ি নিলো এবং রিসেপশনের জন্য বেবি পিংক কালারের লেহেঙ্গা। আহিয়ান অনিমার জন্যও একটা লেহেঙ্গা এবং হলুদের জন্য একটা শাড়ি নিয়েছে। যদিওবা আনিতা অনিমা দুজনেই বেশ বারন করেছিলো ওকে। কিন্তু আহিয়ান সাফসাফ জানিয়ে দেয়,
–“একটাই তো শালী আমার। আর আমার বিয়েতে আমার শালীকে শপিং করে দিবো না তো আর কাকে দিবো?”

কথাগুলো বলে আহিয়ান দোকানীকে সবগুলো প্যাক করতে বললো। কাউন্টারে গিয়ে সব বিল মিটিয়ে বের হয়ে আসতে নিলেই ক্রীম কালার একটা সুতোর কারুকার্য করা শাড়ির উপর চোখ আটকে যায়৷ সাথে সেটাও কিনে নিলো ও আনিতার দাদুর জন্য। আনিতার সব শপিং শেষ অন্যান্য সব শপিং রুহিই করেছে। শুধুমাত্র হলুদ বিয়ে আর রিসেপশনের শপিং গুলোই করেছে এখন। দোকান থেকে বের হয়ে ওরা ছেলেদের শপে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছে। আনিতা আহিয়ানের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–“আচ্ছা অনিমা দাদুর জন্য কিনলেন কেউ কিছু মনে করবে না?”

–“কার কথা বলছো?”

–“যে-কেউ। অনেকেই তো অন্যভাবেও নিতে পারে ব্যাপারটা তাই না? হয়তো ভাববে বিয়ে হতে না হতেই আমি আপনাকে হাত করে নিয়েছি। আপনার টাকায় আমার ফ্যামিলির জন্য কেনাকাটা করছি।”

–“যে যা ভাবার ভাবুক তাতে কিছু যায় আসে না।”

–“তবুও__”

–“উই ডোন্ট কেয়ার আনি।”

–“উই?”

–“আমি আর আমার পরিবার। আর শোনো আসার আগে আম্মুই বলে দিয়েছে এসব কেনাকাটা করতে। যদিওবা আমি নিজেও কিনতাম এসব ওদের জন্য।”

–“আম্মু বলেছে?”

–“হ্যাঁ এখন চুপচাপ চলো জারাফের জন্যও কিনতে হবে৷ আর কোনো প্রশ্ন নয়।”

কথাটা বলে আহিয়ান হাঁটা লাগালো৷ আনিতা আর অনিমাও ওর পিছু দৌড় দিলো। আহিয়ানের সাথে হাঁটায় পারছে না ওরা৷ ছেলেদের শপে ঢুকে আহিয়ান জারাফের জন্য পাঞ্জাবী নিলো৷ তারপর আনিতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
–“নাউ ইট’স ইউর টার্ন।”

–“মানে?”

–“মানে তোমার সবকিছু আমার চয়েজে কেনা হয়েছে। এবার আমার যা যা কেনাকাটা করার আছে সবকিছু তুমি চুজ করে দিবা।”

–“আ্ আমি?”

–“হ্যাঁ তুমি।”

–“আমার চয়েজ অত ভালো না। খুব বাজে।”

আহিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকালো ওর দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আনিতার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“তারমানে তুমি বোঝাতে চাইছো আমিও ভালো না? খুব বাজে?”

আনিতা আমতা আমতা করে বললো,
–“এ্ এটা আবার কখন বললাম?”

–“মাত্রই তো বললা তোমার চয়েজ ভালো না খুব বাজে। তার মানে আমিও বাজে। কয আমিও তো তোমারই চুজ করা। আই মিন আমাকে তো তোমার হাজবেন্ড হিসেবে তুমিই চুজ করেছিলা।”

আহিয়ানের কথা শুনে অনিমা ফিক করে হেসে দিলো৷ সাথে দোকানীরাও মুচকি হাসছে। আনিতা অবাক চোখে একবার সবার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলো। তারপর আহিয়ানের দিকে তাকালো। আনিতা মিনমিন করে বললো,
–“ড্রেস আর আপনি কি এক হলেন?”

আহিয়ান মুচকি হাসলো৷ আনিতার হাত ধরে পুরো শপ ঘুরে দেখলো। ডিসপ্লে করা পাঞ্জাবী পিন্স কোর্ট গুলো কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। দোকানীরা একের পর এক পাঞ্জাবী দেখাচ্ছে। ফাইনালি আনিতার একটা পাঞ্জাবী পছন্দ হলো। সাদা পাঞ্জাবীটার বুকের বা দিকে নীল সুতোর কারুকার্য করা। আনিতা সেই পাঞ্জাবীটাই নিতে বললো আহিয়ানকে। বিনাবাক্যে আহিয়ান সেটাই নিলো। আনিতার দুটো লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচ করে দুটো প্রিন্স কোর্ট বানাতে দিয়ে গেলো আহিয়ান। কোর্টের ডিজাইন অবশ্যই আনিতার চুজ করা। আনিতা ওরা সবাই শপিংমল থেকে বের হয়ে গেলো। কিছুদূর গিয়ে আনিতা থেমে গিয়ে আহিয়ানের হাত চেপে ধরলো। আহিয়ান প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো আনিতার দিকে। আনিতা বললো,
–“আম্মুর জন্য শাড়ি নিয়েছেন?”

–“হ্যাঁ সবার জন্যই নেওয়া হয়েছে।”

–“একটা কথা বলবো?”

–“বলো।”

–“আমি আম্মুর জন্য একটা শাড়ি চুজ করে দেই?”

–“দুটো নিয়েছি তো।”

–“প্লিজ আমি একটা দেইনা।”

আনিতার বাচ্চাদের মতো বায়না ধরা দেখে আহিয়ান মৃদু হাসলো। রুহিদের ডেকে বললো,
–“তোমরা অনিমাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার অর্ডার দাও আমরা একটু আসছি।”

রুহিদের সম্মতি পেয়ে আহিয়ান আনিতাকে নিয়ে আবারো শপিংমলের ভিতরে ঢুকে গেলো। অনেক খুঁজে খুঁজে আনিতা জলপাই কালার একটা জামদানী চুজ করলো। আনিতা সেটা প্যাকেট করতে বলে পার্স থেকে টাকা বের করে পেমেন্ট করতে গেলেই আহিয়ান বললো,
–“কি করছো? আমি থাকতে তুমি টাকা দিচ্ছো কেন?”

–“এটা আমার তরফ থেকে আম্মুর জন্য গিফট। তাহলে টাকা আমি দিবো না তো কে দেবে?”

–“উঁহু টাকাগুলো আগের জায়গায় রাখো। আমি পে করে দিচ্ছি।”

কথাগুলো বলে আহিয়ান ওর ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে দোকানীর হাত দিলো। আনিতা আহিয়ানের দিকে টাকাগুলো এগিয়ে দিলো। আহিয়ান নিয়ে আনিতার পার্সে রেখে দিলো। আনিতা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
–“প্লিজ রাখুন না টাকাগুলো। আমি আমার টাকা দিয়ে গিফট করতে চাই আম্মুকে।”

আহিয়ান প্যাকেট এক হাতে নিয়ে অন্যহাত দিয়ে আনিতার হাত ধরে মল থেকে বেরোতে বেরোতে বলে,
–“আমার টাকা আর তোমার টাকা কি আলাদা? তোমার বরের টাকা মানেই তো তোমার টাকা। সো এই শাড়িটা তোমার টাকাতেই কেনা।”

–“কিন্তু__”

–“নো মোর ওয়ার্ডস পিচ্চি-পাখি।”

কথাগুলো বলতে বলতে ওরা মল থেক বের হয়ে যায়। আহিয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে নাহিয়ানের নাম্বারে ডায়াল করলো। জেনে নিলো ওরা কোন রেস্টুরেন্টে আছে। রেস্টুরেন্টের নাম জেনে আহিয়ান ফোন কেটে পকেটে ঢুকিয়ে বাইকের কাছে চলে গেলো।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাজে। রুহি ওরা সকলে মিলে সব কেনাকাটা শেষ করে রেস্টুরেন্টে বসে খাবার অর্ডার দিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই আহিয়ান আর আনিতা সেখানে গিয়ে ওদের পাশে বসলো। মিনিট পাঁচেক বাদে ওয়েটার খাবার দিয়ে যেতেই সকলে মিলে একসাথে খেতে শুরু করে। খাওয়া শেষে সবাই বাইরে বের হয়ে আসে। রুহিরা সাথে করেই সব শপিং নিয়ে যায়। শুধু আনিতার হলুদের শাড়ি আর কসমেটিকস গুলো আনিতার হাতে দিয়ে যায়। সাথে আহিয়ান অনিমা জারাফ আর ওদের দাদুর জন্য কেনা জামাগুলো নিয়ে নেয়। আনিতা হলুদে পড়ার জন্য কাঠগোলাপের গহনা অর্ডার দিয়ে যায়। হলুদের দিন দুপুরে সেটা আনিতাদের বাসায় পৌঁছে দিবে এখান থেকে।

আটটা নাগাদ আনিতারা ওদের বাসায় এসে পৌঁছায়। আহিয়ান সেখান থেকে চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু অনিমা জোর করে আহিয়ানকে বাসায় নিয়ে আসে। আহিয়ান নিজ হাতেই আনিতার দাদু আর জারাফের জন্য কেনা জামাগুলো ওনাদের হাতে তুলে দেয়। এসময়ে আবার ওদের জন্য শপিং করাতে আনিতার আব্বু আম্মু দাদু সকলেই বেশ রাগারাগি করে ওকে। আহিয়ান মাথা পেতে হাসিমুখে সবটা শুনে। তারপর মাথা তুলে বললো,
–“ভাবলাম শুধু আনিতার জন্যই কেন কিনবো? ওদিকে বাসায় তো আমার ওয়ান এন্ড অনলি লাল টুকটুকে সুন্দরী বড় বউ আছে। তার জন্য না কিনলে যদি আবার আমাকে ছেড়ে চলে যায় তখন কি হবে আমার? কাকে নিয়ে থাকবো আমি? তাই কিনে নিলাম। আর যাই হোক আপনাকে আমি হারাতে চাই না।”

লাস্ট কথাটা বলে আহিয়ান আনিতার দাদুর গাল টেনে দিলো। আহিয়ানের কথায় আর কাজে সেখানে উপস্থিত সকলেই হেসে ফেললেন। আনিতার আম্মু কিচেনে গেলেন ডিনার রেডি করতে। আনিতার দাদু আহিয়ানের কান টেনে ধরে বললো,
–“খুব বেশি ফাজিল হইছো না? কান টেনে একদম ছিঁড়ে ফেলবো।”

আহিয়ান হেসে ফেললো। আনিতার দাদু আহিয়ানের কান ছেড়ে দিয়ে বললো,
–“রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। রাতে খেয়ে তারপর যাবে।”

–“সন্ধ্যায় খেয়েই এসেছি। এখন কিছু খাবো না। তাছাড়া কদিন বাদে তো আসছিই। তখন একেবারে পেট পুরে খাবো।”

আনিতার আব্বু এবারে বললেন,
–“রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও। তোমার আম্মু তোমার জন্য রাতের খাবার রান্না করে রেখেছে।”

–“খেয়ে এসেছি তাছাড়া রাত হবে অনেক বাসায় ফিরতে হবে।”

–“বেশি রাত হবে না। এক্ষুনি টেবিলে খাবার দিচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে আসো।”

আহিয়ান আবারো কিছু বলতে গেলে আনিতার আব্বু এমন চাহনী দেয় যার ফলে আহিয়ান আর কিছু বলার স্কোপ পেলো না। চুপচাপ আনিতার রুমে চলে গেলো। আনিতা তখন ফ্রেশ হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলো। আহিয়ান দরজা অফ করে দিয়ে সোজা গিয়ে আনিতাকে হ্যাঁচকা টানে বুকের উপর নিয়ে শুয়ে পড়লো। আচমকা এরকম হওয়াতে আনিতা বেশ ঘাবড়ে গেলো। চোখ খুলে আহিয়ানকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। আহিয়ানের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
–“আহ! ছাড়ুন না। এভাবে হুটহাট ঝাপিয়ে পড়েন কেন?”

আহিয়ান আনিতাকে নিচে ফেলে দিয়ে আনিতার উপরে উঠে গেলো। আনিতার মাথার একপাশে বিছানায় হাত রেখে শরীরের অনেকটা ভর হাতের উপর নিয়ে নিলো। আনিতার ঠোঁটে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে বললো,
–“কত্ত দিন হলো বউটাকে কাছে পাই না। আজকে একটু কাছে পেয়েছি অমনি তোমার আর সহ্য হলো না তাই না?”

–“কত্তদিন মানে? গত সপ্তাহেও তো__”

আনিতাকে পুরো কথা বলতে না দিয়েই আহিয়ান বললো,
–“সে তো আরো পাঁচ ছয়দিন আগের কথা।”

–“কষ্ট করে আর চারদিন ওয়েট করুন। তারপর সারাটা সময় আমাকে আপনার কাছে পাবেন।”

–“চার দিন না তো চার যুগ মনে হচ্ছে।”

হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। হকচকিয়ে আহিয়ান আনিতার উপর থেকে উঠে বসলো। আনিতা আহিয়ানের হাতে টাওয়াল ধরিয়ে দিয়ে ঠেলে ওকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে দরজা খুলে দিলো। অনিমা দাঁড়িয়ে আছে। দুজনকে ডাইনিংয়ে যেতে বলে চলে গেলো ও।
#শুধু_তোমারই_জন্য(২)
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|২৬|

হলুদের স্টেজে বসে আছে আনিতা। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ বাজে। আনিতার দু পাশে অনিমা আর ফাইয়াজ আছে ফটোশুট করছে ওরা। ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তাসকিয়া রোদেলা আরোহী জেরিন নূর আর শুভ। তখনই পনেরো বিশটা বাইক নিয়ে এন্ট্রি নিলো আহিয়ান। প্রথম বাইকটাতেই আহিয়ান। আনিতার চুজ করে দেওয়া পাঞ্জাবিটা পড়া। গলায় নীল জর্জেট উড়না পেঁচানো। আহিয়ানকে দেখে শোরগোল পড়ে গেলো ওখানে। সব্বাই গিয়ে আহিয়ানকে ঘিরে ধরলো। আনিতা একা স্টেজে বসে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আনিতার দৃষ্টি আহিয়ানের উপর। এই মূহুর্তে আহিয়ানকে এখানে কোনোভাবেই আশা করেনি আনিতা। আহিয়ান ওকে বলেও নি যে ও আজকে আসবে। আহিয়ান ভীর ঠেলে স্টেজের দিকে এগিয়ে আসছে। আনিতা তখনো অবাক চোখে ওর দিকে তাকানো। আহিয়ান স্টেজে গিয়ে আনিতার পাশে বসে ওর কাঁধ দিয়ে আনিতার কাঁধে হালকা ভাবে ধাক্কা মেরে বলে,
–“তোমারই তো বর। কালকে থেকে অনেক সময় পাবা দেখার জন্য। এখন এভাবে তাকিয়ে থেকো না। সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।”

আনিতা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। একজন ফটোগ্রাফার এসে আনিতা আর আহিয়ানের কাপল ছবি তুলছে। বেশ কিছু সময় বাদে আনিতার দাদু এসে আহিয়ানের কান টেনে ধরে বললো,
–“আর একটা দিন বুঝি তর সইলো না? চলেই এলে বউকে দেখতে।”

আহিয়ান মুচকি হেসে আনিতার দাদুর হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসায়। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
–“লাল টুকটুকে সুন্দরী বড় বউটাকে দেখতে এলাম কেমন লাগছে। কিন্তু এখানে এসে তো দেখছি আমি আসাতে সে খুশি হয়নি।”

আনিতার দাদু আবারো আহিয়ানের কান টেনে ধরে বললো,
–“বড্ড পাজী হয়েছো না?”

প্রত্যুত্তরে আহিয়ান মুচকি হাসলো। আহিয়ান মাঝে আর ওর দু পাশে আনিতা আর ওর দাদু। আহিয়ান দু হাতে দুজনকে জড়িয়ে ধরে ফটোগ্রাফারকে বললো ছবি তুলে দিতে। তিনজনে মিলে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলো ওরা।

আনিতার আব্বু আম্মু প্রথমে আনিতাকে হলুদ ছোঁয়ালো। তারপর আহিয়ান হলুদ ছোঁয়ায়। আনিতার হলুদ পর্ব শেষ হতে হতে সাতটা বেজে গেলো। আহিয়ান অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সকলকে রাজি করিয়ে আনিতাকে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। সাথে আনিতার বন্ধুরা ফাইয়াজ এবং বিয়েতে উপস্থিত আরো কিছু ছেলে-মেয়ে গেলো ওদের সাথে। ও বাসায় গিয়ে আহিয়ানকে হলুদ লাগাবে৷

আহিয়ানের বাইকের পিছনে আনিতা। সামনেই ক্যামেরাম্যান ওদের যাত্রাটা ক্যামেরায় বন্দী করছে। আটটা নাগাদ আনিতা ওরা যথাস্থানে এসে পৌঁছালো৷ আহিয়ানরা একটা হল বুক করেছে বিয়ের প্রোগ্রামের জন্য। হলের সামনে এসে আহিয়ান বাইক থামিয়ে নেমে পড়ে। তারপর আনিতার হাত ধরেই হলে প্রবেশ করে ওরা। আহিয়ানের আম্মু এগিয়ে এসে আনিতাকে জড়িয়ে ধরে। আনিতাও আলতো ভাবে তার বুকে মাথা রাখে।

স্টেজে পাশাপাশি আহিয়ান আর আনিতাকে বসিয়ে হলুদ লাগানো হচ্ছে। সবাই এসে হলুদ লাগিয়ে যাচ্ছে ওদের। প্রথমেই আহিয়ানের আম্মু ওদের হলুদ লাগিয়ে স্টেজ থেকে নামার আগে আনিতার হাতে কিছু টাকা গুজে দেয়। নাহিয়ানও সেম কাজটাই করে। সেখানে উপস্থিত অনেকেই হলুদ লাগানোর সময় নতুন বউয়ের মুখ দেখে হাতে টাকা গুজে দেয়।

ফুল ভলিউমে সাউন্ড বক্স বেজে চলছে। অদ্রি আর রুহি দুজনে মিলে একটা পারফরম্যান্স করেছে। রুহি আর নাহিয়ানও কাপল ডান্স করেছে। সবার জোড়াজুড়িতে আহিয়ান আর আনিতাও পারফর্ম করলো। আহিয়ানের বন্ধুরা সবাই মিলে রিমিক্স গান ছেড়ে নাচ করছে। সাথে যোগ হয়েছে আনিতার ফ্রেন্ড আর কাজিন সার্কেলও।

আনিতা এক সাইডে রুহির সাথে বসে গল্প করছিলো। রুহির ফোন আসাতে ও আনিতাকে বসতে বলে চলে গেলো। আনিতা চুপচাপ বসে আহিয়ানকে দেখছিলো। প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে কত ছেলেটাকে। বন্ধুদের সাথে নাচানাচি করছে। কে বলবে এই ছেলেটারই বিয়ে আজকে? নিজের বিয়েতে কেউ এভাবে নাচে? আনিতার পাশের চেয়ারটাতে কেউ একজন এসে ধপ করেই বসে পড়লো। আনিতা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো অনিক। ওকে দেখে আনিতা চলে আসতে নিলেই অনিক আনিতার হাত ধরে ফেলে। এবং কিছুটা জোর করেই ওকে নিয়ে একটু আড়ালে চলে যায়৷ আনিতাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে অনিক বললো,
–“এখনো সময় ছিলো কাঠবিড়ালি৷ সব কিছু ভুলে যাওয়ার। আহিয়ান, বিয়ে, বেবি মিসক্যারেজ এভ্রিথিং__এভ্রিথিং। প্লিজ সবটা ভুলে চলো আমার সাথে৷ তোমাতে আটকে গেছি আমি। যেখান থেকে চাইলেও নিজেকে ছাড়াতে পারছি না। তোমাকে নিয়ে ভাবতে গেলে উলটো আরো গভীরে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। তোমাকে ছাড়া থাকা এখন আমার জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তোমাকে লাগবে আমার সেটা যেভাবেই হোক। প্লিজ চলো আমার সাথে।”

অনেকটা সময় যাবত অনিকের লাগামহীন কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিলো আনিতা। কিন্তু আর সহ্য করতে পারলো না ওকে। ঝামটা মেরে অনিকের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কাটকাট গলায় জবাব দিলো,
–“জন্ম মৃত্যু বিয়ে এই তিনটা মানুষের জীবনে একবারই হয়। আমার অলরেডি একবার বিয়ে হইছে। তাও আবার আমারই ভালোবাসার মানুষটার সাথে। সেখানে আপনি ভাবলেন কি করে আহিয়ান আমার বর হওয়া সত্বেও ওকে ছেড়ে আমি আপনার সাথে যাবো? এত নিচু মন মানসিকতা কেন আপনার? ফারদার যেন আপনাকে আর আমার আশেপাশেও না দেখি।”

কথাগুলো বলে আনিতা চলে আসতে নিলেই অনিক আনিতার হাত ধরে টেনে ওর কাছে নিয়ে যায়। আনিতা ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতেই পিছন থেকে আহিয়ান আনিতাকে টেনে নিজের কাছে এনে অনিকের গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় একটা। দাঁতে দাঁত চেপে আহিয়ান বলে,
–“আনিতার থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম তোকে। কিন্তু তুই ওকে ছোঁয়ার মতো সাহস দেখিয়েছিস। অন্য সময় হলে না তোর হাতটা কেটে রেখে দিতাম আমি। এখানে এত মানুষজন তাই কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না আমি। এরপর যেন তোকে ওর আশেপাশে তো দূরে থাক দশ হাত দূরত্বেও যেন আমি না দেখি।”

কথাগুলো বলে আহিয়ান আনিতার হাত ধরে ওখান থেকে চলে এলো। অনিক রাগে নিজের হাত মুঠো করে নিলো। হ্যাঁ ও মানছে আনিতার ভালোবাসাটা বুঝতে ও বড্ড দেরী করে ফেলেছে। তাই বলে এত বড় শাস্তি দিবে ও অনিককে? এটা অনিক কিছুতেই মানতে পারছে না। ভালোবেসে ফেলেছে তো ও আনিতাকে। তাহলে কিভাবে সহ্য করবে আহিয়ানকে ওর পাশে? এরকম হাজারো কথা ভেবে হল থেকে বের হয়ে গেলো অনিক।

সাড়ে দশটা নাগাদ আহিয়ান ওরা আবার আনিতাদের ওদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়। ওদের বাসাটা এতক্ষণ জনমানবহীন লাগছিলো। এখন ফাইয়াজ ওরা সবাই চলে আসাতে বাড়িটা পূর্ণ হলো। হই হুল্লোড় পড়ে গেলো সারা বাড়িতে। এতক্ষণ আনন্দ করার মানুষগুলো বাড়িতে ছিলো না। এখন সকলে বাড়িতে আসতেই উৎসবমুখোর হলো পরিবেশটা। নাচগান হই হুল্লোড় সব হচ্ছে একসাথে।

বরযাত্রী চলে এসেছে। বড়দের সকলকে ভিতরে যেতে দিয়ে আহিয়ানকে গেইটে আটকে রেখেছে আনিতার বন্ধু আর কাজিনরা। আহিয়ানের সাথে রয়েছে ওর বন্ধুমহলের সকলে এবং কাজিনরাও রয়েছে। ছেলে আর মেয়ে পক্ষের মাঝে রয়েছে লাল ফিতের বেড়াজাল। যা কনে পক্ষের দুজন মেয়ে ফিতের দুই মাথা ধরে রেখেছে। আহিয়ানের ফর্সা গায়ে মেরুন রঙের প্রিন্স স্যুট অসম্ভব মানিয়েছে। আহিয়ানের থেকে চোখ সরানো দায়। বিয়েতে ইনভাইটেড একদল মেয়েরা তো হা করে তাকিয়ে আছে। এতে আহিয়ান বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মিনিট খানেক বাদেই মেয়েদের ভীর ঠেলে দুহাতে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে সকলের সামনে এসে দাঁড়ায় আনিতা৷ আনিতার সাথে ছিলো আরোহী। এখানে আনিতাকে দেখে আহিয়ান সহ সকলে বেশ অবাক হয়ে যায়। মেরুন রঙের লেহেঙ্গা পড়ে বউ সাজে আনিতাকে এখানে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় আহিয়ান। আনিতার উপরই আটকে যায় ওর চোখজোড়া। অবাকের রেশ কাটিয়ে তন্ময় বললো,
–“একি আনিতা? তুমি এখানে কি করছো?”

আনিতা নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
–“বাহ রে! বর এসেছে গেইট ধরবো না?”

রাতুল এগিয়ে এসে বললো,
–“এইটা তো কনে পক্ষের মেয়েরা ধরে। কিন্তু বউ-ও যে গেইট ধরতে চলে আসবে এইটা জানা ছিলো না।”

রাতুলের কথায় বরপক্ষের সকলে হেসে উঠে। আনিতা কিছুটা ভাব নিয়ে বললো,
–“ইট’স মাই স্টাইল। আমার বিয়েতে আমি গেইট ধরবো৷ এতে কারো সমস্যা আছে বা হবে বলে তো আমার মনে হচ্ছে না।”

আরহান এবারে আহিয়ানের এক কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“আমাদের কোনো সমস্যা নেই ডিয়ার ভাবী-জি। তবে তোমার বর তোমাকে এই রুপে দেখে সেন্সলেস হয়ে না পড়লেই হয়।”

–“আমার বর তো, স্ট্রং আছে। এত সহজে সেন্সলেস হবে না৷ এখনো তো অনেক রুপ দেখার বাকী।”

আনিতার কথায় আহিয়ান কিছুটা ঝুঁকে যায় আনিতার দিকে। তারপর নরম কন্ঠে বলে,
–“হ্যাঁ তাহলে আমরা এখানে কেন ওয়েট করছি এখনো? আমার বউয়ের বাকী রুপগুলোও তো দেখতে হবে নাকি? চলো ভিতরে চলো।”

কথাগুলো বলে আহিয়ান কদম ফেলতে নিলেই আনিতা বললো,
–“বাট বাট বাট__ডিয়ার বর ভিতরে আসতে হলে যে টাকা দিয়ে তারপর আসতে হবে।”

–“যদি না দেই?”

রোদেলা এবারে চট করে বলে ফেলে,
–“টাকা না দিলে ভিতরেও যেতে পারবেন না। আর আজকে বউ নিয়ে বাসায়ও যাওয়া লাগবে না।”

তন্ময় এবার অবাক হওয়ার ভাণ ধরে বললো,
–“তাহলে কি টাকার বিনিময়ে তোমার বান্ধবীকে আহিয়ানের হতে দিচ্ছো?”

–“একদমই না। বান্ধবী তো তার বরের কাছে যাবেই। বাট তার আগে শ্যালিকাদের দাবী পূরণ করতে হবে।”

জেরিনের কথায় সহমত প্রকাশ করে সবাই। রাতুল এগিয়ে এসে জেরিনের দিকে ঝুঁকে বললো,
–“তোমাদের দাবীটা না হয় তোমার বান্ধবীর দেবরগুলো পূরন করবে৷ আপাতত বর নিয়ে ভিতরে ঢুকতে দাও। তোমার দাবী পূরণ করার জন্য আমি সদা প্রস্তুত আছি।”

কথাটা বলেই রাতুল চোখ মেরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো৷ জেরিন ভেঙচি কেটে অন্যদিকে তাকালো। আরোহী বললো,
–“আমাদের দাবী আপাতত আমাদের জিজু পূরণ করলেই হবে। তার বন্ধুবান্ধবদের পূরন করতে হবে না।”

আরহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই আনিতা বলে উঠে,
–“এই সবাই সাইলেন্ট প্লিজ।”

আনিতার কথায় সবাই চুপ হয়ে যায়। আনিতা আহিয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“অনেক কথা হয়েছে। এবার আপনি টাকা বের করুন তো। ফাস্ট৷ আমাদের হাতে সময় নেই বেশি।”

–“এই তুমি আমার বউ নাকি শত্রু?”

–“আপাতত ওদের বান্ধবী। এবার টাকা বের করুন।”

–“আমার বউ আমি নিবো৷ গেইটে কেন টাকা দিবো?”

আহিয়ানের কথায় এবার অনিমা বলে,
–“জিজু আপনাকে তো আমি এরকম ভাবিনি। আপনি না কত্ত বড় মনের মানুষ? বিয়ে তো লাইফে একবারই করবেন। আর আমরা মানে আপনার শ্যালিকারা তো একবারই টাকা নিবো আপনার থেকে। বারবার তো আর আপনি বর সেজে আসবেন না। আর বারবার আমরা গেইটও ধরবো না। সো এত কথা না পেঁচিয়ে টাকাটা দিয়ে দিলেই তো পারেন।”

–“আমার ছোট গিন্নি যখন বলেছে তাহলে তো অবশ্যই টাকাটা দিতে হয়।”

আহিয়ান তারপর অনিমার দিকে ঝুঁকে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“কত লাগবে বলো? তুমি যা বলবে তাই হবে।”

তন্ময় আহিয়ানকে টেনে সোজা করে বললো,
–“যেই শালী বললো অমনি গলে গেলা তাই না? তাহলে এতক্ষণ আমাদের কথা কাটাকাটি করে লাভ টা হলো কি?”
আহিয়ান অসহায় ফেস করে বললো,
–“টাকা ছাড়া যে এরা আজকে আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিবে না সেটা তো জানিসই তাহলে কথা বাড়িয়ে লাভ কি বল? যত তাড়াতাড়ি টাকাটা দিবো তত তাড়াতাড়ি ভুতরে ঢুকতে পারবো। আর তত তাড়াতাড়িই আমার বউকে নিয়ে আমি বাড়ি ফিরতে পারবো।”

কথাগুলো বলে আহিয়ান তন্ময়কে ইশারা করতেই তন্ময় পকেট থেকে একটা টাকার খাম বের করে এগিয়ে দেয় ওদের দিকে। ওরা সকলে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে তন্ময় অনিমার হাতে খাম ধরিয়ে দিয়ে বললো,
–“ঠকবে না। আই হোপ তোমাদের মন মতোই আছে।”

নূর কাঁচি এগিয়ে দিলো আহিয়ানের দিকে। আহিয়ান কাঁচি হাতে নিয়ে ফিতে কাটতেই সকলে গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে স্বাগত জানালো ওকে। আহিয়ানের একহাত অনিমা এবং অন্যহাত নূর ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলো ওকে স্টেজের দিকে। শরবত খেলায় জিতটা হয় তন্ময়দের। ফলে নিয়ম অনুযায়ী কনেপক্ষ টাকা দিয়েছে বরপক্ষকে।

খাবার দাবার শেষে এবার হাত ধোয়ার পালা। আহিয়ানের হাতে সাবান মাখিয়ে বসে আছে রোদেলা অনিমা ওরা। অর্থাৎ টাকা না দেওয়া অব্দি আহিয়ানের হাত ধোয়ানো হবে না। এবারে কথা বেশি না বাড়িয়ে তন্ময় টাকা দিয়ে দিতেই ওরা হাত ধুইয়ে চলে যায়। বিপত্তি ঘটে আহিয়ান যখন স্টেজ থেকে নামতে যায় তখন। জুতো খুঁজে পায় না। ওদের থেকে পাঁচ হাত দূরত্বে রোদেলা জেরিন ওরা চেয়ারে বসে মিটমিটিয়ে হাসছে। বরপক্ষের কারোরই বুঝতে অসুবিধা হলো না জুতো চুড়ি করেছে ওরা। রাতুল আরহানকে ডেকে বললো,
–“তোকে যে এক্সট্রা জুতোর ব্যাগটা দিয়েছিলাম ওটা দে।”

আরহান আমতা আমতা করে বলে,
–“আসলে ওটা তো তাড়াহুড়োতে বাসায় ফেলে এসেছি।”

তন্ময় ওদের এবার ইচ্ছে হলো আরহানকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে। নিজেদের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখে তন্ময় অনিমা ওদের জিজ্ঞেস করলো,
–“কি চাই?”

তাসকিয়া চট করে বললো,
–“কি আবার? অবশ্যই টাকা চাই।”

রাতুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
–“কতো?”

নূর নির্দ্বিধায় বললো,
–“বেশি না পাঁচ হাজার হলেই হবে।”

আরহান তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
–“বেশি না আবার পাঁচ হাজারও। এই মেয়েরা কি টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না নাকি?”

নূর এবার আরহানের উপর চটে গিয়ে বললো,
–“ওকে দশ হাজার। পাঁচ হাজার আহিয়ান জিজু দিবে। আর পাঁচ হাজার আপনি দিবেন একটু আগে বলা কথাটার জন্য।”

নূরের কথায় থতমত খেয়ে যায় আরহান ওরা। মেয়েটা বলে কি? তন্ময় দেরী না করে পকেট থেকে এক হাজার টাকার পাঁচটা নোট বের করে গুজে দেয় ওদের হাতে। টাকাটা হাতে পেতেই আরোহী অনিমাকে বলে জুতো নিয়ে আসতে। মিনিট দুইয়ের মাঝেই অনিমা জুতো এনে আহিয়ানের সামনে রাখে।

বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসতেই আনিতা কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যায়। আজকে এই মূহুর্ত থেকে এই বাসার মেহেমান হয়ে যাবে ও। বিদায়ের সময়টা একটা মেয়ের কাছে ঠিক কতটা কষ্টের সেটা শুধু সেই মেয়েটাই জানে। এত বছর বাবার বাসায় বড় হয়ে কিনা নির্দিষ্ট একটা সময়ে এসে অন্যকাউকে বিয়ে করে নিজের বাসা ছেড়ে যেতে হয়। ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত না? আচ্ছা মেয়েদের বিদায় না হয়ে ছেলেদের বিদায় হলে কেমন হতো? মেয়েদেরই কেন তার বাবার বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়? ছেলেরা কি পারে না তাদের বাড়ি রেখে মেয়ের বাড়ি এসে থাকতে? যে বাড়িটাতে একটা মেয়ে ছোট থেকে বড় হয়ে উঠে যার শৈশব কৈশোর কাটে যে বাড়িটাতে সেই বাড়িটাকে ছেড়ে যাওয়া কি চারটিখানি কথা? যে বাড়িতে বেড়ে ওঠা সে বাড়ি ছেড়ে যেতে তো কষ্ট হবেই। বুকের ভিতরটায় অজস্র ব্যাথা হানা দেয়। বাড়িটা, বাড়ির মানুষগুলো ছেড়ে যেতে মনটা সায় দেয় না। তবুও মেয়ে হয়ে যেহেতু জন্ম নিয়েছে বাবার বাড়ি তো একদিন ছাড়তেই হবে।

আনিতারও তার ব্যতিক্রম না। এতদিন যে বাড়িতে ও নিজের মতো করে থেকেছে। ইচ্ছে স্বাধীন মতো চলাফেরা করেছে কাল থেকে সেই বাড়িতে ওকে অতিথি হয়ে আসতে হবে। একটা মেয়ের জন্য এটা খুবই কষ্টদায়ক।

বাবার আদরের রাজকন্যা হয় মেয়েরা। প্রতিটা বাবার চোখের মনি থাকে তার মেয়ে৷ সেই মেয়েকে ছোট থেকে ভালোবাসা দিয়ে আদর যত্নে বড় করে প্রতিটা বাবা। আগলে রাগে তাদের বুকে। সেই মেয়েকেই একটা সময় বিদায় দিতে হয় তাদের। একটা বাবার জন্যও এটা কম যন্ত্রণাদায়ক না। আনিতার আব্বুরও কষ্ট হচ্ছে ভীষন। অতি আদরের বড় মেয়েকে বিদায় দিতে হবে আজকে তার সেটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। তাই তো চোখ ভেঙে অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে। যে আব্বুকে আনিতা কখনো কাঁদতে দেখেনি সেই আব্বু আজকে কাঁদছে বিষয়টা আনিতারও ঠিক হজম হচ্ছে না। আনিতা ঝাপিয়ে পড়ে ওর আব্বুর বুকে। বাবা মেয়ে দুজনেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

কাঁদতে কাঁদতেই আনিতার আব্বু আহিয়ানের হাতে ওকে তুলে দেয়। আনিতা ওর আম্মু দাদু দুই চাচ্চু দুই কাকি ফুপ্পি সব্বাইকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করে। রুহি যখন আনিতাকে নিয়ে উল্টো ঘুরে গাড়ির দিকে চলে আসতে নেয় তখন ও আবারো গিয়ে ওর আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। অনিমাকেও জড়িয়ে ধরে আনিতা। গলা জড়িয়ে ধরে দু বোন বেশ কিছুটা সময় কান্নাকাটি করে। জেরিন শুভ রোদেলা তাসকিয়া আরোহী আনিতা ছয়জনে মিলে গ্রুপ হাগ করে একে অপরকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়ছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। ওদিকে নতুন বউয়ের জন্য অপেক্ষা করছে সকলে। রুহি আর অদ্রি আনিতাকে টেনে ছাড়িয়ে নেয় ওদের থেকে। গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় ওকে নিয়ে। তন্ময় গাড়ির দরজা খুলে দেয়। আনিতা গাড়িতে ঢোকার আগে আরো একবার সবার দিকে চোখ বুলাতেই ফাইয়াজের কথা মনে পড়ে ওর। এখানে সবাই উপস্থিত থাকলেও ফাইয়াজ নেই। আনিতার দু চোখ ফাইয়াজকে খুঁজছে। আনিতা ভাঙা ভাঙা গলায় তন্ময়কে জিজ্ঞেস করে,
–“ফা্ ফাইয়াজ ভাইয়া ক্ কোথায়?”

আনিতার কথায় সকলেই লক্ষ্য করে এখানে ফাইয়াজ নেই। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পর আনিতার চোখ গেলো ওদের থেকে হাত পনেরো দুরেই সেই মাঠটাতে বসে আছে ফাইয়াজ। বিয়ে বাড়ির লাইটিংয়ে স্পষ্ট ফাইয়াজকে বোঝা যাচ্ছে। আনিতা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় ফাইয়াজের দিকে। আনিতা পিছন থেকে ফাইয়াজের কাঁধে হাত রাখতেই ফাইয়াজ চমকে চোখের পানি মুছে পিছন ফিরে আনিতাকে দেখতে পায়। ঠোঁটের কোনে হাসি এনে বললো,
–“আনি বুড়ি এখনো বিদায় হোসনি? আমি আরো ভাবলাম তুই চলে গিয়েছিস। আমি এখন থেকে শান্তিতে থাকবো। আমাকে জ্বালানোর মতো কেউ থাকবে না। আম্মুর হাতের বিরিয়ানি আমি একা খাবো। আম্মু এখন থেকে আমাকেই বেশি ভালোবাসবে। তার ভাইয়ের মেয়েকে আর ভালোবাসবে না। বিন্দাস থাকবো আ___”

ফাইয়াজ পুরো কথা বলার আগেই আনিতা ঝাপিয়ে পড়লো ওর বুকে। দুই ভাই বোন একে অপরের গলা জড়িয়ে কাঁদছে তো কাঁদছেই। কান্না থামার কোনো নাম নেই। কে এদের দেখলে বলবে এরা মামাতো ফুপাতো ভাই বোন? এদের দেখলে যে কেউ বলবে এরা আপন ভাই বোন। ফাইয়াজ আনিতাকে জাপ্টে ধরে কান্না করে যাচ্ছে। কিছু সময় বাদে ফাইয়াজ আনিতাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে আহিয়ান ওদের কাছে এসে আহিয়ানের হাতের উপর আনিতার হাত রেখে বললো,
–“আমার আনিবুড়িকে আজকে থেকে তোর হাতে তুলে দিলাম। ওর চোখে যেন কখনো পানি না আসে। আমাদের সকলের খুব আদর যত্নে বড় করা ও। ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিস না আহিয়ান।”

আহিয়ান ফাইয়াজকে চোখ দিয়ে আস্বস্ত করে বলে,
–“চিন্তা করিস না। তোর বোন এই বাড়িতে যেমন ছিলো আমাদের বাড়িতেও সেভাবেই থাকবে। ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিবো না আমরা।”

অতিরিক্ত কান্না করার ফলে আনিতা সেন্সলেস হয়ে ফাইয়াজের বুকে ঢলে পড়ে। নিচে পড়ার আগেই ফাইয়াজ ভালো করে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। আনিতার আব্বু আম্মু সকলেই এদিকে দৌড়ে আসে। ফাইয়াজ সবাইকে শান্ত হতে বলে আনিতাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। আহিয়ান আগে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো। তারপর ফাইয়াজ আনিতাকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। আহিয়ান আনিতার মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। ফাইয়াজ আনিতার লেহেঙ্গা দোপাট্টা ভালো করে গুছিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজা আটকে দেয়। তন্ময় ফ্রন্ট সিটে উঠে বসে। আহিয়ান গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ফাইয়াজকে জিজ্ঞেস করলো,
–“তুই আসছিস কখন?”

–“তোরা যা। আমি একটু বাদেই অনিমাকে নিয়ে আসছি।”

গাড়ি ছেড়ে দিলো আহিয়ানদের। রুহি অদ্রি নাহিয়ান রাতুল আরহান ওরা সকলের থেকে বিদায় নিয়ে অন্য একটা গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি দুটো চোখের আড়াল হতেই আনিতার আব্বু আম্মু দাদু সকলেই বাড়ির ভিতরে চলে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ~

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here