শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব -২৬

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৬

ঘরটার দরজা বাহির থেকে আটকানো, দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই পায়ের নিচে র*ক্ত দেখতে পায় নিহান। পায়ের দিক থেকে সামনে তাকালেই দেখে শুভ্রতা দাঁড়িয়ে। নিহান জোরে চিৎকার দিয়ে বলে, ” শুভ্রা!”

নিহানকে চিনতে পেরেই দৌঁড়ে এসে নিহানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয় শুভ্রতা। শুভ্রতা শব্দ করে কান্না করছে নিহান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নিহান ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে বাহিরে দুজন পুলিশকে ইশারায় ভেতরে আসতে বলে। শওকত আলী আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কিছু ঘটবে তিনি চিন্তাও করেন নি। তিনি থ’ মে*রে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

দুজন পুলিশ কনস্টেবল টর্চ হাতে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। মেঝেতে একটা র*ক্তাক্ত পুরুষের দেহ পড়ে রয়েছে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকায় কে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দুজন ভেতরে গিয়ে দেহটা সোজা করে। শুভ্রতা নিহানের বুক থেকে মাথা তুলে সেদিকে তাকায়। নিহান পড়ে থাকা শরীরটা দেখেই শওকত আলীকে ডাক দেন।

” স্যার এদিকে একবার আসুন তো।”

শুভ্রতা ততক্ষণে নিহানকে ছেড়ে দিয়েছে। কান্না থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। নিহান শুভ্রতাকে হাত ধরে আবার কাছে নিয়ে এসে শুভ্রতার হাতে নিজের হাতটা রাখে। শুভ্রতার সারাশরীর কাঁপছে। নিহান শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি এসে গেছি শুভ্রা, এখন আর কোন ভয় নেই।”

শুভ্রতা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শওকত আলী রুমের ভেতর আসলে মেঝেতে পড়ে থাকা ব্যক্তির দিকে টর্চের আলো ফেলে বলে, ” এটা সেদিনের ছেলেটা না?”

তিনি ভালো করে দেখে বলেন, ” হ্যাঁ, সেদিনের ছেলেটা।”

” শুভ্রা কি হয়েছিল তোমার সাথে?”

নিহানের প্রশ্নে কোন উত্তর দেয় না শুভ্রতা। চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকে। সবার আর বুঝতে বাকি থাকে না ছেলেটা শুভ্রতার সাথে কি করতে চেয়েছিল। নিহান খুব কষ্টে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে আবার শুভ্রাকে জিজ্ঞেস করে, ” তুমি আত্মরক্ষার জন্য ওর এই হাল করেছ?”

শুভ্রতা এবার উপর নীচ মাথা নাড়ায়। শওকত আলী মান সম্মানের ভয় করছেন। কাল যখন সবাই জানতে পারবে তার ডিপার্টমেন্টে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে কি হবে তখন!

নিহান শওকত আলীর মুখ দেখে বুঝতে পারে তিনি চিন্তিত তার মজার ছলে এবার কনস্টেবলকে বলে, ” দেখুন তো বেঁচে আছে কি না? আমার হবু বউ খুব ছেলে পিটা*ইতে পারে। বেঁচে আছে তো নাকি?”

কনস্টেবল চেক করে দেখে বলে,” হ্যাঁ স্যার বেঁচে আছে।”

” ঠিক আছে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন ওকে তো আমি কালকে দেখে নিচ্ছি।”

” জি স্যার।”

একজন বাহিরে গিয়ে হয়তো টিম মেম্বারকে কল দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে বলে। নিহানও বাড়িতে কল দিয়ে জানিয়ে দেয় শুভ্রতাকে পাওয়া গিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বাড়ি ফিরবে। নিহান এবার শুভ্রতাকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলে, “তোর বান্ধবীর নম্বর মুখস্থ থাকলে কল করে জানিয়ে দে তুই ঠিক আছিস নইলে ওই মেয়েটাও চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারবে না।”

ছেলেটাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। নিহান এসআই -কে বললেন শওকত স্যারকে বাসায় পৌঁছে দিতে। শওকত আলী নিহানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিলেন।

নিহান আর শুভ্রতা হাটছে, কিছুদূরেই নিহানের বাইক রাখা। সেই অবধি হেটে যেতে হবে। রাত তখন একটা, চাঁদের আলো চারপাশে ছড়িয়েছে দুজন পাশাপাশি হাটতে হাটতে শুভ্রতা হঠাৎ থেমে যায়। শুভ্রতা থেমে যাওয়ায় নিহান ও দাঁড়িয়ে যায়। শুভ্রতার দিকে ফিরে বলে, ” কি হলো শুভ্রা?”

শুভ্রতা চুপচাপ নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিহান শুভ্রতার সামনে গিয়ে তার গালে হাত রাখতেই দূরে ছিটকে যায় শুভ্রতা। নিহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কি হয়েছে, আমাকেও ভয় লাগছে?”

” ওই ছেলেকে মা*রার জন্য কি আমারও শা*স্তি হবে নিহান ভাই?”

” না, তোর কিচ্ছু হবে না শুভ্রা। এখন আর দেরি নয় বাড়ি ফিরতে হবে সবাই কত চিন্তায় আছে ভাবতে পারছিস! শাকিরা নাকি বিয়েতেই বসেনি। ও বলেছে তুই ফিরলে তবেই বিয়েতে বসবে। মেয়েটা তোকে কতটা ভালোবাসে বুঝতে পারছিস?”

” আমার তো কিছু করার ছিল না। কীসের থেকে যে কী হয়ে গেল!”

” বাইকে বসে সব শুনছি, এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বললে আজ আর বাড়ি ফিরতে হবে না। মেয়েটার বিয়েও হবে না।”

” হুম চলেন।”

দুজন হাটা শুরু করে, দুই মিনিট হাটতেই বাইকের কাছে এসে দাঁড়ায়। নিহান বাইকে উঠে বসে শুভ্রতাকে উঠতে বলে। শুভ্রতা নিহানের কাধে হাত রেখে পিছনের সিটে বসে পড়ে।

রাস্তা ফাঁকা থাকায় বাইক খুব জোরে চালাচ্ছে নিহান। শুভ্রতা শক্ত করে ধরে বসে আছে। মনে মনে ভাবছে আল্লাহ যদি এই মানুষটাকে না পাঠাতো তাহলে হয়তো কয়েকদিন পর তার লা*শ উদ্ধার করত সবাই কারণ ওখানে কেউ যাওয়া আসা করে না। দুইদিন বা তিনদিন পর যখন মৃ*তদেহের পঁচা গন্ধ বের হতো তখন মানুষ উদ্ধার করত। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে সবকিছু ফেলে ফুলে প্রিয় মানুষকে খুঁজে বের করার জন্য এতরাত অবধি নিজে বাহিরে থাকতে পারে! আর এই মানুষটাকেই কী না সে এতগুলো বছর কষ্ট দিয়ে এসেছে! ভালোবাসার মানুষ তো সে যে শুধু মুখে ভালোবাসি না বলে বিপদে পাশে থাকে সবকিছু থেকে আড়াল করে রাখে। শুধু ভালোবাসলেই হয় না ভালোবেসে আগলেও রাখতে হয়।

নিহান কোন কথা না বলে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে কারণ শুভ্রতাকে এখনই কিছু জিজ্ঞেস করলে সে কষ্ট পাবে এমনিতেই কয়েকঘন্টা সে অনেককিছু সহ্য করেছে। তার আগে বিশ্রামের প্রয়োজন তারপর সব কথা শোনা যাবে।

চল্লিশ মিনিটের রাস্তা বিশ মিনিটে অতিক্রম করে বাড়ি ফিরে আসে সবাই। বাহিরের উঠোনে বাইক এসে থামতেই বাড়ির ভেতর থেকে সবাই ছুটে আসে।

শুভ্রতা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়, তার মা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। স্নিগ্ধাও এসে শুভ্রতার একপাশে দাঁড়িয়ে কান্না করছে। শুভ্রতা একহাত দিয়ে স্নিগ্ধাকে কাছে টেনে নেয় তাতে স্নিগ্ধা আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। শাহাদাত সাহেব ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে শুভ্রতা তার সামনে। চারপাশে সবাই শুভ্রতার দিকে এগিয়ে আসে। শুভ্রতা মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখের পানি মুছে দেয় আর বলে,

” আমি একদম ঠিক আছি মা, এই যে দেখো তোমার মেয়ে একদম ঠিক আছে কিচ্ছু হয়নি। কেঁদো না তো, একদম কাঁদবে না। এই স্নিগ্ধা থাম এবার, একদম কাঁদবি না। ”

শুভ্রতা এবার শাহাদাত সাহেবের দিকে অগ্রসর হয়। মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে গলা অবধি ভারী হয়ে যায়। শুভ্রতা এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরতেই শাহাদাত সাহেব শব্দ করে কেঁদে ফেলে। কিছুক্ষণ পর শুভ্রতা বাবার থেকেও নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিজের চোখের পানি মুছে বলে,

” বাবা তুমি বাচ্চাদের মতো কান্না করছো? তুমি তো আমার স্ট্রং বাবা, আমার সুপারহিরো। তাহলে তুমি কাঁদছো কেন? এই দেখো আমি একদম ঠিক আছে। আর কাঁদবে না।”

সবার চোখে পানি টলমল করছে, নিহান বলে ওঠে, ” বলেছিলাম না যে শুভ্রাকে নিয়েই আমি বাড়ি ফিরব? ফিরলাম তো! এবার সবাই কান্নাকাটি বাদ দিয়ে যাও তো বিয়ের ব্যবস্থা করো। কাজী সাহেব এখনো এখানেই আছেন, উনাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। এই রায়হান যা রেডি হয়ে নে, তোর বউয়ের আবার কাল পরিক্ষা আছে।”

নিহানের কথায় কেউ কেউ হেসে ফেলে কিন্তু শাকিরা একপাশে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলছে। শুভ্রতা সেটা খেয়াল করে। সব বোনগুলো এসে তাকে জড়িয়ে ধরায় শাকিরার দিকে যেতেও পারছে না। শুভ্রতাকে সবাই ছাড়লে সে শাকিরার কাছে যায়। শাকিরার সামনে গিয়ে বলে,

” যুদ্ধ জয় করে ফিরলাম, সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরল আর তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর হবু বর কি কাউকে জড়িয়ে ধরতে নিষেধ করেছে?”

শাকিরা তখনও অভিমান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা এবার রায়হানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” কি গো রায়হান ভাইয়া, বউকে কি নিষেধ করেছ নাকি?”

শুভ্রতার কথায় রায়হান হেসে বলে, ” আমি তো নিষেধ করিনি তার মনে কি চলছে সেটা তুই নিজেই দেখ।”

শাকিরা এবার কোন কথা না বলে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দেয়। শুভ্রতাও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শাকিরাকে।

আধাঘণ্টার মধ্যে শাকিরা আর রায়হানের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। সবাই যার যার বাড়িতে চলে যায়। নিহান নিজের বাইকে করে কাজী সাহেবকে বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়েছে।
শুভ্রতারও এখন গিয়ে গোসল করতে হবে। অন্য পুরুষ যে তাকে খুব নোংরাভাবে ছুয়েছে, সেই ছোয়া ঘষে ঘষে তুলতে হবে। বাড়ির সবার সামনে, কিছু হয় নি এমন ভাব করলে ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে চূড়মার হয়ে গেছে।
শাহাদাত সাহেব আগেই বাড়ি ফিরেছেন। শাকিরাদের বাসায় অনেকক্ষণ দেরি করে আয়েশা বেগম, স্নিগ্ধা, আবিরা, নেহা, তাদের মা সবাই একসাথে বাড়ি ফিরছে। শুভ্রতা রাবেয়া বেগমের হাত ধরে বলে,

” তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন বলো তো?”

রাবেয়া বেগম অভিমানী গলায় বলেন, ” কেউ কি আমার সাথে কথা বলেছে?”

” আরে ডার্লিং রাগ করছো কেন? তুমি আমার কেউ হও না?”

” না, কেউ হই না। কেউ হলে তো হতোই।”

” আরে হবু শাশুড়ী, আই লাভিউ উম্মাহ।”

শুভ্রতা রাবেয়া বেগমের গালে চুমু দিয়ে দেয়। আয়েশা বেগম পাশ থেকে বলে, ” কার ওপর রাগ,অভিমান করবে আপা? এই মেয়ের ওপর? কখনো পারবে না।”

#চলবে…..

সবার কি চিন্তা কমলো? আজকে গল্প দিতে না চেয়েও দিয়ে দিলাম, গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here