শেষটা সুন্দর পর্ব -১১

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।

মেহুলের বাবার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। তবে উনাকে এখন কেবিনে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, আশংকা মুক্ত। রামিনা বেগম তার স্বামীর পাশেই বসে আছেন। দুশ্চিন্তার ছাপ যেন উনার চোখে মুখে এখনো রয়ে গিয়েছে। উনি দু চোখ মেলে না তাকানো পর্যন্ত উনি যেন শান্তি পাচ্ছেন না।
এতক্ষণ মেহুলও কেবিনেই ছিল। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। তাই সবার জন্য কফি নেওয়ার জন্য ক্যান্টিনের দিকে যায়। নিচ তলায় ক্যান্টিন। একটা প্লেটে তিনটা কফি নিয়ে লিফটের কাছে আসতেই রাবীরকে দেখে সে। রিসিপশনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মেহুল ভাবছে তাকে ডাকবে কী ডাকবে না। সে তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য আসছে কিনা সেটাও সে সিউর না। কারণ রাবীর তো আর এত কিছু জানে না। রাবীর রিসিপশনে কথা বলে সামনে এগুতেই মেহুলকে দেখে। সে ছুটে যায় তার কাছে। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

‘বাবা এখন কেমন আছেন, মেহুল?’

‘আপনি বাবার কথা কী করে জানলেন?’

‘আপনাকে কল দিয়েছিলাম, ধরেননি বলে মা’কে কল দিয়েছি। পরে উনিই সবকিছু বলেছেন। আমাকে একবার জানাতে পারতেন তো। একা একা এতকিছু করেছেন।’

‘আপনি তখন ব্যস্ত ছিলেন, তাই আর কল দিইনি।’

‘স্যরি, আপনার কল দেখেও তখন রিসিভ করতে পারিনি। ইম্পোরটেন্ট একটা মিটিং এ ছিলাম।’

‘সমস্যা নেই, আমি বুঝতে পেরেছি।’

‘বাবা এখন কেমন আছেন।’

‘ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। তবে এখনো জ্ঞান ফেরেনি।’

‘আচ্ছা চলুন, দেখা করে আসি।’

দুজনে একসঙ্গে কেবিনে গেল। রামিনা বেগম রাবীরকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

‘ভালো আছেন, বাবা?’

‘জি মা, ভালো আছি। বাবার কথা শুনে আমারও ভীষণ খারাপ লেগেছে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না মা, বাবা একদম ঠিক হয়ে যাবেন।’

‘হ্যাঁ, ডাক্তার ও তো বললেন। কিন্তু, উনার তো এখনো জ্ঞান ফিরছে না।’

‘শরীরের উপর অনেক ধকল গিয়েছে তো, তাই হয়তো জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগছে। আপনি চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা বাবা। আপনি এখানে এসে বসুন।’

‘না না, সমস্যা নেই। আপনি বসুন, আমি এখানে ঠিক আছি।’

‘মেহুল, তোর হাতে কী?’

‘কফি এনেছিলাম, মা।’

‘জামাইকে দে তাহলে।’

‘না, আপনারা খান। অনেক পরিশ্রম করেছেন। কফি খেলে শরীরটা একটু হালকা হবে। মেহুল, আপনি মা আর চাচিকে কফি দিয়ে আসুন।’

মেহুল মা আর চাচিকে কফি দিল। আরেক গ্লাস কফি ছিল। সে এটা নিয়ে রাবীরের দিকে বাড়িয়ে দিতেই রাবীর মৃদু হেসে বলল,

‘আমি খাবো না, আপনি খান।’

‘না না, আপনি খান। আমার খেতে ইচ্ছে করলে আমি নিচে থেকে গিয়ে আবার নিয়ে আসব।’

‘মেহুল, আমার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে নিন।’

মেহুল আর জোর করল না। নিজেই কফিটা খেল।

________

সব শুনে রাবীর বলল,

‘পরে রক্ত কীভাবে জোগাড় করেছেন?’

রামিনা বেগম বললেন,

‘মেহুল একজনকে খুঁজে নিয়ে এসেছিল। ছেলেটা ফেরেশতার মতো এসে আমার স্বামীর প্রাণ বাঁচিয়েছে।’

‘যাক তাহলে, এখনো এমন ভালো মানুষ আছে বলেই না পৃথিবী টিকে আছে।’

মেহুল বলল,

‘হ্যাঁ, উনি আবার উনার কার্ডও দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, আবার রক্ত লাগলে উনাকে যেন জানায়।’

‘না, তার আর প্রয়োজন হবে না। প্রতিমাসে রক্তের ব্যবস্থা আমি করে দিব। আর আপনাদের এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এবার থেকে বাবার রক্তের দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে দিন। আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে রাখব।’

রাবীরের কথা শুনে সবাই খুব খুশি হয়। মেহুলও খুশি হয় খুব। ভরসা পায়। ভেতর থেকে শান্তি অনুভব করে। একবার হলেও মনে হয় তার, এই মানুষটাও কম ভালো না। একটু খানি ভরসা পাওয়ার জন্য এই মানুষটাই তার জন্য যথেষ্ঠ।

________

বাবার জ্ঞান ফিরেছে। তিনি মিটমিট করে চেয়ে সবাইকে দেখছেন। মেহুলের চোখ যেন ভিজে উঠে। ভরা গলায় ডেকে উঠে,

‘বাবা।’

তার বাবা ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে থাকে। জবাব দেয় না। রামিনা বেগমও কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু, তিনি অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়াতে সবার কথার বিপরীতে কিছু বলতে পারছেন না।

________

‘শুনছেন।’

রাবীর মেহুলের দিকে চাইল। বলল,

‘এভাবে ডাকলে কে না শুনবে, বলুন।’

‘আপনি এখন বাড়ি ফিরে যান। বাবা ঠিক আছেন, সকালেই আমরা বাবাকে বাড়ি নিয়ে যাব।’

‘আপনাদের এখানে একা রেখে আমি কী করে যাব। ঐদিকে মাও তো দুশ্চিন্তা করছেন। এখানে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, আমিই আনিনি। নয়তো উনিও এখানে থেকে যেতে চাইতেন।’

‘কিন্তু, এখানে আপনি এভাবে বসে বসে কী করে রাত কাটাবেন? আরেকটা কেবিন নিয়ে ফেললেও তো হয়।’

‘আপনি কি আমার সাথে সেই কেবিনে থাকবেন?’

মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘ওটা হসপিটালের কেবিন, আপনার বেডরুম না যে আমি থাকব।’

রাবীর হাসে। বলে,

‘সেজন্যই বলেছি, আমি এখানে ঠিক আছি। আপনিও তো এখানে আমার সাথে আছেন। তাহলে আর চিন্তা কীসের?’

‘আপনি সারারাত না ঘুমিয়ে কালকে সারাদিন কাজ করতে পারবেন? শরীর খারাপ লাগবে না?’

‘এমন কত না ঘুমিয়ে থেকেছি। কিচ্ছু হবে না।’

মেহুল একটু শান্ত হয়ে বসে। রাবীর তার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বলে,

‘আজকাল আমাকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছেন আপনি।’

মেহুল তার দিকে তাকায়। বিরক্তর ভঙ্গিতে বলে,

‘আমাদের খাতিরে কষ্ট করছেন বলে ভাবছি। না হলে কখনোই ভাবতাম না।’

রাবীর মৃদু হাসে। বলে,

‘ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম।’

রাবীরের পি এ তখন আসে। হাতে কিছু ব্যাগ। এসে রাবীরের কাছে গিয়ে বলে,

‘স্যার, খাবার নিয়ে এসেছি।’

‘ভেতরে গিয়ে, সবগুলো পরিবেশন করুন। আমরা আসছি।’

পি এ তার কথা মতো ভেতরে যায়। মেহুল অবাক হয়ে বলে,

‘বাইরে থেকে খাবার আনার কী দরকার ছিল। আমরা ক্যান্টিনেই খেয়ে ফেলতে পারতাম তো।’

‘কিন্তু, আমি চাইনা আপনারা ক্যান্টিনে খান। তাই এনেছি। চলুন, একসাথে খাওয়া যাক তাহলে।’

________

সবাই ঘুমাচ্ছে। মেহুলের বাবা অল্প খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে এখন আবার ঘুমাচ্ছেন। মা সোফার এক কোণে বসে ঘুমাচ্ছেন। বাসায় বাচ্চাগুলো একা বলে চাচি চলে গিয়েছেন। মেহুল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে কেবিনের ভেতরে লাইট অফ। মা আর বাবা ছাড়া আর কেউ নেই সেখানে। রাবীর কোথায়?

মেহুল কেবিনের দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বাইরে বের হয়। বাইরে গিয়েও দেখে রাবীর নেই। লোকটা কি চলে গেল? না, চলে গেলে অবশ্যই তাকে বলে যেত। মেহুল মুখ কালো করে বসার সিটে গিয়ে বসল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে রাবীরকে লিফট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল হাতে দু’টো কফির গ্লাস নিয়ে।

রাবীর কফি নিয়ে এসে তার পাশে বসে। মেহুলকে একটা কফির গ্লাস দেয়। মেহুল কফির গ্লাস নিয়ে বলে,

‘আপনি মাস্ক পরে আছেন কেন?’

‘আর বলবেন না, ক্যান্টিনে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এই সময় হয়তো মানুষ কম থাকবে। কিন্তু, গিয়ে দেখি অনেক মানুষ। এখন তাদের সামনে গেলেই সবাই আমাকে চিনে ফেলতো। আজকাল মানুষদের দিয়ে তো আর কোনো ভরসা নেই। কী থেকে কী ভিডিও বানিয়ে একটা ক্যাপশন দিয়ে ভাইরাল করতে তো দু মিনিটও লাগে না। তাই মাস্ক পরে সেইফ জোনে ছিলাম।’

মেহুল কফির কাপে চুমুক দিয়ে মজার ছলে বলল,

‘সেলিব্রেটি হলে কত ঝামেলা। তার চেয়ে আমরাই ঠিক আছি। যা খুশি করতে পারি, কাউকে এত পাত্তা দেওয়ার সময় নেই।’

‘আপনিও একদিন এসব ফেইস করবেন। বেশি দেরী নেই। সাংবাদিকরা সব আটঘাট বেঁধে বসে আছেন। কবে আমি আপনাকে নিয়ে মিডিয়ার সামনে যাব। আর কবে উনারা আমাদের বিয়ে নিয়ে নিউজ বানাবেন।’

মেহুল আঁতকে উঠে এই কথা শুনে। বলে,

‘না না, জীবনেও না। আমি ভুলেও এসব মিডিয়ার সামনে যাব না। আমি যেমন আছি তেমনই ভালো। কোনো সেলিব্রেটি হতে চাই না।’

‘এখন না চাইলেও তো কিছু করার নেই। আমার ওয়াইফ হিসেবে তো সবাই’ই আপনাকে দেখতে চাইছেন। এখন না দেখিয়ে আর কোনো উপায় আছে কি?’

মেহুল ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘আশ্চর্য তো! আপনার বউ, আপনি না দেখাতে চাইলে দুনিয়ার কারোর ক্ষমতা আছে, আমাকে এসে দেখার? আপনি সবাইকে সাফ বারণ করে দিবেন। আপনার বউ, আপনি কাউকে দেখাবেন না। পরে যদি সবাই আপনার বউয়ের উপর নজর লাগিয়ে দেয়? তখন কিন্তু আপনার সুন্দর বউ একদম বিচ্ছিরি হয়ে যাবে। তাই ভুলেও এমন করতে যাবেন না।’

রাবীর ঠোঁট চেপে হাসে। কফিটা শেষ করে বলে,

‘সেটা অবশ্য আমিও ভাবছিলাম। সুন্দরী বউ বিয়ে করলেও জ্বালা, সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে রাখতে হয়। ভয় হয়, যদি কেউ আবার আমার জিনিসের উপর নজর দিয়ে ফেলে।’

মেহুল তখন তার দিকে ফিরে চায়। মিহি সুরে বলে,

‘তখন না হয় আপনি সেই নজর একদম উপড়ে ফেলবেন।’

রাবীর চট করে চোখ মুখ শক্ত করে বলে,

‘তা তো অবশ্যই করব। আমার সম্পত্তির উপর কারোর অধিকার তো দূর, নজর পড়লেই সে আর দ্বিতীয়বার তাকানোর সুযোগ পাবে না।’

রাবীরের এমন চোখ মুখ দেখে মেহুল খানিক ভীত হয়। এই লোকটা যে তার ব্যাপারে প্রচন্ড পজেসিভ, সেটা আর তার বুঝতে বাকি থাকে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here