#শেষটা_সুন্দর
#সিজন_২
#পার্ট_৯
#নিশাত_জাহান_নিশি
নূর আয়মনের থেকে চোখ ফিরিয়ে চাঁদনীর তাকাল। চাঁদনী হাসতে হাসতে যেই না বসা থেকে উঠে দৌঁড় লাগাতে যাবে অমনি নূর চাঁদনীর শাড়ির আঁচলটা এক হাত দিয়ে মুঠ করে ধরে ফেলল।
চাঁদনী ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা মুখে দিয়ে, চোখ গুলো পিটপিট করে, ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ করে নূরের দিকে তাকাল। নূর খুব মোডে ছিলো, ভেবেছিলো চাঁদনীকে দু এক্টা ধমক দিয়ে এরপর নিজের মনটাকে শান্তি করবে। কিন্তু না, তা আর হলো না। চাঁদনীর মায়াভরা ফেইস দেখে নূর আর হিংস্র হতে পারল না। উল্টো শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে হু হা করে হেঁসে দিলো। নূরের হাসি দেখে উপস্থিত সবাই হেসে দিলো। চাঁদনী ছাড়া পেয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে বুকের ভিতর অসংখ্য থু থু ছিটাতে লাগল। চাঁদনীরর কান্ড দেখে নূর হেসে হেসে বলল,,,,,,,
—“প্লিজ চাঁদ, বাচ্চামো বন্ধ করো। আমার খুব হাসি পাচ্ছে। তোমাকে এই মুহূর্তে পাঁচ, ছয় বছরের পুচকি এক্টা গলুমলু বাচ্চার মতো লাগছে। ইচ্ছে করছে গাল দুটো টেনে দিতে।”
চাঁদনী কিছুটা লজ্জা পেয়ে শাড়ির আঁচলটা ডান হাতের মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে নিচের দিকে তাকিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,,,,,
–“আমার কোনো প্রবলেম নেই। তুমি চাইলে আমার গাল দুটো টেনে দিতে পারো। আসলে কেউ আমার গাল টেনে দিলে আমার খুব মজা লাগে।”
চাঁদনীর কথায় নূর কিছুটা নড়ে চড়ে বসল। কেমন এক্টা সেইম ফিল করছে নূর। বাকি তিনজন নিচের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। নূর কথা ঘুড়ানোর জন্য শার্টের কলারটা ঠিক করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,
–“সবাই কি এভাবেই বসে থাকবি? বাড়ি যাবি না? কিছুক্ষন পরই তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। জায়গাটা খুব বিপদজনক, কখন কোন বিপদ হয়ে যায়। আমার মনে হয় না, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবে।”
নূরের কথায় সবাই সম্মতি জানিয়ে বসা থেকে উঠে পড়ল সাথে নূর ও। চাঁদনী এখনো নূরের পাশে দাঁড়িযে আছে। হুট করে চাঁদনী নূরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
–“নূর ভাইয়া…..তোমার বাইক কিন্তু এখনো ল্যাকের কাছে পার্ক করা। বাইক ছাড়াই কি বাড়ি চলে যাবে নাকি?”
নূর চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে জিভ কেটে বলল,,,,,
–“দেখেছ? একদম ভুলে গেছি। ইদানিং কিছুই মনে থাকে না। কি জানি, কবে আবার নিজেকেই ভুলে যাই।”
নূর আরো অনেক কিছু আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে বাইকের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। চাঁদনী ও নূরের পিছু পিছু ছুটল। বাইকটাকে হাতে টেনে নূর পার্ক অব্দি নিয়ে এলো। পিছন থেকে চাঁদনী বাইকটাকে দু এক্টা ধাক্কা দিচ্ছে। আয়মন নূরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
–“তুই আর চাঁদ বাইকে করে চলে যা। আমার গাড়িটা ভার্সিটির সামনের গ্যারেজটাতে পার্ক করা। গাড়িটা নিয়েই আমরা তিনজন বাড়ি চলে যাবো।”
নূর আয়মনের কথায় সম্মতি জানিয়ে বাইকে বসে পড়ল। চাঁদনী মুখটা গোমড়া করে আয়মনের পাশে দাঁড়িয়ে আয়মনকে সমানে চিমটি দিতে লাগল। আয়মন বুঝতে পেরেছে চাঁদনী কিছু বলতে চায়। তাই সে এক্টু পিছু হটে দাঁড়াল। চাঁদনী ও আয়মনের পিছু পিছু গেলো। আয়মন চাঁদনীর দিকে এক্টু ঝুঁকে মিনমিন করে বলল,,,,,
–“কি হয়েছে? এভাবে চিমটি কাটছিলি কেনো?”
চাঁদনী হেলেদুলে মুখটা গোমড়া করে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,
–“আমি বাইক ড্রাইভ করব। নূর ভাইয়াকে বল না, আমাকে এক্টা চান্স দিতে।”
আয়মন চাঁদনীর নাক টিপে বলল,,,,
–“সারচে, তোর হাতে দায়িত্ব দিলে আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না।”
চাঁদনী ওর নাক থেকে আয়মনের হাতটা সরিয়ে বলল,,,,,
–“কেনো রে? শিষ্যের প্রতি বিশ্বাস নেই তোর? তুই ই তো আমাকে বাইক ড্রাইভ শিখিয়েছিস।”
–“গুরু বলেই তো শিষ্যের উইক পয়েন্ট টা খুব ভালো করে জানি। নির্ঘাত তুই বিপদ ঘটাবি। মনে আছে? লাস্ট টাইম তুই সাব্বিরের পা ভেঙ্গেছিলি। নির্ঘাত সাব্বিরকে ঘোষ দিয়ে মুখটা বন্ধ করিয়েছিলাম, না হয় মামানী তোর বারোটা বাজাতো।”
চাঁদনী ছোট বাচ্চাদের মতো পা, হাত কচলাতে কচলাতে আয়মনের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে বলল,,,,,
–“ঐটা তো পাঁচ মাস আগের কথা। এখন আমার হাত চালু হয়ে গেছে। খুব ভালো ভাবে ব্রেক কষতে পারি। সামনে কোনো বিপদ দেখলে হুট করে বাইক থামিয়ে দিতে পারি। বল না ভাইয়া, প্লিজ বল না।”
চাঁদনীর ঘ্যান ঘ্যানানি আস্তে আস্তে বেড়ে কান্নায় রূপ নিচ্ছে। ঐ দিকে নূর চোখে মুখে চরম বিরক্তি নিয়ে হাত দুটো বুকের উপর গুজে বাইকের উপর বসে আছে। আয়মন আর টিকতে না পেরে চাঁদনীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,
–“নূর কখনো রাজি হবে না চাঁদ। উল্টো কানের নিচে দুটো বাজিয়ে দিবে। এমনিতেই ওর মন মেজাজ খারাপ। কিছু এক্টা উল্টা পাল্টা হলে তোকে খুব বকবে আবার মারবে ও।”
চাঁদনী মুখটা ছোট করে আবার ঘ্যান ঘ্যান করে বলল,,,,
–“কিচ্চু উল্টা পাল্টা হবে না। আমি পারব ভাইয়া। প্লিজ নূর ভাইয়াকে বল না।”
আয়মন এবার কিছুটা রেগে বলল,,,,
–“কেনো রে? আমি কেনো বলব? তুই গিয়ে বলতে পারিস না? তোর তো জামাই+ভাই দুইটাই লাগে!”
চাঁদনী হুট করে আয়মনের হাত ধরে বলল,,,,,,
–“ভয় পাই আমি। তুই এক্টু বলে দে না। প্লিজ ভাইয়ু।”
চাঁদনীর ভাইয়ু ডাক টা শুনে আয়মনের মন গলে গেলো। আয়মন আর দাঁড়িয়ে না থেকে চাঁদনীর কাঁধে ওর হাত ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নূরের সামনে এসে দাঁড়াল। নূর বাইকের স্টিয়ারিং ধরে আনমনা হয়ে বসে আছে। আয়মন নূরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
–“নূর, তোর শরীরটা তো তেমন ভালো না। তাই আমি বলছিলাম কি……………
নূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকিয়ে আছে। নূরের চাহনি দেখে আয়মন আর কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। ঐদিকে চাঁদনী আয়মনের হাতে এক নাগাড়ে চিমটি কেটে যাচ্ছে। আয়মন এক্টু পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে। নূর আয়মনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,,,,
–“আজব…থেমে গেলি কেনো?”
আয়মন এখনো চুপ করে আছে। মৌনতা ভেঙ্গে চাঁদনী হুট করে বলে উঠল,,,,,
–“নূর ভাইয়া…. আমি না, খুব ভালো বাইক ড্রাইভ করতে পারি। আমার খুব শখ তোমাকে নিয়ে বাইক ড্রাইভ করার। দাও না, আমার ইচ্ছে টা পূরণ করতে। তাছাড়া, তোমার শরীরটা তো খুব দুর্বল। তুমি পারবে না ড্রাইভ করতে। এর চেয়ে বরং ড্রাইভিং করার দায়িত্বটা তুমি আমাকে দিয়ে দাও।”
আয়মন ও এবার চাঁদনীর সাথে তাল মিলিয়ে বলল,,,,,
–“হুম নূর। চাঁদ খুব ভালো বাইক ড্রাইভ করতে পারে।”
আয়মন কিছুটা ভাব নিয়ে শার্টের কলার উঁচু করে বলল,,,,
–“গুরু যেমন, শিষ্য ও তো তেমন ই হবে তাই না?”
নূর এহেম এহেম আওয়াজ করে গলাটা ঠিক করে বলল,,,,,,
–“এ্যা বাবা। তাহলে তো আমি কোনো মতেই চাঁদের উপর এতো বড় দায়িত্বটা দিতে পারব না। যেখানে গুরুই বেপরোয়া, সেখানে যে শিষ্য ঠু মাচ বেপরোয়া হবে না এর গ্যারান্টি কি?”
মুহূর্তেই আয়মনের হাওয়া ফুস হয়ে গেলো। চাঁদনী মাটিতে ধপ করে বসে হাত পা ছুড়াছুড়ি করে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো। উপস্থিত সবাই বেকুব হয়ে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদনী নাকের পানি, চোখের পানি এক করে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুচছে বলছে,,,,,,,
–“আমার শর্ত না মানলে আমি কিছুতেই আজ বাড়ি যাবো না। এখানে বসেই হাত পা ছুড়াছুড়ি করে কাঁদব।”
নূর বাইক থেকে নেমে চাঁদনীর পাশে বসে কিছুটা রাগী স্বরে বলে উঠল,,,,
–“তোমার না পায়ে খুব ব্যাথা, তাহলে এভাবে হাত পা ছুড়াছুড়ি করে কাঁদছ কেনো? ভিজা শার্ট পড়ে ঘুড়ছি শুধুমাএ তোমার পায়ের ব্যাথা সারানোর জন্য। আর তুমি কিনা আমার সব কষ্ট পা দিয়ে পিষিয়ে চাটনি বানিয়ে দিচ্ছ। উঠো বলছি, তাড়াতাড়ি উঠো। ড্রাইভিং করার যেহেতু এতোই শখ। যাও… দিলাম তোমার শর্ত পূরণ করে।”
চাঁদনী বএিশ পাঁটি বের করে চোখের পানি গুলো মুছে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর শাড়ির আঁচলটা ভালো করে কোঁমড়ে বেঁধে চুল গুলো হাত খোঁপা করে আয়মন, নীড় আর হিমেলকে চোখ মেরে বাইকের দুই হ্যান্ডেল ধরে বসে পড়ল বাইকে। নূর হা করে চাঁদনীর কাহিনী দেখছে। চাঁদনী বাইকে বসে ইশারা করে আয়মনকে বলল কাছে আসতে। আয়মন ও ভ্যাবলার মতো চাঁদনীর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পড়ল। চাঁদনী এক্টা ডেবিল স্মাইল দিয়ে আয়মনের শার্টের পকেট থেকে কালো সানগ্লাস টা ছোঁ মেরে নিজের চোখে সেট করে নিলো। উপস্থিত সবাই অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। নূর তো এখনো থম মেরে নিচেই বসে আছে।
চাঁদনী চশমাটা চোখ থেকে এক্টু নিচে নামিয়ে নাকের মাঝামাঝিতে রেখে নিচে বসে থাকা নূরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
—“Come back and sit down. I’m ready to go.” (পিছনে এসে বসে পড়ো। আমি সেজে গুজে প্রস্তুত।)
নূর এক্টা শুকনো ঢোক গিলে বসা থেকে উঠে চাঁদনীর পিছনে বসে পড়ল। নূর দুই পাশে দুই হাত ঝুলিয়ে তব্দা লেগে বসে আছে। চাঁদনী পিছু ফিরে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,
–“আজব… এভাবে এতিম বাচ্চার মতো তব্দা লেগে বসে আছো কেনো? আমার কোমড়ে হাত রাখ। না হয় হাওয়ার উড়ে দুই মাইল বেগে ছিটকে পড়বে।”
নূর কিছুটা রেগে বলল,,,,,
–“চুপ করে বাইকটা স্টার্ট করো। আমি মেয়েদের মতো ঢঙ্গ করে গায়ের সাথে চিপকে বসতে পারব না। সিক্স প্যাক ওয়ালা বডি আমার, এতো সহজে হাওয়ায় উড়ে ছিটকে পড়ব না। ভয় তো পাচ্ছি তোমাকে নিয়ে, তুমি না আবার ড্রাইভিং সিট থেকে উড়ে আমার গায়ে ছিটকে পড়ো। তখন কিন্তু দুজনই গাড়ির নিচে চাঁপা পড়ব।”
চাঁদনী কিছু বলতে যাবে এর আগেই মাগরিবের আযান পড়ে গেলো। চাঁদনী আর কথা না বাড়িয়ে ভোঁ ভোঁ করে গাড়ি স্টার্ট করে পা দিয়ে গিয়ার চেঁপে হাত দিয়ে এক্সিলেটর ধরে বাইক নিয়ে ছুটল। আয়মন, নীড় আর হিমেল পিছু পিছু দৌঁড়াতে লাগল। নূর টাসকি লেগে বসে আছে। চাঁদনী আসলেই খুব ভালো বাইক চালাতে পারে।
মধুমতী পার্ক ক্রস করে চাঁদনী গাড়ি নিয়ে মেইন রাস্তায় চলে এলো। এখনো পুরোপুরি দিনের আলো কাটে নি। আকাশটা নিভু নিভু করে জ্বলছে। আবছা আলোয় চারপাশটা ভালোই দেখা যাচ্ছে। এক্টু পরেই হয়তো ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে। পথচারীরা হা করে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝ বয়সী ছেলেরা চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে বুকে হাত দিয়ে হ্যাং মেরে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদনীকে এই লুকটাতে কম বয়সী বলিউড হিরোইন আলেয়া ভাটের মতো লাগছে। এক্টা পুচকো ছেলে চাঁদনীকে দেখে শিষ মেরে বলল,,,,
–“ইউ আর লুকিং সো কিউট দি। তোমাকে আমার স্বপ্নের নায়িকার মতো লাগছে।”
চাঁদনী আড় চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হু হা করে হেসে দিলো। নূর মুখে হাত দিয়ে বাচ্চা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে।
নূর চারপাশে তাকাচ্ছে আর লোকজনের অদ্ভুত চাহনী দেখে অবাক হচ্ছে। চাঁদনী বাইকটা হাওয়ার বেগে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হুট করে চাঁদনী নূরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
–“নূর ভাইয়া….আমি মনে হয় পথ ভুলে উগান্ডার রাস্তায় চলে এসেছি। মানুষ, গরু সবাইকে কেমন কালো কালো লাগছে। আমাদের দেশের মানুষ তো এতো কালো না।”
নূর হু হা করে হেসে চাঁদনীর সাথে এক্টু চিপকে বসে চাঁদনীর চোখ থেকে সানগ্লাসটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,,,,,
–“এবার নিশ্চয়ই মানুষ, গরু সবাইকে ফর্সা ফর্সা দেখছ?”
–“এমা, এই কালা চশমার জন্য এতো ক্ষন ভুল ভাল দেখেছি। ধুর বাবা, আমি কিনা এতোক্ষন আজাইরা টেনশান করছিলাম!”
নূর কিছুটা কঠোর কন্ঠে বলল,,,,,,
–“এতো ভনভন না করে মনযোগ দিয়ে গাড়িটা চালাও। কখন কোন বিপদ ঘটিয়ে বসো আল্লাহ্ মালুম।”
চাঁদনী যেই না পিছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে নূর কে কিছু বলতে যাবে অমনি ঠাস করে বাইক থেকে ছিটকে পড়ে দুজনই রাস্তার ফুটপাতে পড়ে গেলো। ভাগ্যিস রাস্তার মাঝখানে এই অনর্থটা হয় নি। নূরের গায়ের উপর চাঁদনী চিপকে আছে। বাইকটা ওদের থেকে এক্টু দূরে গিয়ে উল্টে পড়েছে। ওদের গায়ে কোনো রকম চোট লাগে নি। ওরা দুজনেই সেইফ আছে।
নূর চোখ লাল করে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদনী শুকনো ঢোক গিলে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। নূর যেই না গর্জন দিয়ে চাঁদনীকে কিছু বলতে যাবে অমনি পুরুষালী কন্ঠে কেউ তোতলিয়ে ওদের দুই জনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,
—“তোলা দুদনই আমাল বাইট তারাপ তলে দিয়েতিত! এতনি আমাল বাইট তিক কলে দিবি। নইলে দুতো বাংলা মতের টাতা দিবি। না হয় তোতের তাড়ব না আমি।”
নূর আর চাঁদনী দুজনই লোকটির দিকে তাকাল। লোকটির দুই হাতে দুটো বিয়ারের বোতল। দেখে মনে হচ্ছে বাংলা মদ। লোকটি উড়া ধুরা ড্রিংক করে উল্টো পাল্টা বকছে। দুটো বিয়ারেই উনি সমান ভাবে চুমোক দিচ্ছে আর গোল গোল হয়ে ঘুড়ছে।
লোকটাকে দেখতে কিছুটা হিরো আলমের মতো লাগছে। রোগা, পাতলা শরীর। কুচকুচে কালো গায়ের রং। দাঁত দুটো উঁচু হয়ে ঠোঁট ভেদ করে বের হয়ে আছে। এই কালা চান্দ আবার গায়ের উপর লাল টি-শার্ট জড়িয়েছে। হাইট টা পাঁচ ফিটের বেশি হবে না। লোকটি বেসামাল হয়ে মুহূর্তের মধ্যেই দশ থেকে বারো বার হেলেদুলে পড়ছে। এতোটা নেশাক্ত হয়ে ও উনি মদের বোতল দুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে বোতল দুটোই উনার প্রাণ ভোমরা।
লোকটিকে দেখে চাঁদনী আর হাসি আটকে পারল না। চাঁদনী চোখ বন্ধ করে নূরের বুকে এলোপাথারী কিল, ঘুষি মারছে আর হু হা করে অট্ট হাসিতে ফেঁটে পড়ছে। নূরের ও খুব হাসি পাচ্ছে। তবে চাঁদনীর কার্য কলাপে নূর খুব বিরক্ত। নূর চোয়াল শক্ত করে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে আছে আর রাগে ফুসফুস করছে। মনে হচ্ছে কোনো বিষাক্ত সাপ রেগে মেগে তার ভয়ংকর রূপটা প্রকাশ করছে। ফুসফুসানির আওয়াজটা চাঁদনীর কানে এসে বারি খাচ্ছে। চাঁদনী এবার হাসি থামিয়ে নূরের উপর থেকে উঠে ভয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে সমানে লাফাচ্ছে আর চিৎকার দিয়ে বলছে,,,,,,
–“সাপ, সাপ, সাপ নূর ভাইয়া এখানে সাপ আছে। প্লিজ এখান থেকে উঠো বসো। তোমার আশে পাশেই সাপপটা আছে। আমি ভয়ংকর সাপটার ফুসফুসানির আওয়াজ শুনেছি। নিশ্চয়ই নাগ অথবা নাগিন হবে।”
হিরো আলমের মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা এক ঝটকায় হাতের দুটো বিয়ারের বোতল রাস্তায় ছুড়ে মেরে ফুটপাতের কাছে শাখা প্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটাকে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বাঁদড়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সোজা গাছটার মাঝামাঝিতে এসে চোখ দুটো বন্ধ করে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,
–“সাপ, সাপ, সাপ কোথায় সাপ? আমি সাপে খুব ভয় পাই। শো, শো এই সাপ যা। আমার ধারে কাছে ও ঘেঁষবি না। না হয় তোকে ধরে বেঁধে ওঝার কাছে দিয়ে আসব।”
নূর আর হাসি আটকে রাখতে পারল না। হাসতে হাসতে নূর অর্ধ শোয়া থেকে পুরো শোয়া হয়ে গেলো। চাঁদনী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বট গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,
–“ভাই, আমাকে ও সাথে নিয়ে যান। আমি ও সাপে খুব ভয় পাই। দেখুন না, এখনো কেমন ফুসফুস ফুসফুস করছে। মনে হচ্ছে এখনি তেঁড়ে এসে ছোবল বসিয়ে দিবে।”
লোকটা দ্বিগুন ভয় পেয়ে দুর্বল শরীর নিয়ে আফ্রিকার হ্যাংলা পাতলা বাঁদড়ের মতো দৌঁড় ঝাপ দিয়ে একদম বটগাছের চূড়ায় উঠে জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে বলল,,,,,,
–“বইন মাফ চাই। আমারে এক্টু হেল্প কর। সাপটারে এই খান থাইক্কা ভাগা। সাপের ভয়ে আমার নেশা কেটে গেছে। হাজার টাকার মদ কিনেছিলাম, সব এক ঝটকায় শেষ হয়ে গেলো। আমার টাকা ও গেলো এখন জীবনটা ও যাবে।”
চাঁদনী নিচ থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে,,,,
–“ভাই আপনি তো গাছে উঠে জীবন বাঁচিয়ে নিলেন। এখন আমার কি হবে? সাপ তো এবার আমার জীবনটা নিবে। ভাই…. গাছে উঠার টেকনিকটা আমাকে এক্টু শিখিয়ে দিবেনন? আমি ও গাছে উঠব।”
নূর দুইজনের কান্ড দেখছে আর হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নূর আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, লোকটার বাইকটা রাস্তার সাইডে কাহিল হয়ে উল্টে পড়ে আছে। আদৌ এটা বাইক নাকি সাইকেল নূর ঠিক বুঝতে পারছে না। সামনের অংশটা সাইকেলের মতো আর পিছনের অংশটা বাইকের গদির মতো। উভয়ের মিশ্রণে বাইকেল বললে মন্দ হয় না। বাইকেলটা এমনিতেই আধ মরা অবস্থায় ছিলো। এখন তো ড্যাড বডি হয়ে ফুটপাতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।
নূর মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,,,
—“কি আজব, লোকটা মিথ্যা সাপের ভয়ে বাইক, মদ এই দুটো ছেড়েই গাছের চূড়ায় চেঁপে বসল। অথচ এক্টু আগেই লোকটা বাইকের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই দুটো বাংলা মদ চেয়েছে।”
এসব ভেবে নূরের হাসির পরিমান আরো বেড়ে যাচ্ছে।
লোকটি গাছের চূড়ায় বসে ভয়ে মুখের ভাষা চেইন্জ্ঞ করে চাঁদনীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,
–“আমি তোমারে শিখাইয়া দিতাছি কেম্নে গাছে উঠবা। প্রথমে শাড়ি টা ভালো কইরা কোমড়ে গুইজ্জা লও।
#চলবে,,,,,,,,,
(শেষের কয়েকটা লাইন লিখতে গিয়ে অনেক হেসেছি। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। জানি না আপনারা কতোটা হেসেছেন।)