শেষ অধ্যায়ে তুমি পর্ব -০৮+৯

#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৮

তূরের বাবা-মা নিজেদের কিছুটা সামলানোর চেষ্টা করেছে এই একমাস। এইটুকু ভেবে একটু ভালো আছে যে তাদের মেয়ে জীবিত আছে। কোন না কোন এক সময় হয়তো কোমা থেকে ফিরে আসবে। মেয়েটাকে তো দেখতে পারছে তারা এটাই বা কম কিসে! প্রথম সন্তানের মাধ্যমে প্রত্যেক বাবা-মা, বাবা-মা হওয়ার সুখ লাভ করে আর সেই প্রথম সন্তান যখন জীবন- মৃত্যুর সন্নিকটে তখন বাবা-মার অবস্থা কেমন হয় তা তারাই বুঝে।

নাফিহা পড়াশোনা বিষয়ক কোন সমস্যা হলে বড় বোনের কাছে দেখাতে পারত এছাড়া জীবনের অন্যান্য সমস্যাও বড় বোন হিসাবে তূর সলভ করার চেষ্টা করতো আগলে রাখতো তাকে। নীরা তূরের ছোট হয়েও তূর যখন বাচ্চামো করতো সে তখন বড় বোনের মত নিজের বড় বোনকে শাসন করতো আবার নীরার জীবনে কোন প্রবলেম হলে তূর সেটা দেখতো।

———-
সময় থেমে থাকে না। আরো একমাস কেটে গেছে।
নাদিয়া ও শাফকাতের বিয়ে সামনের মাসে হাতে আছে সতেরো দিন। তারা খুব করে চাচ্ছে তূর কোমা থেকে রিকোভার করুক। রাফি ও ইনায়ার বিয়েটা হবে আমেরিকা যাওয়ার কিছুদিন আগে পারিবারিকভাবে। তারপর আমেরিকা থেকে ফিরে আসলে আনুষ্ঠানিকভাবে ওদের আবার বিয়ে দিবে। তূরের সব বন্ধুরা বায়োকেমিস্ট্রি রিলেটেড যেসব কোম্পানি ও ল্যাব আছে সেগুলোতে রিসার্চ করছে শুধু নাদিয়া বাদে। কিছু কিছু কোম্পানিতে ফ্রেশারদের চাহিদা অনেক কারণ তারা সদ্য গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে রানআপের মধ্যে আছে।

মিহাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তানজিনার সাথে যেভাবেই হোক একটু সময় নিয়ে দেখা করবে। তানজিনার কাছ থেকে জানতে চায় সে কি কারনে এমন করছে। নাটকীয়তা দিয়ে ভরে গেছে মিহালের জীবন। তানজিনার প্রতি তার ভালোবাসা কখনোই বাড়াবাড়ি রকমের ছিলোনা কিন্তু জেদটা ছিল। তানজিনাকে আইনতভাবে নিজের করে নিয়েও কেন জানি মনে কখনো স্বস্তি হয়নি। হয়তো ধর্ম অনুসারে পবিত্রভাবে বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়াতে!! মিহাল একটা বিহিত চায় এই সম্পর্কের। সে আর চায়না কারো কাঠপুতুল হয়ে থাকতে।

——-
এদিকে তানজিনারও মনে হচ্ছে তার বাবা-মার কথায় বাধ্য হয়ে রাগ করে রেজিস্ট্রি বিয়েটা করা উচিত হয়নি। কারণ তার কোনো কালেই মিহালকে ভালো লাগতো না। তানজিনার মনে হয় তারা একটা ফাঁকা সম্পর্কে আছে! যে সম্পর্কটা টেনে নিলে আরো তিক্ততায় ভরে যাবে কিন্তু তানজিনা এখন কোনো ডিসিশন নিতে পারছে না। শত হোক সে একজন মেয়ে। সমাজের ডিভোর্সিদের জায়গা কোথায় তা তানজিনা জানে। ডাক্তার আরিফকে তার ভালো লাগে এমনকি তার নিজেরও মনে হয় ডাক্তার আরিফ তাকে পছন্দ করে কিন্তু তানজিনা আগে শিওর হয়ে নিতে চায় নিজের মনে ডাক্তার আরিফকে নিয়ে কতটুকু অনুভূতি আছে আর ডাক্তার আরিফের অনুভূতিটাও সে ভালো করে শিওর হবে। এরপরই সে মিহালের সাথে ডিভোর্স কনফার্ম করবে। বাবা-মা কেও সুজোগ বুঝে বুঝাতে হবে আর ভাবি তাকে সাপোর্ট করবে এটা সে জানে ভাইকেও কোনোমতে মানিয়ে নেবে।

রিজভী ও তাইজুলের সাথে মিহালের কথা হয়। তারা যখন জানতে পারে মিহাল তানজিনার সাথে কিছু একটা বিহিত করতে চায় তখন তারা মিহালকে বলে,

রিজভী: দেখ মিহাল, তোর সাথে তূরের বিয়ের খবর তানজিনা ও তানজিনার পরিবারের কেউ জানে না। মানলাম তূর কোমাতে আছে। এখন যদি তানজিনার পরিবার ঘুনাক্ষরেও টের পায় যে তুই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিস তাহলে কিন্তু তোর অবস্থা তারা খারাপ করবে। সেখানে যতই তানজিনা তোকে হাসবেন্ড হিসাবে না মানুক! তাই আমি বলব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবি।

রিজভীর কথার সাথে তাইজুল সায় মিলিয়ে বলে,
তাইজুল: তোর কি তূরের সাথে বিয়ের শর্ত গুলো মনে আছে? যেগুলো হয়তো তোর কাছে কাগজে-কলমে মনে হতে পারে বা তূর যদি কখনো কোমা থেকে ফিরে না আসে তাহলে তুই হয়তো কাগজটা নষ্ট করে ফেলবি আর তূরের বাবা-মা সন্তান হারানোর শোকে তোকে কিছুই বলবে না।

ওদের দুজনের কথায় মিহাল মলিন হেসে বলে,
মিহাল: শর্ত গুলো শুধু কাগজে ছিলোনা তাইজুল! তূর আমাকে দিয়ে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছে। আমার সাথে যদি তানজিনার ডিভোর্স হয়েও যায় তারপরেও আমি তূর ছাড়া তৃতীয়বার কাউকেই বিয়ে করবো না। আমি জানি আমি তূরকে ভালোবাসিনা কিন্তু ওয়াদা আমি রাখবো সেটা তূর কোমা থেকে না ফিরলেও।

মিহালের কথায় রিজভী মনে মনে বলে,
রিজভী: যাক অবশেষে তুই তোর জেদ ছেড়ে দিলি! তুই তূরকে ভালোবাসিস না কিন্তু মেয়েটা তোকে অনেক ভালোবাসে। তোর বিয়ের খবরটা ওরে কতটা ভেঙে দিয়েছিলো তা যদি তুই জানতি তাহলে হয়তো এটা বলতে পারতি না যে তুই শুধু ওয়াদা রক্ষা করার জন্য তূর ছাড়া তৃতীয় বার কাউকে বিয়ে করবি না।

ভাবনা-চিন্তার সমাপ্তি ঘটিয়ে রিজভী মুখে বলে,
রিজভী: তানজিনার সাথে হওয়া কথা সব কিছু তুই মোবাইলে রেকর্ড করবি।

রিজভীর কথায় মিহাল ও তাইজুল প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। রিজভী আবার বলে,
রিজভী: তানজিনা যেই পরিমান চালাক মেয়ে, সেই অনুসারে তোদের ডিভোর্সের দায়টা তোর উপর চাপিয়ে দিতে পারে। এরপর যদি আবার তোর আর তূরের বিয়ের খবরটা জানতে পারে তাহলে সে যে কি করবে বলা যায় না।

মিহাল রিজভীর কথা শুনে বলে,
মিহাল: কিন্তু আমি তো তানজিনাকে ডিভোর্সের কথা বলতে যাব না! তানজিনা সিদ্ধান্ত শুনতে যাব! সে কি বলে তা শুনতে যাব! তানজিনা যদি ডিভোর্স চায় তাহলেই আমি ডিভোর্স দিব।

রিজভী: তোর কথা বুঝলাম কিন্তু তারপরেও রেকর্ডিংটা অন রাখিস। বলা তো যায় না কখন কাজে লেগে যায়।
রিজভীর কথায় তাইজুলও সায় দেয়। মিহাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেও সায় দেয়।

——–
এদিকে ডাক্তার আরিফ আবার জার্মানিতে যায় কোন একটা সার্জারির জন্য। এমবিবিএস কমপ্লিট করার পর জার্মানির যেই হসপিটালে সে পাঁচ বছর কাজ করেছে সেই হসপিটাল থেকে মেইল এসেছে, জার্মানি থেকে ফেরার আগে আরিফ যেসব পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট করা শুরু করেছিল তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধা মহিলা তার সার্জারির জন্য যেতে হয়েছে। ওই বৃদ্ধা মহিলার এক কথা সে ডাক্তার আরিফের কাছেই সার্জারি করবে। বৃদ্ধা মহিলাটির স্বামী মারা গেছে আট বছর হলো এমনকি ছেলে ও ছেলের বউ কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। যেদিন কার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ছেলে ও ছেলের বউ তাদের সন্তান ‘জ্যাক’ কে তাদের মায়ের কাছে রেখে যায় তাই জ্যাক বেঁচে আছে নাহলে এই পৃথিবীতে বৃদ্ধা মহিলাটি একা হয়ে যেত। বৃদ্ধা মহিলাটির ছোট নাতির বয়স মাত্র নয় বছর। বাচ্চাটির কাছে তার দাদিই তার শেষ ভরসা। বৃদ্ধা মহিলাটির নাম ‘জুলিয়ানা’। ভিনদেশী মাটিতে আরিফ ও ইফতির এক প্রকার কাছের মানুষ বৃদ্ধা মহিলাটি। একই কলোনীতে থাকতো তারা।
তাই আরিফ একপ্রকার মায়ার টানেই যায় বৃদ্ধা মহিলাটির সার্জারি করতে গেছে।

———-
তানজিনার সাথে মিহালের কথা হয়েছিলো সেই কথা অনুসারে তারা দুজন একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে মিহাল দশ মিনিট বসার পর তানজিনা আসে। হাই-হ্যালোর শেষে ওরা নিজেদের জন্য হালকা-পাতলা খাবার অর্ডার করে। মিহাল কিছুক্ষণ নিজেকে ধারস্থ করে তানজিনার অগোচরে রেকর্ডিং অন করে বলে,

মিহাল: তানজিনা, তুমি এগজ্যাক্টলি কি চাও?

তানজিনা তখন স্যান্ডউইচ খাচ্ছিল। এই রেস্টুরেন্টের চিকেন স্যান্ডউইচটা অনেক মজার। মিহালের কথায় খাওয়া থামিয়ে মিহালের দিকে তাকিয়ে বলে,

তানজিনা: আমি আবার কি চাইব? তুমি কেন ডেকেছো সেটা বলো।
মিহাল: দেখো তানজিনা তোমার ভাই-ভাবি দুজনেই ডাক্তার। সেই হিসাবে ধরলে কিন্তু তারা সময় অনেক কম পায় নিজেদের জন্য। কার কখন ইমারজেন্সি থাকে কেউ বলতে পারেনা। কিন্তু তোমার ও আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা কারণ তুমি ডাক্তার আমি ইঞ্জিনিয়ার। সেই তুলনায় তাদের থেকে কিছুটা হলেও সময় কিন্তু আমরা বেশি পাবো। কিন্তু আমি যখনই তোমাকে ফোন দেই তখনই তুমি বলো বিজি আছো, তারপর যখন তোমাকে বলি তাহলে ফ্রি হয়ে আমাকে কল ব্যাক করো কিন্তু তুমি সেটা আর করো না।

তানজিনা মিহালের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে। সে মনে মনে ভাবে,
তানজিনা: আমি আসলে কাজটায় ইচ্ছা করে করি! ফ্রি হবার পর তোমাকে ইচ্ছে করে কলব্যাক করিনা।

কিন্তু মুখে বলে,
তানজিনা: এত কাজের চাপের মধ্যে আর কলব্যাক করতে মনে থাকে না। হসপিটালে এত এত রোগী থাকে যে ফ্রি টাইম পাওয়া অনেক মুশকিল।

তানজিনার কথায় মিহাল নিঃশব্দে হেসে শান্ত স্বরে বলে,
মিহাল: মিথ্যা বলো না তানজিনা! তোমার ব্রেইন যে খুব শার্প সেটা আমি জানি। তোমার আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না এমনকি আমার কিছুই ভালো লাগে না তাহলে আমার দেওয়া প্রস্তাবে কেন রাজি হয়েছিলে?

মিহালের কথায় তানজিনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আর তার খাওয়া থেমে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
তানজিনা: না মিহাল আসলে ভুলে যাই মাঝে মাঝে আর এত রোগী দেখার পর টায়ার্ড হয়ে যাই তখন আর কারো সাথে ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।

মিহাল: আচ্ছা বুঝলাম তুমি টায়ার্ড হয়ে যাও। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কি দশ মিনিট সময় আমাকে দেওয়া যায় না!

তানজিনা এবার হাল ছেড়ে সোজা কথায় আসে,
তানজিনা: তোমার সাথে বিয়েতে আমার কোন মত ছিল না। কিন্তু আমার বাবা-মা যে কেন তোমাকে বিয়ে করার জন্য বারবার ফোর্স করছিল আমি বুঝলাম না ইভেন তারা আমার ভাইকেও মানিয়ে নিয়েছিল। তাই আমি বাধ্য হয়ে বলেছি ‘শুধু রেজিস্ট্রিতে সাইন করবো আর কিছু না।’
আমি ভেবেছিলাম তোমরা এই কথাটা শুনে রাজি হবে না। কিন্তু তোমরা আমাকে ভুল প্রমাণ করে রাজি হয়ে গেলে!
তাই আমি জাস্ট সাইন করে হসপিটালের কথা বলে সেখান থেকে চলে আসি।

তানজিনার কথাগুলো মিহাল শান্ত হয়ে শুনলো কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তানজিনার বলা শেষে মিহাল বলে,
মিহাল: তাহলে এখন তুমি কি করতে চাও?
তানজিনা বলে,…#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৯

মিহাল: তাহলে এখন তুমি কি করতে চাও?
তানজিনা বলে,
তানজিনা: আমার দিক থেকে আমি সম্পর্কটা চাইনা।
তানজিনার কথায় মিহাল কোন ভাবাবেগ না দেখিয়ে বলে,
মিহাল: ওকে দেন, আমাদের ডিভোর্সের পথে যেতে হবে।
তানজিনা: হুম। তবে আমার সময় লাগবে!

তানজিনার কথায় মিহাল অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলে,
মিহাল: সরি, বুঝলাম না!
তানজিনা: দেখো মিহাল সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদেরকে কোন চোখে দেখে তা তুমি জানো। তাই আমি চাই আমরা ডিভোর্স অ্যাপ্লিকেশন করে রাখি কিন্তু ডিভোর্সটা আমার ইচ্ছা মত হবে।

তানজিনার কথায় মিহাল কনফিউসড তাই বলে,
মিহাল: মানে? একটু ক্লিয়ার করে বলো।
তানজিনা: মানে আমরা উকিলের কাছে যাব তারপর ডিভোর্স পেপার রেডি করব। তোমার যেহেতু দেড় মাস পরে আমেরিকার ফ্লাইট তাই তুমি সেটাতে সাইন করে চলে যাবে।

মিহাল ভেবলার মতো বলে,
মিহাল: বুঝলাম আমি সাইন করব কিন্তু তুমি?

তানজিনা হেসে বলে,
তানজিনা: বিয়েটা তোমার ইচ্ছে হয়েছে ডিভোর্সটা না হয় আমার ইচ্ছায় হোক!
মিহাল: হ্যাঁ, ডিভোর্স তোমার ইচ্ছাই হবে আমি কখন না করলাম! এমনকি তোমাকে আমি ডিভোর্স দিতে বাধ্য করবো না তোমার ইচ্ছা।

তানজিনা: হুম আমার ইচ্ছা তাই তো বলছি তুমি সাইন করে চলে যাবে। তারপর আমি নিজের সুবিধামতো সিচুয়েশন বুঝে সাইন করে সাবমিট করে দিব। বিয়েটা তো বাধ্য হয়ে করেছি কিন্তু ডিভোর্সটা ভেবে চিন্তে দিবো।

মিহাল: যা ইচ্ছা হয় করো। আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে চলে যাব পরে ডিভোর্স কনফার্ম হলে আমাকে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিবা। আর উকিল কে বলবা আমাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাতে ডিভোর্স কনফার্ম হয়েছে সেটার।

তানজিনা: তাহলে ডিভোর্স পেপার রেডি করে ফেলবা আর আজকে তাহলে উঠি।

মিহালের কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে বলে,
মিহাল: ওয়েট! ওয়েট! তোমার রেজিস্ট্রির টাকাটা চার লক্ষ টাকা। ওই টাকাটা তুমি ডিভোর্স কনফার্ম হওয়ার পর উকিলের সামনে পাবে। আমার ফ্যামিলি থেকে কেউ তোমাকে টাকাটা দিয়ে দিবে। ভালোই করেছিল তোমার বাবা-মা বেশি দেনমোহর চায়নি। অবশ্য তোমার ভাবি দশ লক্ষ টাকা দেনমোহর চেয়েছিল কিন্তু তোমার বাবা-মা আমার বাবা-মা সবাই মিলে চার লক্ষ তে কনফার্ম করেছিল।

তানজিনা: ভাবি বেশি টাকা চেয়েছিল যাতে বিয়েটা না হয় আমি ভাবিকে বলেছিলাম। কিন্তু সবার কথাবার্তার মধ্যে ভাবি আর কিছু বলেনি।

মিহাল: তাহলে আজকে উঠি। এক সপ্তার মধ্যে ডিভোর্স পেপার রেডি করে ফেলবো।
তানজিনা: ওকে তাহলে বায়।

দুজনের মধ্যে কথাবার্তা শেষ করে তানজিনা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায় আর মিহালও রেকর্ডিংটা সেভ করে রেখে দেয়। এখন মিহালের কাছেও মনে হচ্ছে রেকর্ডিংটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ তানজিনার কথাবার্তায় বোঝা যায় তানজিনা তাকে ফাসাতে পারে ভবিষ্যতে। তারপর মিহাল রেস্টুরেন্ট ত্যাগ করে।

এক সপ্তাহ পর নাদিয়ার বিয়ে শাফকাতের সাথে। বিয়ের শপিং এসব নিয়ে ব্যস্ত নাদিয়া সাথে ফাইজা, লিরা, জারিনও সাহায্য করছে। নাদিয়া একটা লাল বেনারসির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তূরের ইচ্ছা ছিল নিজের বিয়েতে লাল বেনারসি পড়বে কিন্তু দেখো ওর বিয়েটা হলো হাসপাতালের হালকা নীল জামা পড়ে হাসপাতালের সাদা বেডে শুয়ে।
নাদিয়ার বিয়ে নিয়ে ওদের সবার কত প্ল্যান ছিল! সবাই একসাথে নাচ গান করবে, বরের জুতা চুরি করবে, গেট ধরবে আরো কত কি।

তূরের পরিবারের কাছে ডাক্তার ইফতি বলেছে,
ইফতি: উনার কোমা থেকে ফিরার চান্সেস বেশি। অনেকটা ইম্প্রুভ করেছেন উনি। খুব জলদি হয়তো উনি কোমা থেকে ফিরে আসবেন।

ডাক্তারের কথাশুনে তূরের বাবা, চাচার আশাটা আরও ধীর হলো। তূরের মা তো সব সময় মোনাজাতে মেয়ের তাড়াতাড়ি কোমা থেকে ফিরে আসার প্রার্থনা করেন। নাফিহা আর আগের মতো দুষ্টামি করে না বড় বোনকে খুব মিস করে কবে যে তার বড় বোন এই ঘুম থেকে উঠবে! নীরাকে এখন আর কেউ জ্বালায় না কিন্ত নীরা তার বোনের এই জ্বালানোটাকে খুব মিস করে। তূরের চাচাতো ভাইটার বয়স সাত বছর। নাম “তূর্য” সে জানে না তার বোনের এখন কি অবস্থা। প্রতিদিন বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এই বুঝি বোন আসলো। তূরের চাচা ছেলেকে সপ্তাহে একবার তূরের কাছে নিয়ে যায়। তূর্য তূরের কাছে গেলে আর ফিরতে চায় না কান্নাকাটি করে তার বোন কেন তার সাথে কথা বলে না!

নাদিয়ার বিয়েটা সুন্দর মতো হলো, শাফকাতের জুতা চুরি, গেটে আটকানো, সবকিছুই হলো। সব বন্ধুরা আনন্দ করলেও তূরের অনুপস্থিতিতে তাকে মিস করেছে সবাই।

মিহাল তূরের কোমা থেকে ফিরে আসার কথা শুনে খুশি হয় কারন মিহাল জানে তূর মিহালকে এতো শর্ত, ওয়াদা করে একা করে চলে যাবে না। তূরকে মিহাল এখনো ভাল না বাসলেও সারাজীবন থাকতে চায় একসাথে। কথায় আছে না,
” তুমি যাকে ভালোবাসো সে যদি তোমাকে ভালো না বাসে তাহলে তুমি তোমাকে যে ভালবাসে তার দিকে তাকাও।”

মিহাল এখন সেইটাই করছে। সেও এখন তূরকে ভালবাসতে চায় অনেক অনেক বেশি করে। এখন শুধু অনুভূতি গুলোকে উপলব্ধি করার পালা সেটা করতে মিহালের যত সময় লাগে সে তত সময়ই নেবে।

তানজিনা আগের মতো ডাক্টার আরিফের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে খুব ভালো ভাবে আছে। মিহাল ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে ইতিমধ্যে এখন তানজিনার যখন ইচ্ছা হবে তখন সাইন করে সাবমিট করে দেবে।

ডাক্টার আরিফ নিজেও চেষ্টা করছে তানজিনাকে বলার কিন্তু সেও তানজিনার মতো তানজিনার অনুভূতি ও নিজের অনুভূতিকে আরো শিওর হয়ে নিতে চাচ্ছে।

মিহাল নিজের পরিবারকে সব জানায় ও ঐদিনের করার রেকর্ডিংটা শোনায়। রেকর্ডিং শোনার আগে তারা মিহালকে দোষ দিলেও সেটা শোনার পর তারা কিছুক্ষণ চুপ হয়ে তারপর আবার মিহালের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।

কায়রা তো তূরের দেয়া শর্তের কারণে তূরের ওপর রেগে গেছে। তার ভাষ্যমতে, ” তূর যেহেতু মৃত্যুপথযাত্রী ছিল তাহলে এরকম শর্তগুলো কেন দিল! আর তার ভাইকে দিয়ে ওয়াদা কেন করিয়ে নিলো!”

কায়রার এসব কথাবাত্রায় কায়রার মা চুপ ছিলেন কারণ সে কিছুটা হলেও জানে এই সব পরিস্থিতির জন্য তার ছেলেও কিছুটা দায়ী। কায়রা ও মিহালের মায়ের সাথে তূরের ওইদিনের হওয়া কথাগুলো হচ্ছে,——–

” ফ্ল্যাশব্যাক————☆☆

মিহালের মা তূরের কেবিনে ঢুকার পরে পাশের টুলে গিয়ে বসে। ইতিমধ্যে তূর নিজের পরিবারকে সে আদৌ বাঁচবে কিনা এসব বলে রাজী করিয়েছে আর ওর পরিবার তো জানতো তূর এই মিহালকে ভালোবেসে হারিয়ে একমাস কিভাবে ছিলো তাই তারা আর কিছু বলেনি।

মিহালের মা তূরের পাশে বসার পরে তূর বলে,
তূর: আন্টি আমি আপনাকে কিছু কথা বলব। দয়া করে আপনি আগেই রাগ করে বসবেন না।

মিহালের মা তূরের এসব কথা বাত্রায় সন্দিহান। তারপর বলে,
মিহালের মা: বল মা।
তূর আর দেরি না করে একদমে বলে,
তূর: আন্টি আপনার ছেলেকে আমি বিয়ে করতে চাই। আমি জানি মিহাল বিবাহিত আর এটাও জানি তানজিনা মিহালকে মেনে নেয়নি আর আমার মনে হয় না ভবিষ্যতে কখনো মেনে নিবে।

মিহালের মা তূরের কথায় তাজ্জব বনে যায়। উনি কিছু বলবেন তার আগেই তূর বলে,
তূর: মিহাল যে তানজিনাকে কলেজ থেকে ভালোবাসে সেটা আমি জানি। কলেজে এমন অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে যার কারণে মিহালের মনে ভালোবাসাটা জেদে পরিণত হয়েছে। হ্যাঁ, মিহাল তানজিনাকে এখনো ভালবাসে কিন্তু সেটা অনেক কম ওইসব ঘটনাগুলো ঘটার আগের তুলনায়।

এরপর তূর মিহালের মাকে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে মিহালের মা বলে,
মিহালের মা: তোমার কথাগুলো বুঝলাম আমি। আর আমি এটাও লক্ষ্য করেছি যে তানজিনার সাথে মিহালের সম্পর্কটা শুধু কাগজে কলমে রয়ে গেছে। মা তো ছেলের মুখ দেখে বুঝতে পারি কিছুটা। আমরা কেউ প্রথমে মিহালের তানজিনা কে বিয়ে করার প্রস্তাবে রাজি ছিলাম না। কিন্তু ওদের ডিভোর্সের আগে বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে?

তূর: আন্টি আমার কাছে মিহালের ডিভোর্স হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার মত সময় নেই। আপনি তো জানেন তিনদিন পরে আমার সার্জারি। ডাক্টার বলেছে অনেক রিস্ক আছে। বিয়েটা হলে আমার বাঁচার মতো আরো একটু ইচ্ছা জাগতে পারে।

মিহালের মা তূরের কথা গুলো বুঝলো এখন সে ভাবছে সে তার স্বামীকে কিভাবে এসব বুঝাবে! আর যদি তানজিনার পরিবার ভুলেও টের পেয়ে যায় তাহলে কী অবস্থা হবে। তার এসব ভাবনা কে তূর সমাপ্ত করে দিয়ে বলে,

তূর: আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না তানজিনার পরিবারকে কেউ জানাবে না সেরকম কথা সবার সাথে আমার হয়ে গেছে। একমাত্র মিহাল চাইলে উনারা জানতে পারবে। আঙ্কেলকে আপনি আমার আর আপনার সাথে হওয়া কথাগুলো বলবেন।

এরপর মিহালের মা মিহালের বাবাকে বুঝায়। কায়রাকে ওসব বলেনি শুধু তূরের অসুস্থতার কথা বলে। বিয়ের সময় শর্তগুলো দেখে কায়রা রেগে গিয়েছিল তাকে তার স্বামী শান্ত করে।
ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড”————☆☆

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here