শেষ অধ্যায়ে তুমি পর্ব -১৪+১৫

#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১৪ (অনুভূতি❤)

বেলা বারোটায় মিহালের বাবা-মা দেখা করে তূরের সাথে। কায়রা শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ায় তাদের সাথে আসেনি। কায়রাকে তার বাবা-মা খবরটা দিয়েছে, খবর পেয়ে কায়রা খুব খুশি হয় কিন্তু মনে মনে অনুশোচনায় ভুগছে। রিয়াদ কায়রাকে কয়েক দফা কথাও শুনিয়েছে, যদি সেদিন কায়রা জেদ ধরে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতো তাহলে সে তার নিজের ভাইয়েরই ক্ষতি করত। একে তো এখনো তানজিনার সাথে ডিভোর্স কনফার্ম হয়নি, তূরের অবচেতনার সুজোগ নিলে শর্ত খেলাফের দায়ে শাস্তি! তারউপর রিয়াদের বোনের জীবনটাও নষ্ট হয়ে যেতো!
_______

কেটে গেছে এক সপ্তাহ। তূরকে দুইদিন হলো বাড়িতে আনা হয়েছে। হসপিটালে থাকতেই তূর তার বাবাকে বলেছে সে যেন তার আমেরিকার ফ্লাইট কনফার্ম করে কারণ ফাইজাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথা হয়েছিলো সেদিন। তারা জানিয়েছে আর আঠারো দিন পর ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হবে এবং তার মধ্যে ভর্তির সব ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।
ভিসা পেলেই তূর আমেরিকায় চলে যাবে। সেখানে গিয়ে “সানফ্রান্সিকো স্টেট ইউনিভার্সিটি” তে ভর্তি হবে। সবার সাথে তূরের কথা হলেও মিহালের সাথে কথা হয়নি প্রতিবার মিহাল এড়িয়ে গেছে নয়তো তূর এড়িয়ে গেছে।
তূরের এড়িয়ে যাবার কারণ সে চায় মিহালকে একেবারে ওখানে যেয়ে সামনা সামনি দেখবে। তার তৃষ্ণার্ত চোখ সামনা সামনি দেখেই তৃষ্ণা মিটাতে চায়।

কায়রা এসেছে তূরকে দেখতে সাথে সাথে স্বামী রিয়াদ ও দুই বছরের মেয়ে রিয়ানা। কায়রা প্রথমে তূরের পরিবারের কাছে ভুল স্বিকার করেছে আর তূরের পরিবার হাসি মুখে তা বুঝেছে।

—-দশদিন পর তূরের ফ্লাইট। সানফ্রান্সিস্কো তে পৌঁছনোর পাঁচ দিন পর ক্লাস শুরু হবে। তূর ইতিমধ্যে ইউনিভার্সিটি অথরিটির কাছে লেট করার রিজন ও মেডিকেল রিপোর্ট মেইল করে দিয়েছে যাতে তারা পরে কোনো প্রবলেম না করে।

দশদিন পরিবারের সাথে অনেক হাসি খুশিতে কাটায় যেনো আগের সেই প্রানবন্ত তূর! যে রাতের অন্ধকারে কষ্টে জর্জরিত হলেও দিনের আলোয় সদা হাসিখুশি। কিন্তু আগের তুলনায় অন্ধকারের কষ্টটা কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে তার।

যেদিন ফ্লাইট সেদিন সবাই আরো একদফা কান্নাকাটি করে তূরকে প্লেনে উঠিয়ে দেয়। তূর্যতো তূরের হাত ছাড়তেই চাইছে না। পরে সবাই মিলে ওকে বুঝিয়ে তূরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আসে আর তূর প্রতিদিন ফোন করবে বলেছে আবার ভিডিও কল করবে বলেছে তাই তুর্য একটু শান্ত হয়েছে। রাত এগারোটা ত্রিশ বাজে এই পর্যন্ত এই বাচ্চা ছেলেটা বোনকে যেতে দিবে না বলে ঘুমাইনি।
তূরের ইমিগ্রেশন শেষ হবার পর ফ্লাইট টেক অফ করার আগ পর্যন্ত সবাই এয়ারপোর্টে ছিল। তূর্য কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে গেছে। তূরের মা চোখের পানি মুছে মেয়ের জন্য দোয়া করে যেন তূর ভালোভাবে পৌঁছায় ও সফল হয়ে ফিরে আসে।
______

পুরো এক দিন জার্নি শেষে তূর সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে এসে নামে। প্লেন থেকে নামার পর ইমিগ্রেশন গেটে মিহাল, রাফি, রিজভী ও অর্ককে দেখতে পায়। আগে থেকে রাফিকে বলে দিয়েছিলো যাতে মিহালকে এয়ারপোর্টে নিয়ে আসে।

একটু পরে সবার চোখ তূরের দিকে পরে। তূর একটা অতিরিক্ত ঘেরালো রাউন্ড ফ্রক যার ঠিক মাঝামাঝি হাটুর অনেকটা উপর থেকে টাকনুর তিন ইঞ্চি উপর পর্যন্ত যতটুকু লম্বা ততোটুকু কাটা ও ফ্লোরাল হাতার মেরুন রংয়ের সিল্কের ড্রেস সাথে অ্যাস কালার লেগিংস ও মেরুন রংয়ের সিল্কের ওড়না। চুলগুলো ছোট ছোট মাত্র ঘাড়ে পড়ে কিন্তু ওড়না দিয়ে সেগুলো কভার করা শুধু সামনে কিছু চুল দেখা যায়। চোখে গ্লাস চশমা হাতে ব্ল্যাক কালার লেডিস ওয়াচ। হাতে ব্ল্যাক কালার ট্রলি নিয়ে সামনে এগুচ্ছে তূর।

পেছনের সারি সারি প্লেন আর তূর ট্রলি হাতে সামনে অগ্রসর হচ্ছে, দৃশ্যটা নিজের অজান্তেই ক্যামেরাবন্দি করে রাখে মিহাল। তূরকে আসলেই অনেক সুন্দর লাগছে।
তূর ওদের কাছে এসে সবার উদ্দেশ্যে কিউট করে একটা স্মাইল দেয় যার কারনে ওর ঠোঁটের দুই কোণে কিছুটা গর্তের সৃষ্টি হয়। সানফ্রান্সিকোর সময় সকাল এগারোটা ত্রিশ তাই আকাশে হালকা রোদ্দুরে ভাব আছে, বেলা বারোটা বাজলেই রোদের তীব্রতা বাড়বে।

তূর: হাই গাইস! কেমন আছিস?
অর্ক: এতক্ষণ তো ভালোই ছিলাম এখন তুই এসে খারাপ বানিয়ে দিলি!
অর্কর কথায় তূর ওর পিঠে একটা থাপ্পর দেয়। থাপ্পর খেয়ে অর্ক হাসতে থাকে। রাফি বলে,
রাফি: তোর আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো? মাঝখানে তো দুবাই এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করেছিল। ওখানে কোনো প্রবলেম হয়নি তো?

তূর হেসে মাথা দুদিকে নাড়ায়। তূরের না বোধক মাথা নাড়ানোতে রাফিরা স্বস্তি পায়। রিজবি তূরকে জিজ্ঞাসা করে,
রিজভী: তো জার্নি কেমন লাগলো তোমার?

তূর মুচকি হেসে উৎফুল্লতার সাথে বলে,
তূর: অসাধারণ!! সত্যি বলতে একা একা জার্নি করার মজাই আলাদা! বন্ধু ও ফ্যামিলির সাথেও জার্নি করতে মজা কিন্তু একা একা জার্নি করতে এক অন্যরকম শিহরন রোমাঞ্চকর কাজ করে আর তা যদি হয় নিজ দেশ থেকে ভিনদেশের যাত্রায়। চারপাশে সব অচেনা মানুষ যে যার মত আছে। একা জার্নি করার যেমন অন্যরকম শিহরন তেমনি বন্ধু, ফ্যামিলি ও লাইফ পার্টনারের সাথে জার্নি করার আরেক অন্যরকম শিহরন। সত্যি বলতে সবরকম জার্নি উপভোগ্য যদি আপনি সত্যিকারে জার্নি উপভোগ করতে পারেন😍।

কথাটা বলেই এক প্রাণবন্ত হাসি দেয় তূর এরপর তার নজর যায় মিহালের দিকে। অনেকক্ষণ ধরেই আড়চোখে মিহালকে খেয়াল করছিল। মিহাল এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে কোন কথা বলছে না শুধু তার কথাগুলো শুনছে। তাই তূর এবার নিজ থেকে মিহালকে জিজ্ঞাসা করে,
তূর: কেমন আছো মিহাল!!

মিহাল তূরের কথায় তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তূর খুব সুন্দর করে মিহালের নামটা ডাকে ইউনিক ভাবে, মনে হয় নাম ডাকার সময় একরাশ মায়া ঢেলে দেয়।
মিহাল জবাব দেয়,
মিহাল: আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? এখন শরীর কেমন তোমার?
একদমে সবগুলো কথা বলে থামে।

তূর মিহালের দিকে তাকিয়ে বলে,
তূর: আমিও ভালো আছি আর শরীর একদম ফাইন।

এরপর ওরা সবাই এয়ারপোর্ট থেকে সব কাজ শেষ করে ক্যাব বুক করে বাংলোতে আসে। তূরের বাংলোটা অনেক পছন্দ হয়েছে। কিছুটা পুরনো ধাঁচের বাড়ি বলে তূরের খুব পছন্দ হয় কারণ তূরের একটু পুরনো টাইপের বাড়ি বা ভূতের বাড়ি ভালো লাগে যদিও তূর ভূতে ভয় পায় প্রচুর😷।

সারাদিন জার্নি করে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে গেছে আবার অসুস্থ থাকায় বেশি ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু করে ঘুমোতে চলে যায়।

সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে তূর সবার সাথে বন ফায়ার এনজয় করে। আজকে সবাই মিলে চিকেন গ্রিল করবে। বনফায়ার থেকে একটু দূরে চিকেন গ্রিল করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এনে রেখেছে। সবসময়ের মতো তূর কেই চিকেনটা রেডি করতে হবে কারণ তূর রান্না বান্না মাঝে মাঝে খুব শখের বশে করে, অনেক নতুন নতুন আইটেম ইউটিউব দেখে বানায় আর সেসব নতুন আইটেম যখন ফাস্ট ট্রায়াল দেয় তখন সেগুলোর গিনিপিগ হয় তার ছোট দুই বোন ও ভাই! নীরা সবসময় খায় না কিন্তু নাফিহা ও তূর্য মজা করে খায় কারন ফাস্ট ট্রাই হিসেবে ভাল না হলেও অতটা খারাপ হয় না।
( আমিও তূরের মত ইউটিউব দেখে খাবার বানিয়ে আমার বোনদেরকে খাওয়াই😷 ওরাই আমার গিনিপিগ😁)

চিকেন গ্রিল হয়ে যাবার পর সবাই সেগুলো খায় সাথে গান ও গল্প তো আছেই। মিহাল ও তূর একে অপরের অপজিট ডিরেকশনে বসেছে। বন ফায়ারের আলোতে মিহালের সামনে মানে ওদের মাঝে এখন শুধু বনফায়ার! তূরকে দেখছে। মুখের মধ্যে আগুনের আভায় এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য ভর করেছে তূরের মাঝে যা মিহালের চোখে ধরা পরছে।
এদিকে তূরও মাঝে মাঝে আড় চোখে মিহাল কে লক্ষ্য করছে। ব্ল্যাক কালারের শার্টে ছেলেটাকে যখন প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশন গেটে দেখে তখন তূর নিজেও এক অন্যরকম ঘোরে পড়ে গিয়েছিলো আর এখন ব্ল্যাক টি শার্ট ও ব্ল্যাক ট্রাউজারে যেনো মিহালের ফর্সা শরীরে ফুটে উঠেছে আর আগুনের শিখার আলোতে মুখমন্ডলে হালকা রক্তিম আভা ছড়িয়ে পরেছে।

ইনায়ার কাছে মিহালের একদৃষ্টিতে তূরের দিকে তাকানোটা কেমন যেনো ভালো ঠেকলো না, তার মনের মধ্যে কেমন খচখচ করছে।

কিছুক্ষণ পর সবাই বনফায়ার নিভিয়ে যার যার রুমে চলে যায়। ইনায়া রুমে গিয়ে রাফির জন্য অপেক্ষা করে কারণ রাফি ওয়াশরুমে গিয়েছে। রাফি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলে ইনায়া রাফিকে খাটে এসে বসতে বলে আর রাফিকে বলে,

ইনায়া: রাফি তোমাকে একটা কথা বলি কিছু মনে করো না!
রাফির ইনায়ার কথা শুনে তার চোখের দিকে তাকায় আরে মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি দেয়। ইনায়া একটু ঢোক গিলে বলে,
ইনায়া: আমার কাছে না মিহালের চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ভালো ঠেকে নাই!!

ইনায়ার এবারের কথায় রাফির ভ্রু সহসা কুঁচকে আসে। কাল বিলম্ব না করে ইনায়া আবার বলে,
ইনায়া: মিহাল তূরের দিকে কেমন যেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমার না এই জিনিসটা ভাল লাগে নাই।

এবার রাফির কাছে সব কিছু ক্লিয়ার! ইনায়া যে মিহালের দিকে নজর রাখার মতো তাকিয়ে ছিল সেটা সে বুঝতে পেরে গেছে। এখন থেকে তাদের সবাইকে আরো সতর্ক হতে হবে যতদিন না তানজিনার সাথে ডিভোর্স টা কনফার্ম হয়!! এখনতো যেভাবেই হোক ইনায়ার মন থেকে সন্দেহটা দূর করতে হবে তাই রাফি নিজেকে ঠিক করে যাতে ইনায়া তার কথাতে সন্দেহ না করে সেভাবে বলে,

রাফি: আরে মিহাল যখন তূরকে সার্জারির আগে হসপিটালে দেখতে যায় তখন তূর মৃত্যুশয্যায় ছিল তাই তূর নিজের মনের অনুভূতি মিহালের কাছে প্রকাশ করেছিলো আর এরপর থেকেই মিহাল নিজের মনে মনে গিল্টি ফিল করছে হয়তো ভাবছে ওর জন্যই তূরের এই অবস্থা হয়েছিল! বোঝোইতো গিল্ট ফিল করলে কেমন লাগে!! যেমনটা তুমি ফিল করেছিলে!!

রাফির কথায় ইনায়া চুপসে যায় আর ভাবে,
ইনায়া: সত্যিই তো সে নিজেই তো তূরকে দূর থেকে দেখতো গিল্টের কারণে।

ইনায়ার মুখের ভাবসাব দেখে রাফি বুঝলো টপিকটা ঘুরে গেছে তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় আর বলে,
রাফি: তুমি অযথা চিন্তা করছো ইনু!! তূর কি তাকিয়ে ছিলো?
রাফির কথায় ইনায়া না বোধক মাথা হেলায়। তারপর রাফির কথায় ওরা দুজনে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে শুয়ে পড়ে।
#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১৫ (প্রথম ক্লাস)

পরেরদিন ভর্তির কার্জকর্ম শেষ করে কিছুটা আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে সবাই সন্ধ্যার দিকে বাংলোতে পৌছায়। নাদিয়া আর এগারোদিন এখানে থাকবে তাই নাদিয়া বলছে যে কয়দিন আছে বান্ধবীদের সাথে রাতে থাকবে। শাফকাত বেচারা মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে। শাফকাতের ভাষ্যমতে, এতো সুন্দর পুরোনো ধাঁচের বাংলোতে সাথে রাত হলে ভর পরে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর সেখানে বউ থাকতেও বউ ছাড়া ঘুমাতে হবে ভাবতেই তার বুক ফেঁটে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।

শাফকাত যেহেতু বউ ছাড়া থাকবে তাই রাফি ও ইনায়া কেও আলাদা থাকতে হবে এগারো দিন!!! শাফকাতের এমন কথায় রাফি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আর মেয়েরা সব হেসে কুটিকুটি। রাফি বলে,

রাফি: ভাই আপনার বউ আপনার সাথে থাকতে চায় না কিন্তু আপনি আমার কাছ থেকে আমার বউ কেন কেড়ে নিতে চাইতেছেন😕।

রাফির কথার ধরনে শাফকাত বেক্কলের মত তাকিয়ে আছে আর বাকিরা সবাই উচ্চস্বরে হাসা শুরু করে দিয়েছে। হাসতে হাসতে রিজভী বলে,
রিজভী: ভাই একদম ঠিক কথা বলছেন। আমরা সবাই এদিকে সিঙ্গেল থাকব তো রাফি কেন বউ নিয়া থাকবে! এই এগারো দিন এই বাংলোতে কেউ মিঙ্গেল না সবাই সিঙ্গেল😁।

নাদিয়া, তূর, লিরা, ফাইজা, জারিন ও ইনায়া তো খুশিতে পাগল প্রায়। ইউনিভার্সিটি লাইফে ওরা কখনো কারো বাসায় গিয়ে রাতে থাকেনি তাই এখানে এসে তারা বান্ধবীরা সবাই একসাথে থাকতে পেরে মহাখুশি। ছয় জন মেয়ে দুইটা রুমে তিনজন তিনজন করে থাকবে সিদ্ধান্ত নিল। আর নয় জন ছেলে তিন জন করে তিন রুমে থাকবে সেক্ষেত্রে একটা রুম ফাঁকা থেকে যায়।
———
আজ সবার নিজ নিজ ইউনিভার্সিটিতে প্রথম ক্লাস। সবাই খুব এক্সাইটেড। যদিও সবাই নিজ দেশে যখন প্রথম ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হয়েছিল তখন ঠিক এরকম তারা এক্সাইটেড ছিল কিন্তু ভিনদেশে কিভাবে ক্লাস হয় এসব বিষয়ে তারা কিছুটা জানলেও আজ স্বচক্ষে দেখবে ও ক্লাস করবে।

জারিন, রণক, ফাইজা ও তাইজুল ইউনিভার্সিটি অফ সানফ্রান্সিসকো তে চলে যায় আর বাকিরা সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি তে চলে যায়। নাদিয়া, আসফি ও তাওহিদের ক্লাস শুরু হবে আরো দুইদিন পর। তারা তিনজন প্রথম কয়েক দিন এখান থেকে জার্নি করে গিয়ে ক্লাস করবে তারপর হোস্টেল ও ফ্ল্যাট পেলে তারা চলে যাবে। সবাই যেহেতু ইউনিভার্সিটি তে ক্লাস করতে গেছে তাই ওরা তিনজনও ওদের সাথে গেছে। শাফকাত সকালে কিসের একটা দরকারি কাজে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া তে গেছে বিকালের দিকে ফিরবে।
নাদিয়া, আসফি ও তাওহীদ দুই দিন তারা পালাক্রমে দুই ইউনিভার্সিটি’তে ঘুরবে। প্রথম দিন তারা যাবে সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এর পরের দিন যাবে ইউনিভার্সিটি অফ সানফ্রান্সিসকো তে।

তূর একটু ইউনিভার্সিটির অফিস রুমে যায় কিছু কাজের কারণে ওর সাথে লিরাও যায়। এই অফিস রুমের কাজের জন্য ওদের ক্লাসে ঢুকতে পাঁচ মিনিট লেট হয়ে যায় ও সার্ক ইতিমধ্যে ক্লাসে চলে এসেছেন। তূর ও লিরা তো ভয়ে শেষ! অর্ক ও রাফি ওদের মেসেজ করে বলেছে স্যার অনেক রাগি! এবং অনেক পাংচুয়াল।
মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে সে অনেক কিছু অর্জন করেছে। আঠাশ বছর বয়সে সে পিএচডি কমপ্লিট করে সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক হিসেবে আছে। উনার নাম ” মিস্টার হেইডেন ক্লার্ক”। উনি বিয়ে করেছেন এক রাশিয়ানকে, যার সাথে স্যারের এই ইউনিভার্সিটিতে দেখা হয়েছিলো বছর তিনেক আগে যখন স্যার প্রথম সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি তে জয়েন করে আর তার ওয়াইফ তখন এখানে মাস্টার্স এর লাস্ট সেমিস্টারে।

ক্লাস শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিট পর যখন লিরা ও তূর ক্লাসে এসে স্যারকে বলে,
লিরা ও তূর: মে আই কাম ইন স্যার!

দুটি মানবীর একসাথে “মে আই কাম ইন স্যার” বলাতে স্যার পেছনের দিকে ঘুরে তাকায় আর মুখ গম্ভীর করে রাখে। স্যারের গম্ভীর মুখ দেখে ওদের তো জান যায় যায় অবস্থা। কিছুক্ষণ ওদের দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থেকে বলে,
স্যার(ক্লার্ক): হোয়াই ইউ গাইস লেট!! ডোন্ট ইউ নো ইউর ক্লাস টাইম ওয়াজ স্টার্টেড ফাইভ মিনিটস এগো?

স্যারের কথায় ওরা কি বলবে বুঝতে পারছে না। অর্ক ও রাফি অসহায়ের মতো ওদের দিকে তাকিয়ে আছে তার মানে ওরাও কিছু করতে পারবে না এখন। লিরার এখন মনে হচ্ছে ফাইজা থাকলে ভালো হতো! ফাইজা এসব সিচুয়েশন খুব ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে। কিন্তু এখন তো ওদের কিছু বলতে হবে তাই লিরা তূরকে বলে,
লিরা: তুই কিছু বল তোর কাজের জন্যই তো এগুলা হইছে!
তূর: মানে কি ভাই! লেট আমাদের দুজনের হইছে যা বলব দুজনে বলব!

মিস্টার ক্লার্ক ওদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে যে ওরা দুজন দুজনের মধ্যে কি কথা বলছে! মিস্টার ক্লার্ক স্প্যানিশ, ফ্রেন্চ এসব ভাষায় পারদর্শী হলেও বাংলা, হিন্দি মানে এশিয়ান ভাষাগুলোতে সে পারদর্শী না কিন্তু সে এই দুই মেয়ের ফেস কাটিং দেখে একটু বুঝতে পারছে এই মেয়েরা এশিয়ান।

কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলে,
স্যার(ক্লার্ক): হেই! হোয়াট আর ইউ টকিং এবাউট? ডু ইউ হ্যাভ এনি অ্যানসার মাই কোশ্চেন?

তূর ভিতু স্বরে বলে,
তূর: উই আর রিয়েলী স্যরি স্যার! আই হ্যাভ সাম ইম্পর্টেন্ট ওয়ার্ক ইন অফিস রুম! দ্যাটস হোয়াই আই এম লেইট এন্ড মাই ফ্রেন্ডস অলসো।

স্যার(ক্লার্ক): ইট ইজ ইউর ফার্স্ট ক্লাস এন্ড ইফ ইউ হ্যাব এনি ওয়ার্ক সো হোয়াই ডোন্ট ইউ ডিড দিস বিফোর ক্লাস ওর আফটার! এন্ড এসপার এজ মাই নলেজ, ইউর অ্যাডমিশন ফর্মালিটি হ্যাড বিন ডান বিফোর টু অর থ্রি ডেইস এগো।

স্যারের কথায় তূর বলে,
তূর: একচুয়ালি স্যার, আই ওয়াজ ইন হসপিটালাইজড বিকোজ অফ ব্রেইন টিউমার সার্জারি এন্ড আফটার সার্জারি আই ওয়াজ ইন কোমা স্টেজ এন্ড আফটার ফোর মান্থস লেটার আই ওয়েক আপ ফ্রম কোমা, দ্যাটস হোয়াই আই এম লেইট টু ডু মাই অ্যাডমিশন ফরমালিটিজ।

মিস্টার ক্লার্ক তূরের কথা বুঝেছেন এবং সেই মেইলটা মিস্টার ক্লার্কই চেক করেছিলেন তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে ওদেরকে ভিতরে আসতে দিলেন এবং ওদেরকে ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে বললেন।

ফার্স্ট বেঞ্চে “এলেক্স” নামে একটা ছেলে বসা ছিল যে এতক্ষণ ধরে স্যার ও তূরের মাঝে হওয়া সব কথাবার্তা শুনেছে। অ্যালেক্সের সাথে “ম্যাক্স” নামে একটা ছেলে বসে আছে কিন্তু ম্যাক্স স্যারের অগোচরে হোয়াটসঅ্যাপে তার গার্লফ্রেন্ড “এলিনা” যে কি না ইউনিভার্সিটিতেই মাইক্রোবায়োলজি তে পড়াশোনা করে অনার্স থার্ড ইয়ারে।

স্যারের কথায় তূর ও লিরার অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফার্স্ট বেঞ্চে দুইটি অচেনা ছেলের সাথে বসতে হয়। এরপর স্যার ক্লাস কন্টিনিউ করে।

পরপর তিনটা ক্লাস শেষ হবার পরে ওরা সবাই একসাথে ব্রেক টাইমে ভার্সিটির ক্যাম্পাসে দেখা করে। দশ জন একসাথে ক্যাম্পাসের এক জায়গায় বসে আছে। রিজভী বলে,

রিজভী: জানিস আমাদের প্রথম ক্লাস যে নিয়েছে সেই স্যার প্রথম দিন হিসাবে যে একটু আস্তে পড়াবে তা না প্রথম দিনই উনি একদম তাড়াতাড়ি করে সব করছে। কই ভাবছিলাম প্রথমদিন ইন্ট্রোডাকশন নিয়ে ছেড়ে দিবে!

মিহাল: উনি দুইবার পিএইচডি ডিগ্রি নিছে! আর তুই কিনা আশা করোছ তোরে প্রথম দিন ইন্ট্রোডাকশন নিয়ে ছেড়ে দিবে।

রিজভী: ছাড়বো না কেন ভাই তার বয়স পন্চাশ এর উপরে কদিন পরে ঠুস কইরা মইরা যাবে তো এখন তা একটু কথা কম বলা উচিত তার।

রিজভীর কথায় সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসি থামিয়ে অর্ক বলে,
অর্ক: তোদেরতো পড়াইসে। আর আমাদের এই দুই মহান বান্ধুবীদের আজকে স্যার যা ধুইছে!

অর্কর কথায় লিরা ও তূর ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। আর মিহাল অর্কর কথায় তূরের দিকে একবার তাকায় তারপর আবার অর্কর দিকে তাকিয়ে বলে,
মিহাল: কি হয়েছে?
অর্ক: কি আর হবে তারা ক্লাসে পাঁচ মিনিট লেট করে আসছে আর স্যার ক্লাসে লেট করা পছন্দ করে না তাই উনি ওদের কত কিছু বলল।

এবার লিরা বলে,
লিরা: কই কতকিছু বলল! স্যার শুধু আমাদের কাছ থেকে জানতে চাইছে আমাদের লেট করার কারণ আর তো কিছু বলে নাই।

রাফি ওদের কথায় বলে,
রাফি: আরে বাদ দে! যা হওয়ার হয়ে গেছে। ইনু, তোমার ক্লাস কেমন গেছে?
ইনায়া: খুব ভালো আমাদের ম্যাম অনেক ভালো ছিল। ম্যামের পরে একটা স্যার আসছে তারপর আবার সেই ম্যাম আসছে। ম্যামের নাম “জেনিফা” উনি খুব মিশুক।

ওদের এসব কথাবার্তা চলতে থাকে। ওদের সবার কথাবার্তার মাঝে সেখানে এলেক্স, ম্যাক্স, এলিনা ও এরিক আসে। আর কোন কিছু না বলে এলেক্স ও ম্যাক্স ওদের পাশে বসে পড়ে কিন্তু এলিনা ও এরিক দাঁড়িয়ে থাকে কারন তারা ওদের চিনেনা।

দুটো অচেনা ছেলে তাদের পাশে এভাবে বসে পড়াতে সবাই ভুরু কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here