শেষ অধ্যায়ে তুমি পর্ব -১২+১৩

#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১২ (নতুন সূচনা)

( নোট: গল্পের শেষের মন্তব্য গুলো পড়বেন😊।)
সময় বহমান। দেখতে দেখতে ভিনদেশে যাবার সময় এগিয়ে এসেছে। নিজ দেশ থেকে ভিনদেশে পাড়ি জমাবে স্বপ্ন ছোঁয়ার খোঁজে।
আজকে অর্ক, রাফি ও মিহালদের আমেরিকার ফ্লাইট। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হওয়ার একুশ দিন আগে সবাই আমেরিকায় যাবে। ওখানে গিয়ে ভর্তি বিষয়ক ফর্মালিটি গুলো পূরণ করতে কিছুটা সময় লাগবে আবার ভার্সিটির সাথে সাথে যে পার্টটাইম জব গুলো করবে সেগুলোর জয়েনিং এর জন্যও তাড়াতাড়ি যাওয়া।
মিহালের পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে চারদিন হলো তবে হাত এখনো ঝুলানো দুইদিন পরে খুলতে বলেছে ডাক্তার।

আজ চার মাস যাবত তূর কোমাতে। ডাক্তার ইফতির কথা মতো ফ্লাইটের দিন মেইল পাঠাই নি কারণ তাহলে ইউনিভার্সিটি অথরিটি প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এখনো একুশ দিন বাকি আছে তাই সবাই প্রার্থনা করছে যেন তূর ফিরে আসে।

☆☆
“কোমা স্টেজে পেশেন্ট ব্যাথা সৃষ্টিকারী কোনো উদ্দীপনা, আলো, বা শব্দের প্রেক্ষিতে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারেন না। তিনি স্বেচ্ছামূলক কোনো প্রকার কার্য সম্পাদন করতে পারেন না। মূলত বাহ্যিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া স্বেচ্ছায় দেখাতে পারেনা কিন্তু অনুভব করতে পারে। সেরেব্রাম কাজ করে না কিন্তু রোগীর হাইপোথ্যলামাস কিছুটা কাজ করে।”
☆☆

রাত বারোটায় ফ্লাইট তাই সবাই সব কিছু ঠিক মতো গুছিয়ে নিচ্ছে। তূর খিলগাঁও একটা হসপিটালে আছে তাই মিহাল সহ বাকিরা এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে ওকে দেখে যাবে। মিহাল ও তার পরিবার রাত আটটায় তূর যে হসপিটালে ভর্তি আছে সেখানে এসেছে তূরকে দেখতে।

কেবিনে এখন কোনো ডাক্তার ও নার্স নেই তাই মিহাল তূরের কেবিনে যায় এবং ওর পাশে বসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, এক পর্যায়ে তূরের হাত ধরে মিহাল। তূর হয়তো সেটা অনুভব করতে পারছে কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না। হাত ধরা অবস্থায় মিহাল বলে,

মিহাল: চার মাস চলে গেছে তূর! এবার তো উঠো! এবার তো কোমা থেকে ফিরে আসো! তানজিনার থেকে আমার মুক্তির রাস্তা তানজিনা নিজে করে দিয়েছে। এখন শুধু অফিসিয়ালি মুক্তির অপেক্ষা। কিন্তু আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই না তূর! এখনো পর্যন্ত আমি তোমার প্রতি আমার অনুভূতিকে ভালোবাসা বলে কিনা আমি জানিনা! কিন্তু তোমার মায়ায় পড়ে গেছি আমি।

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে,
মিহাল: তাইতো তানজিনার সাথে ওই কাগজে-কলমে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আমার অতোটা কষ্ট হয়নি! কিন্তু মনে হচ্ছে বুক থেকে এক বোঝা নেমে গেছে। যার কাছে আমি থাকা না থাকায় কোনো কিছুই যায় আসে না এবং আমার উপস্থিতি যাকে বিরক্ত করে তার কাছ থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি এবং তাকেও মুক্তি দিয়েছি।

এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিহাল তূরের বন্ধ চোখ জোড়ায় আবার তাকায়। যার চোখের রহস্যময় মায়ায় পড়ার ভয়ে এতদিন এড়িয়ে চলতো আজ মিহাল সেই মানুষটির মায়ায় পড়ে গেছে!
ঠিক তখনই তার মায়ায় পরলো যখন সেই মানুষটা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এমন এক অবস্থায় আছে সেখান থেকে ফিরে আসবে কিনা তা অনিশ্চিত!

______
“ভালোবাসায় জেদ থাকাটা আবশ্যক নাহলেও মায়া থাকাটা জরুরী। আবার কারো প্রতি শুধু মায়া জন্ম নেওয়াকে ভালোবাসা বলা যায়না। যদি ভালোবাসায় মায়াটা না থাকে তাহলে জেদের বশবর্তী হয়ে যদি কাউকে হাসিল করার চেষ্টা করা হয় আর অপর পাশের মানুষটির মনে তোমার জন্য কোন অনুভূতি নাই থাকে তাহলে সেই জেদ ছেড়ে দেওয়াটা উত্তম। কারণ জেদ একসময় ফিকে হয়ে যায় কিন্তু মায়াটা থাকে।”

ঠিক তেমনি মিহালের জীবনে তানজিনা ছিলো তার ভালবাসার জেদ! বলতে গেলে ভালোবাসা থেকে জেদ টাই বেশি। হয়তো তানজিনার প্রতি থাকা ভালোবাসাটা মায়াতে রূপান্তরিত হতো কিন্তু অতীতের কিছু ঘটনার কারণে তা জেদে রূপান্তরিত হয়েছে।

আর তূর! যে কিনা এখন মিহালের মনে মায়ার জন্ম দিয়েছে এখন শুধু সেটা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হওয়ার অপেক্ষা।

______
রাত নয়টায় সবাই ভিনদেশে পা রাখার আগে তূরকে দেখতে এসেছে এরপর দেখা করে তারা চলে যায়।

ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে এক দিন প্লেন জার্নি করে সবাই পৌঁছায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে।

☆☆
“আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া, প্রশান্ত মহাসাগর বরাবর মেক্সিকান সীমান্ত থেকে প্রায় নয়শ মাইল পর্যন্ত প্রসারিত। এর ভূখণ্ডে রয়েছে ক্লিফ-রেখাযুক্ত সৈকত, রেডউড ফরেস্ট, সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা, সেন্ট্রাল ভ্যালির খামার জমি এবং মোজাভ মরুভূমি।
সান ফ্রান্সিসকো যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের একটি শহর। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের চতুর্থ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ১২তম জনবহুল শহর সানফ্রান্সিস্কো। সান ফ্রান্সিস্কোর আয়তন ৪৬.৭ বর্গ মাইল । জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে সান ফ্রান্সিস্কো যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।”
☆☆

সবাই মিলে সানফ্রান্সিসকো শহরে “সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি” ও “ইউনিভার্সিটি অফ সানফ্রান্সিস্কো” এর কাছাকাছি একটা ছয় বেড রুমবিশিষ্ট সাথে ড্রয়িং-ডাইনিং (এটাচড) ও কিচেন আছে এমন একটি পুরনো ধাঁচের বাংলা রেন্ট নেয়।

নাদিয়া ও শাফকাত একমাস এখানে থাকবে এরপর তারা “ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া” এর কাছাকাছি একটা ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে থাকবে। তাওহীদ ও আসফি একমাস পর “ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া” এর হোস্টেলে স্থানান্তরিত হবে।

ভিনদেশে পদার্পণ করে এক অন্যরকম শিহরণের শিহরিত সবাই। সানফ্রান্সিসকোর সময় সকাল এগারোটার সময় সবাই সানফ্রান্সিকোর মাটিতে পদার্পণ করে। এয়ারপোর্টের সব ইমিগ্রেশন বিষয়ক কাজ শেষ করে সকাল সাড়ে এগারোটায় এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়। এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাব বুক করে তারা সবাই ঐ পুরনো বাংলোয় পৌঁছায় সানফ্রান্সিকোর সময় দুপুর দেড়টায়।

পুরনো বাংলার কেয়ারটেকার একজন পঞ্চাশ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ তার নাম ” মিস্টার হেড্রিক”। সে এই বাংলোর দেখাশোনা বিশ বছর যাবৎ করছে। এই বাংলার বর্তমান মালিক ” নিউইয়র্কে” থাকে।

পুরো এক দিন জার্নি শেষে সবাই অনেকটাই ক্লান্ত তাই সবাই নিজ নিজ বাড়িতে সুস্থ ভাবে পৌঁছিয়েছে এই খবর জানানোর পরে প্রয়োজনীয় সব কাজ শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে রেস্ট নিতে বরাদ্দকৃত বেডরুমে চলে যায়।

—-এদিকে বাংলাদেশ থেকে ওদের ফ্লাইট টেক অফ করার একদিন পর তূরের হার্ট রেটের কিছুটা পরিবর্তন ও ব্রেনের কিছু কোষের উদ্দীপনা মনিটরে পরিলক্ষিত হয়। ডাক্তার তূরকে এখন চব্বিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখে।

অর্ক, মিহালরা সবাই সন্ধায় ফ্রেশ হয়ে বাংলোর বাহিরে গার্ডেনে মধ্যিখানে আগুন জ্বালিয়ে চারপাশে ঘিরে বসে।

রণক বাংলাদেশ থেকে টেক অফ করার আগের থেকেই দেখছিল যে জারিন কেমন যেনো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বিষয়টা সে অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে। আর আজকে যখন সবাই আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে তখন জারিন একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রণক এবার কৌতুহল দমাতে না পেরে জারিনকে জিজ্ঞাসা করে বসে,

রণক: জারিন একটু ওদিকে আসো তো!
রণকের ডাকে জারিনের ঘোর ভাঙে এবং উঠে রণকের সাথে যায়।

রণক: কি হয়েছে তোমার? তোমাকে অ্যাবসেন্ট মাইন্ড লাগছে!!
জারিন হকচকিয়ে যায় আর আমতা আমতা করে বলে,
জারিন: আমার আবার কি হবে? আই এম টোটালি ফাইন।

রণক: উহুম! তোমার কিছু তো হয়েছে! বলো আমায় আমি সলভ করার চেষ্টা করব।

জারিন মনে মনে ভাবে,
জারিন: কি সলভ করবে তুমি! যার সবকিছু তোমাকে নিয়ে ভাবনা!

জারিনকে আবার অন্যমনস্ক দেখে রণক জারিনের কাঁধ ধরে ঝাকায়।
রণক: প্লিজ বলবে কি তোমার কি হয়েছে?
জারিন অনেকটা ঘোরের মাঝে বলে,
জারিন: তুমি আমার জন্য ওই দুই ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পরেও ” ইউনিভার্সিটি অফ সানফ্রান্সিসকো” তে ভর্তি হচ্ছো তাইনা!

জারিনের কথায় রণক হেসে দেয় আর বলে,
রণক: তুমি জানলে কিভাবে আমি ওই দুই ইউনিভার্সিটিতেও চান্স পেয়েছি? আমি তো বলেছিলাম আমি ‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া’ তে চান্স পেয়েছি। কিন্তু ‘সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি’ তে চান্স পেয়েছে সেটা তো বলিনি!

জারিন কিছু বলেনা শুধু রণকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রণক: হুম, তোমার জন্যই আমি তুমি যেখানে ভর্তি হচ্ছো সেখানেই ভর্তি হচ্ছি। তোমাকে একা কিভাবে ছাড়ি বলো!!

রণকের কথায় জারিনের চোখ থেকে দু ফোটা পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়ে। জারিনের এখন মনে হচ্ছে, রণকের মনের পুরোটা জুড়ে এখন শুধু তার বসবাস!

রণক মনে মনে ভাবে,
রণক: সত্যি বলতে এখন আর তূরের জন্য মন থেকে কোন ফিলিংস আসে না শুধু বন্ধুত্বের ফিলিংস ছাড়া। তোমায় আমি এখন মাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে ভালোবেসে ফেলেছি জারিন।
#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-১৩ (ফিরে আসা😌)

রণক নিজের ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে জারিনের গালের দুপাশে দুহাত রেখে অশ্রু ভেজা চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছিয়ে দেয়। এরপর কপালে আলতো চুমো দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
জারিন রণকের বুকে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে নিজের অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। এই অশ্রু কোন কষ্টের অশ্রু না এটা হচ্ছে অমূল্য কিছু পাওয়ার অশ্রু।
____

রাফি, মিহালরা সানফ্রান্সিসকোতে যখন পৌঁছিয়েছে তখন বাংলাদেশ সময় রাত বারোটা। ঠিক রাত সাড়ে বারোটার সময় তূরের হার্ট রেটে পরিবর্তন আসে মানে তূর কোমা থেকে ব্যাক করেছে। কিন্তু ডাক্তার বলেছে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যদি জ্ঞান না ফিরে তাহলে তূর মারা যাবে। ডাক্তার তূরকে তাই চব্বিশ ঘন্টা অবজার্ভেশনে রেখেছে।
হসপিটাল অথরিটির এই খবরটা তূরের পরিবারকে সকালে জানানোর কথা কিন্তু ডাক্তার ইফতি রাত একটার দিকে নীরাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানিয়ে দেয়।
নীরা হোয়াটসঅ্যাপ চেক না করাতে সকালে যখন হসপিটাল অথরিটি জানায় তখনই জানতে পারে। তূরের পরিবার হসপিটালে গিয়ে যখন জানতে পারে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে তূর মারা যাবে তখন তূরের মা আরো অসুস্থ হয়ে যায়। তূরের মা মেয়ের শোকে চারমাস যাবত অসুস্থ। ডাক্তার তূরের মাকে অন্য কেবিনে নিয়ে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। সবাই খুব ভয় ও টেনশনে আছে।
_____

সবার ভয় ও টেনশনের অবসান ঘটিয়ে বিশ ঘন্টা পরে রাত সাড়ে নয়টার দিকে তূরের জ্ঞান ফিরে।

” ফিরে এসেছে” তূর দীর্ঘ চার মাস কোমাতে থেকে বিশ ঘন্টা আন্ডার অবজার্ভেশনে থেকে। হাতের মধ্যমা আংগুলের মুভমেন্ট দেখে নার্স ডাক্তারকে খবরটা দেয়। ডাক্তার ইফতি ভিতরে গিয়ে চেকআপ করে এসে তূরের পরিবারকে সুখবরটা দেয়। নার্স তূরকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রেখেছে এখন। সবাই ঘুমন্ত অবস্থায় তূরকে এক নজর দেখে।

তূরের মা আজকে তূরের কাছে হসপিটালে থাকবেন বলে জেদ করেছে তাই নীরা ও তূরের চাচা আজকে হসপিটালে থাকবে। তূরের বাবা, নাফিহা, তূরের চাচি ও তূর্যকে রাত দশটার পরে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় তূরের চাচা।

নীরা হসপিটালে থাকবে বলে ইফতি আজকে ওভারটাইম এক্সট্রা ডিউটি করতে রাজি হয় আর সেও আজকে হসপিটালে থেকে যাবে।

–ভোর সাড়ে পাঁচটায় তূরের ঘুম ভাঙে। দীর্ঘ চার মাস পর তূর নিজের অক্ষি জোড়া খুলে। চোখ খুলার পর কেবিনের চারপাশে নজর বুলায় কিন্তু তখন তূর কেবিনে একা তাই কাউকে দেখতে পায় না। তূরের মা তূরের কেবিনে রাত একটা পর্যন্ত ছিলো এরপর নীরার জোরাজুরিতে পাশের কেবিনে ঘুমাতে যায়।
ভোরের আবছা আলো কেবিনের ভেন্টিলেটর দিয়ে কেবিনে প্রবেশ করছে যা কেবিনের অন্ধকারকে দূর করছে। আজ দীর্ঘ চার মাস পর তূর ভোরের আলো দেখলো। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে নার্স এসে তূরের কেবিনে ঢুকে তখন সকালের নরম সোনালী রোদ্দুর কেবিনের ভেন্টিলেটর দিয়ে কেবিনে এসে পড়েছে। নার্স এসে দেখে তূর চোখ মেলে রোদের উৎসের দিকে তাকিয়ে আছে।

নার্স: গুড মর্নিং ম্যাম😊।
তূর: গুড মর্নিং😊। আজকে কত তারিখ?
নার্স তূরের কথায় হেসে জবাব দেয়।
তূর নার্সের কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আর বলে,
তূর: চার মাস পেরিয়ে গেছে!!
নার্স: জ্বী ম্যাম। আপনি চার মাস কোমাতে ছিলেন।

তূরের অবাকতা এখনো কাটেনি, বিস্ময় নিয়ে বলে,
তূর: আমার ফ্যামিলি মেম্বাররা কোথায়?
নার্স: আপনার মা, বোন ও চাচা পাশের কেবিনে আছে। চব্বিশ ঘন্টার অবজার্ভেশনের বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে যাবার পরে আপনার জ্ঞান ফিরে কালকে রাতে।

তূর এরপর চুপ করে যায়। নার্স নিজের কাজ করছে। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর তূর আবার নার্সকে জিজ্ঞাসা করে,
তূর: আচ্ছা! আমার বন্ধুরা কোথায়? আমার হিসাব অনুযায়ী ওরা এখন আমেরিকায় থাকবে তাই না?

নার্স: জি ম্যাম উনারা দুই দিন আগে রাতে আপনার সাথে দেখা করে গেছে। তারা এখন আমেরিকাতে আছে।

এসব শুনে তূর হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। নার্স নিজের কাজ করে চলে যাবার সময় তূর নার্সকে বলে তার পরিবারকে যেনো বলে এখানে আসতে।

তূরের মা নার্সের কাছ থেকে খবর পেয়ে জলদি তূরের কেবিনে চলে আসে। এসে সে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তূর মায়ের কান্না দেখে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা। নীরা, তূরের চাচা ও ডাক্তার ইফতি কেবিনের দরজার কাছে দাড়িয়ে মা-মেয়ের এই সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করছে। নীরা তার মাকে আজ কত দিন পর খুশি দেখলো! তার মায়ের চোখে যেন আজ অশ্রু নয় খুশীরা বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে।

আস্তে আস্তে সবাই কেবিনে প্রবেশ করে। তূর মাকে পাশে বসিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। নীরার দিকে তাকিয়ে দেখে নীরার চোখে পানি ছলছল করছে যেন একটু টোকা লাগলে টুপ করে পড়ে যাবে। তূর নীরাকে চোখের ইশারায় কাছে আসতে বলে। নীরা তূরের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে। সবার সাথে কুশল বিনিময়ের পর ডাক্তার ইফতি বলে,
ইফতি: গুড মর্নিং এন্ড ওয়েলকাম ব্যাক! আপনার শরীর এখনো কিছুটা উইক আপনাকে আরো এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া লাগবে।

তূর ডাক্তারের কথায় মুচকি হেসে সায় দেয়। সকাল আটটার মধ্যে তূরের পরিবারের বাকি সবাই চলে আসে সাথে কিছু আত্মীয়-স্বজন আসে।

তূর্য তো এতদিন পর বোনকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে হাসতে দেখে দৌড়ে এসে বোনের কোলে উঠে বসে পড়ে। তূরের কোলে চুপ করে বসে আছে সে। নাফিহাও এসে তূরকে জড়িয়ে ধরে।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর তুর্য বলে,
তূর্য: আপু! তুমি এতদিন আমার সাথে কথা বলনি কেন? বাসায় কেন যাওনি? আর তোমার চুলগুলো কোথায়? বড় বড় চুল গুলো? এখন চুল গুলো ছোট ছোট কেনো?
এগুলো বলে বোনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তূর্য।

তূর ভাইয়ের কথায় মলিন হেসে জবাব দেয়,
তূর: আপু তো ঘুমিয়ে ছিলাম ভাইয়া🙂। কয়েকদিন পর দেখবা আপুর চুল আবার বড় বড় হয়ে যাচ্ছে।
আসলে তূর্যর তূরের বড় বড় চুল গুলো অনেক পছন্দের ছিল। সার্জারির আগে যখন চুল কাটে তখন তূর্য দেখেনি।

সকাল দশটার দিকে তূরকে রক্ত দিতে ক্যানোলার সাথে রক্তের ব্যাগ লাগানো হয়।
_____

নীরা তূরের বান্ধবীদের ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে তূরের কোমা থেকে ফিরে আসার খবর জানিয়ে দেয় সকাল আটটার দিকে।

সানফ্রান্সিকোর সময় সন্ধ্যা সাতটার দিকে সবাই তূরের কোমা থেকে ফিরে আসার খবর জানতে পারে। সবাই এতটাই খুশি হয় যে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা একে অপরকে গ্রুপ হাগ করে।

মিহাল খবরটা পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় খুশিতে কারণ তূর তার করা ওয়াদা রেখেছে! তাকে একলা ছেড়ে যায়নি। মিহাল নিজের পরিবারকে খবরটা দেয়। মিহালের পরিবার খবরটা পেয়ে খুব খুশি হয়। তারা দশটার দিকেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

মিহাল তূরের খবরটা পাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাড়ির বাহিরে গার্ডেনে যায়। নিজেকে কিছুটা সময় একাকিত্বে দিয়ে মনের অনুভূতিকে বোঝার চেষ্টা করছে। মিহালকে খুঁজতে খুঁজতে রিজভী, তাইজুল ও রাফি গার্ডেনে আসে। ওরা সবাই মিহালকে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। তাই সবাই এসে মিহালের পেছনে দাঁড়ায়।

রাফি: তূর ফিরে এসেছে কোমা থেকে এখন তুমি কি করবে?

রাফির কথায় মিহাল পেছোন ঘুরে দাঁড়ায় আর মলিন হেসে বলে,
মিহাল: জানিনা!
রিজভী: তানজিনা কে জিজ্ঞাসা করেছিস কবে সাবমিট করবে ডিভোর্স পেপার?

মিহাল হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
মিহাল: না! সে এখনো ঝুলিয়ে রেখেছে। তার নিজের সুবিধামতো সাবমিট করবে।

তাইজুল: তানজিনা ভেবেছে তোকে সবার সামনে ফাঁসাবে তারপর ডিভোর্স দেবে! মানে ডিভোর্সের পুরো দায়টা তোর ঘাড়ে চাপাবে।

তাইজুলের কথায় রিজভী ও রাফি বাঁকা হেসে বলে,
রাফি: সেটাতো আর সম্ভব না! মিহালতো সব কথা বাত্রা রেকর্ড করে রেখেছে।

রিজভী: তবে আমাদের সাবধান থাকতে হবে যাতে ইনায়া কোনভাবে তূর ও মিহালের বিয়ের খবর জানতে না পারে তানজিনার সাথে ডিভোর্স কনফার্ম হওয়ার আগে।

তাইজুল ওদের কথায় সায় দিয়ে বলে,
তাইজুল: এটা ঠিক বলেছিস! তূরতো তানজিনাকে বলবে না শিউর কিন্তু ইনায়া যদি জানতে পারে তাহলে সে তার বেস্টফ্রেন্ড কে বলে দিতেই পারে। তাই রাফি তুই খেয়াল রাখবি যাতে ইনায়া ঘুণাক্ষরেও টের না পায় তানজিনার সাথে ডিভোর্স কনফার্ম হওয়ার আগে।

এরপর ওরা চারজন বাংলোর ভেতরে প্রবেশ করে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here