শেষ পর্ব -০১

স্কুলের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে ইরাদ ওর বউকে নিয়ে আসবে কথাটা শুনে কলিজার ভিতরটা ধুক করে উঠলো। মনে হচ্ছিলো কেউ কলিজার ভেতরটা কেটে তার মধ্যে লবণ মরিচ গুঁড়ো দিয়ে তার ওপরে আবারো ধারালো ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে।
তবুও সামিয়াকে বুঝতে দিলাম না আমার মনের অবস্থা। সে এবার অবাক চোখে আমাকে প্রশ্ন করলো, “তুই আসবি তো?”
হাসি মুখে কফির কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললাম,
” কি যে বলিস? আসবো না কেনো?”
সামিয়া এবার হাসি দিয়ে বললো, “যাক বাবা ফাইনালি ১০ বছর পর সবগুলো একসাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ভুলেও মিস করিস না কিন্তু ডাক্তার সাহেবা। নইলে মার একটাও মাটিতে পড়বে না। রুনা, লাবিবা সবাই কিন্তু এই দিনটার জন্যই লন্ডন থেকে দেশে ফিরতেসে ওকে?”
” ওকে বাবা ডান। আজকে আমি উঠি রে। ”
” আচ্ছা বাই,আমিও যাবো তোর দুলাভাইয়ের জন্য শপিং করতে।”
সামিয়ার হাসবেন্ডের বার্থডে কাল তাই আজ সে ব্যাস্ত। আসলে শুধু সামিয়া না সবাই ব্যাস্ত তাদের জীবনে স্বামী/ স্ত্রীকে নিয়ে, আর হওয়াটাও স্বাভাবিক।

আমি হাসি মুখে সামিয়াকে বিদায় দিলাম। আজকে চেম্বারে যাওয়ার কথা ছিলো কফিশপ থেকে ডাইরেক্ট কিন্তু আমার হঠাৎ করেই শরীরটা খুব ভারী লাগছে। মনে হচ্ছে হাটা চলা করার মতোন শক্তিটুকুও শরীরে অবশিষ্ট নেই। আমি আমার পি.এ কে ফোন করে বলে দিলাম আজকের সকল এপোয়েন্টমেন্ট গুলো ক্যান্সেল করে দিতে। আজ আমি কাউকে কোনো চিকিৎসা দিতে পারবো না।

কারণ আমার অসুখটা যে মাথাচাড়া দিয়ে বেড়েছে। এই অসুখটা যে আমার আজীবনের শান্তিটা কেড়ে নিয়েছে তা তো কাউকে বলে বুঝানো অসম্ভব প্রায়। আর আমি এই কথস বললে হয়তো বা সবাই হাসি-তামাশা ও করবে।নিজেকে ব্যাস্ত রাখি, ভালো রাখার প্রচেষ্টায় থাকি সবসময়, আর সত্যি বলতে থাকিও।
এই যে ভালোই ছিলাম কিছুক্ষন আগেও তবে কেমন যেনো হয়ে গেলাম ইরাদের কথা শুনে। কথাটা হয়তো ঠিক বলিনি মূলত ইরাদের কথা শুনে না, ওর স্ত্রীর কথা শুনে। আমি জানি ইরাদ বিবাহিত, দুই বছর আগেই শুনেছি ও বিয়ে করেছে অন্য কাউকে।সব বন্ধু-বান্ধবীরা গিয়েছিলো ওর বিয়েতে। তাদের আইডিতে বউয়ের ও ইরাদের ছবিও আপলোড করেছিলো, বউকে ছবিতে দেখেছিও, তবে মুহুর্ত ও দেরি করিনি তার ছবি স্ক্রল করতে তাই ঠিকভাবে বউকে দেখা হয়নি আমার। ইরাদ বিয়ে করেছে এটাই মেনে নিতে কষ্ট হয় আজও, আর সে তার স্ত্রীর সাথে আমার চোখের সামনে আসবে তাও পুরো ৮ বছর পর এই জিনিসটা আমার মানতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে।
বাড়ি ফিরে এলাম, আজ আমার বাসায় কেউ নেই। ভালোই হয়েছে সবাই ফিরবে সপ্তাহ দুয়েক পর, আমার এই বিধ্বস্ত অবস্থা কাউকে দেখতে হবেনা আর দেখে প্রশ্ন করতেও হবেনা। কারণ আমার কাছে কোনো জবাব নেই, এজন্য বলতেও চাই না। বিকেল ঘনিয়ে রাত হয়ে এলো আমি ইজি চেয়ারে বসে আমি আবার রুমের জানালাটা খুলে, বারান্দার সাথে লাগোয়া জানালা। বাইরে খুব শীতল বাতাস বইছে। আজ আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে, চাঁদটা ঝিকঝিক করছে তার রুপালী আলো দিয়ে চারিপাশকে করে তুলেছে অপরূপ। আমার বারান্দায় রাখা গোলাপ ও বেলী গাছের পাতা গুলোর ওপরে পরছে আছড়ে পড়ছে চাঁদের রুপালী আলো, এতে গাছ ও গাছের ফুলগুলো ঝকমক করছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে পুরো পরিবেশটা। তবে আমার মনে বিষাদের ছায়া নেমেছে। এই বিষাদ নতুন না, তবে আজকে একটু বেশি। আমরা মানবজাতি বড়ই অদ্ভুত, অনেক সময় সত্যিটা জানি এবং মানিও তবে চোখে তাকিয়ে দেখতে চাই না। কারণ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্তক্ষরণ বড়ই ভয়ানক, চোখে দেখা যায় না কিন্তু নিজেকে একদম নিঃস্ব করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পুরোনো কথা গুলো ভাবতে চাই না, তবে আজকে কেনো যেনো মনে হচ্ছে ভাবলে হয়তো ভেতরের পাথরটাকে কোনোভাবে একটু সড়াতে পারবো।

.

জীবনে প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম ক্লাস ১০ এ থাকতে। আসলে প্রথম প্রেম না, আমি জীবনে একবারই প্রেমে পড়েছিলাম তারপর আর প্রেম আসেনি আমার জীবনে। আসে নি যদি বলি ভুল হবে, আমি আসতেই দেইনি। প্রেমের জায়গাটায় সে এমনভাবে গেথে গিয়েছিলো সেটা আর মুছতেই পারিনি। আজও রাতের আধারে তার কথা মনে পড়লে একা একা চোখের জল ফেলি, নিজেকে শক্ত করে আবারো পরদিনের জন্য তৈরী করে ফেলি। জীবনটা তো সিনেমা না, যে ৩ ঘন্টায় শেষ হয়ে যাবে। জীবন তো অনেক বড় এই বড় জীবনটা নিজের ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া কাটানো খুব কঠিন তবে তাকে পাশে পেয়েও যদি অশান্তি থাকে এর চেয়ে হয়তো দূরে থেকে তাকে ভেবে জীবনটা কাটানোই উত্তম। আচ্ছা কেনো এমন লাগছে আজকেও? আমি তো এখন সেই ১৬-১৭ বছরের কিশোরী না। তবে কেনো ইচ্ছা করছে আবেগে কাঁদতে, যেমনটা ১০ বছর আগে লাগতো। তুমি যাওয়ার পর পর যখন বুকের ভিতর খুব ভারী লাগতো, নামাজে বসে পড়তাম। অঝরে কাঁদতাম আর আল্লাহকে বলতাম “আল্লাহ প্লিজ আমার মনে শান্তি দেন। নিজেকে যেনো শক্ত রাখতে পারি।” আল্লাহ আমাকে সাহায্য ও করেছেন। কাউকে আজ অবধি কোনোদিন বলিনি এখনো তোমার জন্য কলিজাটা ফেটে যায়। খুব মিস করি তোমাকে। “আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড” কথাটা আমার জীবনে ফলে নি।আমার তো বন্ধু ও তুমি ছিলে, ভালোবাসা ও তুমি ছিলে। তাই তুমি যাওয়ার পরে অত কাছের কোনো বন্ধু/বান্ধুবীও হয়নি যাকে মনের সবটা খুলে বলতে পারি। আজ পর্যন্ত নিজের সবটা নিজেই ওকা ডিলিংস করে এসেছি। এইজে দেখো না? আজকে কিভাবে কান্না করছি তোমার জন্য? ঠিক এভাবেই আস্তে আস্তে নিজেকে নিজে সামলে নিবো।
তবে আজকে কেনো ইচ্ছা করছে ইরাদকে জিজ্ঞেস করতে, তুমি কি একটুও কষ্ট পাওনি আমাকে ফেলে চলে যেতে? পেরেছো নতুন জীবনে আমার মতো করে অন্য কাউকে ভালোবাসতে? সে কি আমার মতো কথায় কথায় তোমার সাথে মুড সুইং দেখায়? তুমি রাগ করলে সেও কি আমার মতো করে তোমায় মানায়? তাকেও কি তুমি হুটহাট করে পেছন থেকে কোলে তুলে নাও? তার জন্যও কি তুমি চুড়ি টিপ কিনে আনো? সে কি তোমাকে তোমার মনের মতো হয়েই ভালোবাসে? নাকি আমার মতোই…………………
নাহ আমার মতো হলে তো আজ তোমরা এক হতে না। হয়তো সে তোমাকে পুরোপুরি তোমার মতো হয়েই আগলে রেখেছে।

রুহির সারাদিন কাটে কাজের মাধ্যমে, মাঝে মাঝে রাত গুলো এভাবে কাটে। ইরাদ, এই একটা নাম কারো মুখে শুনলে রুহি নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। যদিও এই বিষয়টা সে বেশির ভাগ সময়ই উপেক্ষা করে চলে যায়। আর ইরাদের ব্যাপারে কথা হবে বলে সে তার স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথেও মিশে না খুব ঘনিষ্ঠভাবে। উপর দিয়ে হাই হ্যালো পর্যন্ত থাকে সবার সাথে তাও খুব কম। এইতো দু’দিন বাদে রুহির স্কুলের সবার পুনর্মিলন অনুষ্ঠান। পুরো ১০ বছর পর সবাই একসাথে দেখা করতে যাচ্ছে। যদিও বেশির ভাগ ছাত্র/ছাত্রীরা একই কলেজে ছিলো। ইরাদ আর রুহিও একই কলেজেই ছিলো তবে কলেজের পরে সবার মতো ওদের গন্তব্য ও আলাদা হয়ে গিয়েছলো।

.

রাত ১০টা বাজে ইরাদ প্রায় ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে। আজকে অফিসে বেশ কাজের চাপ ছিলো। ইরাদের স্ত্রী একজন গৃহিণী, তার নাম তমা। তমা আজকে সারাদিন অপেক্ষা করছিলো ইরাদ কখন ফিরবে বাসায় আর ইরাদ আসলেই তমা ওকে অনলাইনে পছন্দ হওয়া একটা বোরকা দেখাবে। ইরাদ বাড়ি ফিরতেই তমা সুন্দর করে হেসে ওকে বললো,
– তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো তাড়াতাড়ি আমি খাবার দিচ্ছি।
ইরাদ গোসল সেড়ে খেয়ে বিছানায় শুয়ে ফোনটা হাতে নিতেই তমা আসে,
– শুনছো, তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।
– হ্যাঁ বলো
– আমার একটা জিনিস খুব ভালো লাগলো আজ কিনে দিবে?
– হ্যাঁ টাকা নাও কি কিনবে?
– এই যে দেখো একটা বোরকা আর আলাদা করে দুটো হিজাব।
ইরাদ হাসলো বললো,
টাকা নিয়ে নাও আমার মানিব্যাগ থেকে।
তমা খুব খুশি হয়ে গেলো। এবং উচ্ছাসিত কন্ঠে ইরাদকে বললো,
– আচ্ছা তুমি থাকো আমি কিচেনের কাজটুকু মিটিয়ে আসছি।
তমা মেয়েটা বেশ লক্ষ্যি। বেশ রাখঢাক করেই চলাফেরা করে, ঘরকনে সে। তার তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। বিয়ে হয়েছে সংসারেই সে মনোযোগ দিচ্ছে, স্বামীকে বেশ ভালো রাখার চেষ্টা করে আর দশটা মেয়ের মতোই। ইরাদ আর তমার বিয়েটা পারিবারিকভাবেই হয়েছে। আর সত্যি বলতে ইরাদ যেমন মেয়ে চাইতো তমা পুরোটাই তেমন। তমার হেটে যাওয়াটা ইরাদ দেখছে তাকিয়ে। সে পুরোই ইরাদের মনের মতো। ইরাদ যেরকম চাইতো তার বউকে, মেয়েটা ওইরকমই তবুও একবুক হতাশা কাজ করে মনের ভিতরে। এই হতাশা কেনো? ইরাদ জানে না।

রাত ৩টা বাজে, স্ত্রী আছে ইরাদের তবুও মাঝেমধ্যে নির্ঘুম রাত কেটে যায়। রাত জাগার অভ্যাস তো সেই ১০ বছর আগে থেকেই হয়েছিলো। আগে খুব সুখ নিয়ে জাগা হতো, দুনিয়াটা রঙিন প্রচ্ছদে আবৃত ছিলো। এখন সেই প্রচ্ছদটা আর নেই, ছিড়ে গেছে এক ঝাটকায়। তবে রাত জাগার সেই অভ্যাসটা রয়েই গেছে। সবকিছু বদলে গেলেও কিছু জিনিস একবার জীবনে এসে দাড়ালে তার দাগ রেখেই যায়।

ইরাদ ভালো একজন স্বামী। তমাকে ভালো রাখছে শারীরিক ও মানসিক সুখ দিয়েই। সবার সবটা পরিপূর্ণ করে রাখে ইরাদ, কিন্তু নিজের দিকে কিছুটা অপূর্ণতা তাকে গ্রাস করেই যায়।
কেনো জেনো মনে হয় মাঝে মাঝেই যে ভালোবাসার দিকটা কেমন যেনো ফাকা রয়েই যায়। তমার সাথে মিলনটা হওয়ায় কেনো যেনো সেই এক্সাইটমেন্টটা কাজ করে না। তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে গেলে শুধু নিজের যৌনতাই কাজ করে। কখনো ভালোবাসাটা আসে না। এইতো বিয়ের এতোগুলো সময় কেটে গেল, কেনো যেনো খুব একটা অপ্রোয়জনীয় কথাও আসে না মুখে যেমনটা সেই ১০ বছর আগে আসতো রুহির সাথে। ভিন্ন দু’টো মানুষও সারা সারা রাত জেগে অনেক কথা বলতো আর কোনো টপিক ভাবতেও হতো না। কথা নিয় যেনো খই ফুটতো দুজনের মুখে। আজ কি নেই? সবই তো আছে, আসলে সব তো এখন পার্ফেক্ট মনের মতো। তবে কি মিসিং এখানে? ইরাদ আকাশ পানে তাকিয়ে ভাবছে….
দু’দিন বাদেই যেতে হবে অনুষ্ঠানে, তবে কারো জন্য ইরাদ কাঁদবে না। আর নাই কোনো দুঃখ ও প্রকাশ করবে। জীবনে করার মতো অনেক কাজ আছে, যে নাকি তাকে ভুলে নিজ জীবনে আগে বেড়ে গেছে সম্পুর্ন আলাদা পথ বেছে এমন কাউকে ভেবে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে।

(

#শেষ
#প্রথম_প্রহর
#Yasira_Abisha (#Fatha)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here