শেষ প্রহরের মায়াজাল পর্ব -০৩

#শেষ_প্রহরের_মায়াজাল
#পর্ব_৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

চোখে কালো কাপড় বাঁধা অবস্থায় বারিশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মান্নাত। মান্নাতের চোখে ভয় তবে বারিশের চোখে শীতল মুগ্ধতা। মান্নাত রেগেমেগে চোখের কাপড় সরাতে গেলে বারিশ হাত আটকে দেয় ওর। মান্নাত এতে রেগেমেগে আগুন হলো। সে দাত চেপে বললো,

— ” কে আপনি? এভাবে আটকে রেখেছেন কেনো আমায়? জানেন আমি আপনার কি হাল করতে পারি? সোজা লকাপে পুড়ে দিবো। ছাড়ুন আমায়!”

বারিশ মুচকি হাসলো। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মান্নাতের কোমর জড়িয়ে ধরলো। মান্নাত এতে দ্বিগুণ বেগে কেপে উঠলো। খানিক ভয় পেয়ে সরে যেতে নিলে বারিশ হঠাৎ মান্নাতের ঘাড়ে মুখ ডুবায়। মান্নাতের ঘাড়ে ছোট ছোট চুমু দিতে দিতে নেশা ধরানো গলায় বললো,

— ” পুড়ে দে না তোর মনের লকাপে। আজীবন সেখানে শিকল দিয়ে আটকে রাখ আমায়।আমি স্বইচ্ছায় রয়ে যাবে সেথায়। বিশ্বাস কর। ”

মান্নাতের শরীর কেপে উঠলো ওমন কথা শুনে। বারিশ এখনো মান্নাতের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। কখনো নাক দিয়ে স্লাইড করছে, আবার কখনো ঠোঁটের স্পর্শ দিচ্ছে। মান্নাতের মুখ ভয়ে নীলবর্ণ ধারণ করেছে। অজানা এক ছেলে এভাবে তার এত কাছে… মান্নাত আর সহ্য করতে না পেরে খুব জোড়ে ধাক্কা দেয় বারিশকে। বারিশ টাল সামলাতে না পেরে একটু সরে দাঁড়ায়। মান্নাত রাগে তরতর করে কাপছে। চোখের কাপড় খুলতে গেলে উপলব্ধি করলেন যে কাপড়ে গিট বেধে গেছে। মান্নাত বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে চোখ থেকে কাপড় নামিয়ে দিলো। সঙ্গেসঙ্গে বারিশ হাওয়া। মান্নাত চোখের সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হলো। এখনো সেই মানুষটার শরীরের কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ চারপাশে মো মো করছে। মান্নাত নিজের শরীর থেকে নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিলো। তার কাপড়েও সেই লোকটার শরীরের ঘ্রাণ। মান্নাত ” ব্লাডি ম্যান” বলে হনহন করে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। আজ এই পারফিউমের ঘ্রাণ-ই সেই লোকটার কাল হবে। অসহ্য!

বারিশের বাড়ীর হলরুমের চারদিকে মানুষের গমগম অবস্থা। সবাই যে যার মতো মত্ত হয়ে আছে। মান্নাত একে একে সবার কাছে গিয়ে হালচাল জিজ্ঞেস করলো। সবার সাথে কথা বলার ফাঁকে মান্নাত একবার করে তাদের শরীরের ঘ্রাণ নিলো। নাহ্! এদের মধ্যে কারোর শরীরেই সেই পারফিউমের ঘ্রাণ নেই। মান্নাত একপাশে দাড়ালো। পুনরায় চারিদিকে একপলক চোখ বুলালো। বারিশ একপাশে দাড়িয়ে তার কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলছে। মান্নাতের চোখ থেমে গেলো বারিশের দিকে। তার অবচেতন মন জানান দিলো “সেই অজানা লোক বারিশ নয় তো? ”
মান্নাত দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেলো বারিশের দিকে।
মান্নাত বারিশের পাশে দাঁড়ালে বারিশের বন্ধু বান্ধব ওকে দেখে ” হাই” বললো। মান্নাতও ভদ্রতার খাতিরে কতক্ষণ কথাবার্তা বললো ওদের সাথে। বারিশ ভ্রু কুঁচকে মান্নাতের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটার মতিগতি সুবিধার লাগছে না। এ ওর পাশে কি করছে?
কিছুসময় পর বারিশের সব বন্ধু ওকে রেখে চলে গেলে মান্নাত বারিশের মুখোমুখি দাড়ালো। বারিশ এখনো হাতে কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মান্নাত কোনো ভনিতা ছাড়াই বললো,

— “আমি আপনার পারফিউমের ঘ্রাণ শুকবো। ”

বারিশ সন্দেহের কারণে ভ্রু নাচিয়ে বললো,

— ” বাট হুয়াই? ”
— ” আমার মন চাচ্ছে তাই। ”

বারিশ ত্যারাভাবে বললো,

— ” আপনার মন রক্ষা করতে আমি আগ্রহী নই। থ্যাংকস। ”

বারিশ মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে নিলে মান্নাত বারিশের কলার হাত দিয়ে ধরে ফেলে। বারিশ থমকে যায়। মান্নাতের দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালে মান্নাত ত্যেছরভাবে বললো,

— ” আই নিড ইট অ্যান্ড আই উইল এ্যার্ন ইট। ”

অতঃপর মান্নাত বারিশকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বারিশের কাছে এগিয়ে এলো। মুখটা বারিশের বুকের কাছে এগিয়ে এনে নাক দিয়ে ঘ্রাণ শুঁকলো। একবার দুবার তারপর কয়েকবার। বারিশ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে মান্নাতের দিকে। মান্নাত নিজে তার এতটা কাছে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই বারিশের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। মান্নাত সরে এলো বারিশের থেকে। চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করছে তার। সেই অজানা লোকটা তবে বারিশ ছিলো? কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব?
বারিশ খানিক নড়েচড়ে নিজেকে সামলে নিলো। তারপর মান্নতের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ” কাজ শেষ? ”

মান্নাত এখনো হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারিশের কথা কানে যেতেই হুড়মুড়িয়ে বললো,

–” একটু আগে ওই লোকটা আপনি ছিলেন, তাইনা? ”

বারিশ থতমত খেয়ে গেলো। কিন্তু চেহারা স্বাভাবিক রেখে বললো,

— ” কোন লোকটা? ”
— ” ঐ যে যে লোকটা আমার ঘাড়ে…”

বারিশ ভ্রু বাঁকা করতেই মান্নাত থেমে গেলো। ইশ! কি বলতে যাচ্ছিল ও। এখনই লজ্জায় পড়তে হতো। মান্নাত স্বাভাবিক হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বারিশের দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকাতেই বারিশ বললো,

— ” তোমার ঘাড়ে কি সে করেছে ? ”
— ” ব.. না..মানে! ওকে! ফরগেট ইট। আপনি আগে বলুন করিডোরে আমার সাথে থাকা ওই লোক আপনি ছিলেন, তাইনা? আপনিই আমাকে ওসব আওল ফাউল কথা বলছিলেন? ”

বারিশ কিছুক্ষণ মান্নাতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। মান্নাত বারিশের দিকে হাঁ করে তাকালে বারিশ মান্নাতের মাথায় এক চাটা মেরে শিস বাজিয়ে সামনে এগুলো। মান্নাত বারিশের ওমন ব্যাবহারে নাক মুখ কুচকে ফেললো। কি ভাব! গা জ্বলে যায় দেখলে!

_____________________
— ” আসো বাচ্চারা! এদিকে আসো! ”

পিলারেরসামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে এক লোক। সম্পূর্ণ মুখ বিকৃত। তার মুখের ডান গাল থেকে ত্বকের কিছু অংশ খসে পড়ছে। তার ঠিক সামনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো বাচ্চা। ভয়ে তাদের আত্মা রীতিমত লাফাচ্ছে। দুচোখ থেকে জলের ধারা অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে। বারবার মাথা দুলিয়ে বলছে,

— ” না। যাবো না। আমাদের ছেড়ে দিন। দয়া করুন। ছেড়ে দিন আমাদের। ”

লোকটা হটাৎ মুখটা থমথমে করে ফেললো। দাতে দাত চিবালো। শব্দ হলো তাতে ” মটমট”। লোকটা এবার হিংস্র শব্দ তুলে বললো,

— ” আয়। আয় বলছি। রাগাবি না আমায়। আমি রাগলে খুব ভয়ংকর হয়ে যাই। আমার ভয়ংকর রূপ তোদের জন্য একটুও ভালো হবে না। ”

বাচ্চা দুটো এবার শব্দ করে কেঁদে ফেললো। একটা মাসুম বাচ্চার জন্য এরকম বিকৃত রূপ সহ্য করা আসলেই খুব কষ্টকর। বাচ্চাগুলো ফুপিয়ে কান্না শুনে লোকটা মাথা দুদিকে ঘুরালো। ঘাড়েও শব্দ হলো” কটকট।”। লোকটা এবার আচমকা বাচ্চাগুলোর খুব কাছে চলে এলো। খুব খুব কাছে। বাচ্চাগুলো মাথা আর লোকটার মাথা ছুঁইছুঁই। লোকটা এবার হুট করে একটা বাচ্চার ঘাড়ে ধারালো ছুরি বসিয়ে দিলো। বাচ্চাটা একবার সজোরে আর্তনাদ করেই থেমে গেলো। গলা দিয়ে আর আওয়াজ বের হলো না। চোখের পাতা এক দুবার কেপেই স্থির হয়ে গেলো। দুচোখের পাতা আপনা আপনি নেমে এলো। লোকটা হিংস্র হেসে তাকালো আরেক বাচ্চার দিকে। জীবিত বাচ্চাটা সশব্দে কাদঁছে। ভয়ে চেহারার রক্ত শুকিয়ে গেছে।
আবারও শোনা গেলো আরেক যন্ত্রনাদায়ক আর্তনাদ। মারা হলো আরেকটা বাচ্চা। না। এটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এক নির্মম খুনের স্বীকার হয়েছে দুটো নিষ্পাপ বাচ্চা। কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here