শেষ প্রহরের মায়াজাল পর্ব -০৫

#শেষ_প্রহরের_মায়াজাল
#পর্ব_৫( বোনাস পার্ট)
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

ঘন জঙ্গলের একেবারে মধ্য জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে মান্নাত, বারিশ এবং দিব্য। এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানের পরপরই তারা জঙ্গলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। আজকে বাচ্চা খুন কেইসটার একটা সুরাহা করতেই হবে। এভাবে আর কতদিন! দিব্য তার ব্যাগ থেকে একটা ম্যাপ বের করলো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে বলতে শুরু করলো,

— ” এই ম্যাপটা ভালো করে লক্ষ্য করো। আমাদের জানামতে গত তিনদিন আগে বাচ্চা খুন করার কেইস সামনে এসেছে। কিন্তু পরিসংখ্যান আর পত্রিকা বলছে এরকম একই ধরনের খুন গত তিনমাস ধরে হয়ে আসছে। গত তিন মাসে মোট পঁয়তাল্লিশটা বাচ্চা এই নির্মম ধরনের খুনের স্বীকার হয়েছে। আর আমার মতে নিঃসন্দেহে এটা একটা সিরিয়াল কিলারের কাজ। ”

বারিশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো দিব্যর দিকে। মান্নাতের ত এসব শুভ্রর পশম দাড়িয়ে গেছে। কি সাংঘাতিক! এত গুলো বাচ্চা খুন হয়েছে আর আমরা তা জানিনা। অদ্ভুত! বারিশ বললো,

— ” কিন্তু কেউ তো সেই পঁয়তাল্লিশটা বাচ্চার খুনের মামলা করেনি। কেনো? ”

দিব্য চশমা নাকের উপরে তুলে বললো,

— ” কয়েকটা মামলা করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মামলার কারণে সেটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। ”

মান্নাত ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ” এই ম্যাপ কিসের? ”

দিব্য ম্যাপটা সম্পূর্ণ খুলে তাদের সামনে মেলে ধরলো। বললো,

— ” এটা এই জঙ্গলের ম্যাপ।এই মার্ক করা জায়গায় নজর দাও। এখন পর্যন্ত যতটা বাচ্চা খুন হয়েছে তারা ঠিক এই মার্ক করা জায়গা থেকে কিডন্যাপ হয়েছে। ”

মান্নাতের চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। মান্নাত জিজ্ঞেস করলো,

— ” কিন্তু তারা এই জঙ্গলের ভিতর এলো কি করে? ”

বারিশ উত্তর দিলো,

— ” হতে পারে তাদের ছল চাতুরী করে এখানে আনা হয়েছে। ”

দিব্য মাথা নাড়লো। বারিশের কথায় পয়েন্ট আছে। দিব্য বললো,

— ” কালকে যখন বারিশ ফোন দিয়ে আমাকে জঙ্গলের ব্যাপারে খবর নিতে বললো আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু অমত করিনি। সেদিনই এসে জঙ্গলের আনাচে কানাচে খোঁজ নিয়েছি। আর আজকে তার প্রমাণ তোমাদের সামনে আছে। ”

অতঃপর নিরবতা। সবার মুখ থমথমে, গম্ভীর। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ। হঠাৎ বারিশ চমকে বললো,

— ” একটা উপায় পেয়েছি। ”

দুইজোড়া উৎসুক চোখ বারিশের দিকে তাকালে বারিশ বলতে থাকে,

— ” সেই সিরিয়াল কিলারকে ধরতে গেলে আমাদের একটা বাচ্চা দরকার। যেই বাচ্চাকে আমরা এই মার্ক করা জায়গায় এনে রাখবো। তারপর সেই বাচ্চা কিডন্যাপ হলে আমরা একটা ট্রেনিংপ্রাপ্ত কুকুর দিয়ে আমরা বাচ্চার খবর নিয়ে সেই কিলার পর্যন্ত পৌঁছে যাবো। হাও’জ দ্যাট? ”

বারিশের আইডিয়া শুনে সবার মুখ চকচক করে উঠলো। মান্নাত অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো,

— ” কিন্তু এখন বাচ্চা কোথাও পাবো? ”

বারিশ উত্তর দিলো,

–” আমার একটা ভাগ্নে আছে। তাকে ব্যাবহার করবো। ”

মান্নাত ত রীতিমত আঁতকে উঠলো। বললো,

— ” মানে? আপনি দিয়াকে ওমন রিস্কি জায়গায় পাঠাবেন? মাথা ঠিক আছে তো আপনার? কিসব বলছেন? ”

— ” দিয়াকে ওই জায়গায় পাঠালে আমরা সেই কিলারকে কিছু একটা করতে পারবো। এই কেইসের একটা সুরাহা হবে। আর কোনো উপায় নেই। ”

বারিশের নির্লিপ্ত উত্তর। মান্নাত কড়া গলায় বললো,

— ” তাই বলে দিয়াকে? ”

— ” যারা খুন হচ্ছে তারাও তো কারো না কারো মেয়ে, ভাগ্নি, বোন। তাদের কি অবস্থা হয়েছে সেটা একবার ভেবে দেখেছো? আমরা পুলিশ, মান্নাত। আমাদের নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্রিমিনালকে ধরতে হয়। এটাই নিয়ম। ”

মান্নাত আর কথা বাড়ালো না। বারিশের সাথে এই নিয়ে কথা বাড়ানো মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল দেওয়া। তর্ক লাগার সম্ভাবনা খুব বেশি। তাই চুপ থাকায় শ্রেয়।

_______________________
পরদিন, ঘন রাত। জঙ্গলের একেবারে মধ্যখানে দিয়াকে রাখা হয়েছে। একেবারে একা, নিঃসঙ্গ। বারিশ, মান্নাত আর দিব্য তিনজন একটু দূরে একটা গাছে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে একটা ঘন জঙ্গলে এক দাড়িয়ে আছে দিয়া। ভয়ে রীতিমত চিৎকার করে কান্না করছে। মান্নাতের দিয়াকে দেখে খুব মায়া লাগছে। ও একবার এগিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু বারিশ ওর হাত আটকে রেখেছে। মান্নাত দুর থেকে দিয়ার এই অবস্থা দেখে ছটফট করছে শুধু। বাচ্চা একটা মেয়ে। একা এত রাতে জঙ্গলে দাড়িয়ে আছে, ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বারিশই এটা বুঝতে পারছে না। কি নিষ্ঠুর মানুষ!

কেটে গেলো কয়েক ঘণ্টা। ভোরের আলো আর আধা ঘণ্টার মধ্যে আকাশে দেখা দিবে। দিয়া কান্নাকাটি করে এখন নীরবে চোখের জল ফেলছে। গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে খা খা করছে। বারিশ একবার হাত ঘড়ি দেখলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণে ত সেই ক্রিমিনাল এসে যাওয়ার কথা।
প্রায় মিনিট খানেক পর আচমকা একটা কালো হুডি পড়া এক লোক দিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালো। মান্নাত, বারিশ আর দিব্য মনোযোগ দিলো সেদিকে। হুডি পড়া লোকটা দিয়ার চোখে চোখ রেখে কি যেনো বিড়বিড় করলো। তারপর মিনিট দেড়েক পর দিয়ার হাত ধরে কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। সাথেসাথে সবাই গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। বারিশ পুলিশ কুকুরের নাকের সামনে দিয়ার একটা কাপড় ছুয়ালো। কুকুরটা কাপড়ের ঘ্রাণ দিয়ে এক দৌড়ে ছুটে চললো সামনে। কুকুরটার সঙ্গে মান্নাত, বারিশ আর দিব্য দৌড় লাগালো।
আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিতেই কুকুরটা একটা পোড়া বাড়ির সামনে এসে থামলো। মুখ দিয়ে ঘেউ ঘেউ শব্দ তুলতে লাগলো। সবাই বাড়িটার দিকে একপলক তাকালো। শতবর্ষের পুরনো বাড়ি মনে হচ্ছে। বারিশ একে একে মান্নাত আর দিব্যর মুখের দিকে তাকালো। বারিশ বললো,

— ” আমি ভিতরে যাচ্ছি। তোমরা এখানে দাড়াও। আমি একটা সিগনাল দিলে তোমরা ভিতরে ঢুকবে। তার আগে না। ঠিক আছে? ”

দিব্য সায় দিলো। কিন্তু মান্নাতের চোখ ছলছল করছে।আজ প্রথমবার বারিশকে হারানোর ভয় পাচ্ছে সে। এতদিন নিজের অনুভূতি নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখলেও আজকে তো ওরা অফিসিয়ালি একে অপরের হয়ে গেছে। এবার তো কোনো বাধা নেই। কিন্তু আজকে যদি বারিশের কিছু হয়ে যায়। মান্নাত আঁতকে উঠলো। বারিশ মান্নাতের চোখের দিকে তাকালো। যেকোনো সময় এই মেয়ে কেঁদে দিতে পারে বারিশ মান্নাতের দিকে এগিয়ে এসে দুহাত ধরে ওর গাল ধরলো। মান্নাত মাথা নিচু করে এক ফোঁটা জল বিসর্জন দিলো। বারিশ আলতো গলায় বললো,

— ” চিন্তা নেই। আমি ফিরে আসবো। তোমাকে ছুঁয়ে বলছি।”

মান্নাত চোখ খুললো না। বারিশের চোখে চোখ রাখলে সে আর নিজেকে সামলাতে পারবে না। তাই মান্নাত চোখ বুজে বারিশকে ভিতরে যাওয়ার জন্যে অনুমতি দিলো। বারিশ হাতে একটা টর্চ লাইট নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।

অন্ধকার, ছমছমে পরিবেশ। বারিশ ঘরের দরজা খুলতেই কতগুলো বাঁদর শো উড়ে গেলো বারিশের মাথার উপর দিয়ে। বাড়িটাকে ভুতুড়ে লাগলেও বারিশের মনে ভয় ডর নেই। সে নির্বিঘ্নে খুব দেখেশুনে পা ফেলছে।
করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগে বারিশ। তার পায়ের নিচেs সৃষ্ট খচখচ আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

— “আ..আ.মাকে ছে..ড়ে দাও। ”

বারিশ চমকে চারপাশে তাকালো। দিয়ার কণ্ঠ! বারিশ পাগলের মতন টর্চ নিয়ে হাঁটতে লাগলো কণ্ঠর উৎস শুনে। মনে মনে দোয়া করছে দিয়া যাতে কথা বলা বন্ধ না করে। দিয়া একবার কথা বলছে বারিশ একপা এগুচ্ছে।
একটা কক্ষের সামনে এসে বারিশ স্থির হয়ে গেলো। ভিতর থেকে দিয়ার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। বারিশ মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিলো। তারপরও এক ধাক্কা দিয়ে কক্ষের দরজা ভেঙে ফেললো।
বারিশের সামনে দিয়া দাড়িয়ে আছে। একটা লোক হাতে ধারালো ছুরি নিয়ে বারিশের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে। লোকটার চোখ থেকে লাভা বেরুচ্ছে। বারিশ দিয়ার দিকে তাকালো। দিয়া বারিশকে দেখে” মামা” বলে এগিয়ে আসতে গেলে লোকটা দিয়াকে এক পলকের মধ্যে আটকে ফেলে। লোকটা দিয়ার গলায় ছুরি তাক করতেই বারিশের চোখ বড়বড় হয়ে যায়। লোকটা দাতে দাট চিবিয়ে বললো,

— ” ওই পুলিশের বাচ্চা, আর এক পা এগুলে এই বাচ্চারে এখানেই মেরে ফেলবো। ”

বারিশ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তার এখন পা মেপে মেপে ফেলতে হবে। তার একটা অসাবধানতা দিয়ার জন্যে বিপদ হতে পারে। বারিশ আশপাশে তাকালো। কিছু পায় কিনা দেখতে। লোকটা বারিশের অগোছালো চাহনি দেখে বিভৎস কণ্ঠে বললো,

— ” বেরিয়ে যায় এই ঘর থেকে। আমার এখন খাওয়া সময়। বের হ। ”

বারিশ মাথা দুলিয়ে দিয়ার দিকে তাকালো। বাচ্চা মেয়েটা ভয়ে রক্ত পানি হয়ে গেছে। বারবার মাথা নাড়িয়ে বারিশকে যাওয়ার জন্যে নিষেধ করছে। বারিশ চলে যাওয়া জন্যে মুখ ফিরাতেই পায়ে লাগলো একটা কাঠের টুকরো। বারিশ আর দেরি না করে লাথি দিয়ে কাঠের টুকরো এক ঝটকা দিয়ে লোকটার মাথায় ফেললো। লোকটা ব্যাথায় ” উফ” করে উঠে দিয়াকে ছেড়ে আঘাত পাওয়া জায়গায় হাত দিলো। দিয়া সেই ফাঁকে এক দৌড়ে চলে গেলো বারিশের কাছে। বারিশ দিয়ার হাতে টর্চ দিয়ে ব্লুটুথ অন করে মান্নাতকে ভিতরে এসে দিয়াকে নিয়ে যেতে বললো। দিয়া বারিশকে ছেড়ে এক দৌড়ে বাইরে চলে গেলো। ব্যাপারটা এতো দ্রুত হলো যে লোকটা সুবিধা করতে পারলো না। লোকটা এবার উঠে দাঁড়ালো। ধারালো ছুরি নিয়ে বারিশকে আঘাত করতে গেলে বারিশ সরে দাঁড়ালো। লোকটা মাথা ঠেকলো একটা আলমারিতে। ব্যাথা পেলো কিন্তু লোকটা দমে এলো না। পুনরায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বারিশের দিকে এগিয়ে এলো।
বারিশ লোকটার হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিতে চাইলে লোকটা হঠাৎ ছুরি বসায় বারিশের পিঠ বরাবর। বারিশ যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠে। তবুও ও দমে আসে না। একের পর এক পাল্টা আঘাত করে।
বারিশ লোকটাকে বুদ্ধি করে গেটের বাইরে নিয়ে আসে। দুজনের ধস্তাধস্তির পর লোকটা হুট করে বারিশের বুকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে গেলে ছুরি বসে বারিশের ঘাড়ে। বারিশ থমকে যায়। এবারের আঘাতটা মারাত্মক ছিলো। বারিশ মাথা ঘুরে ঢুলে গেটের কাছে যেতেই আচমকা লোকটা খুব জোড়ে চিৎকার করে উঠে। একটু দূরে একটি মশালে আগুন জ্বলছে। লোকটা আগুন দেখে ভয়ে পালাতে থাকে। একসময় সে নিজের শরীরে আঁচড় কাটতে কাটতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। বারিশ অবাক হয়ে তাকায় তার যাওয়ার দিকে। পুনরায় বাড়ির ভিতরে ঢুকতে চাইলে মান্নাত আর দিব্য এসে বাঁধা দেয় ওকে। বারিশ গাড়িতে উঠে বসে। মান্নাত আর দিব্য হাজারটা প্রশ্ন করলেও বারিশ তার কোনো উত্তর দেয়না। তার মনে আপাতত একটাই চিন্তা ঘুরছে ” লোকটা আগুন দেখে ওমন ভয় পেলো কেনো? ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here