শেষ প্রহরের মায়াজাল পর্ব -০২

#শেষ_প্রহরের_মায়াজাল
#পর্ব_২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

মান্নাত একদৃষ্টিতে বারিশের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রায় আধা ঘন্টার কাছাকছি সময় ধরে বারিশ টেবিলের উপর একটা তামার সিকি ঘুরিয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম কোনো কেইস ওদের হাতে এলো , যেটা নিয়ে বারিশের এতটা চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছে না। মান্নাত চোখ উল্টিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে বারিশের কাছে গিয়ে গলা কেশে বললো,

–” স্যার, স্টেশনের বাইরে মেয়েটার মা আপনার সাথে কথা বলবে বলে দাড়িয়ে আছে।আপনি কি একবার আসবেন? ”

মান্নাতের কথা শুনে বারিশ ঘুরন্ত সিকিটা এক থাবা দিয়ে বন্ধ করে দিলো। স্টেশনের বাইরে খুব হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। হয়তো কন্সটেবল মৃত মেয়ের পরিবারের মানুষকে সামলানোর চেষ্টা করছে। বারিশ চোখ উল্টিয়ে একবার মান্নাতের দিকে তাকালো। মান্নাতের চোখ অস্থির। তার দুচোখ ইতি-ওতি ঘুরে আবারও বারিশের দিকে যাচ্ছে। বারিশ ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের উপর থেকে পুলিশি ক্যাপ মাথায় লাগিয়ে ঝটপট বেরিয়ে গেলো বাইরের দিকে। মান্নাত মুখ ফুলিয়ে এক নিঃশ্বাস নিয়ে বারিশকে অনুসরন করলো।

— ” এভরিওয়ান কিপ কুয়াইট। ”

বারিশের ধমক শুনে সবাই এক মুহূর্তের মধ্যে চুপ হয়ে গেলো। মেয়ের মা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে দ্রুত এগিয়ে এলো বারিশের দিকে। মেয়ের মা কান্নাভেজা গলায় বললো,

— ” বাবাজি, আমার মেয়ে! কি থেকে কি হয়ে গেলো ওর। এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ ছিলো ও। থানায় জিডিও করেছিলাম। আর আজ যখন পেলাম তখন ওর নিথর লাশ পেলাম। নিজের বাচ্চা মেয়ের লাশ নিয়ে আমি বাড়ি যাবো কিভাবে, বাবাজি। আমার দিল সয় না আর। কিছু করুন আপনারা। ”

বারিশ মহিলার অবস্থা দেখে বিমর্ষ হলো। মায়ের কাঁধে মেয়ের লাশ বহন করার মতো নিকৃষ্ট অনুভূতি দুনিয়াতে আর কিছু হয়না। বারিশ মহিলাকে শান্তনা দিতে ধীরে সুস্থে বললো,

— ” দেখুন , খুনের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। কোনো ক্লু পেলে আমরা আপনাকে জানাবো। আপনি আপাতত মেয়ের লাশ বাড়িতে নিয়ে দাফনের ব্যাবস্থা করুন। ”

মহিলাটা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো বারিশের দিকে। ” লাশ দাফন” কথাটা শুনে তার চোখের কোণা থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। অতঃপর হুহু করে কেঁদে মাটিতে বসে পড়লো। বুকটা জ্বলে যাচ্ছে তার। মেয়ে মরা এক অভাগা মহিলার কান্না দেখা ছাড়া এই মুহূর্তে বারিশ আর কিছুই করতে পারছে না। আফসোস! কান্নারত মহিলার পরিবারের লোক এসে তাকে কোনক্রমে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে গেলো।

বারিশ মাথার ক্যাপ খুলে গাড়িতে উঠে বসলো। মান্নাত দুর থেকে বারিশকে দেখছে। বারিশ এই কেইস নিয়ে যে খুব বেশি চিন্তিত তা তার মুখ দেখেই উপলব্ধি করতে পারছে সে। মিনিটের মধ্যে বারিশ গাড়ি চালু করে বেরিয়ে গেলো স্টেশন থেকে। গাড়ির কালো ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে মান্নাত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুঝতে পারছে, এই কেইসটা তাদের বহু দুর নিয়ে যাবে।

___________________
মান্নাতের স্কুটি আজকে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই স্কুটি মেকানিকের কাছে দিয়েছে। এই মুহূর্তে মান্নাত কড়া রোদের মধ্যে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই বাস এখনো এসে পৌঁছায় নি। মান্নাতের বিরক্ত লাগছে। মাথার পুলিশি ক্যাপ খুলে হাতে নিয়ে একটা পিলারে ঠেস দিয়ে দাড়ালো ও।

— “মিস.মান্নাত? ”

বারিশের কণ্ঠ শুনে মান্নাত চকিতে পাশে তাকালো। জিপ গাড়িতে বসে আছে বারিশ। চোখে সানগ্লাস, মাথার চুলগুলো খুব যত্নে সেট করে রাখা। হয়তো চুলগুলো বারিশের ধমকা ধামকির কারণে তাদের জায়গামতো বসে আছে। মান্নাত একপলক বারিশকে দেখেও মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। বারিশের সাথে ও রাগ করেছে। একদম উনার সাথে কথা বলা যাবে না। তাই মান্নাত তাকে দেখেও না দেখার ভান করলো।

বারিশ মান্নাতের এই রুপ দেখেও অবাক হলো না। এটা মান্নাতের রোজকার রূপ। কখন যে এই মেয়েটার মেজাজ পাল্টে যায় সেটা স্বয়ং মান্নাতও জানে না। বারিশ গাড়ি একটু এগিয়ে এনে মান্নাতের একদম পাশে থামালো। একবার দুবার গাড়ির হর্ন বাজালে মান্নাত বিরক্ত হয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসে বারিশের দিকে। প্রচন্ড রেগেমেগে বারিশের দিকে আঙ্গুল উচিয়ে মান্নাত বললো,

— ” দেখুন,এটা রাস্তা। পুলিশ হয়েও অযথা হর্ন বাজিয়ে শব্দদূষণ করছেন কেনো? ”

বারিশ মুচকি হেসে সানগ্লাস চোখ থেকে খুলে শার্টে ঝুলালো। অতঃপর খুব রয়ে সয়ে বললো,

— ” গাড়িতে উঠো। বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি। ”

মান্নাত আঙ্গুল নামিয়ে ফেললো। বুকে হাত গুজে খুব অ্যাটিটিউডের সাথে বললো,

— ” আমি হেল্প চেয়েছি আপনার কাছে? ”

বারিশ মাথা দুলিয়ে বললো,

— ” অবলা নারীকে হেল্প করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যায় হোক! পুলিশ তো! ”

মান্নাত অবাক হয়ে বললো,

— ” আমি অবলা নারী? ”
— ‘ অবশ্যই। তাতে কোনো সন্দেহ আছে? ”
— ” দেখুন আমি একজন পুলিশ। আর পুলিশরা কখনো অবলা হয়না। বুঝেছেন? ”
— ” ইয়াহ! পুলিশ! ”

বারিশ তাচ্ছিল্যের সাথে মুখ ফেরালো। মান্নাত বারিশের এমন অপমান দেখে হা হয়ে গেলো। এত অপমান! হাহ্। মান্নাত আকাশসম রাগ দেখিয়ে বললো,

— ” যাবো না আমি আপনার সাথে। কত বড় সাহস! আমার পেশা নিয়ে মজা করা! ”

বারিশ কিছু না বলে শার্টে ঝুলানো সানগ্লাস খুলে নিয়ে চোখে লাগালো। মান্নাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ” ওকে দেন। বেস্ট অফ লাক।আজকের দিন মোবারক হোক তোমার। ”

মান্নাত বারিশের দিকে তাকালে বারিশ শো আওয়াজ তুলে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। মান্নাত সেদিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচালো। গেলে যাক। ওর তাতে কি! সবসময় আমাকে অপমান করা। স্যার হয়েছেন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন?
মান্নাত বিড়বিড় করে এসব বলছে আর রাস্তা ধরে হাঁটছে। আজ আর বাস পাওয়া যাবে না।
প্রায় বিশ মিনিট হাঁটার পরেই মান্নাতের পা ভেঙে এলো। ব্যথায় কোমর ধরে দাঁড়িয়ে গেলো রাস্তায়। গ্রীষ্মকালীন রোদের তীব্র আলো মাথায় পড়তেই মনে হলো পুরো জ্বলে গেলো মাথাটা। মান্নাত আশেপাশে তাকিয়ে রিকশা খোঁজলো। প্রায় আধা ঘন্টা পর শেষ পর্যন্ত একটা রিক্সা পেলো ও। কিন্তু রিকশাওয়ালা মান্নাতকে দেখে মুখ কালো করে দাঁড়ালো। মান্নাত ভাড়া জিজ্ঞেস করলে রিকশার ড্রাইভার বললো,

— ” ভাড়া লাগবো না। আপনার জন্যে ফিরি। আহেন। ”

মান্নাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো মধ্যবয়স্ক লোকটার দিকে। লোকটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। লোকটা ওকে দেখে বেশ ভয় পাচ্ছে তা তার চোখে মুখে স্পষ্ট। মান্নাত লোকটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,

— ” আগে বলেন, আপনি এখন কোনো অন্যায় করছেন?”

লোকটা হঠাৎ ঘাবড়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে বললো,

— ” না না। কিছু করি নাই আমি।আমারে জেলে ঢুকাবেন না। দোহায় লাগে আপনার। ”

— ” এক্সাক্টলি। আপনি এখন কোনো অন্যায় করছেন না তাহলে আমি কোন দুঃখে আপনাকে জেলে ঢোকাবো। পুলিশ মানেই কি যেকোনো লোককে ধরে বেধে জেলে পুড়ে দেওয়া? ”

লোকটার মুখে এবার হাসি ফুটলো। ফোকলা দাঁতে হেসে বললো,

— ” পঞ্চাশ টাহা ভাড়া। ”

মান্নাত মুচকি হেসে রিক্সায় চড়ে বসলো।

— ” হেই, মিস মান্নাত। ”

বারিশের কথা শুনে মান্নাত চলন্ত রিক্সা থেকে মাথা বাহির করে পাশের রাস্তায় তাকাল। বারিশ রিক্সার পাশ দিয়ে খুব ধীরে জিপগাড়ি চালাচ্ছে। বারিশ মান্নাতকে আবারও অপমান করে বাঁকা হেসে বললো,

— ” হ্যাপি জার্নি, মিস মান্নাত। ”

মান্নাত কিছু বলার আগেই বারিশ রিকশাকে পিছনে ফেলে খুব স্পিডে জিপ চালিয়ে চলে গেলো। মান্নাত সোজা হয়ে বসে খুব তেজ নিয়ে বিড়বিড় করলো,

— ” অসভ্য ছেলে। সারাক্ষণ আমাকে জ্বালানোর ধান্দা। ফাউল একটা! ”

রোজকার মতন আজকেও বারিশ আর মান্নাতের দিনটা ঝগড়া করেই কেটে গেলো। এটাও কি কম আফসোসের কথা? উহু!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here