শেষ প্রহরের মায়াজাল পর্ব -০১

— ” মিস মান্নাত, আপনার পিঠের তিন ইঞ্চি নিচে থাকা বাদামি রঙের তিলটা দেখা যাচ্ছে। তিলটা এভাব জ্বলজ্বল করে সবাইকে না দেখিয়ে দয়া করে জামার চেইনটা লাগিয়ে নিন। আমরা এখানে কাজে এসেছি। মডেলিং করতে নয়।”

পুলিশ ইউনিফর্ম পড়া দ্যা গ্রেট আজওয়াদ আহমেদ বারিশের কথা শুনে মান্নাতের চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। এক মুহুর্ত কাল বিলম্ব না করে নিজের হাত পিছনে পিঠের কাছে নিয়ে দেখলো। হায় হায়! জামার চেইন লাগাতেই সে ভুলে গেছে। মান্নাত সেকেন্ডের ভিতর একটা পাথরে পিঠ দিয়ে দাড়ালো। বারিশ এসবে পাত্তা না দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে দূরবীন নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। আপাতত মান্নাতের দিকে নজর দেওয়ার তার সময় নেই। মান্নাত মুখ কাচুমাচু করে বললো,

— ” আপনি একটু ওদিকে ফিরুন। আমি চেইন লাগাবো। ”

বারিশ দূরবীন হাতে নিয়ে মান্নাতের দিকে তাকালো। ভ্রু নাচিয়ে বললো,

— ” আপনার কি মনে হয়? আমি এখানে আপনার সো কল্ড তিল দেখার জন্যে দাড়িয়ে আছি। আমার সময়ের অনেক দাম আছে। ওকে?

মান্নাত এবার রেগে বারিশের দিকে আঙুল উচিয়ে বললো,

— ” দেখুন ভাইয়া, আপনি ওদিকে ফিরবেন কিনা বলুন। উল্টাপাল্টা কথা বলছেন কেন? ”

বারিশ এবার হুট করে মান্নাতের পাশে চলে এলো। মান্নাতের দিকে মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকালে মান্নাত মাথা বামে হেলায়। বারিশ ভ্রু বাঁকা করে বললো,

— ” ফার্স্ট অফ অল এটা আমাদের কাজের জায়গা। এখানে আমি তোমার স্যার আর তুমি আমাকে কাজে এসিস্ট করছো। কাজের জায়গায় তুমি আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে নও। আর আমি তোমার কোনো ভাই.ইয়া নই। মাথায় ঢুকেছে কথাটা? ”

বারিশের ধমকে মান্নাত খানিক কেপে উঠলো। চুপচাপ মাথা নিচু করে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলো। বারিশ এবার সরে এলো মান্নাতের কাছে থেকে। দূরবীন দিয়ে চারপাশ খানেক দেখে বললো,

— ” আমি জঙ্গলের ওদিকটায় যাচ্ছি। আপনার সেই দামী তিল ঢাকা শেষ হলে চলে আসবেন। যদি কাজ করতে মন চায় তো! ”

বারিশ চলে গেলো। মান্নাত তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললো,

— ” কি অসভ্য এই লোক। কথায় কথায় অপমান করে। আমারও একদিন সময় আসবে। তখন দেখাবো। ফাউল লোক কোথাকার। ”

জঙ্গলের চারিদিকে শুধু গাছ আর গাছ। মাথা উচুঁ করে আকাশ দেখাও এখন মুশকিল। থেমে থেমে পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। মান্নাত মনে মনে বারিশকে ধোলাই করে কোনমতে জামার চেইন লাগিয়ে বারিশের পিছু পিছু এলো। বারিশ গাছের পাতা সরিয়ে সামনে এগুচ্ছে। মান্নাত ও ভ্রু কুচকে বারিশকে অনুসরন করছে।
মান্নাত আর বারিশ একজায়গায় দাড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ হলো। মান্নাতের এবার পায়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। মান্নাত কোমরে হাত দিয়ে হয়রান হয়ে বললো,

— ” আর কতটুকু হাঁটতে হবে? ”

বারিশ চোখ ছোটছোট করে আশেপাশে তাকালো। আবারো চোখের সামনে দূরবীন দিয়ে দেখতে দেখতে বললো,

— ” লাশ তো এখানেই পাওয়ার কথা। ”

মান্নাত এবার একটা পাথরের উপর বসে গেলো। বড় একটা হাফ ছেড়ে বললো,

— ” আপনি খুঁজুন। আমি বসি এখানে। ”

বারিশ এবার মান্নাতের দিকে কুচকানো ভ্রু নিয়ে তাকালো। বললো,

— ” তোমার কাজ কি? ”

মান্নাত বুঝতে না পেরে বোকা বোকা কণ্ঠে বললো,

— ” আপনাকে এসিস্ট করা। ”
— ” তাহ্, তুমি এখন কি করছো? ”
— ” কেনো? আপনাকে এসিস্ট করছি। ”
— ” মোটেও না। বরং তুমি এখানে বসে আরাম করছো আর আমি খেটে মরছি। তোমাকে যে কে পুলিশ বানালো কে জানে? নির্ঘাত তার মাথায় প্রবলেম আছে। ডিসগাস্টিং। ”

মান্নাত ঝট করে পাথর থেকে উঠে দাঁড়ালো। বারিশের দিকে আঙুল উচিয়ে বললো,

— ” এক্সকিউজ মি, আমাকে কেউ এমনি এমনি পুলিশের ইউনিফর্ম দেয়নি। যোগ্যতা আছে বলেই দিয়েছে। আপনি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কে? হুঁ? ”

বারিশ মান্নাতের এই রাগী রূপ দেখে একটুও অবাক হলো না। ধীরে সুস্থে নিজের হাত দিয়ে মান্নতের আঙ্গুল নিচে নামিয়ে বললো,

— ” আঙ্গুল নামিয়ে কথা বলো। এত বড়াই তোমার ইউনিফর্ম নিয়ে, তো তোমার ইউনিফর্ম কই? আমি তো দেখছি না। ”

মান্নাত এবার নিজের দিকে তাকালো। তার পরনে একটা বাদামী রঙের কুর্তি, লেগিংস আর একটা ওড়না। মান্নাত এবার খানিক নিভে এলো। বারিশের খোঁচা মারা কথা শুনে চোখ খিচে বন্ধ করলো। কিন্তু পুনরায় দ্বিগুণ তেজে বারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,

— “আমার ইউনিফর্ম বাসায় আছে। আপনিইতো আমাকে আর্জেন্ট ফোন দিয়ে ডাকলেন। আমি তার ইউনিফর্ম পড়ার সময় পাইনি। একটা দাওয়াতে ছিলাম। আপনার ফোন কল দেখেই সেই জামা পড়েই আমার দায়িত্বের জন্যে ছুটে এসেছি। বুঝেছেন এবার? ”

বারিশ এবার মান্নাতের চোখে চোখ রেখে বললো,

— ” একজন পুলিশের প্রথম দায়িত্ব হলো সময়জ্ঞান রেখে চলা। যেটা তোমার মাঝে নেই। সো গো টু হেল। ”

মান্নাতও বারিশের চোখে চোখ রেখে বললো,

— ” সেম টু ইউ। গো টু হেল! ‘

অতঃপর দুজনেই দুদিকে ফিরে কাজে মগ্ন হয়ে গেলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। এতক্ষণ যে দুজনের কথার প্যাঁচে পরে জঙ্গলের প্রায় সব পাখি উড়ে চলে গিয়েছিলো এখন তারা চুপচাপ থাকায় পাখি আবারও নীরে ফিরে এসেছে।

— ” ও আল্লাহ! ”

মান্নাতের চিৎকার শুনে বারিশ থমকে গেলো। পরক্ষনেই জলদি পা চালিয়ে মান্নাতের দিকে এগিয়ে গেলো ও। কিছু হয়নি তো মান্নাতের?

বারিশ সামনে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেছে। মান্নাত নিজেও মুখে হাত চেপে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা গাছের দিকে। সামনে একটা বট গাছে একজন বাচ্চা মেয়ের উলঙ্গ লাশ ঝুলানো। সম্পূর্ণ শরীর ফ্যাকাশে হয়ে আছে। যেনো শরীরের সব রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে। সম্পূর্ণ শরীরে ছোটছোট গর্ত দেখা যাচ্ছে। সেই গর্ত দিয়ে শরীরের সব মাংস দেখা যাচ্ছে। মনে হয় এসব গর্ত থেকেই শরীরের রক্ত শোষন করা হয়েছে। মান্নাতের চোখের পলক পড়ছে না।মুখে হাত দিয়ে সেই বিভৎস লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বারিশ মান্নাতের এই অবস্থা দেখে জলদি মান্নাতের কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। মান্নাত এখন হুশে নেই। জীবনে অনেক লাশ দেখেছে কিন্তু এরকম জঘন্য লাশ কখনোই দেখেনি সে। বারিশ মান্নাতের পিঠে হাত বুলিয়ে আলতো সুরে বলতে লাগলো,

— ” অল ইজ ওয়েল, মান্নাত। শান্ত হও। ওকে? রিলাক্স। ”

মান্নাত বারিশের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজলো। খুব অশান্তি লাগছে তার। লাশটা দেখে মাথা ফাঁপা হয়ে গেছে।
বারিশ মান্নাতকে বুকে জড়িয়ে ধরে লাশের দিকে তাকালো। এরকম জঘন্য খুন কে করেছে? খুনটা কি কোনো আততায়ীর কাজ নাকি নতুন কোনো কেইস? বারিশের মাথায় ঘুরতে লাগলো নানা চিন্তা। সব চিন্তা ধীরে ধীরে ঝট পাকাতে লাগলো তার মস্তিষ্কে।

— ” শহরে আবারও এক খুন। এবারও এক বাচ্চার লাশ পাওয়া গেছে জঙ্গলের ভিতর। অত্যন্ত নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে তাকে। শরীরের রক্তের কোনো ফোঁটা নেই। জায়গায় জায়গায় জখম। মৃত মেয়ের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এ ব্যাপারে পুলিশি তদন্ত চলছে। আশা করি খুব শীগ্রই আসামি ধরা পড়বে পুলিশের হাতে। ”

পুলিশ স্টেশনে থাকা টিভিতে নিউজ চলছে। স্টেশনে থাকা সবাই কাজটাজ ফেলে টিভির সামনে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে নিউজ দেখছে। কয়েকজন কনস্টেবল বলাবলি করছে,

— ” মাইয়াটার মা এখনো স্টেশনের বাইরে মাতম করছে। একটাই কথা মেয়ের খুনীর বিচার চাই। এদিকে খুনি কোথায় আছে এই খবর থাকা তো দূরের কথা , কে খুন করেছে সেটাই জানিনা। হায়রে! ”

সবাই যখন এই রহস্যময় খুন নিয়ে বলাবলি করছে তখন বারিশ ভাবলেশহীন। আনমনে টেবিলের উপর একটা তামার সিকি ঘুরিয়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ। ভ্রুযুগল কুচকানো। তার মন প্রায় সম্পূর্ণ অন্যদিকে। খুনটা কে করলো?

#চলবে

#শেষ_প্রহরের_মায়াজাল
#সূচনা_পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here