শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ২০
রুমাইসার ফুপু আর ফুপা বাসায় আসতেই রুমাইসার ঠোঁটে বহুদিন পর এক সুখের আত্মতৃপ্তির দেখা মেলল। ইহান দূর থেকে দেখে মনে মনে শান্তি পেল। ফুপুর আগে ফুপাই জিজ্ঞেস করল “মা কেমন আছিস তুই? এতদিন তোর একটুও খবর নেই নি, তাই বুঝি রাগ করেছিস? ”
রুমাইসা হেসে বলল “কি যে বল বাবা, আমি কেন রাগ করব। এতদিন পরে দেখা পেলাম তোমাদের এতেই শান্তি।”
ফুপি ফট করে জিজ্ঞেস করল “পেটের টা কই তোর? ”
সামনে তখন ইহান আর রুমাইসা।রুমাইসা মলিন হয়ে গেল।ফুপি গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল “কিরে কিছু বলস না কেন? পেটের টা কি মরসে নি? ”
কথাটা এতটাই রুক্ষ্ম আর গায়ে বেধার মত ছিল যে রুমাইসা কান্না করে দিল। ইহান নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত করে রাখল। রুমাইসার ফুপা রমিজ সাহেব স্ত্রীর এমন প্রশ্ন শুনে লজ্জা পেল। একটা মানুষ কত বেশি বেশরম হতে পারে সেটা উনি এই মহিলার সাথে ঘর না করলে বুঝতে পারত না।
রুমাইসা ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল “১.৫ মাস আগে মারা গেছে? ”
মহিলা আঁতকে উঠল এটা শুনে। এক রকম চেচিয়ে বলল “হ্যা রে, মরল কিভাবে? যেটার জন্য বাড়ি ঘর ছাড়লি, কত মার খেলি সেই কৈ মাছের প্রাণ এত তাড়াতাড়ি মরল কি করে? ”
এবার ইহান আর থামতে পারল না। এক রকম চেচিয়ে বলল “আপনি দয়া করে চুপ থাকুন ফুপু। আপনি রুমাইসার ফুপু এবং আমার বড় বলে আমি এতক্ষন চুপ ছিলাম।কিন্তু আপনার এসব খোচা মারা কথা বন্ধ না করলে আমি আপনাকে এ বাড়িতে থেকে চলে যেতে বলতে বাধ্য হব। এখানে আপনি ওর পরিবারের মানুষ , সো সেভাবে থাকুন।এতদিন যেহেতু খবর নেন নি, এখন কিভাবে কি হল সে খবর জেনে আপনার কাজ নেই। ”
মহিলা সরাসরি দাড়িয়ে গেল। চিৎকার করে বলল “কলঙ্কিনী আমাকে কি অপমান করতে বাড়ি ডেকেছিস রে? এতিমের বাচ্চা, আমার খেয়ে আমার পরেই বেচে ছিলি এতদিন। এখন আমাকেই কথা শুনাস জামাইকে দিয়ে। তোর বাচ্চা থাকবে, কুত্তারবাচ্চা তোর বাচ্চা পেটের ভেতর মরল না কেন? বাপ মা খেয়েছিস এবার বাচ্চা টাও খেয়ে ফেললি কলঙ্কিনী মেয়ে।”
রমিজ সাহেব এতকথা শুনে ক্রোধ সংবরণ করতে পারল না, উপস্থিত সবার সামনে খুব জোরে চর মারল। একটা না পর পর তিন চারটা থাপ্পড় মারল। রুমাইসার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি , সাইয়ারা, মিলি, সাহিল, ইহান সবাই অবাক হয়্র গেল।রমিজ সাহেব চিৎকার দিয়ে বলল “আজ তুই বাড়ি চল, আজ তোকে আমি বুঝাব। এতদিন তোকে কিছু বলি নি বলে মাথায় চড়ে বসেছিস তুই। আমার মেয়েটার এত বড় বিপদ গেল আর তুই এসব যা তা বলতে আসছিস এখানে। তুই কার সম্পত্তি ভোগ করছিস যে ও কে খোটা দিচ্ছিস? ৫ বিঘা জমি, আর ৪ তলা বাড়িটা কার যে তুই ও কে খাওয়া পড়ার খোটা দিচ্ছিস? তোর জামাই কোন বড়লোকের আমলা যে তুই ঘুষের টাকায় বড় পাওয়ার দেখাস। আজ বাড়ি চল তুই। ”
রুমাইসা ফুপার হাত পায়ে ধরল যাতে ফুপু কে কিছু না বলে। কিন্তু ফুপা কাউকে কিছু না বলে ফুপুর হাত ধরে টেনে বের হয়ে গেল। রুমাইসা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল দরজার দিকে। নাসিমা বেগম খুব মৃদু স্বরে বলল “আল্লাহ হেদায়েত দেক, আল্লাহ হেদায়েত দেক। রুমাইসা মা তুই ঘরে যেয়ে আরাম কর। মিলি খাবার দিয়ে আসবে। ইহান তুমিও যাও ও কে নিয়ে। ”
ইহান রুমাইসা কে ধরে নিয়ে গেল। এতকিছুর মাঝে কেউ সাহিল কে লক্ষ করল না। ওর মুখের রং পাল্টে গেছে। ওর একটা ভুলের ফল কি থেকে কি হয়ে গেল। জীবন দিয়ে দিলেও হয়ত এই ভুলের মাশুল দিতে পারবে না।
সপ্তাহ খানেক পর সাইয়ারার বিয়ে ফাইনাল করতে ছেলে পক্ষ আসবে। রুমাইসা সকাল থেকে ব্যস্ত। নাসিমা বেগম কে অনেক রিকোয়েস্ট করে রুমাইসা রুম থেকে বের করেছে। নাসিমা বেগম ডাইনিং এ বসে কাজেত তদারকি করছে। ছেলে নাসিমা বেগমের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। এর সাথেই এতদিন প্রেম করেছে সাইয়ারা। বাসা থেকে তাই এবার বিয়ের ব্যবস্থা করবে। হঠাৎ করে খবর আসল তৃষার বাবু এখন পুরোপুরি সুস্থ। ওরা যেন এসে আজ নিয়ে যায়।নাসিমা বেগম ই ফোন উঠিয়েছিল। ফোন রেখে উনি খুশিতে সাহিল কে ডাক দিল আগে। সাহিল বাসায় ই আছে আজ। তবে রুম থেকে বের হবে না যতক্ষন প্রয়োজন না হবে।ডাক শুনেও বের হচ্ছিল না দেখে নাসিমা বেগম তজবি হাতে রুমে গেল।
“সাহিল ঘুমাচ্ছিস বাবা তুই? ”
সাহিল মাথা থেকে বালিশ তুলে বলল “না।”
আর কোন কিছু জিজ্ঞেস করল না। নাসিমা বেগম ই বলল “বাবু নাকি পুরা সুস্থ আজ নিয়ে আসতে বলছে। যাইয়া নিয়া আয় বাবা। আমাদের ঘরের আলো। এক আলো তো হারাইসি, এই আলো হারাইতে চাই না।”
“আমার ওই বাচ্চা কে আনার কোন ইচ্ছা নাই। মনে চাইলে তোমরা আনতে পার বা কাউকে দিয়ে দেও। এই বাচ্চার প্রতি আমার টান নেই। যেই তৃষা কে এই বাচ্চা মেরে ফেলেছে তাকে আমি কোন দিন আদর স্নেহ দিব না। এটা আমার শেষ কথা। ”
নাসিমা বেগম আর কিছু বলল না বের হয়ে গেল ঘর থেকে । মলিন মুখে রুমাইসার কাছে গেল। রুমাইসা ওনার দিকে চেয়ে একবার দেখল আবার রান্না তে ব্যস্ত হয়ে গেল। এখনো কয়েক পদ বাকি রান্না।নাসিমা বেগম তবুও দাড়িয়ে রইল আর চোখ ভিজাতে লাগল। টাক টানের শব্দে রুমাইসা অবাক হয়ে বলল “আম্মা কান্না করছেন কেন? কি হয়েছে? ”
নাসিমা বেগম জবাব দিল না কান্না করতে লাগল। রুমাইসা ফের জিজ্ঞেস করল “আম্মা ব্যাপার কি কান্না করছেন কেন? ”
“কান্না করছি নিজের দোষে রে মা। কি জঘন্য কাজ টা করলাম রে মা।এক তোর মেয়েকে নিলাম আবার আরেক মেয়ে কে এতিম করে দিলাম। ”
রুমাইসা চুপসে গেল আবার। ইহিতার কথা মনে পড়তেই বুকের ব্যথা টা বেড়ে গেল আবার। তবুও রুমাইসা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল।
“আম্মা সেসব পুরান কথা বাদ দেন। ভাবীর বাচ্চা দেখার জন্য তার স্বামী আছে। চিন্তা কিসের। ”
“মা রে দুঃখের কথা কি বলব। বাবু কে নিয়া আসতে বলছে হসপিটাল থেকে। খুশি মনে সাহিলের ঘরে যেয়ে বললাম নিয়া আসতে। কত কথা শুনায় দিল। বলল এ মেয়ে নাকি মা রে খাইসে, এখন এই মেয়েকে ও চায় না।”
রুমাইসার বুকে শেল বিধল। ঠিক এ রকম কথা ও কেও শুনতে হয় এতিম বলে। শেষ পর্যন্ত কি এক সদ্য দুনিয়ায় আসা বাচ্চা টাও এসব শুনবে।মনে হচ্ছে এ যেন দ্বিতীয় রুমাইসা যে জন্ম থেকেই যুদ্ধ করছে এই দুনিয়ায় টিকে থাকার।
রুমাইসা কিছু বলতে যাবে তখনি ইহান হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে বলল “মেহমান চলে গেলে তৈরি হয়ে নিবে আমরা বাচ্চা কে নিয়ে আসব।কে কি ভাবল আর বলল সেটা দেখার সময় আমার নেই। সাহিল ভাই বরাবর ই তার সন্তান দের গ্রহণ করতে চায় না। সো আমার বাড়ির বাচ্চা রাস্তায় পড়ে বড় হবে না কার কাছে যাবে এটা আমার দেখার সময় নাই।বাচ্চা এ বাড়িতেই আসবে।আমি নিয়ে আসব। আর রুমাইসা তুমি যদি পালতে না চাও বলবে আমি আলাদা আয়া রাখব মেয়ের জন্য।”
এক দমে সব কথা বলে উত্তর শুনার অপেক্ষা না করেই আবার চলে গেল। সামনে যে ওর মা দাড়িয়ে আছে সেই তোয়াক্কা ও করল না।নাসিমা বেগম হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ মুছল।
“আমার ছেলে গুলো কবে আগের মত আমাকে মা বলে ডাকবে। কতদিন শুনি না ওদের ডাক। আমাকে কবরে যাওয়ার আগে আল্লাহ তুমি একবার মা ডাক শুনায় নিও। তোমার কাছে এই পাপীর এক টু দোয়া। ”
রুমাইসার আজ কাল এ বাড়িতেই থাকতে ইচ্ছে করে না। এ বাড়ির সব খানে তাকালেই ইহিতা কে দেখা যায়। মন থেকে এখনো তার ভেতরের শোক কাটাতে পারে নি। অথচ বাইরে কত শক্ত হয়ে চলছে। এক ঘরে ইহানের সাথে থাকলেও কথা বলতে ইচ্ছা করে না।ইহান ই মাঝে মধ্যে এসে ওটা সেটা জিজ্ঞেস করে। প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খেতে হয়।একটা মা কে যে সব পাড়তে হয়।একা মেয়ে বলে কোথাও যেতেও পারে না। ভেবেছিল ফুপা ফুপি কে বলে কয়দিন তাদের বাসায় থাকতে যাবে।কিন্তু রুমাইসা বুঝে গেছে, ফুপি তাকে কোন দিন স্বাভাবিক ভাবে আর নিবে না। নিতান্তই বাধ্য হয়ে পড়ে আছে এ বাড়িতে। সুযোগ পেলে দূরে কোথাও চলে যাবে।
সাইয়ারার বিয়ের ডেট ঠিক হল এক মাস পর জুনের ২২ তারিখে। সাইয়ারা তো বেশ খুশি। আংটি পড়িয়ে গেছে ও বাসা থেকে। বরাবরই রুমাইসার হাতের রান্নার প্রশংসা করে সবাই। এবারো ব্যতিক্রম হল না। একজন তো বলেই ফেলল “বিয়েতে এত মানুষ না থাকলে তো বৌমা কেই বলতাম রান্না করতে। ”
রুমাইসার শ্বাশুড়ি বেশ খুশি আজকে। যাক এবার মেয়েটার হিল্লে হচ্ছে ভালো ঘরে। যাওয়ার সময় সাইয়ারার হবু জামাইয়ের জন্য আলাদা খাবার দিয়ে দিল। ওনারা রাতের ৮ টা বাজে গেল। মেহমান গেলে যেন কাজের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। সবাইর সাথে মিলে কাজ গুলো শেষ করল দ্রুত।ইহান তাড়া দিচ্ছে হসপিটাল যাবে। সাহিল মেহমান যাওয়ার পরেই বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। আজ রাতে কখন আসবে কেউ জানে না। রুমাইসা মাঝে মাঝে অবাক হয়। এই লোকটা কেই এক সময় পাগলের মত ভালোবাসত। অথচ আজ, অভি কি করছে না করছে তাতে ওর কিছু যায় আসে না। নিজের মনের অনুভূতি টাকে বুঝি মেরে ফেলেছে।
হসপিটালে যখন পৌছাল তখন রাত ১১ টা। ডক্টর এর ডিউটি শেষ। বের হবে ঠিক তখনি ওরা দুইজন হাজির হল। ডক্টর বলল, কাল সকালে এসে নিয়ে যেতে। কিন্তু ইহান এক রকম জোরাজোরি শুরু করল যে বাচ্চা কে আর একদিন ও এখানে রাখবে না ওরা।অগত্যা ডক্টর নার্স কে বলল বাবু কে নিয়ে আসতে। রুমাইসা অনুভব করল ওর বুক কেমন যেন ধুকপুক করছে। হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এ হসপিটালেই ওর ইহিতা কে হারিয়েছে। আজ আবার নতুনভাবে কাউকে গ্রহণ করতে এসেছে। খুব নার্ভাস হয়ে গেছে ও।ইহান পাশেই বসা ছিল।ও রুমাইসার দিকে তাকাতেই দেখল ওর হাত পা কাঁপছে। ইহান সেই কাঁপা হাতের মাঝে নিজের হাত টা ঢুকিয়ে দিল। রুমাইসার হাত কে নিজের হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। রুমাইসা যেন শিহরিত হল। আজ বহুদিন পর এই হাত টা আবার ও কে আকড়ে ধরেছে। এই হাত টার মাঝে যেন বিশেষ শক্তি আছে। এই তো ওর হাত পা কাঁপানো বন্ধ হয়ে গেছে।ইহান ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। রুমাইসা ভেতরে কেমন শান্তি পাচ্ছে। আচ্ছা লোক টা কি বুঝে ওর কখন কি দরকার। রুমাইসার মাথায় যখন এসব ঘুরছে তখনি নার্স বাচ্চা নিয়ে রুমে আসল।
ডক্টর আঙুল দিয়ে রুমাইসার দিকে দেখাল দিতে। রুমাইসা তখন ইহানের ধ্যানে ব্যস্ত। নার্স রুমাইসার কোলে দিতেই ইহান রুমাইসার হাত এগিয়ে দিল ধরার জন্য। রুমাইসা তাকিয়ে দেখল পুতুলের মত ঘুমন্ত একটা বাবু ওর কোলে।রুমাইসা সম্মোহিতের মত চেয়ে রইল।
নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হল “ইহিতা”।
শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ২১
একদম অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগে যেন এই ছোট জীবন টা রুমাইসার জন্য আলো হয়ে এসেছে। রুমাইসা বাবুর দিকে চেয়ে রইল। হাত পা মোচড়াতে মোচড়াতে বাবুটা রুমাইসার দিকে চোখ খুলে তাকাল।রুমাইসা এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বাবুর দিকে। একদম ইহিতার মত চোখ দুটো।মুখ টা বুঝি তৃষার মত লাগছে। কপাল টা একদম সাহিলের মত বড়। রুমাইসা ইহানের দিকে তাকাল।লোকটা যেন কিভাবে বুঝে যায় ওর কি প্রয়োজন কখন।
রাত ১২ টার পর বাসায় আসল দুজন। রুমাইসার মনে পড়ে বিয়ের দিন রাতেও ঠিক এভাবে ইহিতা কে কোলে করে ইহান রুমাইসার সাথে বাসায় এসেছিল।আজ এক নতুন ইহিতা কে নিয়ে বাসায় যাচ্ছে রুমাইসা। জানে না এই পথচলা কতটুক সুন্দর হবে। তবে ইহিতার মত ও কে হারাতে চায় না দ্বিতীয় বার।
দরজা খুলতেই দেখল অধীর আগ্রহে সবাই দরজার সামনেই দাড়িয়ে আছে। রুমাইসা ভেতরে পা দিতেই নাসিমা বেগম ছুটে আসল।
“কই দেখি, আমার নাতনি কে আমার কোলে দেও। আমি মন ভরে দেখি একটু। ”
রুমাইসা খুব সুন্দর করে কোলে দিয়ে দিল ওনার। নাসিমা বেগম তার স্বামী কে বারবার দেখাচ্ছিল বাবুকে। রুমাইসার মনে পড়ে ইহিতার সময় ও ঠিক এই ঘটনা টাই ঘটেছিল।পুরোনো স্মৃতি গুলো হয়ত বারবার কোন না কোন ভাবে মানুষের মন কে তাজা করে তুলে। নাসিমা বেগম আর তালুকদার সাহেব এগিয়ে আসল রুমাইসার দিকে। ইহান সোফায় বসে আছে। ও দূর থেকে সব দেখছে। কিন্তু ওর মন টা এদিকে নেই। মন টা অন্য খেয়ালে পড়ে আছে।
“মা, আমি তোর এক বাচ্চা কে মারসি, আজ আমি আমার এই এতিম দাদুভাই কে তোর হাতে দিচ্ছি মা। তুই আমার দাদুভাই কে দয়া করে কোন অবহেলা করিস না।আর যদি না পারিস, তবে আমি ই দেখাশোনা করব। ”
নাসিমা বেগম আলতো করে বাবুর কপালে চুমু দিল। তালুকদার সাহেব রুমাইসার মাথায় হাত রেখে বলল “মা রে, আল্লাহ কাউকে ফিরায় দেয় না তার দরবার থেকে । দেখ তোর কোল খালি হইসে আবার একটা সন্তান দিয়ে তোর কোল ভরে দিসে।এটাকে দূরে রাখিস না মা।
রুমাইসার হঠাৎ যেন মনে হচ্ছে সত্যি ই কি এটা ওর বাচ্চা। নাকি আবার ওর থেকে কেউ কেড়ে নিবে। কোন জবাব আসছে না ওর দিক থেকে। তালুকদার দম্পতি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। স্বভাবতই রুমাইসার কাছে এই রকম কিছুর আবদার করা অনুচিত। কারন শত হোক এটা সাহিলের আর তৃষার মেয়ে। রুমাইসা কি নিজের জীবন নষ্টকারীর সন্তান কেই বা কেন এক্সেপ্ট করতে যাবে। তালুকদার দম্পতি শেষ পর্যন্ত উত্তর না পেয়ে চুপসে গেল একদম।
” সমস্যা নেই মা। তোমাকে দায়িত্ব নিতে হবে না। এই এতিম কে আমরাই বড় করব। তাতে যদি একটু পাপ কমে আমার। ” নাসিমা বেগমের কন্ঠ ভারী হয়ে গেল।উনি বাবুকে নিয়ে সোফার উপর বসে পড়ল। রুমাইসা ঠায় ওর জায়গায় দাড়িয়ে আছে। এতক্ষন সব কথাই কানে এসেছে কিন্তু কেন যেন শরীর তাতে সাড়া দিচ্ছিল না।
যেই মাত্র বাবু একটু আওয়াজ করে কান্না শুরু করল তখনি রুমাইসার ধ্যান যেন কোথাও হারিয়ে গেল। শ্বাশুড়ি কোলে নিয়ে খুব থামানোর চেষ্টা করছে। অবশেষে রুমাইসা এগিয়ে যেয়ে বাচ্চা কে নিজের কোলে টেনে নিল। বুকের সাথে লাগাতেই একটু চুপ হল। খুব ক্ষুধা লেগেছে বাবুর। রুমাইসা মেয়েকে নিয়ে হাটতে হাটতে নিজের রুমে চলে গেল।
সময় গুলো বড় ই অদ্ভুত। রুমাইসা নিজের ক্ষত ভুলে ছোট জীবন টা কে আকড়ে ধরেছে। এদিকে ইহান আগের তুলনায় কেমন যেন দূরে সরে গেছে। যদিও রুমাইসার সাথে আগে থেকেই তেমন কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু একটা আন্তরিকতা ছিল সেটা হঠাৎ কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। রুমাইসার মন খুব ভালো থাকে এখন। তাই ও ইহানের সাথে খু্শিতে দু চারটা কথা বলতে চায়। কিন্তু ইহান সারাদিন এ একবারও ও কে সেই সুযোগ দেয় না। সাইয়ারার বিয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, নয়তো সারাদিন ইচ্ছে করেই বাইরে থাকে। প্রয়োজন এ রুমাইসার কিছু লাগলে এনে দিবে বেশি হলে।
সাহিল ইদানীং বাসায় থাকে বেশি। একদিন হুট করেই মেয়েকে দেখতে রুমাইসার রুমে চলে গেল। রুমাইসা মেয়েকে মাত্র ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিয়েছে আর তখনি দেখল দরজার সামনে সাহিল। হকচকিয়ে উঠল আচমকা।
“আসতে পারি রুমাইসা? ”
রুমাইসা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ও কপাল কুঁচকে চেয়ে রইল ওই দিক। “মেয়েকে একবার দেখব, আসতে পারি কি? ”
রুমাইসার মনে পড়ল এটা সাহিলের ই বাচ্চা। তাই ওর দেখার অধিকার টাই বেশি। আজ এতদিন পর যখন দেখতে আসল না করে কিভাবে। মৃদু স্বরে বলল “আসুন। ঘুমিয়ে গেছে। ”
সাহিল বিছানার এক কোনায় বসে পড়ল। মেয়েকে দূর থেকেই দেখে হেসে বলল “আমার মেয়েটা যেন তোমার মত সাহসী হয় রুমাইসা। ”
রুমাইসার কেন যেন কথাটা গায়ে লাগল। তবুও চুপ করে রইল। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াল।
“এ কি দাড়িয়ে আছো কেন! আমি বসেছি বলে কি ঘৃণা লাগছে? ”
রুমাইসা ভেবেছিল উত্তর দিবে না। আর ঠিক সেটাই করল কোন উত্তর দিল না। কথাটা কোন দিক দিয়ে ভুল ছিল না।রুমাইসা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।
সাহিল কিছু সময় নীরব থেকে আবার বলল “রুমাইসা তোমার প্রতি করা প্রতিটা অবিচার এর শাস্তি হাতে হাতে পেয়েছি। এবার তোমার ক্ষনা চাইছি। আর শাস্তি দিও না আমাকে। যতদিন ক্ষমা না করবে ততদিন আমি শাস্তি পেতেই থাকব।”
রুমাইসার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে সাহিল একটা তিক্ত জিনিস। যেটা কে সামনে থেকে ওর মোটেও সহ্য হচ্ছে না। এক রকম বিরক্ত গলায় বলল “দেখুন আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তাই অযথা পুরোনো ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলেই ভালো হবে।”
সাহিলা যেন সন্তুষ্ট হতে পারল না।ও বিছানা থেকে উঠে গিয়ে রুমাইসার হাত টা খপ করে ধরে বলল “সত্যি রুমাইসা আমাকে তুমি মাফ করে দিয়েছ? ”
ঠিক তখনি রুমের ভেতর ইহান ঢুকল। দুজন কে এমন অবস্থায় দেখে কোন কথা না বাড়িয়ে মোবাইল আর মানিব্যাগ রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল। এত দ্রুত সব হয়ে গেল যে রুমাইসা কিছুই বুঝতে পারল না।সাহিলের হাত টা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল “আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী। অযথা হুটহাট এমন হাত ধরে বসবেন না দয়া করে। নিজের লিমিট বজায় রাখবেন।”
সাহিল খুব অবাক হয়ে বলল “রুমাইসা এভাবে কথা বলছ কেন। ইহানের বউ হওয়ার আগে তুমি আমার ছিলে ভুলে গেছ? ”
রুমাইসা একটু জোর করেই হাসি দিয়ে বলল “সিরিয়াসলি ! আমি আপনার ছিলাম কবে থেকে? আপনি কি আদৌ আমাকে মেনে নিয়েছিলেন? আপনি তো মরার অভিনয় করেছেন। তাই সারাজীবন আমার কাছে আপনি মৃত ই থাকবেন। ”
সাহিলের কাছে কথাটা তীরের মত বিঁধল। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে গিয়েছিল। আজ এক নৌকায় ও সাতরে উঠতে পারছে না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে গেল সাহিল। রুমাইসা মূর্তির মত দাড়িয়ে রইল। সারা গা জ্বলে যাচ্ছে ওর রাগে। ইহান গোসল করে বের হতেই রুমাইসা ছুটে গেল ওর কাছে।
ইহান একদম না দেখার মত করে বারান্দায় চলে গেল। রুমাইসা ভাবল ইহান বুঝি রাগ করল সাহিল কে দেখে। রুমাইসা এক রকম এক্সপ্লেইন করা শুরু করল ইহান কে সব কিছু। ইহান চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনি রুমাইসা হাত টা ধরে ফেলল।
ইহান কিছুটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল “কিছু বলবে আর? ”
রুমাইসা এক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইল। এই ইহান কে ও চিনে না। এত গুলো মাস হয়েছে বিয়ের অথচ আজ এই প্রথম ইহান কে ওর অচেনা লাগছে।
হাত টা ছেড়ে দিয়ে বলল “নাহ, আপনি টেবিলে আসুন খাবার দিচ্ছি। ”
ইহান হুম বলে সেখান থেকে চলে গেল। রুমাইসার বারবার মনে হচ্ছে ইহান যেন ইচ্ছে করেই দূরে সরে যাচ্ছে আবার এটাও মনে হল আসলেই কি ইহান ওর কাছাকাছি কখনো ছিল!
দুপুরের খাবার খেয়ে ইহান এসে শুয়ে পড়ল বাবুর পাশে। সবাই মিলে বাবুকে ডাকে ইমতি নামে। একমাত্র রুমাইসা ও কে ইহিতা নামেই ডাকে সব সময়। বিছানায় এসেই ইহান ইমতির শরীরে একটা হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। রুমাইসা কাজ শেষ করে রুমে এসেই দেখল দুজনেই ঘুমাচ্ছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে সেই ছোট ইহিতা আর ওর প্রিয় বাবা ইহান।অথচ বাস্তবতা অন্য কিছু।
রুমাইসা ঠিক করেছিল আজ আলমারির উপরের জায়গা টা পরিষ্কার করবে। অনেক দিন সময়ের কারনে করতে পারে না।তাই টুল রেখে তার উপর দাড়িয়ে গেল। আলমারির উপর বেশকিছু বই, খাতাপত্র জমা করা। রুমাইসা একে একে সব নামাল নিচে। বইয়ের উপর প্রচুর ধূলা, তার উপর উইপোকা খেয়ে অবস্থা নাজেহাল করে রেখেছে। সব নিয়ে বারান্দায় গেল রুমাইসা। একটা কাপড় নিয়ে রুমাইসা একে একে পরিষ্কার করতে লাগল সব। সব ইহানের ই বই। কিছু গল্পের বই ও আছে সাথে। হঠাৎ দুই তিনটা বই সরাতেই দুটো ডায়রি একটা সাদা পলিথিন এ মোড়ানো অবস্থায় পেল রুমাইসা। একটু অবাক হয়ে রুমাইসা পলিথিন থেকে ডায়েরি দুটো বের করল। ডায়েরি দুটো বেশ পুরনো। উপরে দাগ পড়ে আছে অনেক। রুমাইসা মলট টা উল্টে প্রথম পেজেই দেখল লিখা “রুহি এই ডায়েরি কিন্তু তোমার জন্য।কাউকে ধরতে দিবে না।”
রুমাইসার হঠাৎ মনে হল এই নাম টা আগেও শুনেছে কোথাও। হ্যা সেদিন জুই ও বলেছিল রুহি নাম টা। রুমাইসার গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। ভয়ে ভয়ে ডায়েরির পরের পেজ টা খুলল। আঠা দিয়ে একটি মেয়ের ছবি লাগানো। মেয়েটিকে দেখে রুমাইসার চোখ বিস্ফরিত হয়ে গেল।
(