শেষ বিকেলের আলো পর্ব ১৮+১৯

শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ১৮

সাহিল ভীর ঠেলে এগিয়ে গেল। তৃষার লাশ বের করা হচ্ছে অপারেশন রুম থেকে। তৃষার মা দাতি লেগে আছে তৃষার কথাস শুনে। সাহিল সহ সবাই থমকে গেল। একসাথে দুটো লাশ পাশাপাশি । বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করতেই ডক্টর বলল “বাচ্চা কে বিশেষ রুমে রাখা হয়েছে। যেহেতু প্রি ম্যাচুয়রড বেবি।তবে সার্ভাইব না করার সম্ভাবনা ই বেশি। ”

সাহিল ভেঙে পড়ল একদম। পাপ বাপ কেও ছাড়ে না সাহিল টার উৎকৃষ্ট প্রমান। ওর সবকিছু আজ শেষ । ঝড়ের মত এক নিমিষেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল। রাতের বেলা লাশ নিয়ে বাসায় ফিরল সবাই।রুমাইসা সারাটা সময় ইহিতা কে কোলে করে রেখেছে। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে এই মৃত্যুর শোকে।

রাতের বেলা এম্বুল্যান্স এর আওয়াজে এলাকা সচল হয়ে গেল। বিশেষ করে তালুকদার বাড়ির আশেপাশের জায়গা গুলো তে রাতের ১২ টা বাজে জনসমাগম বেড়ে গেল।সবাই এক নামে চিনে ওনাকে।।সকালে এম্বুলেন্স কে আসতে দেখেছে। এখন ফিরে আসছে দেখে সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। গাড়ি থেকে নামানো হল দুটো লাশ। সাদা কাপড়ে ঢাকা নিস্তেজ শরীর টা উঠানে রাখা খাটিয়া তে রাখা হল। রুমাইসা ইহিতা কে ছাড়ে নি। ঠান্ডা শরীর টা ধরে বসে আছে।ইহিতা কে দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি গভীর ঘুম ভেঙে চোখ খুলবে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের আনাগোনা বেড়ে গেল। সবাই এক নজর লাশ দেখে যাচ্ছে তৃষার। কিন্তু ইহিতা কে দেখেতে দিচ্ছে না রুমাইসা। ওড়না দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে। সকালের সেই রক্তমাখা জামা কাপড় এখনো কেউ বদলায় নি।সাহিল এক কোনায় বসে আছে। চোখ গুলো যেন পাথরের মূর্তির মত থেমে আছে। তৃষার মা বিলাপ করে কান্না করছে। কেউ জানে না আসল ঘটনা কি। এমন এক পরিস্থিতি এই পরিবারের, যে আসল ঘটনা জানার মত অবস্থা নেই। সবাই আফসোস করছিল বাচ্চা টা আর তৃষার জন্য।যারা জানতে পেরেছিল ইহান বিয়ে করে বাচ্চা সহ এসেছে বাসায়, তখন আশেপাশে থেকে অনেক কটু কথাই বলেছিল।ওরা আজ সবাই চুপ হয়ে গেছে এইটুকু বাচ্চার লাশ দেখে। রুমাইসা কোলের কাছে এমন ভাবে আগলে রেখেছে ছাড়তেই চাচ্ছে না।

কেউ এসে দেখতে চাইলেই বলে “আমার মেয়ে ঘুমাচ্ছে। দেখেন কি চুপচাপ ঘুমাচ্ছে আমার মেয়ে। ”

যেই মানুষ গুলো সবেমাত্র গতকাল খেয়ে গেল এ বাসা থেকে তারাই আজ আবার মৃত লাশ দেখতে এসেছিল। জীবন্ত মানুষ গুলো কে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তারাও শিউড়ে উঠল। জুই ও ছিল তাদের মাঝে। রুমাইসা আর তার বাচ্চা কে এভাবে দেখে একটু খারাপ ই লাগছে। তবে ওর শান্তিও লাগছে পথের কাটা শেষ । মনে মনে ভাবল, রুমাইসা ও মারা যেত আজ। তবে ওর ঝামেলা শেষ হত।

নাসিমা বেগম এর সারা শরীর যেন প্যারালাইজড। দুটো মানুষ কে মেরে ফেলেছে উনি। এই পাপের ভার কি উনি সইতে পারবে আদৌ! জেদের বশে উনি যেই পাপ করেছেন সেটা থেকে আদৌ কোন দিন মুক্তি পাবে উনি। তালুকদার সাহেবের বাড়ির একমাত্র নাতনী ছিল।যে কটা দিন কাছে ছিল একদম সারাদিন ইহিতা কে নিয়েই থাকত। আজ লাশ টা দেখে হু হু করে কান্না আসছে।

চারিদিকে মাইক দিয়ে এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে। এই রাতেও বাড়িতে উপচে পড়া ভীর।এক নজর লাশ টা দেখার জন্য।রুমাইসার বাড়ি থেকে কেউ আসে নি।কেউ জানেই না ওর অস্তিত্বের কথা। মরে আছে কি বেচে আছে। একা মেয়েকে নিয়ে বসে আছে। আগরবাতির ঘ্রাণে সারা বাড়ি ছড়িয়ে আছে। এখন কান্না হচ্ছে না কিন্তু সবাই চুপ। ভীর কমে গেছে।

সকাল ৯ টায় জানাজা দিবে লাশ দুটোর। মানুষ গুলো যখন জীবন্ত থেকে লাশ হয়ে যায় তখন বুঝি তার কদর বেড়ে যায় আরো। তবে তার নাম টা তখন লাশ হয়ে যায়। এই তো যেমন তৃষা কে বারবার মানুষ বলছিল লাশ টা কত আরামে শুয়ে আছে। অথচ জীবিত থাকতে কেউ ওর নাম ছাড়া কথা বলত না।দুনিয়াটাই বুঝি এমন। আজ মরলে কাল নাম পাব লাশ।

সারা রাত এভাবে কেটে গেল তালুকদার পরিবারের। ভোরের আজান পড়তেই তালুকদার সাহেব আর তৃষার বাবা নামাজ আদায় করতে চলে গেল। সারাটা রাত ইহান পাথর হয়ে ছিল। মেয়েটাকে একবারো ছুঁয়ে দেখতে পারি নি এখনো। রুমাইসা ওর কোলে একবারো দেয় নি।হয়ত রুমাইসা ভাবে ওর সন্তান হত্যার দোষী ভাবে ইহান কেই। এ এক বড় বোঝা হয়ে বুকের মাঝে চেপে ধরল ইহান কে। অতিরিক্ত রাগের ফল আজ দুটো লাশ। শূন্য দৃষ্টিতে খাটিয়ার দিকে চেয়ে আছে। ছোট খাটিয়া টা খালি পড়ে আছে। সারা রাত লাশ রাখায় লাশ গুলো কিছুটা ভারী হয়ে গেছে।

সকালের নামাজ সেরে সবাই আবার ভীর জমাতে শুরু করল তালুকদার বাড়িতে। সকালের আলো ফুটে উঠেছে চারিদিকে । পাখির কিচিরমিচির এ চারিদিক এ একটা ব্যস্ততার জানান দিল।

একজন বয়স্কা মহিলা বলল “জানাজা তো ৯ টায় দিবেন। এখন ৭.৩০ বাজে। লাশ গোসল করাতে হবে। এতক্ষন এভাবে রাখলে লাশ আরো ফুলে যাবে। ”

সবাই করুন দৃষ্টিতে তাকাল মহিলার দিকে। তালুকদার সাহেব বলল “হ্যা নিয়ে যান। লাশ গোসল করানো শুরু করেন। ”

মহিলা আবার বলল “সব কি ব্যবস্থা করা হইসে? ”

“তালুকদার সাহেব ভাঙা গলায় মিলিকে ডাক দিল। মিলির চোখ মুখ ভারী হয়ে আছে। ও মাথা নিচু করে দাড়িয়ে বলল ” জ্বি খালু? ”

“তোরে যা যা বলছিলাম আনসোস তুই? ”

“জ্বি খালু আনায় রাখসি। ”

“ওনাকে দেখায় দে সব। কই কি হবে। ”

মিলি মাথা ঝাকিয়ে চলে গেল। ১০ মিনিট পর তৃষার লাশ নিয়ে যাওয়া হল গোসলের জন্য।তৃষার লাশ উঠাতে দেখে স্তব্ধ রুমাইসা নড়াচড়া করে উঠল। সারা রাত এক কোনায় মেয়েকে নিয়ে বসে ছিল। একা একা কথা বলেছে মেয়ের সাথে। ইহান সব দেখেছে, তবুও কাছে যায় নি।সাহিল এর চোখ এড়ায় নি। মেয়েকে দেখে চোখ গড়িয়ে কেবল পানি পড়েছে। এই মেয়েকে জন্মের আগেই পিতার পরিচয় থেকে দূরে রেখেছিল ও। আজ অভিমান করে তার মেয়ে তাকে ফাকি দিয়ে হারিয়ে গেছে। সে কে ব্যর্থ পিতা, এক ব্যর্থ স্বামী।

তৃষার গোসল শেষ হতেই তাকে এনে যথাস্থানে আবার রাখল। গোসল করলে মানুষের শুভ্রতা যেন বেড়ে যায়। একটা লাশের বেলায় তার ব্যতিক্রম ঘটে না।তৃষা কে যেন আরো সুন্দর লাগছিল গোসল করানোর পর। কি সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে খাটিয়ায়। আর একটু পর যাকে কবরে রেখে আসবে সবাই।চির নিদ্রায় শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা।

এবার ইহিতার পালা। একজন মহিলা এসে ইহিতা কে চাইল রুমাইসার কাছে। রুমাইসা বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করল “কই যাবে আমার মেয়ে? ”

“গোসল করাতে হবে তো। লাশ এতক্ষন কোলে রাখে না মা।”

মহিলা হাত দিয়ে কোলে নিতে গেল রুমাইসা আরো শক্ত করে ইহিতা কে চেপে ধরল। “আমার মেয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠলে ওর আম্মু গোসল করাবে আপনি কে, যান এখান থেকে।”

এক রকম উদ্ভ্রান্তের মত আচরন শুরু করল সবার সাথে রুমাইসা। তারপর উপায় না দেখে সাইয়ারা এসে ইহিতাকে হাত থেকে টানতে লাগল রুমাইসার। রুমাইসা ছাড়তেই নারাজ মেয়ে কে। আরো কয়েকজন এবার রুমাইসা কে ধরল।

রুমাইসা চেচিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলল।”আমার মেয়েকে ছেড়ে দেও সাইয়ারা। ইহান আমার মেয়েকে দিতে বলেন। ইহান ইহিতার ঘুম ভাঙবে। আমার মেয়েকে ছেড়ে দেও তোমরা। ইহিতা কে কই নিয়ে যাচ্ছো তোমরা। আমার মেয়েকে ছেড়ে দে। ইহিতা আম্মু। ”

রুমাইসা অজ্ঞান হয়ে গেল আবার। ইহান আর সইতে পারছে না এসব। চোখ ভারী হয়ে এসেছে। দৌড়ে উঠে ভেতরে চলে গেল। ভেতরে যে কান্না করতে লাগল ইহান। কান্না করতে করতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ওর। একটা বাবার পীড়া কে বুঝবে। মায়ের মত তো এভাবে কান্না করতে পারে না। একাকী চার দেয়ালের মাঝেই তাদের কান্না সীমাবদ্ধ থাকে। ইহান পাগলের মত ইহিতার বিছানা,বালিশ, কাপড় ধরে কান্না করতে লাগল। কাধে হাত পড়তেই ইহান চমকে পেছনে তাকাল। দেখল সাহিল দাড়িয়ে আছে। ভাই কে দেখে যেন দুনিয়া ভুলে গেল। ভাইয়ের গলায় ধরে বাধাহীন ভাবে কান্না করতে লাগল। সাহিলের ও বাধ মানছে না।এ বাড়ির সব সুখ শান্তি কে কবর দিবে একটু পর সবাই। পারছে না আর সইতে।

রুনাইসার জ্ঞান ফিরতেই দেখল দুজন মহিলা ওর পাশে বসে আছে। ও চোখ খুলতেই প্র‍থম মনে পড়ল ইহিতার কথা । সবাইকে ফেলেই বাইরে ছুটে আসল। “ইহিতা, ইহিতা, আমার মেয়ে কই। আমার মেয়ে কই? ”

সাইয়ারা এসে রুমাইসা কে জড়িয়ে ধরল। রুমাইসা ও কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। “আমার মেয়ে কে কই নিয়ে গেছ সাইয়ারা? ”

সাইয়ারা আঙুল দিয়ে খাটিয়ার দিকে তাক করল। ইহিতার নাকে দুটো তুলো৷ কানে তুলো। সারা শরীর সাদা কাপড়ে মোড়ানো ।গভীর ঘুমে পড়ে আছে খাটিয়ার মাঝে।

রুমাইসা চিৎকার দিয়ে বলল “আমার মেয়ে ব্যথা পাবে, ওইখানে কে রেখেছে। ”

কিন্তু উপস্থিত সবাই রুমাইসা কে জোর করে ধরে রাখল। কারন এখন লাশ নিয়ে যাবে। পুরুষ গণ সবাই রেডি বাইরে দাড়িয়ে। শেষ বারের মত সবাইকে লাশের চেহারা দেখতে দিচ্ছে। বাড়িটা কান্নায় ভারী হয়ে গেল আবার। নাসিমা বেগম এবার আর সইতে পারল না। কান্নায় ফেটে যাচ্ছে তার ভেতরটা। সবার চোখেই পানি।

রুমাইসা কে ধরে নিয়ে সবাই তৃষার লাশ দেখাল আগে। রুমাইসা স্থির চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। কি সুন্দর মুখখানা ওর অভির বউয়ের। কি শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। পাশেই রাখা ওর ইহিতা।

রুমাইসা ধপ করে বসে পড়ল। দুইটা লাশ এর খাটিয়ায় দুই হাত রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। এক মায়ের আর্তনাদে ভারী হয়ে গেল আকাশ বাতাস।

তৃষার লাশ ধরল ওর বাবা,সাহিল আরো দুইজন। খাটিয়ার সামনের দু জায়গায় দুজন।সাহিলের বুক ফেটে কান্না আসছে কেবল। আজ যেন ওর পা ভারী হয়ে গেছে। চলছে না।

ইহিতার লাশ যখন উঠানো হল, রুমাইসা কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওর কান্না দেখে সবাই কান্না করে ফেলল। ইহান তাকাতেই পারছিল না।ও বারবার বলছিল “ইহান আমার মেয়েটা একা কবরে ভয় পাবে। ইহান আমার মেয়েটা আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। আমাকে নিয়ে যাও। ইহান আমার মেয়ের সাথে আমাকে নিয়ে যাও। ”

দূর রাস্তা থেকে রুমাইসার আহাজারি শুনতে পেল ইহান।বাবার কাধে কন্যার লাশ তুলে নেওবুঝি দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ। ইহানের গাল বেয়ে টুপটাপ পানি পড়ছে। আজ সকালে ইহিতা কে কোলে নিয়ে ঘুরতে পারল না।আজ ইহিতা ওর কাধে। সারাজীবন এর জন্য সায়িত হবে কবরে। এই পাষাণ দুনিয়ার অত্যাচার থেকে ইহিতা মুক্তি নিয়েছে। ইহানের বাবা ছেলের দিকে তাকাল। তার বখে যাওয়া ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে নিজের ও কান্না পাচ্ছে। সবেমাত্র ও ওর দায়িত্ব নিয়েছিল। আজ এক নিমিষেই সব শেষ।

কবরস্থান এ ঢুকতেই দেখল দুটো কবর কাটা পাশাপাশি । তৃষা কে ধরাধরি করে ইহান আর সাহিল ই শুইয়ে দিল তৃষার বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েছে সেখানে। ইহিতার লাশ টা কোলে নিয়ে ইহান চেয়ে রইল। আদরের টুকরা কে আজ নামিয়ে দিয়ে যাবে কবরে। কিভাবে পারবে ও, ওর আদরের সোনা কিভাবে থাকবে সবাইকে ছাড়া।

কবরস্থানে সবার সামনে হু হু করে কেদে দিল ইহিতা কে ধরে ইহান। সাহিল শেষ বারের মত কোলে নিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাইলো নিজের মেয়েকে। ইহিতা কে কোলে নিয়ে বাপ ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল। আজ যেন এই হাত দুটো খুব ভারী লাগছে। আপন সন্তান কে কবরে শুইয়ে দিবে একটু পর ই। কানে ভাসছে ইহিতার কান্নার আওয়াজ।

সাহিল এক গগনবিদারী আত্মচিৎকার দিয়ে ইহিতা কে ধরে রাখল। কিছু শূন্যতা বোধ হয় কোন দিন পূরণ হয় না। হবেও না।
শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ১৯

কবর দেওয়া শেষ এ সবাই একে একে চলে গেছে। সাহিল আর ইহান বসে আছে কবরের পাশে। দুনিয়া থেমে গেছে ওদের। ইহান সবেমাত্র সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিল। রুমাইসা কে বিয়ে করেছিল সাহিল কে কষ্ট দিতে আর কিছুই না। সাহিল সব সময় পরিবারের প্রিয় ছেলে ছিল। অথচ এই ব্যাপার টা ইহান মানতেই পারে নি কখনো। যার কারনে হিংসার কারনে রুমাইসা কে বিয়ে করেছে। ভাগ্য ও সহায় ছিল তখন। কিন্তু ওর এটাই যে ইহিতার মৃত্যুর কারন হবে জানলে দূরে কোথাও চলে যেত। আজ নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে। এই ছোট ইহিতা কে কোলে নিয়ে কত গুলো দিন কাটিয়েছে। আজ ও পড়ে আছে কবরের ভেতর। বাবার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তো ওর সাথে অভিমান করে ইহিতা ছুটি নিয়েছে। ইহান এর চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে।একা মেয়েটা কিভাবে থাকবে সারা রাত। রাতে ঘুমালেও একটা হাত ওর উপর দিয়ে রাখত।সকালেই উঠেই ইহিতা কে কোলে নিয়ে বাইরে যেত। মেয়েটাও ওর কোলে আসলেই কান্না বন্ধ করে দিত। আজ সকালেও মেয়েকে কোলে নিয়েছে। শেষ বারের মত লাশ রূপে। বুক টা ফেটে যাচ্ছে হাহাকার এ। ইচ্ছে করছে জীবন টা দিয়ে দিতে। তাহলে ওর মেয়েটা ওর কাছে থাকবে।

সাহিল ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। একদিন মৃত্যুর অভিনয় করেছিল। আর আজ আপন জন এর মৃত্যু চোখের সামনে দেখল। এই কষ্টের চাইতে মরে যেত তবুও হত। সবকিছুর মূলে ও ই ছিল। দুই দুই জন মেয়েকে কষ্ট দিয়েছে ও। কর্মফলের ভাগ নিজের টা নিজের ই নিতে হয়। হয়ত আবার কবরে আসবে ওর সদ্য জন্মানো বাচ্চার লাশ নিয়ে আবার। সেদিন নিজের জন্য ও কবর খুড়বে।

মানুষ জন চলে গেছে আসতে আসতে। যারা আছে সব আপন জন। রুমাইসা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। এই বুঝি ইহান ওর মেয়েকে নিয়ে আসবে। কান্না আসছে না, বুক টা ভার হয়ে আছে। ওর পাশে কেউ বসে নেই। সেই রক্তাক্ত কাপড়ে কাল থেকে আজো একি ভাবে বসে আছে। ইহান কে ঘরে ঢুকতে দেখেই রুমাইসা ছুটে গেল ওর কাছে।

ইহানের হাত ধরে বলল “ইহান, ইহিতা কই? নিয়ে আসছেন ও কে? খাওয়ার সময় হুইসে তো ওর। ও কে খাওয়াতে হবে। ”

আত্মীয় স্বজন সবাই চেয়ে আছে ওর দিকে। একদম পাগলের মত লাগছে। এলোমেলো চুল, রক্তাক্ত জামা।ইহান রুমাইসা কে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল। শক্ত করে জড়িয়ে বলল “রুমাইসা নিজেকে সামলাও। ইহিতা আর নেই। ”

রুমাইসা দাতে দাত চেপে ইহানের বুকে শুয়ে রইল।ওর মেয়েটা নেই। ওর কোল খালি হয়ে গেল আজ। যার জন্য এত গুলো মাস যুদ্ধ করেছে সেই মেয়ে আজ ফাকি দিয়ে চলে গেল। সবকিছু স্বপ্ন কেন হল না। ইহান বুঝতে পারল ওর পাঞ্জাবি বেয়ে গরম নোনাপানি ভেসে যাচ্ছে।

সময় গুলো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। মানুষ শোক ভুলে যায় এক সময়। তবে যার যায় সে ই কেবল জানে কষ্ট কি। যেমন রুমাইসা, ইহান, সাহিল এরা যতটাই স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করুক কিন্তু মনের কষ্ট এখনো দূর করতে পারে নি। নাসিমা বেগম সারাদিন নামাজ কালাম পড়ে। ঘর থেকে একটুও বের হয় না।দুনিয়ায় সাথে যেন ওনার লেনদেন নেই। তিন বেলার খাবার মিলি এসে দিয়ে যায়। ছেলেরাও মায়ের খোজ নেয় না।দুটো মানুষ কে মারার অনুশোচনা আর ছেলেদের অবহেলার কষ্ট দুটোই নাসিমা বেগম কে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।রুমাইসা সারাদিন কাজ কর্ম করে সময় পেলেই নামাজে বসে যায় কিংবা ইবাদত করে। এই বাড়ির সবাই যেন এখন নামাজের প্রতি আগ্রহী। কাছের মানুষ কে হারাতে দেখে প্রতিটা মানুষের ভেতরে যেন এক রকম আঘাত, ভয় সৃষ্টি করে গেছে। সাহিল সারাদিন অফিস করে।ওর মেয়ে হয়েছে। ওকে NICU তে রাখা হয়েছে আজ ১.৫ মাস। ডক্টর রা এখনো জানে না কি হবে শেষ পর্যন্ত। সাহিল একবারো খোঁজ নিতে যায় না।দেখতেও যায় না। ওর দিন শুধু অফিস, মসজিদ আর কবরস্থানে কাটছে। ইহান প্রতিদিন ই একবার করে দেখে আসে বাবু কে। ইহান আর রুমাইসার সম্পর্ক টা আগের চাইতে ক্ষীণ হয়ে গেছে। একি ঘরে একি ছাদের নিচে দুইজন অচেনা ব্যক্তির বসবাস যেন।প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথেই যোগাযোগ করে না। রুমাইসা নিয়ম করে প্রতিদিন তৃষার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করবে আর কিছু না । প্রায় রাতেই বালিশে মুখ গুজে কান্না করে রুমাইসা। ইহান সব বুঝে শুনে দেখেও, তবুও কিছু বলে না। ওর ও খুব ইচ্ছে করে রুমাইসার মত কান্না করতে।কিন্তু পুরুষের চোখের পানি বোধ হয় এত তাড়াতাড়ি নেমে যায় না। বাহিরের সবাই জানে জগের পানি তে পিছলে পড়ে দুজনেই আঘাত পেয়ে মারা গেছে। অথচ সত্যি টা জানানোর সাহস কেউ পায় নি।

রুমাইসার ফুপা ফুপু আসবে কাল। ইহান নিজে থেকে যোগাযোগ করেছে ওদের সাথে। ফুপু একটু রাগ হলেও ফুপা খু্শি হয়েছে।তবে ইহিতার কথা কেউ জানে না।কাল আসবে বাসায় তারা। রুমাইসা খবর টা শুনেছে তবে ওর মুখে কোন হাসি দেখা গেল না।

সকাল বেলা থেকে রুমাইসা রান্না করছে। এখন আর কাজ করতে কারো জন্য বসে থাকে না।মিলি, সাইয়ারা দুজনেই আসে সাহায্য করতে। শ্বাশুড়ির মুখ দেখেছিল শেষ বার যেদিন দুটো লাশ বাসায় এসেছিল। তারপর থেকে কেউ কারো চেহারা দেখে নি। সকাল বেলা হঠাৎ মিলি এসে বলল “ভাবী খালাম্মা আপনাকে ডাকে। ”

রুমাইসা চমকে গেল এই কথা শুনে। ও মিলিকে আবার জিজ্ঞেস করল “কে ডাকে? ”

“খালাম্মায় ডাকে আপনারে ঘরে। ”

রুমাইসা বেশ আশ্চর্য হল। হঠাৎ এমন কি হল যে তার ডাক পড়ল ওই ঘরে। রুমাইসা মিলির দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষন। তারপর নিজেকে শক্ত করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঘরে ঢুকল রুমাইসা।

“আসব বাবা? ”

তালুকদার সাহেব চেয়ারে বসে বুখারী শরীফ পড়ছিল। রুমাইসা কে দেখে এক পলক চেয়ে বলল “হ্যা আসো। ”

“আমাকে ডেকেছেন বাবা? ”

তালুকদার সাহেব বইতে মুখ রেখেই জবাব দিল “আমি না নাসিমা ডাকে তোমাকে। ”

রুমাইসার ভেতরে খুব অস্বস্তি লাগছিল। এতদিন পর কথা বলতে যাবে সেই মহিলার সাথে যে ওর মেয়েকে মেরে ফেলেছে। রুমাইসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তালুকদার সাহেব কে এড়িয়ে সামনের দিকে গেল। জায়নামাজে বসে কুরান শরীফ পড়ছে গুনগুন করে।রুমাইসা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দাড়িয়ে রইল। কিন্তু শ্বাশুড়ি এক মনে কোরান পড়ছেই। রুমাইসা মৃদু গলায় বলল “আম্মা আমাকে ডেকেছেন? ”

রুমাইসার ডাকে কিছুক্ষন পর নাসিমা বেগম চোখ তুলে চাইল। রুমাইসা কিছুক্ষন এর জন্য ভয় পেয়ে গেল। নাসিমা বেগমের চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।চোখ গুলো যেন কোটোরের ভেতর চলে গেসে।১.৫ মাস আগেও ভারী গড়নের নাসিমা বেগম এখন শুকিয়ে কাঠ।বয়স বড় জোর ৫২ হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে ৭০ বছরের বৃদ্ধ মহিলা। নাসিমা বেগম রুমাইসা কে বসতে বলল মাটিতে।

রুমাইসা বসে পড়ল আর এক দৃষ্টিতে নাসিমা বেগম কে দেখতে লাগল। পাপ বোধ কি মানুষ কে এতটাই পরিবর্তন করে দেয়? পাপীর পাপবোধ বুঝি তার জন্য চরম শাস্তি। আর মানসিক শাস্তির উপর বুঝি কিছু হয় না।

রুমাইসার হাতে একটা চাবির গোছা দিয়ে বলল “মা রে, আমি তোর সবচেয়ে বড় শাস্তি পাওয়ার দাবি রাখি।তবুও তুই কাউকে কিছু বলস নাই। কিন্তু মা এই দুনিয়াতে যে আমি শাস্তির পর শাস্তি পাচ্ছি রে। দেখ আমি তোর সন্তান নিসি এজন্য আমার সন্তান আমার থেকে দূরে সরে গেসে। আমার স্বামী আমার সাথে থাকে। কিন্তু এক বেলা একটার বেশি দুইটা কথা বলে না।আমার যেই মেয়েকে নিয়া এতকিছু করলাম,আজ ওই মেয়েও আমার ঘরে আসে না।গলা টা ধরে আসল নাসিমা বেগমের। আমার অহংকার, গরীমা ভাঙার জন্য আল্লাহ আমাকে এত বড় শাস্তি দিল। আমি জানি জাহান্নাম ছাড়া আমার গতি নাই। তবুও এই দুনিয়ায় যতটুক পাড়ি প্রায়শ্চিত্ত করব,করতাসি। সংসার বাস আমি ছাইড়া দিসি আজ অনেক দিন।তোরে ডাকার সাহস আমার হয় না। আজকে অনেক সাহস করে ডাক দিসি একটা দায়িত্ব দিতে মা।আমার এই শেষ উপকার টা করবি মা? ”

রুমাইসা কোন পাষন্ড হৃদয়ের মানুষ না। যত টাই সে নাসিমা বেগম কে ঘৃণা করত কিন্তু আজ তার কথা আর পরিণতি দেখে সে ও নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না।সন্তান হারানো মা রুমাইসা। আরেক মায়ের কষ্ট হারে হারে টের পায় ও। সন্তানের দূরে থাকার মত কষ্ট এই দুনিয়ায় খুব কম আছে। রুমাইসা উল্টো হাতে নিজের চোখের পানি মুছে বলল “আম্মা, আল্লাহ হয়ত আমারে মা হিসাবে কবুল করে নাই। সেজন্য আমার সন্তান আমার থেকে নিয়া নিসে। তবে আমার সন্তান বড় হইলে হয়ত একদিন পরিচয় নিয়া প্রশ্ন উঠত। তার আগে আল্লাহ ওরে নিয়ে গেছে নিজের কাছে, অবশ্যই সেটা কোন ভালো উদ্দেশ্যে। ”

নাসিমা বেগম আচল দিয়ে চোখের পানি মুছল। নাক টেনে বলল “মা কুরান শরীফ খোলা বেশি কথা বলব না। এই টা ঘরের চাবি। মনে কর আজ থেকে পুরা সংসার টাই তোমার । নিজের মত করে দেইখো। তোমার শ্বশুর আছে, লাগলে জিজ্ঞেস কইরা নিও। আমি আমার এই ইবাদত নিয়াই থাকব বাকি দিন।”

রুমাইসা অবাক হয়ে বলল “আম্মা এটা কি বলতাসেন। আমার বয়স ই বা কত। আমি এখন এত বড় সংসার কিভাবে সামলাবো? ”

নাসিমা বেগম হাসলো।আবার চোখ গড়িয়ে পানিও পড়ল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল “মা, আমি তোমার থেকে ছোট বয়সে এই সংসারের হাল ধরসিলাম। আমারো কষ্ট হইত। তোমারো হবে মা, তারপর সব যখন বুঝবা সব ঠিক হয়ে যাইব।”

“আম্মা এটা ঠিক হবে না। আপনি থাকতে আমি কেন এসব করব। আম্মা আপনি ই সব দেখাশোনা করবেন। ”

এক রকম পাল্টা যুক্তি তর্কে নাসিমা বেগম ই জয়ী হল। যাওয়ার সময় নাসিমা বেগম হাত ধরে রুমাইসার ক্ষমা চাইল। রুমাইসার খুব খারাপ লাগছিল। আজ একটা ভুল মানুষ গুলো কে কত টা দূরে নিয়ে গেছে একজন আরেকজন এর।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here