শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -২০+২১

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_২০
#Tahmina_Akther

-এই রুশা দাঁড়া, এই দাঁড়া বলছি। আমাকে রেখে চলে যাবি না কি!

নাজ, রুশার পিছনে পিছনে দৌঁড়ে যাচ্ছে আর অনবরত ডেকে চলেছে। কিন্তু, রুশা যেন আজ কিছুই শুনবে না পণ করেছে।একপর্যায়ে রুশার হাত ধরে ফেলল নাজ। রুশা থেমে গেলেও নাজের দিকে তাকালো না। নাজ ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

-কি হয়েছে, দোস্ত? আমি দ্বারা কোনো ভুল হয়েছে, হলে বল আমি শুধরে নেব কিন্তু এভাবে আমার সাথে রেগে থাকিস না।

-কি করিসনি সেটা বল! মিসবাহকে ওই কথাগুলো তুই কেন বললি?একটি বারও আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করলি না! এখন মিসবাহ যদি তোর দেয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে আসে তখন কি করব আমি?

-কি করবি আর!ওকে সোজা একসেপ্ট করে নিবি। ওর চেহারার দিকে তাকালে বুঝা যায় সে তোর প্রতি দূর্বল।

-আমি কি তাকে একবারও বলেছি আমার প্রতি দূর্বল হও মিসবাহ!আমি মিসবাহ কেন আর কাউকে চাই না আমার জীবনে। জীবনে একজনের হাতে হাত রেখে বহুদূর ছুটে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে কি করল? মেয়ে হবে দেখে কাপুরুষের মতো আমাকে পিটিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল।কাপুরুষটার একটি ভুল পদক্ষেপের কারণে আমি সন্তান জন্ম দিয়েও মা হবার যে মিষ্টি অনুভূতি সেই অনুভবটুকু থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। নতুন করে আমাকে আর কারো অনলে পুড়াস না।এখন আমি আমার জীবনে অনেক সুখে আছি, আর কারও মায়া জড়িয়ে নিজেকে অসহায় বানাতে চাই না। ভালোবাসার চেয়ে মায়া অনেক বিশ্রি অনুভূতি চাইলেও কারো মায়া কাটিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না।

বেশ রেগে গিয়ে কথাগুলো বলল রুশা। নাজ যেন আজ নতুন রূপে দেখল রুশাকে। কারণ আজ এতবছরের ফ্রেন্ডশিপে ওকে গম্ভীর থাকতে দেখলেও রেগে যেতে দেখেনি। রুশা যে শেষের কথাগুলো বলল সেই কথাগুলোতে মিশে আছে ঘৃণা।

নাজ রুশার হাত ধরে হেঁটে যেতে থাকল ফুটপাতের ওপর দিয়ে। আরেকটু সামনে গিয়ে একটি রিকশা ডেকে উঠে বসল দুই বান্ধবী,উদ্দেশ্য কুঞ্জ বাড়ি।

কুঞ্জ বাড়ির সামনে এসে পৌঁছাতে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভিতরে এগিয়ে চললো নাজ আর রুশা। এতসময়ের মাঝে একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি রুশা আর নাজও আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি।

কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দিলো ফাহিমা খালা। নাজ আর রুশা ড্রইংরুমের দিকে এগুতেই দেখল অচেনা কয়েকটি মুখ। রায়হান সাহেব রুশাকে দেখতেই হাসিমুখে এগিয়ে এসে নিচুস্বরে বলছেন,

-রুশা,উনারা তোকে দেখতে এসেছেন। যা গিয়ে সালাম দিয়ে আয় মা। নয়তো বলবে মেয়েটি মন্দ, তুই কি মন্দ বল?

-কিন্তু, আঙ্কেল?

-তুই কি বলতে চাইছিস, আমি বুঝতে পেরেছি। তুই শুধু ফর্মালিটিস রক্ষার্থে উনাদের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করবি কেমন আছেন? ব্যস,এতটুকু আর কিছু করা লাগবে না বাকিটা আমি সামলে নিব।যা মা। আর নাজ মামুনি তুমি গিয়ে একটু কাজলকে হ্যাল্প করো বুঝতেই পারছো হঠাৎ করে উনারা চলে আসাতে খাবার-দাবারের ব্যাপারটা সামলাতে মেয়েটা হিমশিম খাচ্ছে।

-জি আঙ্কেল। আমি যাচ্ছি।

নাজ চলে গেল রান্নাঘরে আর রায়হান সাহেব রুশাকে সাথে নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফা গিয়ে বসে পড়লেন।রুশা সামনের সোফায় বসা একজন নারী,দু’জন পুরুষকে উদ্দেশ্য করে সালাম প্রদান করল।উনারা হেঁসে সালামের উওর দিলেন এরপর,খুটিনাটি বিষয় রুশাকে জিজ্ঞেস করলেন। রুশা মাথানিচু করে সকল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

কথা বলার একপর্যায়ে রুশা জানতে পারল, উনারা হচ্ছে মিসবাহ পরিবারের লোক।ভদ্র মহিলা হচ্ছে মিসবাহর মা এবং সাথে থাকা দু’জন হচ্ছে একজন মিসবাহর বাবা আর চাচা।

মিসবাহর মা সোফা থেকে উঠে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

-চলো তো মা তোমার ঘরে। একটু নিরিবিলিতে তোমার সাথে কথা বলি।

আমি মিসবাহর আম্মুর কথা শুনে রায়হান আঙ্কেলের দিকে তাকালাম। উনি চোখ দিয়ে ইশারা করলেন, যেন আমি উনাকে আমার ঘরে নিয়ে যাই।

উপায়ান্তর না পেয়ে আমি মিসবাহর আম্মুকে সঙ্গে নিয়ে আমার ঘরে এলাম। উনি আমার ঘরে প্রবেশ করে ঘরেরে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। উনার ঘরের দিকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকানো দেখে আমি বুঝে গেলাম, আসলে উনি দেখছেন আমি ঠিক কতটা গোছালো স্বভাবের?

যখন আমার রাফির সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, ঠিক সেইসময়ে আমার শ্বাশুড়ি এভাবে আমার থাকার ঘরে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। তাই মিসবাহর আম্মুর এই দেখার ব্যাপারটা আমি খুব সহজে ধরতে পেরেছি।

-রুশা, দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও গিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসো।এভাবে বোরকা-নিকাব পরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। যাও যাও আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

উনার কথা শুনে আমার মনে পড়ল আসলেই তো আমি এতক্ষণ ধরে এই পোশাকে আছি। তৎক্ষনাৎ, কাবার্ড থেকে একটি কালো-সাদা মিশেলের থ্রীপিছ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

মিসবাহর আম্মুর মোবাইলে কল এলো। উনি কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে মিসবাহ বলছে,

-আম্মু, কি খবর ওখানকার?রুশার আঙ্কেল কিছু বলেছে তোমাকে?

-আরে বাবা,একটু শ্বাস নিয়ে তো কথা বলতে পারিস!রায়হান সাহেব কিছুই জানায়নি উনার একটাই কথা রুশার সিদ্ধান্ত মানে উনার সিদ্ধান্ত। এখন রুশার সাথে কথা বলে দেখি ও কি বলে এই বিয়ের ব্যাপারে?

-ও রাজি হবে না, আম্মু। ওর সাথে আমার আজ কথা হয়েছে। ও কি বলেছে জানো?

মিসবাহর সাথে রুশা এবং নাজের যত কথোপকথনের হয়েছিল সবই খুলে বলল ওর মায়ের সাথে।সব শুনে ওর মা বললো,

-দু’টো প্রশ্নের উত্তর কিন্তু অনেক সহজ। কিন্তু, আসল কথা হচ্ছে যারা কখনো কাউকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসেনি তারা কখনো এই প্রশ্ন দু’টোর সঠিক বর্ননা করতে পারবে না,যেমনটা তুই।

-আম্মু, তুমি এসব কি বলছো? আমি ওকে সত্যিই পছন্দ করি। ওকে নিয়ে আমার বাকি জীবন কাটাতে চাই তারমানে বুঝতে পারছো তুমি? ওকেই লাগবে আমার পাশে সারাজীবনের জন্য। এখন আমি জানি না তুমি কিভাবে রুশাকে রাজি করাবে?

-তোকে বুঝানোর বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। তারপরও আমি চেষ্টা করে দেখি রুশা কি বলে? রাখছি তাহলে।

বলেই কল কেটে দিলেন মিসবাহর আম্মু। মিনিট দু’য়েক পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো রুশা।
মিসবাহর আম্মু রুশার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলো। আসলে, এতক্ষণ ধরে রুশা বোরকায় আবৃত থাকার কারণে ওর মুখশ্রী বুঝতে পারেনি মিসবাহর আম্মু। মনে মনে বললেন,

-এই জন্য বুঝি আমার ছেলেটা এত পাগল হল। কিন্তু রুশা যদি আমার ছেলেটাকে বিয়ে করতে রাজি না হয় তখন আমার ছেলেকে কি উত্তর দিব আমি?

———————-

-মাধুর্য, তুমি আমার কাছে অনেক দূর্লভ। আমার জীবনে যদি আমি কিছু আশা করে না পেয়ে থাকি তা হলো তুমি। তোমার যখন অনেক কাছে পৌঁছে যাই আমি ঠিক তখনি কোনো না কোনো তান্ডব আমাকে তোমার কাছ থেকে বহু ক্রোশ দূরে সরিয়ে দেয়। তবুও, আমি চেষ্টা করব যাতে তোমাকে আমার জীবনের সাথে সংযুক্ত করে রাখতে পারি।তোমার জন্য আজ কতবছর ধরে অপেক্ষা করছি কিন্তু আমার ক্লান্তি আসে না জানো। মনে হয় আরও সহস্র শতাব্দী তোমার অপেক্ষায় এক অতল সাগরে নিমজ্জিত থাকতে পারব। অপেক্ষা আগামীকাল সকালের,আর দেরি করবো না আমি। আগামীকাল তোমাকে আমার মনের কথা জানিয়ে দেব আর বুকের ভিতর চেপে রাখতে পারছি না। মনে হয় শ্বাস নিতে পারি না।

এতক্ষণ ধরে নিজে নিজে কথাগুলো বলছে আদিল। হাতে তার মাধুর্যের ছবি,সুলতানার গায়ে হলুদের দিনের তোলা। কি স্নিগ্ধ মুখ! এই হাসোজ্জল মুখটি দেখলে কে বলবে,তার বাবা-মা নেই,স্বামী মেয়ে হবে শুনে একপ্রকার ত্যাগ করল, মেয়েটাও হলো মৃত। তবুও, হাল ছাড়েনি এই ধৈর্যশীল মেয়েটি।এগিয়ে চলছে তার স্বপ্নকে সাথে নিয়ে, ডাক্তার হবার স্বপ্ন।

আদিল প্রায় সময় ভাবে সে আর মাধুর্য। তাদের দুজনের জীবনে আপন মানুষ নেই যাদের কাছে নিজেদের দুঃখগুলো ব্যক্ত করা যায় কোনোপ্রকার দ্বিধা ছাড়া। তারা দুজনেই ভালোবাসার কাঙাল।আদিল সে তো চাইলে তার ভালোবাসার মানুষকে আপন করতে পারছে না আর রুশা সে তো জানেও না কেউ একজন তাকে শর্তহীন ভালোবাসে।

যদি জানতো তবে কি করতো রুশা? বড্ড লোভ জাগে সেই দৃশ্য দেখতে,যখন রুশা জানবে আদিল তাকে ১১বছর ধরে চুপিচুপি ভালোবাসে?#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_২১
#Tahmina_Akther

-আন্টি,একটু দেরি হয়ে গেলো।প্লিজ, আপনি কিছু মনে করবেন না।

-না,না, সমস্যা নেই। তুমি বরং আমার পাশে এসে বসো।কিছু কথা বলি তোমার সাথে।

রুশা অস্বস্তি নিয়ে মিসবাহর আম্মুর পাশে গিয়ে বসলো।মিসবাহর আম্মু হালকা হেসে রুশাকে বললো,

-তোমাকে দেখে যা বুঝলাম,তুমি মোটামুটি ধার্মিক একটা মেয়ে। কিন্তু, মিসবাহ তোমাকে দেখলো কিভাবে?

উনার এই প্রশ্নগুলো শুনে আমি হতভম্ব।মানে আমি পর্দা মেইনটেইন করে চলি ঠিকআছে তবে উনার ছেলে আমাকে কিভাবে দেখলো এটা নিয়ে উনার এত কৌতূহল কেন? নাকি উনি এটা ভাবছে উনার ছেলের সামনে আমি মুখের কাপড় সরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম!আসলে মেয়েরা পর্দা করলেও কথা শুনে আর না করলে মেয়ের চরিত্রের দোষ আছে শুনতে হয়।

নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে হাসিমুখে রুশা বললো,

-আসলে,আন্টি আমিও জানি না মিসবাহ আমাকে ঠিক কখন দেখেছে কিন্তু একদিন কাকতালীয়ভাবে ক্যান্টিনে আমি আর আমার বান্ধবী বসে খাবার খাচ্ছিলাম সেই সময় মিসবাহ আর আমাদের অন্য এক ক্লাসমেটকে সাথে নিয়ে ক্যান্টিনে আসে তখনই হয়তো মিসবাহ আমাকে দেখেছে।এইটুকু আমার ধারণা বাকিটা নাহয় আপনি মিসবাহর কাছ থেকে জেনে নিবেন।

-আচ্ছা, বাদ দাও এইসব কথা৷ডা. রায়হান কি তোমার আপন চাচা?

মিসবাহর আম্মুর কথা শুনে আমি উনার মুখের দিকে বুঝার চেষ্টা করছিল আসলেই কি উনি জানেন না যে আমি এই বাড়ির আশ্রিতা? যদি না জেনে থাকেন তবে আমার উচিত হবে উনাকে সব সত্যি জানানো। আর এমনিতেও আমার জীবনে কাউকে জড়াতে চাই না শুধু শুধু এই বিষয়টাকে টেনেহিঁচড়ে বড় না করাই উত্তম।

-আসলে আন্টি, রায়হান আঙ্কেল আমার আপন চাচা নন।

-কিন্তু, মিসবাহ যে বলল,ডা.রায়হান তোমার আপন চাচা!কিন্তু, মিসবাহ আমার সাথে মিথ্যে বলবে কেন?

-মিসবাহ, হয়তো আপনাকে আরও অনেক কথা জানায়নি। আমার সম্পর্কে আপনি ঠিক কি কি জেনেছেন মিসবাহর কাছ থেকে আমি জানি না। তবে, আমি নতুন করে আমার পরিচয় আপনার কাছে দিতে চাই, শুনবেন আন্টি?

মিসবাহর আম্মুর ছেলের উপর ভীষণ রাগ হলো।ছেলে কেন উনার সাথে মিথ্যে বলল?রুশার কথা শুনে তিনি এইটুকু বুঝতে পারলেন তার ছেলে তাকে এমন আরও অনেক কিছু আছে যা জানায়নি। রুশাকে মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে দিলেন যার অর্থ রুশার পরিচয় উনি জানতে চান।

-আমার পুরো নাম রুশা হাসান।আমার জন্মস্থান কুমিল্লা। আমি যখন ছোট ছিলাম আমার বাবা মারা যায় এরপর আমার মায়ের অনত্র বিয়ে দিয়ে দেয় আমার মামারা। এরপর থেকে আমার বেড়ে উঠা আমার মামার বাড়িতে। মামী ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন, কিন্তু টাকার অভাবে উনি আমার অনেক চাওয়া পূরণ করতে পারতেন না। কারণ আমি ছাড়াও আমার আরও দু’টো মামাতো ভাইবোন ছিল যাদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় সংসারের সকল খরচ আমার মামা একাই সামলাতেন। কোনোভাবে আমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। ছেলে আমাদের এলাকার ছিল। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো।আমার মতো এতিম একটি মেয়ের জন্য এইরকম ভালো প্রস্তাব এসেছে এই বা কম কিসের?
আমার জীবন বাঁধা পড়ে গেলো রাফি নামক মানুষটার সঙ্গে। বিয়ের প্রথম ক’মাস সব ভালোই চলছিলো শ্বাশুড়ি মায়ের ভালোবাসা, বন্ধুর মতো স্বামী,বোনের মত ননদ। কিন্তু, বিপত্তি ঘটলো তখন, যখন আমি সন্তানসম্ভবা হলাম। আমার শ্বাশুড়ি মায়ের একটাই কথা,উনার বংশের প্রথম বাচ্চা যেন ছেলে হয়। আমার স্বামী, রাফির উনার বক্তব্য উনার মায়ের মতো ছিল।
মনে মনে ভয় পেতে শুরু করলাম, যদি আমার ছেলে না হয় তবে উনারা কি করবে আমার সাথে? বাড়ি থেকে বের করে দিবে না তো। এরকম জল্পনা-কল্পনার মাঝে আমি তখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার শ্বাশুড়ি আমায় নিয়ে গেলেন এক হসপিটালে।যেন উনি জানতে পারেন আমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে?আলট্রাসোনোগ্রাফি শেষে ডক্টর যখন জানালো আমার মেয়ে হবে তখন আমার শ্বাশুড়ি মুখ কালো করে আমায় নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে এলেন।
বাড়িতে আসার পর উনার আসল রূপধারন করলেন। যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করলেন আমার সাথে। আমার চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সন্ধ্যার পর রাফি আসতেই আমার শ্বাশুড়ি ওকে জানায় আমার মেয়ে হবে। ব্যস, ওর চিৎকার চেঁচামেঁচি শুরু হল।আমি সহ্য করতে না পেরে শুধু বলেছিলাম,

-কেন, আমার মেয়ে হবে বলে এইরকম আচরণ করছেন?আচ্ছা,মা সন্তান ভূমিষ্ট হবার অনুভূতি কেবল মা অনুভব করতে জানে। মেয়ে সন্তান আর ছেলে সন্তানের ভূমিষ্টের ব্যাথা কি তবে আলাদা? মানে ছেলে হলে কোনো কষ্ট হয় না আর মেয়ে হলে কষ্ট বেশি হয়।

ব্যস, আমার স্বামী আমাকে এই কথা তার মায়ের মুখের উপর বলার কারণে, ওর কোমড়ের বেল দিয়ে আমার শরীরে ইচ্ছেমতো প্রয়োগ করেছিলো। সে কি দুঃসহনীয় যন্ত্রণা!এইটুকু পর্যন্ত উনারা থেমে থাকেননি আমাকে এর পরদিন সকালে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা, পুরো শরীরের মারের যন্ত্রণা,না খাওয়া অভুক্ত শরীর নিয়ে রওনা হয়েছিলাম মামার বাড়ির উদ্দেশ্য। কিন্তু, বাস ভাড়া দিতে পারিনি বলে আমাকে মাঝ রাস্তায় বৃষ্টির মাঝে বাস থেকে নামিয়ে দেয় বাসের হেলপার। জানেন, আন্টি বাসের প্রত্যেকটি যাত্রী আমার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল কিন্তু আমার বাস ভাড়াটুকু তারা কেউ দিতে চায়নি। কয়েকজনের কাছে চেয়েছিলাম কিন্তু উনারা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন অচেতন হয়ে পড়ি। এরপর, যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি। আমাকে হাসপাতালে নেয়া লোকটি ছিল ডা.রায়হান আঙ্কেল। উনি আমার জীবন বৃত্তান্ত শুনে আমাকে উনার বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছেন।মাসখানেক পর জেনেছিলাম আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছে তাই ওকে ডির্ভোস দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। রাফিকে ডির্ভোস দেয়ার পর আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব নিয়েছেন রায়হান আঙ্কেলের মেয়ে কাজল আপুর স্বামী নূর আহমেদ আয়াত।
এই হলো আমার জীবন বৃত্তান্ত। এই কথাগুলো হয়তো আপনাকে মিসবাহ বলেনি। আর সহজ ভাষায় বলতে গেলে আমি এই বাড়ির আশ্রিতা,আন্টি। রায়হান আঙ্কেল আমার রক্তের সম্পর্কিয় চাচা নন।

কথাগুলো গড়গড়িয়ে বলে চোখের পানিটুকু মুছে মিসবাহর মায়ের দিকে তাকালো রুশা। দেখলো মিসবাহর আম্মুর গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। রুশা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল উনার দিকে।

মিসবাহর আম্মু বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক করে রুশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-রুশা আসলেই আমাকে এই সবকিছু জানায়নি মিসবাহ। কিন্তু, ওর প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। কারণ, ও একটি চমৎকার মেয়েকে ওর জীবনের একটি বড় অংশে স্থান দিতে চাইছে। আমার তো এখন আজ নিজের ছেলের প্রতি গর্ব হচ্ছে। আমি চাইলেও তোমার মতো একটি আত্মসম্পূর্ণবোধ মেয়ে খুঁজে আনতে পারতাম না মিসবাহর জন্য কিন্তু ও পেরেছে। মা,আমি চাই তুমি আমার পরিবারের একজন সদস্য হও। এমন একজন মানুষ আমাদের পরিবারে থাকলে সকলেই অনুপ্রেরণা পাবে। মা,তুমি আমার মিসবাহকে তোমার জীবনের একটুখানি অংশে জড়িয়ে রাখবে?

মিসবাহর মায়ের কথা শুনে রুশা অবাক হলো কারণ সে তো ভেবেছিল এই কথাগুলো জানার পর উনি সরাসরি নাকচ করে দিবেন এই বিয়ের ব্যাপারে। কিন্তু, এইখানে তো উল্টো ব্যাপার ঘটে গেলো।

-আসলে, আপা আমি চাচ্ছিলাম এই বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমরা আর কিছুদিন পর কথা বলি। কারণ, আজই তো ওদের তৃতীয় প্রফ শেষ হলো। ছুটির এই মাঝের সময়টুকুতে রুশা নাহয় ভেবে জানাবে এই বিয়ের ব্যাপারে। বুঝতেই পারছেন মেয়ের মনের ব্যাপার।

রায়হান সাহেব রুশার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো মিসবাহর আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

রায়হান সাহেবের এই কথা শুনে হয়তো মিসবাহর আম্মু খুশি হতে পারেননি তবে সৌজন্যে রক্ষার্থে হেসে বললেন,

-জি ভাইজান, সমস্যা নেই রুশার ঠিক যতদিন সময় লাগুক দেব আমরা কিন্তু ওর উত্তরে যেন আমাদের সন্তুষ্টি লাভ হয়। কারণ, ওকে আমার ছেলের বৌ হিসেবে চাই।আসছি তাহলে, আল্লাহ হাফেজ।

-রাতের খাবার খেয়ে যান, আপা।

-না, ভাইজান। একেবারে ছেলেকে এই বাড়ির জামাই বানিয়ে এরপর এই বাড়ির পানি খাব তার আগে নয়।

মিসবাহর পরিবারের সকলে চলে যেতেই, রুশা তার আঙ্কেলের মুখের দিকে তাকাতেই রায়হান সাহেব হালকা হেঁসে ইশারায় বললেন,

-খুশি হয়েছিস?

-অনেক খুশি হয়েছি আঙ্কেল।

এরপর, সকলে রাতের খাবার খেয়ে নিলো আয়াত বাদে কারণ আয়াত আজ কুঞ্জ বাড়িতে আসেনি ওর অফিসের জরুরি কাজ থাকায়।কাজল জানালো আজ রুশার সাথে ও ঘুমাবে। রুশা হেসে বললো,

-তবে আজ সারারাত অনেক গল্প চলবে,তাই না আপু?

-হুম, অনেক গল্প হবে।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here