শেষ বিকেলে তুমি আমি-০১

বাসর রাতেই আমার কোলটা দখল করে নেয় একটা পিচ্চি মেয়ে। প্রথম দফায় অবাকতায় জড়িয়ে যাই। আর দ্বিতীয় দফায়? পুরোদমে স্তব্ধ হতে বাধ্য হই। সদ্য হওয়া স্বামী অবলীলায় বলে দেয়

— বউয়ের অধিকার চেয়ে নিজেকে ছোট করবেন না আশা করি। টাকার লোভে বিয়ে করেছেন আমাকে এটা আমি জানি। ছোঁয়া আমার মেয়ে। আপনাকে বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না আমার। দ্বিতীয় বার ঘর বাঁধার স্বপ্ন আমি দেখিনা। ডিভোর্সের জন্য তৈরি হন।

এহেন কথার পিঠে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া সেদিন দ্বিতীয় কোনো অভিব্যাক্তি মুখে জমাতে পারিনি। কোলে বসে থাকা পাঁচ বছরের মেয়েটার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে ছিলাম আমি। জানি না বাচ্চাটা কি বুঝলো। সে হঠাৎই এক পলকে আমার ডান হাতটায় দাঁতের দাগ ফেলে দিলো। একটা কামড় দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো ঘরের বাইরে। অনেক আগেই তার বাবাও চলে গেছে। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম মিনিট তিনেক। তারপরই হঠাৎ কাল পরিস্থিতি মাথা ঘুরিয়ে তুলল। সুদূর হতে তীক্ষ্ণ তীর এসে যেন গেঁথে পরলো বুকে। ভেবেছিলাম সব দুঃখ বুঝি এবার বিয়ের দ্বারা অবসান হবে। শেষ ভালোটা এবার হওয়ার পথে। কিন্তু আমার জন্য যে সুখ কানা কলসির জল! উচ্চবিত্ত পরিবারের বউ হয়ে এসেও আমি রইলাম নগন্য। স্বামী অমান্য করলো আমাকে। খুব ছোটোতে বাবা মা হারিয়ে চাচার বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছিলাম। অবমাননা, লাঞ্ছনা সইয়ে বিশটা বছর পেরোনোর পর আমি চেয়েছিলাম, একটা ঘর বাঁধবো। দোচালা টিনের ঘর হলেও বেশ হবে। আমার আপন সংসারে সে আর আমি মিলে যাত্রা দিয়ে পার করবো যুগের পর যুগ। দুমুঠো ভাত খাবো মরিচ আর লবণের সন্ধিতে। তবুও আমি আমার আঙ্গিনায় সুখের বাগান করবো।

— এই মেয়ে, তোমার জন্য বাবা বকা খাচ্ছে দাদুর কাছে। তুমি কেন আমার বাবাকে বিয়ে করেছো?

অগোছালো ভাবনার মাঝে এমন কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আমি চোখ ফিরে চাইলাম। ছোঁয়া মেয়েটা দাড়িয়ে আছে আমার সামনে। ভীষণ রাগ যেন তার চোখ মুখ জুড়ে। আমি কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে কান সজাগ করলাম। ড্রয়িং রুম হতে তুমুল কথা কাটাকাটির জের ভেসে আসছে রুমে। স্পষ্ট একটা ভাড়ি কন্ঠ কঠোর করে বলছে

— একদম বেয়াদবি করবে না স্মরণ। বিয়ে হয়েছে এখন তোমাকে মানতে হবে। মেয়ে তো এমন না যে অশিক্ষিত, অসুন্দর।

— তো? আমি তো বলেছিলাম আমার কাউকে দরকার নেই। আমি একা ভালো আছি।

— জীবনে চলতে গেলে কাউকে পাশে দরকার স্মরণ।

— তোমারও তো দরকার ছিলো বাবা। মা মারা যাওয়ার পর তুমিও তো কারো হাত ধরোনি।

আবেগ মিশ্রিত কন্ঠটা যেন বাড়ি স্তব্ধ করে দিলো। বাবার মুখ হতে তাৎক্ষনিক কিছু শোনা গেলো না।

— বাবা, আমি ঘর সংসার করতে পারবো না।

তাদের কথার মাঝে আমি দরজার আড়ালে লুকিয়ে পরলাম। দরজার এক ফালি ফাঁক দিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলাম স্মরণ নামের মানুষটার দিকে। কি হয়েছিলো তার? মেয়েটা তবে তারই? তার পূর্বে একটা সংসারও ছিলো? ভাবনার মাঝে অজান্তে চোখ ভিজে উঠলো। সে এদিকেই আসছে। আমি চটজলদি চোখ মুছে যেন ছিটকে দূরে চলে এলাম। একটু পর বিকট একটা শব্দ হলো দরজার। কানে ভেসে এলো

— বেরিয়ে যান ঘর থেকে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। প্লিজ গেট লস্ট।

চিৎকার শুনে কেঁপে উঠলাম আমি। দ্রুত পায়ে ভয়ে ঘর ত্যাগ করলাম। সে ততক্ষণে ফুলে মোড়ানো বিছানা তছনছ করেছে। ছোট মেয়েটা ভয়ে জড়সড় হয়ে ঘরের এক কোণে বসে রইলো।

আমি ঘর হতে বেরিয়ে দরজার ওপাশে চুপটি করে দাড়িয়ে রইলাম। বুকটা ক্রমশ দুঃখে দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মিনিট তিনেক পেরোতেই হঠাৎ শশুরের আগমন হলো। তিনি বড্ড বেদনা নিয়ে আমাকে বললেন

— আমিই হয়তো তোমার জীবন নষ্ট করলাম মা। ছোঁয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে স্মরণ কে বিয়ে করালাম। কিন্তু ও….

আটকে গেলেন মাঝপথে। আমি অধোমস্তকে তখন দাড়িয়ে দু ফোঁটা অশ্রু ঝড়ানো ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না।

— আমার তো বয়স হচ্ছে। আমার একটা মেয়ের দরকার ছিলো৷ তোমাকে আমার মেয়ে করে এনে হয়তো তোমার জীবন নষ্ট করলাম। ক্ষমা করে দিও।

বৃদ্ধ মানুষটার এমন কথা শুনে আমি হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মুখে হাত চাপা দিলাম তৎক্ষনাৎ। ভাঙা গলায় কিছু বলতে চেয়েও আমি পারলাম না।

.
রাতটা নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম। আর দিনটা শুরু হলো অবহেলা নিয়ে। আত্মীয় স্বজন দু চারজন যারা ছিলো তারা দ্রুতই যেন বাড়িছাড়া হলো। চাচা চাচি বিয়ে দিয়েই যেন বেঁচে গেছে। ফের আর একটাবারও খোঁজ নেওয়ার কথা হয়তো ভাবেনি। চাচাতো বোনটা শুধু একবার ফোন করেছিলো। সকালের নাস্তা করছিলো সে, ছোট মেয়েটা আর বাবা। আমিই নাস্তা বানিয়েছিলাম। রুটি, পরোটা করেছিলাম। সে বিনাবাক্যে যেন মেঘে ঢাকা মন নিয়ে খেতে বসে৷ বাবা বেশ প্রশংসা করে আর ছোট মেয়েটা বায়না ধরে সে এগুলো খাবে না। তাকে বিরিয়ানি রান্না করে দিতে হবে। উনি একটু অস্বস্তিতে পরলেও মেয়ের জেদের কাছে হার মানে। আমি গত রাত থেকে না খাওয়া এখন অব্দি। তবুও হাসি মুখে ছোট মেয়েটার আবদার পূরণ করলাম। কিন্তু সে জানি না কেন এমন করলো। এক লোকমা মুখে নিয়েই থু থু করে ফেলে দিলো। পুরো প্লেট উল্টে দিলো মেঝেতে। আমি তার পাশেই দাড়িয়ে থাকায় সব পরলো আমার পায়ের ওপর। চিৎকার করে দূরে সরে যাই। সেই মুহূর্তে সে আশ্চর্য জনক ভাবে চিৎকার দিয়ে তার বাবাকে ডাকে। হুড়মুড় করে আসেন উনি। ছোঁয়া বলে দিলো

— বাবা, উনি আমার ওপর চিল্লাপাল্লা করে। দেখো আমাকে খেতে দিলো না। ফেলে দিয়েছে বিরিয়ানি।

আমি চরম অবাক হলাম। কি বলে এই টুকু বাচ্চা? অবাকতা নিয়ে যখন স্মরণের দিকে তাকালাম তখন সে আলগোছে শীতল চোখে দেখলেন আমাকে। অতঃপর মেয়েকে বললেন

— আসো আমার সাথে।

ছোঁয়া চলে গেলো। যাওয়ার সময় তার বাবাকে বলল

— তুমি তাকে বকলে না কেন বাবা?

কোনো প্রত্যুত্তর সে পেলো না।

.
এভাবে রোজই চলতে লাগলো কিছু ঘটনা। আমি মুখ বুঁজে সইয়ে গেলাম। আজ দশ দিন হতে চলল। কখনো ভাবি, এমন সংসারে থাকা কি আমার জন্য সুখের? মন বলে, পূর্বের চাইতে একটু ভালো আছিস। কোথায় যাবি তুই? এখান থেকে বেরিয়ে একটা কোথাও দাঁড়ানোর মতো জায়গা তো তোর নেই। পড়ালেখাও সামান্য। মাত্র এইচএসসি পাশ। আরও ভাবি বাবার কথা। একটা বাবা পেয়েছি। তার দেখভাল করে করেই ভালো সময় কাটে। বাবা আমাকে বলে

” তুই কখনো চলে যাওয়ার কথা ভাবিস না মা। তুই চলে গেলে আমাকে কে দেখভাল করবে? হুইল চেয়ারে বসে থাকা মানুষ আমি।”

কিছুটা হয়তো জড়িয়ে গেছি আমি এই সংসারের সাথে। কিছুটা মানিয়ে নিয়েছি সবকিছুকে। পুরোটা দিয়ে ছোঁয়ার মা হয়ে ওঠার চেষ্টায় মত্ত হয়েছি আমি। শুধু জানি না আমি ভালোবাসার চেষ্টাটা করবো কিনা। তাকে ভালোবাসার কথা ভাবতেও যে আমার ভয় লাগে।

— কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে।

হঠাৎ তার ডাকে ভাবনা ছুটে গেলো আমার। পিছন ফিরে চাইলাম। সে দাড়িয়ে আছে। মুখে ক্লান্তির ছাপ। ঘামে ভেজা কপাল। সুন্দর নাক, মুখ, ঠোঁট জুড়ে ভেসে উঠেছে যেন আমাকে নিয়ে তার অবজ্ঞা।

— আপনার ঘরে ডাকতে পারতেন। আমি চলে যেতাম।

সে আমার কথার পিঠে বলল

— আমি বিজনেসের জন্য বিদেশ যাচ্ছি কালদিন পর। ডিভোর্সের পেপার রেডি করছি। দ্রুত হয়ে যাবে। আর আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি এসে আপনাকে এই বাসা থেকে সিপ্ট করিয়ে অন্য বাসায় পাঠিয়ে দেবো। একটা ভার্সিটিতে এডমিট করিয়ে দেবো। প্লিজ একটু নিজের রাস্তা নিজে বেছে নেবেন।

আমার বুকের মাঝে যেন মোচড় দিয়ে উঠলো তার এমন কথা শুনে।

চলবে….

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
আলিশা
সূচনা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here