শেষ বিকেলে তুমি আমি-০৪

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_৪

— ছোঁয়া বলছিল তাই পরেছিলাম।

বলতে গেলে মিনমিন করে জবাব দিলাম। স্মরণ যেন ফুঁসে উঠলো আরো। বলে উঠলো

— ছোঁয়ার কথা কেন শুনবেন আপনি? আপনার কি কমন সেন্স নেই? অন্যের জিনিসে কেন হাত দেবেন আপনি?

তার চিৎকারে কেঁপে উঠলাম। সে হঠাৎই রাগে পাশে থাকা ছোট কাচের টেবিলে সজোরে লাথি দিয়ে বলে উঠলো আঙ্গুল উঁচিয়ে

— ইন ফিউচার, এমন দুঃসাহসিকতা দেখাবেন না। আপনার কোনো রাইট আছে এই জিনিসগুলোর প্রতি? আমি দিয়েছি?

আমি ধমক শুনে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। সে যেন মিনিট তিনেক আমাকে পরখ করে গেলো রাগ ঝড়া চোখে। যখন কানে কারো গটগট করে চলে যাওয়ার শব্দ এলো তখন চোখ খুলে দৃষ্টি উর্ধ্বে তুলে দেখলাম, সে চলে যাচ্ছে। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে মনে মনে বলে দিলাম

” এমন ব্যাবহার আমার কাছে স্বাভাবিক লাগে জানেন? চাচি আম্মা আরো কত বাজে ব্যাবহার করতো? কলেজের নবীন বরণে পরে যাওয়ার জন্য শুধু একটা শাড়ি চেয়েছিলাম তার থেকে। কত কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো! আসলে মানুষ বলে না, বিষে বিষে বিষক্ষয়। আমার বেলায় কথা শুনে শুনে অটোমেটিক হজম হয়”

মন মোটামুটি ভাবে একটু খারাপ হলো। তবে খুব হতে পারলো না। এমন এক পরিস্থিতি যে সৃষ্টি হবে তা আমি তাকে দেখেই মনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছিলাম। কিছু বললে শুধু শুনে যেতে হবে খেয়া। সে বলতেই পারে। কারণ কারো ভালোবাসার জিনিসে কেউ হস্তক্ষেপ করলে তা অসহনীয়, কাঁটার মতো বিঁধে। এ ব্যাথা আমি সইয়ে এসেছি। সেই ছোট বেলাতেই। প্রথম ভালোবেসে ভুল করে। একপাক্ষিক ভালোবাসায় জড়িয়ে গিয়ে। সে যে কোথায় কে জানে? দশ বছর বয়সে প্রথম দেখা। বাবা বাসা সিপ্ট করার দরুন। একটা মজার বিষয় ছিলো হলো, আমি আজও তার নাম জানি না। সে কোথায় এখন? কে জানে?
তাকে আর মনে পরে না। সব অনুভূতি ফিকে। তবে হ্যা, যখন তার কথা মাথায় আসে, তখন বুকে সুক্ষ্ম এক অদ্ভুত ব্যাথার সুর ওঠে।

.
রাতের খাবার আর খাওয়া হলো না আমার। বাবাকে শুধু খাবার দিয়ে তার পাশে বসে গল্প করে গেলাম। গল্পে গল্পে অনেক বারই প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। অথৈ কিভাবে মারা গেছে? কি হয়েছিল ওর? কিন্তু কোনো এক অজানা বাঁধা আটকে রাখলো আমাকে। বলা হলো না। বাবার খাবার খাওয়া শেষ হলে সব গুছিয়ে পুনরায় উনাকে ঘরে রেখে আসলাম। বৃষ্টির ধারা তখনও চলমান। খাবার টেবিলে কিছুসময় মৌণ হয়ে বসে বসে এক ঝাঁক ভাবনা ভাবলাম। আমার জীনটা যেন মাঝি ছাড়া নৌকা হয়ে গেছে। কোনো আপন ঠাঁই ঠিকানা নেই। নদীর স্রোত যেদিকে আমিও যেন সেদিকেই চলছি। ভাবতে গিয়ে চোখ জোরা মিইয়ে পরছে যেন। ঘুম ঘুম অভিপ্রায়। এরই মাঝে মনে হলো ছোঁয়ার কথা। কিছু খেয়েছে কি মেয়েটা? একবার কি উঁকি দিয়ে আসবো ও ঘরে? যাওয়াই যায়। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়ালাম। এক কদম সামনে এগোতেই হঠাৎ থমকে গেলাম আমি। আধো আলোতে দেখতে পেলাম কেউ হেটে আসছে ড্রইং রুমের দিকে। বুঝতে অসুবিধা হলো না ওটা স্মরণ। আমি যথাসম্ভব স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলাম। এই আশায় যেন তার নজরে না পরি। মনের ছোট খাটো এই ইচ্ছেটা পূরণ হলো। আমি স্মরণের দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেলাম। মেইন ডোর খুলে সে বেরিয়ে যেতেই আমিও কিছু না ভেবে পিছু নিলাম। তন্দ্রা ভাবটা ছুটে পালিয়ে গেছে। মনে বাসা বেধেছে এক ঝাঁক কৌতুহল। প্রায় দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝুম বৃষ্টির মাঝে কেউ যেন নেই। শুধু স্মরণ হাঁটছে হাতে একটা চর্ট নিয়ে। আমি বিপত্তিতে পরে গেলাম। এই আঁধারে ভয়ে ভয়ে পা ফেলে তবুও কৌতুহলী হয়ে ছুটলাম। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে হলো। এরমাঝে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলো আলো ছড়িয়ে দিলো। ইলেক্ট্রিসিটি অফিসের সেই ভালো মানুষটাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে এগোতে লাগলাম। বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয়ে ওঠা কাপরে ঠান্ডা লাগছিল বেশ। কিন্তু তোয়াক্কা করছি না এখন।

স্মরণের হাতে শুধু টর্চই ছিলো না। ছিলো একটা লাল টুকটুকে গোলাপের গুচ্ছ। সে তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে সেই ফুলটা রেখে দিলো আলগোছে। পরম যত্নে, ভালোবেসে একটা কবরের ওপর। আমি তার থেকে বেশ দূরে দাড়িয়ে দেখতে লাগলাম তার কর্ম। এটাই তার গন্তব্য ছিলো? কবরস্থান! স্মরণ বিরবির করে কিছু বলতে লাগলো মাটির ঘরটায় দৃষ্টি রেখে। আমি তা শুনবো বলে একটু এগিয়ে গেলাম। অস্পষ্ট কন্ঠে বলতে শুনলাম

— আজকের দিনে ছোঁয়া আমাদের কাছে এসেছিল। ওর ছয় বছর হতে চলল। গতবারও তুমি ছিলে। আর এবার? আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হয় অথৈ। সেদিন আমি তোমার সাথে থাকলে হয়তো এতো কিছু হতো না। তুমি আমি আর ছোঁয়া মিলে অনেক সুখে থাকতাম। এতো দ্রুত কেন চলে গেলে বলো? তুমি সেদিন কোথায় গিয়েছিলে সেটাও আমি জানতে পারলাম না। তুমি শুধু একবার বলে যেতে আমাকে। কে আমার গলায় ছুড়ি চা…..

বলতে গিয়ে স্মরণ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো। আমি চমকে উঠলাম। ছু*ড়ি চালিয়েছিলো মানে? অথৈ কে খু*ন করা হয়েছে? আমার গা কাটা দিয়ে উঠলো। স্মরণের মুখে শুনতে পেলাম

— আমি তাদের আরো দ্বিগুণ কষ্ট দিয়ে শেষ করবো অথৈ। আমার ভালোবাসা যারা কেড়ে নিলো তাদের আমি একটাকেও ছাড়বো না। আমাকে যারা খুব কষ্ট দিয়েছে তাদের কাউকে ভালো থাকতে দেবো না। আমাকে যারা তোমার অভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে তাদেরও আমি পুড়িয়ে দেবো।

বলতে বলতে দেহের ভার ছেড়ে দিলো স্মরণ। মাটিতে ধপ করে বসে গিয়ে সে হঠাৎ ভীষণ আবেগ নিয়ে বলে উঠলো

— অথৈ, সবশেষে এটাও তো হতে পারতো। তুমি আমাকে ছেড়ে না গেলেও পারতে। আমার ভীষণ অভিমান তোমার প্রতি।

কন্ঠস্বর বারংবার ক্ষীণ হয়ে আসছে স্মরণের। পুরুষ হৃদয় অসহনীয় দুঃখ গুলো আর ধরে রাখতে পারলো না যেন। অঝোরে নিশ্বাসে বন্ধ চোখে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। আমি অনিমেষ তাকিয়ে দেখতে লাগলাম এই দৃশ্য। সবটাই যেন দরকল্পনীয়। ভাবনার বাহিরে। আমার মাথায় পুনঃপুন একটা শব্দই ঘুরতে লাগলো। মার্ডার, মার্ডার, মার্ডার। চোখে ভেসে ভেসে উঠতে লাগলো কারো গ*লায় ছু*ড়ি বাজানো লাশ। চোখ দু’টো কি খোলা ছিলো? ভাবনার মাঝেই দেখলাম স্মরণ উঠে দাড়িয়ে গেছে। চোখ মুছে সে প্রিয়তমার কবরের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে আসছে। আমি একটু আড়ালে গিয়ে দাড়িয়ে গেলাম। সম্ভব হলো কি বুঝালাম না। পুরো কবরস্থান ঘিরে ছিলো বৈদ্যুতিক আলো। আমি আরো একটু আড়ালে চলে গেলাম। কিন্তু তখনই বাধলো বিপত্তি। হঠাৎ মনে হলো কোনো ঠান্ডা কিছু আমার শরীরে হাত দিলো। আত্মা ধড়ফড়িয়ে উঠলো আমার। কবরস্থান এটা! এ কথা মাথায় আসতেই কিছু না ভেবে, কাল পরিস্থিতি ভুলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ভয়ে জমে গেলাম। আধ বোজা হয়ে এলো আমার চোখ। আমি দৌড়ে সেখান থেকে চলে আসতে চেয়েও পারলাম। হাত পায়ের শক্তির অবনতি। সব যেন হারিয়ে গেলো। লুটিয়ে পরলাম যেন মাটিতে। মাথার মধ্যে তখন আরো একটা ভাবনা খেলে গেলো। এটা কি অথৈ হতে পারে? স্মরণকে বিয়ে করার অপরাধে কি শাস্তি দেবে সে আামকে?

.
— পেশেন্টের হার্ট দূর্বল। মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছে খুব।

এমন কিছুই কর্ণপাত হলো। অনুভব করলাম মাথা ঝিমঝিম করছে। অতঃপর আচমকা মনে পরে গেলো সেই ভীতিকর কাহিনী। ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে আমি চারিদিকে চোখ বুলালাম। এটা তো আমার ঘর? বেডের পাশে দাড়িয়ে আছে ছোঁয়া, স্মরণ আর একজন সুদর্শন পুরুষ। বেশ ভুসা বলে দিচ্ছে সে ডাক্তার।

চলবে……

( ওয়াই-ফাই এর লাইনে সমস্যার কারণে গল্প দিতে দেরি হয়ে গেলো। যাই হোক, ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here