শেষ বিকেলে তুমি আমি-১০

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১০

বসন্তের রোদ মানে সে মিঠা। গায়ে লেগে মনে অন্যরকম ঢেউ তোলে। কোকিলের কন্ঠ শহুরে শোনা ভারি দুষ্কর। তবুও আজ শুনতে পেয়েছি। একটা কোকিল মধুভরা কন্ঠে ডাক দিলো। আমি তখন বসন্তের মিঠা মিঠা রোদ উপভোগ করছি বেখেয়ালি মনে। রিকশা ছুটে চলেছে ব্যাস্ত সরকে। আশপাশ গাড়ির আনাগোনায় পূর্ণ। আমি যাচ্ছি ওয়ারেশিয়ার সাথে দেখা করতে। ও গত রাতে বলল একটা কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হবে। ক্লাস টু-এর বাচ্চাদের পড়াতেও হলেও আমার আপত্তি নেই। বরং বাচ্চাদের সান্নিধ্য আমি উপভোগ করি। তার বসন্তদূতের মতোই মধুর সুরে আলাপ জমাতে পারে। তারা সরল, সহজ বাক দিয়ে মন কেড়ে নিতে পারে। সতেজ করতে পারে দুঃখে ঢাকা হৃদয়।

দশ মিনিটের মতো রিকশায় অবস্থান, অতঃপর চলতি রিকশা থামলো। ভাড়া মিটিয়ে নামতেই ওয়ারেশিয়া চলে এলো আমার নিকট। বাসা থেকে বেরোনো কালেই সে আমাকে বলে দিয়েছিল এই পদ্ম পুকুর ঘাটে আসার কথা।

— স্কুলটাতে আমার এক ফ্রেন্ডও জব করে। এখন ওখানে টিচার খুঁজছে। আজই একবার তোকে স্কুলের পরিচালকের সাথে কথা বলতে হবে। রেডি তুই?

— হ্যা। চল যাই।

— আচ্ছা চল।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা। হাঁটতে হাঁটতে আলাপ। ওয়ারেশিয়া হাঁটতে লাগলো আমার আগে। আমি ওর পিছু পিছু।

— তুই কি এখন সবসময়ই শাড়ি পরে চলাফেরা করিস আপু?

হঠাৎ তার এমন প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলাম। পরক্ষণেই সে ভাব উবে দিয়ে বললাম

— না। এমন কিছু না। আসলে ঐ বাড়িতে আপাতত আমার শাড়ি ছাড়া পরার মতো কিছু নেই।

— ভাইয়া এমন কেন? অন্তত একজন মানুষের খাওয়া দাওয়া, ভরনপোষণের দিকে নজর দেওয়া উচিত। আজব! তোর রাগ লাগে না?

— রাগ করে লাভ কি? নিজের পুঁজি পূর্ণ না থাকলে অন্যেরটা দিয়ে লাভ নেই।

— তুই কি এজন্য চাকরি করবি?

— হয়তোবা।

— তোর শশুর তো অনেক অনুরোধ করে তোকে ছেলের বউ বানিয়ে নিয়ে গেলো। সে তোর খেয়াল রাখে না কেন?

ওয়ারেসিয়ার কথাগুলো বড্ড গভীরে এগোচ্ছিলো। আমি কথার মোর হুট করে পাল্টে ফেলার প্রয়াসে বললাম

— স্কুলের নামটা কি রে?

ওয়ারেসিয়া পূর্বের বিষয় ভুলে নতুন করে কথার জাল বুনতে আরম্ভ করলো। আমি শুনছি তার কথা। পথ ফুরিয়ে আসছে। গন্তব্য নিকটেই। একবার কম্পমান হৃদয় নিয়ে কল্পনা করলাম সেখানকার হেড টিচার আমাকে কি কি প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে। অতি ছোট হলেও ভাইবা পরীক্ষা। জীবনের প্রথম কর্মের জন্য নিজেকে সেখানে তুলে ধারার একটা প্রচেষ্টা।

.
কিন্ডারগার্টেন থেকে বেরোলাম প্রায় এক ঘন্টা পর। ওয়ারেসিয়া ভার্সিটিতে যাচ্ছিল। আমি যেন বিয়ে, সংসার, সন্তান নিয়ে মহা ব্যাস্ততায় প্রিয় ভার্সিটি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার ভীষণ প্রিয় ক্যাম্পাসটাকেই মন থেকে বের করে দিয়েছিলাম। আজ সুযোগ বুঝে ওয়ারেসিয়ার সাথে ভার্সিটিতে যাচ্ছি। নিলু, প্রিয়ার সাথে কতদিন আড্ডা জমে না।

অগোছালো কিছু চিন্তা নিয়ে পৌঁছে গেলাম ভার্সিটিতে। ধীর পায়ে চিরচেনা ক্যান্টিনে গমন করতেই সেই বামের টেবিলটায় বসে থাকা চারজন মানুষ নজরে এলো। আনন্দে কিংবা কোনো এক অদ্ভুত অনুভূতির কারণে আমি অনুভব করলাম আমার চোখ সিক্ত হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে অত্যধিক ছটফটে স্বভাবের প্রিয়ার নজরেআমি পরে গেলাম। ও যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। ঠিক একই ভাবে আমিও। কাটলো যেন একটা মুহূর্ত। অতঃপর আচমকা ছুটে আসতে শুরু করলো।প্রিয়া। আমিও ঠিক তারই মতো। আমিও পরিস্থিতি, সময়, স্থান ভুলে ছুট লাগালাম। প্রায় তিনটে মিনিট প্রিয়র তালিকায় রাখা প্রিয় মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বোবা হয়ে রইলাম। এই বোবাভাব কাটলো নীলিমার কন্ঠে

— সুন্দরী তুই কেন এলি? তোকে ছাড়া কত ভালো ছিলাম আমরা। ক্যাম্পাসে সব ছেলেরা পাত্তা দিতো।

আমি নীলিমার হাতের বাহুতে একটা ইচ্ছাকৃত থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললাম

— ঢং করবি না।

— আগে বল তুই কেন আমাকে এভাবে ঠকালি। কেন আমার ছাড়া অন্য কারো হলি? আমার যত্নে গড়া ভালোবাসার অপমান করছোস? তুই মাইয়া অপরাধী।

প্রতিবারের মতোই শান্তর অশান্ত মনোভাবের কথা। আমি প্রিয়াকে ছেড়ে ওর দিকে কড়া করে নজর তাক করে বললাম

— চুপ ইডিয়ট। একবারও তো খোঁজ নিতে গেলি না। আমি মরে গেলাম নাকি বাচালাম এটা কি খুজতে গেছিস?

সজিব পাশেই ছিলো। সে তার স্বভাবতই সকলকে টেবিলে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলো। গুরু দায়িত্ব পালন করতে আমার জন্য খাবারের অর্ডার করতে গেলো। বাকি সবাই পরলো আমার বিবাহ কাহিনী নিয়ে। তোর নাকি বাচ্চা আছে? কত বড়? জানিস, আমরা তোর চাচার বাড়িতে গিয়ে প্রায় হর্তাল দিচ্ছিলাম। তুই বিয়ের দিন আমাদের কেন জানাসনি? জানালে আমরা এন বুইড়া বেডার সাথে তোর বিয়েই দিতাম না। এই দেখতে কেমন রে? অনেক বেশি বুড়ো? এমন প্রশ্নের মেলা বসলো। আমি মনে দুঃখের রেশমাত্র না রেখে প্রফুল্ল মনে ওদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে লাগলাম। এই একটা জায়গায় আমি কিছু গোপন করতে পারি না। এরাই আমার আরেক পরিবার। আমাকে আগলে রাখার মানুষ। আমার সুখ দুঃখের অংশীদার তারা ভার্সিটির প্রথম থেকেই। তবে ভাবতে অবাক লাগে। কেন যে এই রক্তহীন বন্ধুত্বের বন্ধন ছুটিয়ে চলে যেতে হয় বহু দূর! ফিকে হয়ে যায় স্বভাব। সময়ের সাথে হারিয়ে যায় নিত্য দিনের মুহূর্তে গুলো।

আজ যখন ওরা আমাকে পেয়েই গেলো তখন তাদের আবদার ঘুরতে যাওয়ার। আমিও নাবোধক কোনো মন্তব্য করলাম না। তাদের আরও জানিয়ে দিলাম আমিও নিয়মিত ভার্সিটিতে আসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।

.
সময়টা মন্দ কাটেনি। বরং বেশ ভালো কেটেছে। তবে এই ভালোটার মাঝে কিছু খারাপ হলো। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো স্মরণের সাথে। অকল্পনীয় ছিলো। চট্টগ্রামের ছেলেমেয়ে আমরা। সমুদ্র আমাদের প্রথম ভালোবাসা বলতে গেলে। সেখানেই ঘুরতে গিয়েছিলাম। কোনো এক কারণে বা অকারণে সেখানে হঠাৎ স্মরণও ছিলো। প্রিয়া একটা অঘটন করে বসেছে। আমাকে হঠাৎ সবার মাঝ হতে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল

— দোস্ত, তার সিগারেট খাওয়ার স্টাইল দেখে তাকে আমার মনে ধরেছে।

আমি প্রায় লাফিয়ে দু-হাত পেছনে সরে বলেছিলাম

— তওবা। এমন অসভ্য কাউককে তোর ভালো লাগলো?

সে আমার কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে বলল

— অসভ্য কেন বলছিস? শুধুমাত্র একটা নিকোটিনের কারণে ওমন সুন্দর মানুষটা অসভ্য হতে পারে না।

আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম প্রিয়া পানে। এমন অদ্ভুত কেন মেয়েটা? ভাবনার অতল সাগরে ডুবে ছিলাম। এমন সময়ই প্রিয়া আমার হাত টেনে নিয়ে গেলো তার ভালোলাগার মানুষটার কাছে। সে সমুদ্র পানে তাকিয়ে ছিলো। পায়ের পাতা সমুদ্রের পানির সাথে ডুবি ভাসি খেলায় মগ্ন। প্রিয়া পেছন থেকে ডেকে উঠলো

— এক্সকিউজ মি?

সে যেন বিব্রত হয়ে গেলো। তার পেছন থেকে হলেও অনুমান করলাম সে তড়িঘড়ি করে ফেলে দিলো হাতের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়ানো বস্তুটা। ততক্ষণে আমার শ্বাস নেওয়ার পথ তুলনামূলক কষ্টসাধ্য মনে হয়ে গেছে। এই কষ্টের সাথে যোগ হলো একটা বিড়াট বিষ্ময়। আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো যখন অনাকাঙ্খিত মানুষটা আমাদের মুখোমুখি হলো। ঘুরে দাঁড়াতেই আমাকেও সে লক্ষ্য করে যেন ভীষণ অবাক হলো। সে এই অবাক ভাব দমাতে না পেরে বলে ফেলল

— আপনি? এখানে?

তখনই মুখের ধোঁয়া এসে ছিটকে পরলো আমার নাকে মুখে। হামলা করে কাশির উৎপত্তি ঘটিয়ে দিলো। আমি নাম মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে বললাম

— আপনাকে সভ্য ভেবে আমি অসভ্য হলাম। ছিহ!

প্রিয়া থতমত খেয়ে দাড়িয়ে রইলো। আমি শাড়ির আচলে নাক মুখ চেপে ধরে নিয়ে প্রিয়ার কানের নিকট বললাম

— তুই আর “মনে ধরা” লোক পেলি না? অবশেষে কিনা আমার বুইড়া জামাইয়ের দিকে নজর দিলি? তুইও একটা ছিহ। তোর রুচিও ছিহঃ!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here