শেষ বিকেলে তুমি আমি-১২

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১২

সময়টা বেশ গাম্ভীর্যে পেরুলো। স্মরণের অভিমান ঝড়ে পরা কন্ঠ শুনে বুকটা যেমন ছ্যাৎ করে উঠলো আমার তেমনই স্নিগ্ধ এক শান্তি মনে উদয় হলো। আমার জন্যও এই পৃথিবীতে কেউ একজন আছে। যে বেলা শেষে চায় আমি ঘরে ফিরি। হারিয়ে না যাই তার থেকে দূরে কোথাও। ভাবনার মাঝে স্মরণের পানে চাইলাম। এলোমেলো দমকা হাওয়া থেমে থেমে এসে দোল দিয়ে যাচ্ছে তার অর্ধ সিক্ত চুলগুলো। সমুদ্রের বিশালতার প্রতিচ্ছবি তার চোখে ধারণ করা। লুকানো ব্যাথারা দৃষ্টিতে থৈ থৈ করছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। বরাবরের মতো আজও জানতে ভীষণ ইচ্ছে হলো তার অথৈ এর কি হয়েছিল? কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহসটা হলো না।

— চলুন।

উদাসী স্মরণ আমার কন্ঠ কানে তুলে তাকালো আমার পানে। আজ হঠাৎ কিছু সময় দৃষ্টিতে ধারণ করলো আমাকে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত ভাব অনুভব করলাম। স্মরণের তাতে কিছু এলো বা গেলো না। সে ঘুরে দাড়িয়ে চলতে আরম্ভ করলো। চলার পথে হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল

— শেষ বিকেলে কখনো সমুদ্র পাড়ে হেঁটেছেন?

আমি কিছুটা অবাক হলাম তার প্রশ্নে। পরক্ষণেই কিছু অবাধ্য ইচ্ছে কে প্রশ্রয় দিয়ে তার পাশাপাশি দাড়িয়ে পা বাড়িয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। বললাম

— হেঁটেছি। খুব প্রিয় মানুষের সাথে।

সে যেন আমার থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু শুনলো। একবার আমার দিকে তাকিয়ে পরখ করলো আমাকে। আমি মিথ্যে কিছু বলিনি। এখন যার সাথে হাঁটছি সে কি আমার খুব প্রিয় কেউ নয়?

— আপনার ভালোবাসার মানুষ আছে?

আমি বললাম

— হ্যা আছে।

— তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করলেন?

— এক প্রকার জোর করে। বাধ্য হয়ে। আর আমার পূর্বে নিশ্চয়তা ছিল না। তাকে পাবো কি পাবো না এটা জানতাম না।

— আজ আপনার সাহস কি বেড়ে গেলো? স্মার্টলি সব উত্তর দিচ্ছেন। আগে তো প্রশ্ন করলে চুপ করে থাকতেন।

— মানুষ কি আর চিরকাল একই রকম থাকে?

স্মরণ জবাব দিলো না। নীরবে হাঁটতে লাগলো। আমিও হাঁটছি তার পাশাপাশি। পেটের ক্ষুধা যেন ছুটি নিয়েছে। ভেজা শাড়ি অনেকটা শুকিয়ে গেছে। প্রিয়র পাশে হাঁটার অনুভূতি বুকে মৃদু কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।

— আপনি আমাকে বিয়ে করেছিলেন কেন?

প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম। স্মরণ চোখের দৃষ্টি অনড়ভাবে রেখে জবাব দিলো

— আমি অফিস থেকে এসে শুনি আমার বিয়ে। সেই মুহূর্তে বিয়ে ভাঙতে চেয়েও পারিনি। শুনলাম মেয়ে বাবা মা ছাড়া। বিয়ে ভেঙে গেলে নাকি মেয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে পারে এমন ভয় দেখালো বাবা।

আমি চুপটি করে রইলাম। স্মরণ হাঁটা থামিয়ে দিয়ে দাড়িয়ে পরলো। সমুদ্রের দিকে মুখ করে বলল

— সূর্য ডোবা দেখবেন না? আমার ভীষণ প্রিয়। অথৈয়ের সাথে অনেক বার দেখেছি। তারপরও একই রকম লাগে দৃশ্যটা। ইভেন আরো নতুন লাগে। নতুন কিছু। তাকে ছাড়া দেখতে নতুন নতুন লাগে।

আমি হঠাৎ কিছু বলতে পারলাম না। শুধু অনুভব করলাম পাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষটার বুকে হারানোর ব্যাথা উত্তপ্ত। দহন হচ্ছে তার বুকের মাঝে।

— ছোঁয়া কান্না করবে না?

–নাহ।

আরো কিছু সময় নীরবতা। এরপর স্মরণ আবারও নতুন মোড় নিলো। বলল

— আপনি হাতে চুড়ি পরেন না কেন? বিয়ে হয়েছে আপনার ভুলে গেছেন?

আমি থতমত খেয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালাম।

— আসলে.. চিকন চুড়ি নেই তাই…

আমার কথার ইতি না হতেই সে বলল

— আপনার ডান দিকে একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে। চুড়ি টুরি পড়লে এই দৃষ্টিগুলো থেকে বেঁচে যাবেন অনেকটা।

আমার মনের মাঝে কিছুটা ভালোলাগা কাজ করেছিল। ভেবেছিলাম সে বুঝি আমার প্রতি একটু হলেও নজর দিয়েছে। কিন্তু নাহ! তার শেষোক্ত কথায় ভাঙা মনের জোড়া লাগা টুকরো গুলো পুনরায় ভেঙে গুড়িয়ে গেলো।

— অঙ্কনকে আপনার কেমন লাগে?

ভাবনার মাঝে আমি এমন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলাম। ধ্বক করে উঠলো বুক। কিছুটা স্বশব্দে বললাম

— মানে?

সে শান্ত। শীতল কন্ঠে হিমায়িত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

— কানে সমস্যা আছে?

আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে তার তিরস্কার শুনলাম। সে বলল

— ছেলেটা কিন্তু ভালো। আমার বন্ধু বলে বলছি না। আপনাকে ভালোই রাখবে।

আমার মাথা চড়াও হলো। চোখ ছলছল করে উঠলো আমার। তার অতি নিকটে গিয়ে বললাম

— আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

সে কানের মাঝে শাহাদত আঙুল দিয়ে বলল

— গলার জোর আছে দেখছি। এতো জোরে চিৎকার করার কি আছে? আমি বলছি অঙ্কন ভালো ছেলে। আপনার সাথে বেশ যায়।

আমি এবার রাগ সইতে না পেরে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিলাম। সে বলল

— আজ অঙ্কন আমাকে বলল ‘তোর দুঃসম্পর্কের বোনটাকে আমার পছন্দ হয়েছে বেশ। পেটানোর উপায় বলে দে। অথৈ কে কিভাবে পটিয়েছি এসব শুনলো।

— আপনি এতো খারাপ কেন? এতো অসভ্য কেন? আপনার বউকে নিয়ে অন্য কেউ আজেবাজে বলে আর আপনি এসে আবার আমার সাথে আলতু ফালতু মজা করেন? লজ্জা করে না? অসভ্য লোক।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলাম নির্ভয়ে। রাগে আমার হাত পায়ে কাঁপন ধরে গেলো। সে ভাবনাহীন যেন। কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।

— আমি তো প্রথম রাতে বলেছি আমি আপনাকে বউ মানি না।

এই কথা আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। মিইয়ে পরলাম আমি। ভীষণ নিষ্ঠুর, পাষাণ মনে হতে লাগলো এই মানুষটাকে। আমার মাথায় হঠাৎ কি খেলে গেলো জানি না। তবে স্মরণকে আমি রাগের বশে ধাক্কা দিতে চাইলাম পানির মধ্যে। মুখে বললাম

— আপনি এতোটা খারাপ হবেন এটা আমার কল্পনাতেও ছিলো না। আমি তো সত্যিই পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি আপনার থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার। তার মাঝে আপনি কেন এমন কথা বললেন?

স্মরণ আমার দু’হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে বলল

— আরে বাবা রিল্যাক্স। আমার সব বউ একে একে চলে যাবে আর আমি তা মেনে নেবো এই কথা ভাবলেন কিভাবে? আমার বউগুলো কি মগের মুল্লুক নাকি যে সব নিয়ে যাবে সবাই।

আমি তখন তার বুকে কিল-ঘুষি মারতে শুরু করলাম। দুমদুম করে শব্দ হতে লাগলো। হঠাৎ কানে এলো কারো ব্যাথাতুর শব্দ। আমার চোখের পল্লব দ্বয় আচমকা ভারি লাগছে। বন্ধ মনে হচ্ছে। কেউ বলছে

— ঠাস করে ফেলে দিলে শিক্ষা হবে।

আমি চমকে উঠলাম। চোখ দুটো টানটান করে খুলে ওপরে তাকাতেই দেখি স্মরণের চিবুক। পাশ ফিরে নব্বই ডিগ্রি কোণে তাকালে চোখে ফুটে ওঠে কালো রঙের শার্ট। আমি কি স্মরণের কোলে? ভাবতেই থরথর করে কাঁপন ধরলো শরীরে। তাহলে এতোক্ষণ কেন জগতে ছিলাম? স্বপ্ন? ভাবনার মাঝে যেন ওপর থেকে ঠাস করে নিচে পরে গলাম। শব্দ করে চিৎকার করতে ভুল হলো না। স্মরণ যেন ঠাস করে নিচে নামিয়ে দিয়েছে আমাকে। আমি অবুঝ দৃষ্টি মেলে তাকালাম তার পানে। সে বিরক্ত মুখে বলল

— আজব! মনে হচ্ছে দশ তলা থেকে ফেলে দিয়েছি ওনাকে। মাজার হাড় ক্ষয় করে ছাড়লো। দিনে দুপুরে ঠাস করে পরে পরে যায়।

আমি বুঝলাম না তার কথা। হা রূপ মুখ করে তাকিয়ে রইলাম। সে যেন বুঝললো আমার মনের কথা। বলল

— সমুদ্রের পাড়ে বালুর মধ্যে ঠাস করে পরে গিয়েছিলেন। অজ্ঞান ছিলেন। কোলে তুলে গাড়িতে উঠিয়েছি। আবার কোলে তুলে গাড়ি থেকে নামিয়ে এনেছি। এখন জ্ঞান ফিরেছে তাই নামিয়ে দিলাম। গুণে গুণে পাঁচ কদম পরই আপনার ঘর। আশা করি হেটে যেতে পারবেন।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতো নিষ্ঠুর মানুষ! পুরোটা রাস্তা যদি কোলে তুলে আনতেই পারিস ভাই আর পাঁচটা কদম এগিয়ে একেবারে ঘরে রেখে আসতে পারলি না? আর আমার তো ঠাস করে পরারই কথা ছিলো। না খেয়ে, ভেজা শাড়ি শরীরে চাপিয়ে মাটি ফেটে চৌচির করে দেওয়া রোদের মাঝে দাড়িয়ে ছিলাম। ভাবতে গিয়ে ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। একবার অবচেতন মনে দেখে আসা স্বপ্নটা ভাবলাম। আবার অবলোকন করলাম নিজের অবস্থান। ঠিক দু’টো সিড়ি অতিক্রম করে তিন নম্বর সিঁড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেছে। কমপক্ষে আরো বিশটা সিঁড়ি আমাকে অতিক্রম করতে হবে। অতঃপর আরো পাঁচ পা ফেলে রুমে প্রবেশ করতে হবে। হায়! হায়! কত পথ এখনো চলা বাকি। অতঃপর জ্বলবে ঘরের বাতি।

.
রাতটা পেরোলো জোরজুলুমে। ঠেলতে ঠেলতে যেন পার করালাম। ক্ষুধার্ত পেটে জেলি মাখা রুটি চালান করে দিয়ে শান্ত করলাম তনু মনকে। অতঃপর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতেই কিছু ভালো বার্তা বয়ে এলো। ওয়ারেসিয়া ফোন করে বলল চাকরিটা হয়ে গেছে। আমি যেন আজ থেকেই সে স্কুলে বিদ্যা বিতরণ করি।

চলবে…..

( একটা দোয়া চাই আপনাদের থেকে। কার দোয়া কিভাবে যে মহান রব কবুল করেন তা তো বলা যায় না। আমার ছোট ভাইয়ের হাত ভেঙে গেছে। কনুইয়ের হাড়ের জয়েন্ট আলাদা হয়ে গেছে। একবার অপারেশন করা হয়েছে। শুক্রবারে ব্যান্ডেজ, সেলাই সব খুলে আনা হলো। কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হয়নি। ডাক্তার বলছেন আবার অপারেশন করতে হবে। আপনারা একটু দোয়া করবেন ও যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় 😥 সব যেন আল্লাহ ঠিক করে দেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here