শেষ_বিকেলের_মায়া (১৬)

#শেষ_বিকেলের_মায়া (১৬)

সকাল সকাল ফারিহাকে দেখতে পেয়ে আদীব যেন নিশ্বাস ফিরে পেল। ও ছুটে এসে বলল,”ফারিহা,কল ধরছিলে না কেন?”

মেয়েটি নত মুখে ঘরে প্রবেশ করল। ওর পেছন পেছন এল আদীব ও।

“এই, উত্তর দাও।”

ফারিহা এবার ও চুপ করে রইল। তারপর ই জিনিস পত্র গোছাতে লাগল। আদীব অবাক হয়ে দেখছে।

“ফারিহা।”

উপায় না পেয়ে মেয়েটির বাহুতে স্পর্শ করল আদীব। ফারিহা,পূর্ণ নজরে চাইল। দেখল আদীবের দু চোখের আকাঙ্ক্ষা। অথচ ও নিজের ভেতর থেকে ভালোবাসা খুঁজে পেল না। যা পেল তা কেবল উত্তপ্ত দীঘল শ্বাস।

“তুমি, কোথায় যাও?”

“চলে যাচ্ছি,আদীব ভাই।”

“এভাবে? এটা কেন করছো?”

“প্রয়োজন পড়ে গেল।”

“ফারিহা, তাকাও আমার দিকে।”

মেয়েটিকে নিজের দিকে ঘুরালো আদীব। ফারিহা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,”আদীব ভাইয়া,আপনাকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি। তবে এই শ্রদ্ধার সম্পর্কের সাথে অন্য কোনো সম্পর্ক মিলাতে পারি না।”

সহজ, সরল স্বীকারোক্তি পেয়ে আদীব থম মে রে গেল। ফারিহা বিশেষ কিছু নিল না। প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ পত্র নিয়ে বলল,”আপনার মনের ভেতর আমার জন্য কোনো অনুভূতি থেকে থাকলে আমায় মাফ করবেন। আমি সে অনুভূতির যোগ্য নই।”

তারপর ই বেরিয়ে পড়ল মেয়েটি। যাওয়ার পূর্বে অবশ্য মরজিনার সাথে দেখা করে গেল। আদীব চেয়ে রইল। দেখতে পেল তার আরাধ্য নারী অন্য এক পুরুষের দিকে এগিয়ে চলেছে। যে পুরুষটির নাম রিহান জোয়ার্দার মাহাদী।

মানুষ প্রয়োজনের জন্য সম্পর্ক তৈরি করে থাকে। রিহানের পরিবারের সাথে ফারিহার সম্পর্কটা তেমনই। কি এক যন্ত্রণা বুকের ভেতর লালন করছে মেয়েটি। অথচ, এ জীবনে এমন কিছু সে কি চেয়েছিল? উহু না। রিহান ফুরফুরে মেজাজে। তার ব্যক্তিগত খারাপ লাগা নেই। তার কাছে এখন সবটা রয়েছে। কিয়া বিদেশে ফিরে গেলেও নিয়ম করে কল করে। রিহানের অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না। তবে বাবা মা কে মিথ্যে বলার জন্য ভেতরে অপরাধবোধ জাগে। কিন্তু সে কি নিরুপায় নয়? আর কোনো অপশন কি আছে তার নিকট? সে ভেবে পায় না। ফারিহা মাথা ব্যথা নিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। মায়ের কথা তার মনে পড়ল।

“রিহান স্যার, মা কে কল করা যাবে?”

“এখন তো ওনার চেকাপ চলার কথা। লাঞ্চের পরে কোরো।”

ফারিহা চুপ করে রইল। এই দুনিয়ায় ওর আছে কেবল মা। আর কেউ তো নেই। মানুষটার জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিচ্ছে। তবু শেষ রক্ষা যদি না হয়? হঠাৎ এ ধরনের চিন্তা করে মেয়েটির শরীর শিউরে উঠল। চোখে নেমে এল জল।

নরম তুলতুলে বিছানা। বিশাল ঘর। জিনিস পত্রের খামতি নেই। অথচ ভেতরে ভালো লাগা কাজ করছে না। এই রকম একটা ঘর সকল নারীই কাম্য করে থাকে। তবু কেন যেন শান্তি মিলছে না ফারিহার অন্তরে। সে জানে, এ ঘর দুদিনের। মরিচিকার মতো। এখানে তার সংসার বালি দিয়ে তৈরি। যা একটুখানি বাতাসেই মিলিয়ে যাবে। চিরস্থায়ী জিনিস ব্যতীত কোনো কিছুতেই তার খুব একটা ঝোঁক নেই। মেয়েটি আরাম করে বসল। রুমে একটা পড়ার টেবিল ও রয়েছে। সেখানে এক গাদা বই। দুদিন বাদেই ফারিহার এডমিশন। তার খুব ইচ্ছে,পাবলিকে পড়ার। যদিও রিহান বলেছিল নামজাদা প্রাইভেট ভার্সিটিতে এডমিট করিয়ে দিবে। কিন্তু ফারিহা চায় নি। লাখ লাখা টাকা খরচের দরকার নেই। সে এত বেশি ঋণী হতে চায় না। এমনিতেও রিহান তাদের অনেক টাকা দিচ্ছে। মেয়েটি মনে মনে ভেবে নিল যদি কখনো সামর্থ্য আসে রিহানের সবটুকু টাকা ফিরিয়ে দিবে। যদিও বিনিময় প্রথা মেনেছে তারা তবুও টাকা গুলো ফিরিয়ে দিবে ফারিহা।

“ফারিহা, ফারিহা।”

রুনার কণ্ঠে ওঠে দাঁড়াল ফারিহা। ভদ্র মহিলা এক হাত ভর্তি জিনিস পত্র নিয়ে এসেছেন।

“এগুলো কাবাডে রেখে দাও।”

“এত সব কিছু!”

“প্রয়োজন আছে না? দুদিন পর তো নিয়মিত ভার্সিটি যাওয়া আসা করবে।”

“তবু এত সব।”

“কোনো কথা না। এসব রেখে,খেতে আসো। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।”

ফারিহা আর কিছু বলল না। কিংবা সুযোগ পেল না। প্যাকেট গুলো কাবাডে রেখে ডাইনিং এ এল। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল রিহান। ফারিহাকে দেখে হাসল। ইশারায় পাশের সিটে বসতে বলল। ছেলের এই আচরণ দেখে খুশি হলেন রুনা। অথচ তিনি জানেন না এ নর নারী একে অপরের প্রতি যত ভালোবাসা দেখায় তার সবটুকুই ধোঁয়ার মতো। যা ক্ষণিক বাদেই মিলিয়ে যায়। বাড়ির সহযোগী এসে খাবার রাখল। ফারিহা নিজ থেকেই বলল,”আমি সার্ভ করে দিচ্ছি।”

রুনা বাঁধা দিলেন না। মেয়েটিকে তিনি মন প্রাণ দিয়ে পুত্র বধূ হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

“আপনাকে মাছ দিব?”

রিহান তড়িঘড়ি করে বলল,”না,না। আমি মাছ খাই না।”

“কেন?”

“ভালো লাগে না।”

“খেয়ে দেখুন।”

“ভালো লাগে না। রাখো এটা।”

ফারিহা রাখতেই যাচ্ছিল। রুনা পাশ থেকে বললেন,”খেয়ে দেখ না। মেয়েটা এত করে বলছে। খেলে কি এমন হবে?”

মা কে খুশি করতে গিয়ে প্লেটে মাছ নিল রিহান। অথচ রুনা ভাবলেন ছেলে বুঝি প্রেমিকার কথায় মাছ তুলে নিয়েছে। ফারিহা বুঝল, তার এমনটা করা ঠিক হয় নি। সে নিচু স্বরে বলল,”মাফ করবেন।”

রিহান কিছু বলল না। সে ভেবেছিল রুনার খাওয়া শেষ হলে মাছ উঠিয়ে রাখবে। কিন্তু তিনি আজ খুব ধীরে খাচ্ছেন! অথচ অন্য দিন দ্রুত খাবার খেয়ে নেন। ওর প্লেটের খাবার প্রায় শেষ। অথচ মাছ ধরেও দেখে নি। রুনা বার বার ছেলের প্লেটে তাকাচ্ছেন। মায়ের চাহনি দেখে দম বন্ধ করে মাছে কামড় দিল রিহান। একটু চিবুতেই মনে হলো খেতে খারাপ নয়। সে আরেক কামড় দিল। এবার ভালো লাগছে। তৃতীয় কামড়ে মনে হলো মাছ আসলেই সুস্বাদু খাবার। খুব ছোট সময়ে একবার কাটা বিঁধেছিল রিহানের। সেই থেকে মাছ খাওয়া ছেড়েছে সে। রুনা ছেলের মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে হাসলেন। তিনি উঠে যেতেই ফারিহা বলল‍,”আন্টি চলে গেছে। মাছটা রেখে দিন।”

রিহান গুমোট মুখে বলল,”না। খাচ্ছি,ভালো লাগছে।”

আড়াল থেকে ছেলের কথা শুনলেন রুনা। তিনি বড়ো খুশি হলেন। কতটা ভালোবাসা থাকলে এভাবে অপ্রিয় জিনিস ও গ্রহন করে মানুষ?

খাবার খাওয়া শেষে রিহানের পেছন পেছন আসছিল ফারিহা। সেটা দেখতে পেয়ে রিহান বলল,”কিছু বলবে?”

“মায়ের সাথে কথা বলব।”

রিহান টাইম দেখে বলল,”আচ্ছা।”

তারপর সে যোগাযোগ করিয়ে দিল। ফাহিমার সাথে মোবাইল ফোন দেওয়া হয় নি। নিয়মিত চেকাপে রাখা হচ্ছে। ফোন সাথে থাকলে দিনে একাধিক বার মেয়ের সাথে কথা বলবেন। যা এ অবস্থায় একদম ই ঠিক নয়।

আদীব একটা শান্ত নদীর তীরে এসে বসেছে। ওর জীবনটা কেমন উলোট পালোট হয়ে গেল। ফারিহার প্রতি তার অনুভূতি আসলেই কি অযৌক্তিক? ও ভেবে পায় না সামনে কতটা আশা রাখবে।

“আদীব, আদীব, আদীব।”

ছুটে এল মিরাজ। তার মুখে হাসি। হাতে লেটার।

“কি হয়েছে? সব ঠিক আছে?”

“আরে দোস্ত, তুই তো এক ধাক্কায় উঠে গেলি।”

আদীব ঠিক বুঝল না কি এমন ঘটেছে। মিরাজ হাতে থাকা লেটার টা এগিয়ে দিয়ে বলল,”দেখ।”

সে দেখল তার করা প্রজেক্ট টা একটা বড়ো কোম্পানির পছন্দ হয়েছে। তারা ওর সাথে চুক্তি করতে যায়। মাসিক বেতনটাও কম নয়। কয়েক লক্ষ টাকার বেতনের চাকরিটি নিশ্চয় ফেলনা নয়। শত সাধনা করেও এ চাকরি পায় না মানুষ। অথচ আদীব নাকোচ করে দিল। মিরাজ অবাক হয়ে বলল,”কি বলছিস তুই?”

“জব টা করব না।”

“ভাই, এটা কি বলিস? চার লাখ টাকা বেতন! এর পর আরো বাড়বে। এটা জাস্ট বিগেনিং স্যালারি।”

আদীব মলিন হাসল। টাকা পয়সা এমনকি এই দুনিয়ার প্রতিও সে কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বুকের বা পাশ টা খালি হয়ে গেল।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here