শেষ_বিকেলের_মায়া (৩)

#শেষ_বিকেলের_মায়া (৩)

ফারিহা রুমে যেতেই রিহান বেডে গিয়ে বসল। মেয়েটা নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সে মানুক আর না মানুক এখন রীতি মতো রিহানের গোলাম সে। রিহান যা বলবে তাই করতে হবে। রিহান ভ্রু কুঁচকে ফারিহাকে দেখতে লাগল। মেয়েটা কেমন যেন! একটা কথা দশ বার করে বলতে হয়। হাজার চেষ্টা করে ও নিজেকে দমাতে পারছে না ফারিহা। এক হাতে জামা খামচে ধরল। একটু পর হয়ত পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্টতম আচরণে সায় দিতে হবে। ভাগ্য বড় বিচিত্র রঙা। রিহান ধীর পায়ে এগিয়ে আসল। ফারিহা জড়সড়ো হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। রিহান যত এগোচ্ছে বুক টা তো পুড়ছে। চোখ দুটো কেমন ভিজে যাচ্ছে। রিহান ফারিহার কাছে এসে গলা থেকে এক টানে ওড়না টা নিয়ে গেল। ফারিহা নিজেকে আড়াল করতে চেয়ে ও করল না। শুধু চোখ বুঝে ঠোঁট কামড়ে রইল। গায়ে কোনো স্পর্শ না পেয়ে অবাক হলো। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে দেখল রিহান ওড়না টা সুন্দর করে ভাঁজ করছে। চোখে মুখে বিরক্তি। পুরো বিষয় টা ফারিহার মাথার উপর দিয়ে গেল। রিহান ভাঁজ করা ওড়না টা ফারিহার কাঁধের এক দিকে দিয়ে দিল। সাথে চুল গুলো খুলে ফেলল। তিন ভাগের এক ভাগ চুল এনে অন্য পাশে দিয়ে দিল। মেয়েটা এখনো অবাক চোখে রিহান কে দেখছে। ও কি ভেবেছিল আর কি হলো। রিহান ঠোঁটে দাঁত চেপে ফারিহাকে দেখে নিল।
“নাউ পারফেক্ট।”

“স্যার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“আমাদের ছবি তুলতে হবে। লাইক বয়েফ্রন্ড গার্লফ্রেন্ড। তোমাকে তো হাতে ধরে সব শিখিয়ে দিতে হয়।”

একটু লজ্জা পেল ফারিহা। তাকে দু বার বলার পর ও বুঝে নি সে। তাই রিহান নিজ থেকে ঠিক করে দিল। ছবিল কথাটা মাথায় আসতেই ফারিহা বলল,”কেন? ছবি কেন তুলতে হবে?”

ফারিহার প্রশ্নে বিরক্ত হলো রিহান। তবু ও নিজেকে ঠান্ডা রেখে বলল,”আমার মম ড্যাড কে দেখাব। আর তার আগে ছবির ডেট গুলো চেঞ্জ করতে হবে। আমার মম ড্যাড জানে যে তোমার সাথে এক বছর ধরে আমার রিলেশন।”

“ও কিন্তু আমার সাথে তো…”

“স্টপ। অনেক কথা বল তুমি। মনে রাখবে,বেশি কথা বলা আমার একদম ই পছন্দ নয়। তোমাকে পরে সব বুঝিয়ে দিব। এখন আসো আমার সাথে।”

ফারিহা মাথা ঝাঁকাল। নিঃশব্দে রিহানের পিছু চলছে এখন। সাথে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল। যে ভয় টা ছিল সেটা কেটে গিয়েছে। স্বস্তির নিশ্বাস টা যেন বুকের পাথর টা নামিয়ে দিল।

ফারিহার পাশা পাশি বসে , দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভাবে ছবি তুলল রিহান। এই ছবির ডেট গুলো চেঞ্জ করতে হবে। অনেক অনেক কাজ। তার মম ডেড অত্যন্ত চঞ্চল ব্যাক্তি। ধরা না খেলেই হয়। প্রায় আধ ঘন্টা পর ছবি তুলা শেষ হলো। ফারিহা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রিহানের কাছাকাছি অবস্থান করতে এতটা অস্বস্তি হচ্ছিল তার! রিহান ছবি গুলো দেখতে দেখতে বলল‍,”ওকে আজকের জন্য ডান , তুমি এখন আসতে পারো।”

ফারিহা মলিন হেসে মাথা ঝাঁকাল। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কিছু দূর যেতেই পুনরায় রিহান ডেকে উঠল।

“এই শোনো।”

“জি স্যার?”

“তোমরা বাসা এখান থেকে কতদূর?”

“১০ কিলোমিটার প্রায়।”

রিহান ঘড়িতে টাইম দেখল। সাড়ে দশ টা বাজে অলরেডি। এত রাতে মেয়েটার একা যাওয়া টা রিস্ক এর হবে। তাই বলল,”আমি তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।”

“আমি একাই যেতে পারব।”

“হুস, কাম উইথ মি। তাছাড়া তোমার বাসা চেনার প্রয়োজন আছে। যদি পালিয়ে যাও।”

কথা শেষেই হাসল রিহান। পুরোটাই মজার ছলে বলেছে সে। ফারিহা আর কথা বাড়াল না। রিহানের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। তবে গাড়ির কাছে এসে বেশ দ্বিধায় পড়ল। ফ্রন্ট সিটে বসবে নাকি পেছনে? এই ছোট্ট সমীকরনটা কিছুতেই মিলাতে পারল না। রিহান ড্রাইভিং সিটে বসে বলল,”উঠ।”

ফারিহা আমতা আমতা করতে লাগল। ওর অস্বস্তির কারণ বুঝতে পারল না রিহান। বিরক্তিতে ভরে উঠল তার মুখশ্রী। এভাবে এর সাথে এক বছর থাকতে হবে ভাবতেই কেমন লাগছে।

“কি হলো? উঠ না কেন?”

“আমি কোথায় বসব?”

“সিটে বসবে। এটা কি বলে দিতে হয়?”

“না মানে আমি কোন সিটে?”

ফারিহা কে হাত দিয়ে কথার মাঝ পথেই থামিয়ে দিল রিহান। মাথার চুল গুলো তে হাত বুলিয়ে নিল। ফ্রন্ট ক্যামেরায় নিজে কে দেখতে দেখতে বলল,”ফ্রন্ট সিটে আসো। যখন আমার সাথে যাবা ফ্রন্ট সিটেই বসবে। নাটক সিনেমা দেখে না নাকি?”

“জি? কি বললেন?”

রিহান যেন বিরক্ত হলো। এই মেয়েকে বোঝানো তার কর্ম নয়।

“উঠ প্লিজ। লেট হচ্ছে।”

ছোট্ট করে হুম বলে ফ্রন্ট সিটে বসল যুবতী। ফারিহার থেকে লোকেশন জেনে নিয়ে রিহান ড্রাইভ করছে। অনেকটা পথ চলার পর ফারিহা বলল, “স্যার গাড়ি থামান।”

“কেন?”

“সামনে গাড়ি ঘোরানোর ব্যবস্থা নেই।”

রিহান ভ্রু কুঁচকে গাড়ি থামিয়ে দিল। সামনের দিকে সরু একটা ইটের রাস্তা গিয়েছে। চার পাশে চোখ বুলিয়ে যা বুঝল এটা কোনো বস্তি এলাকা। রিহান তপ্ত শ্বাস ফেলে গাড়ির ব্রেক কষল। ফারিহা গাড়ি থেকে নেমে বলল,”এখান থেকে আট নাম্বার বাসায় আমি থাকি।”

“আচ্ছা। ফোনটা সবসময় অন রাখবে। টাইম ওয়েস্ট একদম ই পছন্দ নয় আমার।”

“জি স্যার।”

বলেই সামনের দিকে হাঁটা লাগাল মেয়েটি। রিহান হঠাৎ করেই গাড়ি থেকে নেমে এল। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকাল ফারিহা। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“স্যার কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ।”

“জি স্যার বলুন।”

রিহান পকেট থেকে টাকার বান্ডেল বের করল। ফারিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পঞ্চাশ হাজার টাকা।”

“স্যার আপনি তো বলেছিলেন।”

“হু তোমার মায়ের ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা আমি ই করব। এটা আজকের জন্য। আমাদের এগ্রিমেন্ট এ ছবি তোলার বিষয়টা ছিল না।”

ফারিহা মাথা নিচু করে ফেলল। এই টাকা নেওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে তার নেই। তবু ও টাকা টা নিল। এক প্রকার মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধ ই চালিয়েছে। ধন্যবাদ জানাল সে। দুজন দু দিকে হাঁটতে লাগল। দুজন দু দিক থেকে এক পা করে বাড়ালেই দুজনের মাঝের দুরুত্ব বেড়ে হচ্ছে দ্বিগুন।

ঘরে আসতেই মায়ের কাশির খ্যাক খ্যাক শব্দ ভেসে আসল। হুমড়ি খেয়ে মায়ের কাছে বসল ফারিহা। মা হালকা পিট পিট করে তাকালেন। অসুস্থ শরীর একা একা কিছু করতে ও পারেন না। ফারিহা টেবিল থেকে পানির গ্লাস ভর্তি করে নিল। মা কে উঠিয়ে মুখের সামনে গ্লাস ধরতেই ঢক ঢক করে গিলে নিলেন। ওড়নার কোণ দিয়ে মায়ের মুখ মুছিয়ে দিতেই রুগ্ন কণ্ঠে মা বললেন,”কোথায় গিয়েছিলি ফারিহা?”

“একটু বাইরে ছিলাম মা। বলেছিলাম না একটা কাজ পেয়েছি। ঐ টার জন্য ই গিয়েছিলাম।”

কাঁপা হাতে মেয়ের সমস্ত মুখে হাত বুলালেন। ফারিহার দৃষ্টি স্থির। তবে মায়ের হাল চাল বুঝে উঠতে পারল না।

“কিছু বলবে মা?”

“আমি জানি তুই কোনো বাজে কাজের সাথে যুক্ত নেই। তবু ও এত রাতে কি কাজ থাকতে পারে?”

“একটা মিটিং ছিল মা। যে স্যার আমাকে কাজ দিয়েছিলেন তার ই সাথে মিটিং এ ছিলাম।”

মা হয়ত কথাটা বিশ্বাস করলেন। তবে কোথাও একটা চাপা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। মলিন মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। এ যে তার গর্ব। অথচ ফারিহার জন্মের পর ওর দাদি দু চোখে সহ্য করতে পারেন নি। দাদা সব সম্পত্তি থেকে বহিষ্কার করলেন। আর বাবার টাকা পয়সার বেশির ভাগ অংশ ছিল দাদির কাছে। সেটা ও দিলেন না। এক কাপড়ে সবাইকে বের করে দিলেন ওনারা। সেসব ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন করে উঠল।

ফারিহার মায়ের দু চোখ নোনা জলে ভরে উঠল। ছেলে হলেই কি সুখ হয়? এই যে তার মেয়েটা তার কাছে সুখের দুনিয়া। এত কষ্টের মাঝে ও মেয়েটার মায়াবি মুখ খানা হৃদয়ে শীতল আবহাওয়া এনে দেয়।

মায়ের অশ্রু সিক্ত মুখটা দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফারিহা। মায়ের ভেজা পাপড়ি তে হাত রেখে বলল,”কাঁদছ কেন?”

“তুই খুব ভালো মেয়ে রে মা। আমার জীবনে দেখা সেরা সন্তান তুই।”

ফারিহা ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটো কেমন ভেজা ভেজা লাগছে। চোখ খিচে পানি আটকাল সে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,”মাস খানেক এর মধ্য ই আমি তোমাকে সিঙ্গাপুর পাঠাব মা। তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে। এত চিন্তা কর না তো।”

“সিঙ্গাপুর। এত টাকা পাবি কোথায়?”

“স্যার তোমার সমস্ত চিকিৎসার খরচ দিবেন। এই যে আজ ও পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছেন।”

টাকা গুলো মায়ের হাতে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল ফারিহা। মা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। এত টাকা কেন দিবে কেউ! কি এমন কাজ করে ফারিহা?

চলবে…
ফাতেমা তুজ নৌশি

পর্ব (৪)
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=307642901796611&id=100076527090739&mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here