শ্রাবণের শেষ সন্ধ্যা পর্ব ১২

#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#১২তম_পর্ব

এর মধ্যেই তার মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠে। লক খুলতে তার এসিসটেন্ট আবিদের মেইল। মেইল এসেছে দেখেই বুকটা ধক করে উঠে শান্ত এর। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে মেইলটা ওপেন করে সে। মেইল ওপেন করতেই কিছু সিসি টিভি ফুটেজের ফাইল দেখতে পেলো শান্ত। হাতে থাকা অর্ধপুড়ানো সিগারেটটি রেলিং এ চেপে নিভালো শান্ত। এবার একে একে ফুটেজগুলো দেখতে লাগলো সে। ধীরে ধীরে ভ্রু কুঞ্চিত হতে লাগলো তার। একটা সময় কপালের বা পাশের শিরাটা ফুলে উঠলো। মিথ্যে তার মোটেই সহ্য হয় না। আর নীতি সেই কাজটি ই করেছে। নবনীতা এবং নীলয় শেষ যে দোকান থেকে শপিং করছিলো তার সিসি টিভি তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীতি এবং নবনীতা একই সাথে দোকান থেকে বের হচ্ছে। তবুও নীতি মিথ্যে কথা বলেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেনো? কি কারণ ছিলো মিথ্যেটা বলার? কি লুকাতে চাচ্ছে নীতি?

শান্ত একে একে প্রতিটি ফুটেজ চেক করতে থাকে। সারা মলের যেখানে যেখানে নবনীতার ফুটেজ রয়েছে আবিদ সবগুলো ফুটেজ ই যোগাড় করেছে। শুধু সিড়ির জায়গাটির কোনো ফুটেজ নেই। কারণ ঐ সিড়িতে কোনো সিসি টিভি ক্যামেরা ছিলো না। গ্যারেজের একটা সিসি টিভি ও পাঠিয়েছে আবিদ। এটা শুধু মাত্র মলের সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট জানে। এই ক্যামেরা থেকে গ্যারেজের একটি পাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই ফুটেজটা সেদিন শান্তদের দেখা হয় নি। শান্ত ফুটেজটা অন করে। বেশ কিছুক্ষণ পর হুট করে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো শান্তের। উত্তেজনায় তার শরীর ঈষৎ কাঁপছে। সে রিভাইন্ড করে পুনরায় ক্লিপটা চালালো। স্পষ্ট সেখানে নবনীতাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে যেতে দেখা গেলো। মাথায় হাত দিয়ে পা টেনে টেনে সে হেটে গেলো। তার অবস্থা বিধ্বস্ত। সে বারবার পেছনে ফিরছে তার মুখে ভয়ের সূক্ষ্ণ ছাপ। তার পর তাকে আর দেখা যাচ্ছিলো না। স্বাভাবিক নবনীতাকে যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে কোনো সিসি টিভি ফুটেজ ছিলো না। শান্ত ফুটেজটি বার বার দেখতে থাকলো। নবনীতা বলেছিলো সিড়িতে সে জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু এখানে স্পষ্ট গ্যারেজ অবধি সে হেটে যাচ্ছিলো। যদিও আহত, কিন্তু জ্ঞান তার ছিলো। তবে কি নবনীতা শান্তকে বিশ্বাস করতে পারছে না? অবিশ্বাসের কারণে তাকে ঘটনা বলতে পারছে না? আর কে ছিলো সে ব্যাক্তি যে নবনীতার পিছু করছিলো? অনেকক্ষণ ফুটেজ দেখার পর ও সেখানে কোনো মানুষের ফুটেজ নেই। নবনীতার পর যে দুজন ওখানে উপস্থিত হয় তারা হলো নীলয় এবং শান্ত। তাদের গ্যারেজে ঢোকার ফুটেজ রয়েছে।

শান্তের মাথা কাজ করছে না। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন ঢেউ তুলছে। ঘাড় কাত করে আড়চোখে তাকালো সে নবনীতার দিকে। নবনীতার করা কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। সে স্নেহাকে বকছে। মেয়েটি আজকেও বানাতে ভূল করেছে। “is” এর পরিবর্তে “in”। এতো কিছুই না, “business” এর জায়গায় “buisness” আর “women” এর জায়গায় “womans”। সে স্নেহাকে প্রতিদিন শুধরে দেয়, তবুও আজ একই ভুল। শান্ত শীতল দৃষ্টিতে নবনীতা দেখতে থাকে। অনেক প্রশ্ন জমে আছে, কিন্তু উত্তর দেবার মানুষটি ই রাজী নয়। শান্ত নীতির একটা ছবি আবিদকে মেইল করলো। তারপর তাকে ফোন করলো। আবিদ ফোন রিসিভ করতেই বললো,
“আবিদ, আমি এক সপ্তাহ ঢাকার বাহিরে থাকবো। আমার অবর্তমানে আমার কাজগুলো তুমি দেখে রাখবে। আর একটি ছবি পাঠিয়েছি। ওর ইচ এন্ড এভ্রি ডিটেইল আমি চাই। কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে দেখা করছে, সব কিছু?”
“কিন্তু স্যার…”
“কিসের কিন্তু?”
“স্যার আমি তো বোমক্যাশ বক্সীর অজিত নই। আমাকে দিয়ে এসব গোয়েন্দার কাজ গুলো না করালেই নয়?”
“আমি তো শুধু শুধু তোমাকে মাসের পর মাস পঞ্চাশ হাজার টাকা দেই না অজিত, সরি আবিদ। আমার লেফট হ্যান্ড না হতে পারলে, কাজ ছেড়ে দাও।“
“সরি স্যার।“
“মনে থাকে যেনো।“

বলেই ফোন কেটে দেয় শান্ত। আবিদের মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেলো। পাশ থেকে তার বউ দোলা বলতে লাগলো,
“এই রাতেও কি কাজ বাপু? একদন্ড সময় কাটাবো, তার ও উপায় নেই। ধ্যাত”

বলেই মুখ গোমড়া করে পাশ ফিরে দোলা। আবিদ মনে মনে কিছুক্ষণ গালমন্দ করলো শান্তকে। লোকটার আন্ডারে কাজ করা পৃথিবীর সবথেকে কঠিন কাজ। অবশ্য যা বেতন দেয় তাতে একটু ওভারটাইম করাটা পাপের কিছু নয়। শুধু টাকাটার কথা ভেবেই চাকরিটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। নয়তো এমন আখাস্তা লোকের সাথে কেউ ই কাজ করতো না। এখন বউটাও চটে গেছে। আবিদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর দোলার রাগ ভাঙাতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। সংসারে আর যাই হোক মা কিংবা বউ কে চটানো যাবে না। নারী চটলে সংসারে আগুন, আর সেই আগুনে বেগুন ভাজা হয়ে যায় পুরুষের জীবন। তাই বউ কে এখন মাখন দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখাটাই উত্তম_____________

রাত দশটা,
আবদুল্লাহপুর বাস টার্মিনাল থেকে বাসে উঠে শান্ত এবং নবনীতা। তাদের লাগেজ গুলো সুপারভাইজার সাহেব একে একে ল্যাভেল লাগিয়ে বক্সে রাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সামিয়া, স্নেহা এবং হেনা বেগম এসেছেন তাদের সি অফ করতে। মারুফ অফিসে থাকায় সে এখনো আসে নি। নবনীতা জসীম সাহেব এবং শারমিন বেগমের সাথে কথা বলে বাসে উঠে পড়লো। জসীম সাহেব খুব ই খুশী, তার মেয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। সে তার নতুন জীবনে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগছে তার। হেনা বেগমের মুখে উজ্জ্বল হাসি, তবে উনার থেকে বেশি খুশি স্নেহা। হোম ওয়ার্ক দিলেও সাতদিন চাচী পড়া ধরবে না। সে ইচ্ছে মতো কার্টুন দেখতে পারবে। চাচী তাকে মায়ের থেকেও অধিক শাসনে রাখে। কার্টুন দেখতে দেখলেই চোখ রাঙ্গিয়ে বলবে,
“স্নেহা হোম ওয়ার্ক কমপ্লিট?”

এই সাতদিন চাচীর এই বকা আর শুনতে হবে না। খুশিতে তার লাফাতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু দাদীজান বকবে। তাই সে লাফাবে না। হেনা বেগম সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাসায় যেয়ে আমার রুমে একটু এসো তো, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।“

শাশুড়ীর কথায় বেশ চমকে যায় সামিয়া। ধুরু ধুরু ভয়ে কাজ করছে, কি কথা বলবে হেনা বেগম।

বাস ছেড়েছে বিশ মিনিট হয়েছে। এজেন্সির ট্রিপে মোট বিশজন যাত্রী। সাথে ড্রাইভার, গাইড এবং সুপারভাইজার। এসি বাস, পিচের রাস্তার বুকে চিরে চলছে নিজের গন্তব্যে। এসি বাসে চড়ার অভ্যাস নেই নবনীতার। তাপ কম হওয়ায় ঠান্ডা করছে। বাহিরে আবহাওয়াও নরম। সন্ধ্যা থেকে এক নাগারে দু ঘন্টা বৃষ্টি হয়েছিলো। তাই আবহাওয়া খুব শীতল। তার মাঝে এসি বাস হওয়ায় ঠান্দার প্রকোপ বাড়লো। নবনীতা ওড়নাটাকে শালের মতো পেঁচিয়ে নিলো। মাথা রাখলো বাসের জানালায়। কি অদ্ভুত না! একটা সময় মধ্যরাতে এই ঘোরাঘুরি নিয়ে কতই না আলাপ আলোচনা করতো নীলয় এবং সে। টানাটানির সংসার হবার কারণে কখনো ঢাকার বাহিরে যাওয়া হয় নি নবনীতার। তাই নীলয়ের কাছে আবদার করেছিলো, বিয়ের পর যেনো মেঘের রাজ্যে ঘুরতে নিয়ে যায় তাকে। নীলয় তখন আদুরে স্বরে বলেছিলো,
“মহারানীর ইচ্ছে সবার আগে। যদিও আমার সমুদ্র ভালো লাগে, তবে তোমাকে মেঘের রাজ্য সাজেকই ঘুরতে নিয়ে যাবো নীতু। বিয়েটা হোক। তোমার সব আবদার আমি পূরণ করবো।“

আবদারটা আবদার ই রয়ে গেলো। মানুষটাই হাতটা ছেড়ে দিলো। আজ সে সাজেক ঘুরতে যাচ্ছে, কিন্তু পাশে একজন অন্য মানুষ। কথাগুলো ভাবতেই বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। চোখের কোনে বিষাদের ঢেউ উঠলো। চাপা কষ্ট ছড়িয়ে গেলো অজান্তেই। চোখ বুঝে নিলো নবনীতা। এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো শ্যামলীর গাল বেয়ে। শান্ত দেখে ও না দেখার ভান করলো। মোবাইলের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো। তারা হানিমুনে যাচ্ছে, অথচ দুজনের মধ্যে কোনো আমেজ নেই। বাকি যাত্রীরা বেশ হৈচৈ করছে। তাদের মধ্যে দু জোড়া রয়েছে চল্লিশোর্ধ দম্পতি। তারাও যাচ্ছে ঘুরতে। একটা বন্ধুমহল হয়েছে বারো জনের। তাদের উল্লাসের অন্ত নেই। তারা গিটারে সুর তুলেছে, গান গাইছে এক সাথে,
“আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দু’জনে
চলো না ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।
চলো না ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।“

কিন্তু বাসের সর্বোশেষ সিটে বসে থাকে দম্পতির মাঝে কোনো আমেজ নেই। একজন ফোন স্ক্রল করছে তো অপরজন অতীতের স্বর্নালী মূহুর্ত গুলোকে স্মরণ করে কাঁদছে।

নবনীতার ঘুম ভাঙ্গলো ভোরে। বাস তখন খাগড়াচড়ির আঁকাবাকা সরু পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রাতে বেশ শীত করছিলো, এখন শীতটা করছে না নবনীতার। তার গায়ে কম্বল টেনে দেওয়া। যতদূর মনে পড়ে সে কম্বল নেয় নি ঘুমানোর সময়। সত্যি বলতে কখন ঘুমিয়ে গেছে তার মনে নেই। নবনীতা পিটপিট করে চোখ খুললো। চোখ খুলতেই এক মাতাল কড়া গন্ধ নাকে এলো তার। বেশ সুন্দর মাতাল কড়া গন্ধ। মাথা তুলতেই…………

চলবে

[অসুস্থ হবার কারণে একটু ছোট করে দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল পুষিয়ে দিবো।পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে দিবো। কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here