শ্রাবণের শেষ সন্ধ্যা পর্ব ৮

#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#৮ম_পর্ব

বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় নবনীতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে শান্ত। নিজের ভাইয়ের উপর কেনো যেনো মেজাজ খারাপ লাগছে তার। তবে নবনীতার জন্য একটা খারাপ লাগা কাজ করছে। সারাটা রাস্তা মেয়েটা বাহিরেই তাকিয়ে থাকে, তেজী মেয়েটাকে এভাবে পাথর হতে দেখে শান্তের অস্বস্তি বেড়েই যায়। সে কাউকে শান্তনা দিতে পারে না। পারলে হয়তো প্রথম মানুষটা নবনীতা হতো। জড়ো পদার্থের মতো বাসায় ঢুকে নবনীতা। নবনীতা বাসায় ঢুকতেই জানতে পারে জসীম সাহেব উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন। বাবার শরীরের অবস্থা শুনেই ছুটে যায় বাবার রুমে। জসীম সাহেব তখন বিছানায় শায়িত। দীপু পেশায় ডাক্তার হওয়ায় তৎক্ষাণিক চিকিৎসা পেতে অসুবিধা হয় নি। অতিরিক্ত চিন্তা জসীম সাহেব নিতে পারেন নি; একেই হাই প্রেসারের রোগী উপরে এতো টেনশন না নিতে পারায় শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। দীপু তাকে ওসারটিল ৫০ খাওয়িয়ে দিয়েছে। এখন তার প্রেসারটা নর্মাল। নবনীতা ছুটে বাবার কাছে গিয়ে বসে। মেয়ের এমন মলিন মুখখানা দেখে হুহু করে উঠে বাবার বুক। হয়তো সে ধনী নয়, তবে মেয়েটাকে কখনো কষ্ট পেতে দেয় নি জসীম সাহেব। বিলাসীতা না দিলেও তার মেয়েকে আদরের আচ্ছাদনে রাখার চেষ্টা ছিলো তার সর্বক্ষণ। মানুষ ঠিক বলে,
“বড় সন্তানদের প্রতি বাবা মার মনের একটা কোনা ফাঁকা থাকে।“

নবনীতা জসীম সাহেবের বড় সন্তান। তাই তার প্রতি ভালোবাসাটা ছোট ছেলে নিশাদের থেকেও বেশি। নিজ কন্যাকে এরুপ বিধ্বস্ত দেখার সাদ ইহজীবনে তার ছিলো না। অথচ ভাগ্যের নির্মমতা; তার তেজী মেয়েকে তার কাঁচের মতো ভেঙ্গে যেতে দেখতে হচ্ছে। জসীম সাহেবের হাতটা দু হাতে ধরে নবনীতা। কেনো যেনো খুব কষ্ট হচ্ছে। কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে। কাঁদতে না চাইলেও চোখটা জ্বালা করছে। সে এতোটা দূর্বল কখনোই ছিলো না। অথচ আজ নবনীতা দূর্বল। খুব দূর্বল। বাবা-মেয়ের মাঝে কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধু চাহনিতেই তারা একে অপরের সাথে ভাবনার বিনিময় করছে। জসীম সাহেব শ্লেষ্মাজড়ানো কন্ঠে শুধু এটুকুই বলে,
“যে তোমার মর্ম বোঝে নি, সে চলে গেছে এটাই শ্রেয়। আল্লাহ হাতে ধরে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। যদি বিয়ের পর এমনটা হতো কি করতাম আমরা?”

নবনীতা নত মাথায় বসে থাকে। বাবা ঠিক বলছে। তবুও কষ্ট যে কমতে চাইছে না। কিসের এতো কষ্ট! অবশয় এটা তো চিরন্তন সত্য ছিলো,
“যে ভালোবাসার গল্পের সূচনা সুন্দর হয়, তার শেষ পাতাটার সমাপ্তি বেদনা দিয়েই হয়”

তার এবং নীলয়ের গল্পটার সূচনাও অতি মধুর ছিলো। কিন্তু নিষ্ঠুর প্রতারণা এবং নীল বিষাক্ত বিষাদই হলো তাদের গল্পের শেষ লাইন। জসীম সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। কঠোর কন্ঠে বললেন,
“তুমি চিন্তা করো না, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করেন।“
“মেয়েটার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, এতে কি ভালো হয়েছে? বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে। সবাই তো বলবে খুঁদ আমার মেয়ের। কেউ তো নীলয়ের দোষ দেখবে না।“

কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে উঠেন শারমিন বেগম। শারমিন বেগমের কথায় মাথা নত হয়ে যায় প্রিয়া বেগমের। ছেলেটা বিয়ের দিন কেনো এমন কাজ করলো কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তিনি। জসীম সাহেব শারমিন বেগমকে কড়া স্বরে বলে,
“এতো কান্নার কি আছে? আমার মেয়ে কি ফেলনা? আর উপরে একজন আছেন। উনি সব দেখছেন।“

তার কথা শেষ না হতেই হেনা বেগম বলে উঠেন,
“জসীম ভাই, আমি একটা বলতে চাই।“

হেনা বেগমের কথা শুনে জসীম সাহেব তার দিকে তাকান। সবার দৃষ্টি তার দিকে। হেনা বেগম এতোক্ষণ চুপ ছিলেন। এতো কিছু হয়ে যাবার পর ও তিনি শান্ত ছিলেন। নির্বাক দর্শকের মতো সবটা দেখেছেন। কিন্তু এখন আর চুপ থাকতে পারলেন না তিনি। তাই স্পষ্ট কন্ঠে বললেন,
“আমাদের ছেলের বাচ্চামির জন্য আজ আপনাদের এতোটা হেনস্তা হতে হয়েছে। আমি তার জন্য আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।“

কথাটা বলার সময় প্রিয়া বেগমের দিকে আড়চোখে তাকান তিনি। তার তীর্যক চাহনীতে প্রিয়া বেগমের গলা শুকিয়ে আসে। তারপর একটু থেমে আবার বলেন,
“আমি জানি আমার ক্ষমাতে হয়তো এই অপমানটা মিটবে না। আবার নবনীতার ও জীবনটা গুছিয়ে যাবে না। ওর কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। তাই একটা প্রস্তাব দিতে চাই। আমি চাই আমার ছেলের সাথে নবনীতার বিয়েটা হোক। হয়তো মনে অনেক প্রশ্ন জন্মাবে আপনার! ভাববেন আমি গিলটের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। এটা ভুল। নবনীতাকে আমার সবসময় পছন্দ ছিলো। আমার ছেলের জন্য তার চেয়ে ভালো মেয়ে আমি খুঁজলে হয়তো পাবো না। তাই আমার এই আবদার বা প্রস্তাব। আমার ছেলে হাজারে একটা এমনটা নয়, তবে আমি আমার মতো করে আমার ছেলেকে গড়ে তুলেছি। আজ তার একটা নিজস্ব ফার্ম আছে। সে নিজ চেষ্টায় আজ নিজের জায়গা করছে সমাজে। আজ শুক্রবার, আমি চাই আজ ই তাদের বিয়েটা হোক।“

হেনা বেগমের কথা শুনে থমথমে পরিবেশ আরোও বেশী থমথমে হয়ে যায়। কারেন্টের শকেও হয়তো এতো ঝাকুনি থাকে না যতটা মায়ের প্রস্তাবে রয়েছে। শান্তের মাথা মূহুর্তের জন্য ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। তার ধারণা ছিলো মা হয়তো নিজের সেই জেদ ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু না ফাঁকা ময়দানে ছক্কা হাকানোর চেষ্টায় রয়েছে সে। শান্ত এর রাগে গা কাঁপছে। নিজের জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্তটা আজ কয়েক মিনিটে ঘোষণা করে দিলো মা। বিয়ে আর নবনীতাকে? চিন্তাটা মাথায় আসলেই সব তালগোল পেঁকে যায় শান্তের। জসীম সাহেব বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি চিন্তিত কন্ঠে বলেন,
“আপা, আমার একটু লাগবে।“
“আমার সমস্যা নেই। আপনি সময় নিন। আমরা বাইরে আছি। যদি হ্যা হয়, তবে আজ ই আমি আমার বউ মাকে নিয়ে যাবো।“

বলেই হেনা বেগম এবং তার পরিবারের সবাই বসার ঘরে চলে যায়। নবনীতা স্তব্ধ, তার কোনো ইচ্ছা, স্বপ্ন নেই। সবকিছু প্রচুর নিষ্ঠুরতার সাথে গলা টিপে হত্যা করেছে নীলয়। আজ যদি শান্তের সাথে তার বিয়েটাও হয়, তাতে তার কোনোই মতবাদ নেই। শুধু চোখগুলো বাড়ে বাড়ে ভিজে যাচ্ছে এক অজানা অভিমানে। কন্ঠ ছেড়ে কাঁদতে পারলে হয়তো সব অভিমানগুলো গলে বহমান হতো। কিন্তু সে কাঁদবে না। মস্তিষ্ক অবিরামভাবে বিদ্রোহ করছে; কাপুরুষের জন্য কান্না মানা। তাই তো অভিমানগুলো জমছে আর বুকটা ভারী হচ্ছে।

জসীম সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। কি উত্তর দিবেন তিনি হেনা বেগমকে। শান্ত ছেলে হিসেবে মন্দ নয়, খুব ভদ্র এবং মার্জিত। দেখতেও বেশ সুদর্শন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, মায়ের ব্যবসা থাকতেও নিজের ছোট একটা ফার্ম আছে। নবনীতার সাথে তার জোড়াটাও মন্দ নয়। আর সবথেকে বড় যে কথা, হেনা বেগম সব জেনে নবনীতাকে নিজের ঘরের বউ করতে চাচ্ছেন। মহিলা সমাজের একজন সম্মানিত ব্যাক্তি। হেনা বেগমকে আজ থেকে চিনেন না জসীম সাহেব। তার ব্যাংকের একজন নিয়মিত কাস্টোমার হেনা বেগম। তিনি যতটা মার্জিত ততটাই সম্মানীয়। গার্মেন্টস এর মালিক হবার সাথে সাথে কিছু কিছু সামাজিক কাজেও জড়িত হেনা বেগম। এমন একজনের ঘরে বউ হয়ে তার মেয়ে যাবে ভাবতেই ভালো লাগার কথা জসীম সাহেবের। কিন্তু কিছুক্ষণ পুর্বের ঘটনায় বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন তিনি। মেয়ে কি বিয়েটা করবে? শারমিন বেগমের দিকে তাকালে তিনি বলন,
“আমার এই বিয়েতে আপত্তি নেই। উনি নিজ থেকে আমাদের মেয়ের হাত চাচ্ছেন। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে।“

এবার জসীম সাহেব নবনীতার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমার কি মত?”
“যা তোমরা ভালো মতে করো। আমার কিছুই বলার নেই।“

নত মাথায় কথাটা বলে নবনীতা। অন্য সময় হলে নবনীতা রেগে মেগে ঘর মাথায় তুলতো। কিন্তু আজ শান্ত সে। ঝড়ের পড়ের নদীর শান্ত ধারার মতো শান্ত। বুকে উত্তাল ঢেউ আটকে রেখেছে। মেয়েটাকে এরুপ ভগ্ন দেখে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয় জসীম সাহেবের। শান্ত কি পারবে তার মেয়েটাকে আগের মতো প্রাণোজ্জ্বল করে তুলতে, সেই আগের নবনীতা করে তুলতে_________________

শ্রাবণের শেষ সন্ধ্যায় একই সুতোয় বাধা পড়লো নবনীতা এবং শান্ত। দুই মেরুর দুটো মানুষ এক পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পড়ে। যে মেয়েটি শান্তের চেহারা দেখলেই রাগে লাল হতো আজ তার সাথেই নিজের নাম জড়িয়ে নিলো। নবনীতা আহমেদ থেকে হয়ে গেলো মিসেস আরেফিন শান্ত। কি অদ্ভুত জীবনের সাপসিড়ি খেলা, কখন মই এর ডগায় উঠে যায় আর কখন সাপের পেটে বলা ভার। অতি কষ্টে নিজের রাগ সংবরণ করে রেখেছে শান্ত। নিজের জীবনের এই অজানা পরিবর্তনের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না সে। মায়ের উপর কথা বলার ইচ্ছে বা সাহস তার নেই। তাই মুখ বুঝেই মেনে নিতে হলো এই স্বার্থপর সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে নির্বিকার বসে আছে নবনীতা। তার জীবনে এতো বড় পরিবর্তন এই শ্রাবণের শেষ সন্ধ্যা বয়ে আনবে সেটা জানা ছিলো না তার। এক সন্ধ্যা জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে তার। হঠাৎ চোখ গেলো হাতের মেহদির দিকে। বান্ধবীরা মজা করে “N” অক্ষরটা বড় করে লিখে দিয়েছিলো ডিজাইনে। অথচ আজ সেই মানুষটার অস্তিত্বই মুছে গিয়ে এই ক্ষুদ্র জীবন থেকে। সেই কদম ফুলগুলো শুকিয়ে গিয়েছে, ঝরে গিয়েছে সেই পাপড়ি। গন্ধহীন হয়ে গিয়েছে তার বেলীফুলের শুকনো মালাটা।

রাত দশটা,
নতুন বউ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা তার বরণের। হেনা বেগম সামিয়াকে বলে,
“যাও মিষ্টি একটা প্লেট এ সাজিয়ে আনো। আমি আমার বউ মা মিষ্টিমুখ করিয়ে বরণ করবো।“

সামিয়া শ্বাশুড়ির মন কখনোই বুঝতে পারে না। যেই মেয়ে তাকে অপমান করে তার ছেলেকে নিষ্ঠুর ভাবে রিজেক্ট করেছিলো সেই মেয়েটাকেই মিষ্টিমুখ করে বরণ করবেন তিনি। ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না তার। তাই মুখ ফসকেই বলে,
“মা, মিষ্টি তো?”
“ফ্রিজে একটা প্যাকেট আছে, কাল প্রিয়া পাঠিয়ে ছিলো। ওখান থেকে আনো সামিয়া।“

হেনা বেগমের ক্রুদ্ধ কন্ঠ শুনে চুপ হয়ে গেলো সামিয়া। সুরসুর করে ভেতর থেকে মিষ্টির প্লেট নিয়ে এলো। তারপর হেনা বেগম সুন্দর ভাবে নবনীতাকে বরণ করলেন। বরণের পর সামিয়াকে বললেন,
“শান্ত এর রুমে ওকে নিয়ে যাও। আমি আমার রুমে যাচ্ছি“

সামিয়া নবনীতাকে শান্তের ঘরে নিয়ে গেলো। শান্তের ঘরটা খুব সাদাসিধে। সাদা ঘরটিতে একটা বিছানা, আলমারি এবং পড়ার টেবিল বাধে কিছুই নেই। চারদিকে সাদা রঙ্গে একাকার। সাদা বিছানা, সাদা দেওয়াল, সাদা পর্দা। সামিয়া তখন মজার ছলে বললো,
“আমার দেবরের সাদা জীবনে তোমার স্বাগতম। একটু রাঙ্গিয়ে নিতে হবে ভাই। সাদামাটা দেবরটাকে একটু গুছিয়ে নিও।“

নবনীতা ম্লান হাসি হাসে। নিজের সাথে হয়ে যাওয়া পরিহাসের উত্তর কেবল এই ম্লান হাসি টুকু।

শান্ত কড়া নাড়ে হেনা বেগমের রুমের। হেনা বেগম তখন হিজাব খুলতে ব্যাস্ত। তিনি স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“কে?”
“মা আসবো।“
“এসো”

শান্ত প্রবেশ করলে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
“নতুন বরের তো আজ নিজ রুমে থাকার কথা, এখানে কি করছো? নবনীতা কি রুমে একা?”
“আমার মনে হলো তোমার সাথে কথা বলাটা বেশি জরুরী। তাই এখানে আসা। আজ তোমাকে মাত্রাতিরিক্ত খুশি লাগছে কারণ কি মা?”………………

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে দিবো। কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here