শ্রাবণের শেষ সন্ধ্যা পর্ব ৯

#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#৯ম_পর্ব

শান্ত প্রবেশ করলে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
“নতুন বরের তো আজ নিজ রুমে থাকার কথা, এখানে কি করছো? নবনীতা কি রুমে একা?”
“আমার মনে হলো তোমার সাথে কথা বলাটা বেশি জরুরী। তাই এখানে আসা। আজ তোমাকে মাত্রাতিরিক্ত খুশি লাগছে কারণ কি মা?”

শান্তের নির্লিপ্ত কন্ঠের প্রশ্নে সরু দৃষ্টিতে তাকান হেনা বেগম। এক সূক্ষ্ণ বিষ্ময় তার চাহনীতে। পরমূহুর্তে নিজে সামলে নেন তিনি বাকা হাসি ঠোঁটে রাঙ্গিয়ে বলেন,
“হাসালে শান্ত, তোমার প্রশ্নটাকে কোন কাতারে ফেলবো বুঝতে পারছি না। বলি, ছেলে বিয়ে দিয়ে কি কেউ পা ছড়িয়ে কাঁদে? ছেলে বিয়ে দিয়েছি মেয়ে নয়। খুশি না হবার কি আছে?”
“মা, হেয়ালী ছেড়ে একটু স্পষ্ট বলো তো, তুমি কি জানতে না নীলয় বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে?”
“আমি কি ভবিষ্যত দেখতে পাই নাকি? নীলয় পালিয়ে যাবে সেটা আমি কিভাবে জানবো? সে কি আমাকে কানে কানে বলে গিয়েছিলো?”

হেনা বেগম তার হিজাবটা ভাজ করতে করতে কথাটা বললেন। তার কন্ঠে নেই কোনো জড়তা, নেই কোনো অস্বস্তি। শান্তের মনের সন্দেহটা প্রখর হচ্ছে না। তবে একটা রেশ রয়েই যাচ্ছে। নবনীতার সাথে এই তিনদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক। আর এতে একমাত্র হেনা বেগমের মনোবাঞ্ছাই পূরণ হয়েছে। কিন্তু যারা ভুল কাজ করে তারা থাকে বিচলিত, ভীত। কিন্তু হেনা বেগমের ভাবমূর্তি আগের ন্যায় অবিচল। তিনি তার হাবভাব আগের ন্যায় ই রেখেছেন। ছেলের সরাসরি প্রশ্নেও তিনি ভীত নন। তবে কি শান্তের চিন্তা ভুল? হতেই পারে! হেনা বেগম এক ক্তহার মানুষ হতে পারেন, হতে পারেন অসম্ভব জেদি; কিন্তু এতো বড় একটা খেলার সূচনা করার মতো কুটিলতা কি তার মাঝে আছে! শান্তকে চিন্তায় বিভোর থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দেন হেনা বেগম,
“আমাকে নিয়ে তোমার এমন অদ্ভুত সন্দেহ দেখে আমি অবাক হচ্ছি। যাই হোক, আমি আজ খুব খুশি। আমার পছন্দের মেয়েই আমার বাড়িতে এসেছে। তবে, নীলয়ের সাথে বিয়েটা হলেও আমার কোনো আপত্তি কিন্তু ছিলো না। থাকলে আমি সেদিন ই বিয়েটা ভেঙ্গে দিতাম। এতো নাটকীয়তার কি আছে? তুমি জানো প্রিয়া আমার কথায় উঠে বসে। তাই খামোখা আমাকে সন্দেহ না করে নিজের রুমে যাও।“
“আমি মন থেকে চাই মা, যেনো এই বিয়ে ভাঙার রঙ্গে তোমার হাত না থাকে।“
“তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, সন্দেহ থাকলে তুমি রহস্যভেদ করো। প্রতিটা মানুষের মাঝে একজন সত্যান্বেসী থাকে। তুমি তোমার ভেতরের সত্যান্বেসীকে কাজে লাগাও। উত্তর পেয়ে যাবে। তাতে মনের কাঁদা মুছে যাবে। হেয়ালী কেটে যাবে। সন্দেহ জিনিসটা খুব বাজে। খুব খুব বাজে।“

হেনা বেগমের ঠোঁটে হাসির প্রলেপ অক্ষুন্ন। যদিও নবনীতার প্রতি তার একচুল টান নেই। কিন্তু কেনো যেনো এই রহস্যের একটা খোলসা না করে শান্তি হচ্ছে না। সেদিন কি হয়েছিলো মেয়েটির সাথে? হয়তো রহস্যের জট খুললে নিজের মনে মায়ের প্রতি অবিশ্বাসটা কেঁটে যাবে। হেনা বেগমের শেষ কথাগুলো শান্তকে ভাবাচ্ছে। সত্যি কি হেনা বেগম নির্দোষ নাকি এগুলো কেবল ই তার আত্নবিশ্বাস। মাঝে মাঝে সন্দেহ কাটাতে মানুষ আত্নবিশ্বাস দেখায়। ফলে বিপরীতের মানুষের সন্দেহের বানটা লক্ষ্যভেদ করতে পারি না। হয়তো এমন ই কিছু করতে চাচ্ছেন। শান্ত কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। হেনা বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার যাবার পানে। ছেলের অবিশ্বাসের দৃষ্টি তাকে আহত করেছে। কিন্তু একটা কৌতুহল তার মনেও কাটার মতো বিঁধছে, তা হলো নিলয় কেনো বিয়েটা ভাঙ্গলো! সে তো নবনীতাকে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো। তবে কি এমন হয়েছে যে বিয়ের দিন ই সে এক কান্ড করেছে? শান্তকে জিজ্ঞেস করলে সে হয়তো বলবে না। তবে একটা মানুষ ই রয়েছে যে কি না গরগর করে সব বলে দিবে। হেনা বেগম গামছাটা হাতে নিলেন। এখন নামাজ পড়বেন তিনি। দু রাকাআত নফল নামাজ পড়বেন। তার শ্বেত শান্তের জীবনে রঙ্গের সূচনা হতে চলেছে। সেজন্য শুকরিয়া আদায় করবেন তিনি।

নিজের রুমে যেতে যেতে রাত এগারোটা বেজে যায় শান্তের। এতোদিন রুমটি একান্ত তার নিবাস ছিলো কিন্তু এখন অন্য কেউ সেই রুমের অধিকারিণী। ব্যাপারটা ভাবতেই একরাশ বিরক্তিতে ভরে উঠলো মনটা। নবনীতাকে সে পছন্দ কিংবা অপছন্দ কোনো কাতারেই ফেলতে পারে না; মেয়েটির সাথে তার সম্পর্কটা বেশ জটিল। কিছুদিন পূর্বে মেয়েটিকে অসম্ভব বিরক্তিকর এবং ঘৃণার কাতারে ফেলেছিলো সে। কিন্তু এরপর তাদের মাঝে সম্পর্কের বদল হলো। অপরিচিত বিরক্তিকর মানুষের থেকে সে হয়ে উঠলো পরিচিত বিরক্তিকর নারী। তার ফুপাতো ভাইয়ের হবু স্ত্রী। আর আজ সেই নারী তার স্ত্রী রুপে তার খাটে বসে আছে। তার প্রতি ঠিক কিরুপ অনুভূতি কাজ করা উচিত জানা নেই শান্তের। যে নারী তাকে অপমান করেছে, চড় মেরেছে সেই নারীর সাথে সারাটাজীবন কাটানো কি সহজ হবে? ভবিষ্যতের চিন্তা করতেই বিরক্তিটা বাড়তে লাগলো। একটা সিগারেট খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা রুমের ভেতরে। তাই সে আশায় গুড়েবালি।

ঘরে ঢুকতে যাবে তখন ই স্নেহা এসে তার হাত টেনে ধরলো। এই বিয়েতে শান্ত এর থেকেও মন খারাপ কারোর হলে সে স্নেহা। বেচারি মোটেই এই মাস্টারনি চাচী যায় নি। অথচ ছোট বলে তার মনের খেয়াল নেই কারোর। তার মতামত ও জাননে চায় নি দাদী। নীলয় চাচুর জায়গায় তার ছোট চাচুর বিয়ে করিয়ে দিলেন। ছোট মাথায় কারণ বুঝতে না পারলেও এটা বুঝেছে, এখন থেকে এই খাটাশ, রাগী, খচ্চর ম্যাডাম প্রতিদিন তাকে সারাদিন এবং রাত পড়াবে। তাই চাচুকে দুঃখের কথা বলতেই আসা তার। স্নেহাকে মুখ ঘোমড়া দেখে শান্ত জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে স্নেহামনি? মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেন?”
“চাচু, মা বলেছে ম্যাডাম নাকি আমার চাচী। তুমি কেনো ম্যাডামকে বিয়ে করলে? উনি শুধু হোম ওয়ার্ক দেয়। আর কিছু হলেই চোখ বড় বড় করে তাকায়। আমাকে ভালো লাগে না।“

স্নেহার কথায় হেসে উঠে শান্ত। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তুমি কি সেই জন্য আমার কাছে এসেছো?”
“হ্যা, মা বললো, সে ম্যাডামকে বলবে কাল থেকে আমাকে পড়াতে। আমি উনার কাছে পড়বো না।“
“ঠিক আছে আম্মু, আমি নবনীতাকে বকে দিবো। সে তোমাকে কম হোম ওয়ার্ক দিবে, আর চোখ বড় বড় করে ভয় ও দেখাবে না। ঠিক আছে?”

চাচুর কথায় আশ্বস্ত হতে পারলো না স্নেহা। তার ধারণা তার চাচাও কিছুদিন পর তার বাবার মতো হয়ে যাবে। বাবা যেমন মায়ের কাছে বকা খেলে চুপ করে যায়, তার ছোট চাচুর অবস্থাও কিছুদিন পর তাই হবে। তাই বিষন্ন মনেই চলে যেতে হলো তাকে।

স্নেহা চলে যাবার পর নিজ রুমে প্রবেশ করে শান্ত। ঘরটি ফাঁকা। নবনীতা ঘরে নেই। নবনীতাকে না দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে শান্ত। কিন্তু মূহুর্তেই কানে একটা চাপা আর্তনাদ আসে। নবনীতার চাঁপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে বারান্দার কোন থেকে। শান্তের রুমের দক্ষিণে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা না বলে স্মোকিং এরিয়া বললে বেশ ভালো মানাতো। মার কাছ থেকে লুকানোর জন্য এখানেই সে স্মোক করে। ফলে ঘরে কোনো গন্ধ থাকে না। শান্ত ধীর পায়ে বারান্দার সামনে দাঁড়ায়। ভেজা অপরিস্কার বারান্দায় হাটু গেড়ে বসে আছে নবনীতা। অঝর ধারায় কান্নারত সে। হয়তো কষ্টগুলো বুকে চেপে রেখেছিলো এতো সময়। কাজল লেপ্টানো চোখজোড়া ফুলে গেছে। এক সূক্ষ্ণ কালো রেখা মুখশ্রীতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কারোর কান্নার সময় সামনে থাকতে নেই। কান্না খুব ছোয়াছে হুট করেই মনকে কাতর করে ফেলে। তাই বিনা শব্দে ফ্রেশ হতে চলে গেলো শান্ত। আজ খুব ক্লান্তদিন কেটেছে তার। অন্যের জন্য এতোটা খাটাখাটুনি সে এই প্রথম করলো। তাই চোখ বন্ধ করে ঝরণার নিচে দাঁড়ালো সে। ক্লান্তি গুলো ধুয়ে যাক সেই আশায়।

মিনিট বিশেক পর চুল মুছতে মুছতে বের হলো শান্ত। এখন কাঁদছে নবনীতা। তার চাপা ক্রন্দন শোনা যাচ্ছে। মেয়েরা পারেও। এতো কাঁদার কি আছে? ভেবে পায় না শান্ত। একটা বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে, জীবন তো থেমে যায় নি। একটা মানুষ তার হাত ই তো ছেড়ে দিয়েছে। এতে এতো কাঁদার কি আছে। একেই শরীরটা ক্লান্ত উপরন্তু এই মরা ক্রন্দন। নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না শান্ত। বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্তি জড়ানো কন্ঠে বললো,
“এই কান্না বন্ধ, সেই কখন থেকে পেঁচার মতো কেঁদেই যাচ্ছো। একটা মাত্রা আছে তো নাকি? আরেকবার কাঁদতে দেখলে ঘর থেকে বের করে দিবো, এই বলে রাখলাম।“

শান্ত এর কন্ঠ কানে আসতেই চমকে উঠে নবনীতা। চিন্তার সাগরে এতোটাই লিপ্ত ছিলো যে শান্তের উপস্থিতি ও টের পায় নি সে। একাকীত্বে বিষাদস্রোত চেপে ধরেছিলো তাকে। শেষ বারের মতো প্রতারকটির জন্য কাঁদছিলো সে। কিন্তু শান্ত এভাবে কথাটা বলবে বুঝে নি সে। খানিকটা আতে ঘা ও লাগলো তার। যতই হোক, বিয়ে যেহেতু হয়েছে এই ঘরের তার ও অধিকার আছে। সে কাঁদবে নাকি নাঁচবে সেটা তার একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এখানে শান্তের হস্তক্ষেপ মোটেই কাম্য নয়। চোখটা মুছে উঠে দাঁড়ালো নবনীতা। ভাঙ্গা কন্ঠে বললো,
“যদি ভালো না লাগে, বেড়িয়ে যান। আমি কি আপনাকে বলেছি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার কান্না দেখতে?”
“এটা আমার রুম, আমি কেনো বের হবো? আর আমার ঘরে থাকতে হলে আমার রুল মানতে হবে। আমার এই প্যানপানানি মোটেই ভালো লাগে না।“
“রুমে কি নাম লেখা আছে? নাকি আপনার মা এই রুমের অংশটা আপনাকে লিখে দিয়েছে?”

নবনীতার জড়তাহীন বক্তব্যে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায় শান্ত, চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে,
“হ্যা??”
“আপনার বুদ্ধি কম জানতাম, এখন তো দেখি শোনেন ও কম। যাক গে, ভাবী বলেছে এখন থেকে রুমটা আমাদের। মানে আমাদের দুজনের। তাই একজন ভালো রুমমেটের মতো থাকুন। আমার কান্না পাচ্ছিলো তাই কাঁদছিলাম। আমি বুঝি নি আপনি চলে এসেছেন নয়তো…”
“নয়তো কাঁদতে না। কি জানো তো তোমার এই দাপট গুলো শুধু আমার সামনেই। সত্যি যদি দাপটে হতে না নীলয়কে এতো সহজে ছেড়ে দিতে না। অন্তত একটা চড় তো ওর পাওনা ছিলো। কিন্তু তুমি ওকে ছেড়ে দিলে। আর এখন ওর জন্য ই কাঁদছো। হায় রে, ভালোবাসা।“

শান্তের তাচ্ছিল্যভরা কথাগুলো বিষের মতো লাগছে নবনীতার কাছে। সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে পশ্ন করে,
“কে বলেছে আমি তার জন্য কাঁদছি? আর তাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি ঠিক ই। তবে জানেন তো প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। তার প্রতিশোধ প্রকৃতি ই নিবে। অযথ আমার হাত ভরাতে হবে না।“
“তাহলে কাঁদছো ই বা কেনো? জানো না দূর্বলরা কাঁদে।“
“না কাঁদলে আমি সবল, কাঁদলে আমি দূর্বল এই উক্তি কোন মহাপুরুষ দিয়েছে শুনি?”

নবনীতার পালটা প্রশ্নের উত্তর নেই শান্তের কাছে। তাই কথা পাল্টানো অতীব জরুরী। আর এমনিতেও সেদিনের ঘটনার পর কিছু প্রশ্ন তার মনে জড়ো হয়েছে। সময় এবং বিয়ের ব্যাস্ততায় করা হয়ে উঠে নি নবনীতাকে। তাই হাত জোর করে শান্ত বলে,
“মাফ চাই, ভুল আমার ছিলো। তোমাকে ঘাটানো উচিত হয় নি। এবার আসো মেইন কথায়। সেদিন ঠিক কি ঘটেছিলো নবনীতা?”
“উত্তর কি দিতেই হবে?”
“সত্যটা জানাটা দরকার। এজন্য নয় যে আমার কোনো আপত্তি আছে। এজন্য যে এটা তোমার মনের সন্দেহ ও দূর করে দিবে।“

শান্ত এর শান্ত কন্ঠে অবাক করছে নবনীতাকে। একই পরিবারের লোক হয়েও দুটো পুরুষ আলাদা চিন্তা কি করে করে? কিভাবে তারা এতোটা ভিন্ন ভাবে দেখে ঘটনাগুলো। নবনীতাকে চুপ থাকতে দেখে শান্ত তুড়ি বাজায়। অবাক কন্ঠে বলে,
“কই হারায়ে গেলে? বলো, সেদিন কাউকে না বলে একা একা কেনো গিয়েছিলে ওয়াশরুমে?”
“কে বলেছে একা গিয়েছিলাম? নীতি আমার সাথে গিয়েছিলো……….

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে দিবো। কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here