সতীনের ঘর পর্ব -০৪

সতীনের ঘর
পর্ব ৪

ছোটো কে নিয়ে হসপিটালে উপস্থিত হলাম।সিজারের সব ব্যাবস্থা হয়ে গেছে,ডাক্তার বললো রক্তের ব্যাবস্থা করে রাখতে,রক্তের প্রয়োজন পরতে পারে।আমি ডাক্তার কে বললাম সমস্যা নাই,আমার আর রোগীর ব্লাড গ্রুপ একটাই,ব্লাড লাগলে আমি দিবো। বিজয় কি যেনো ভেবে বললো
– তোমার ব্লাড দিতে হবেনা,আমি দেখি ব্লাড ব্যাংকে ব্লাড পাওয়া যায় কি না।
– কেনো ভয়‌ পাও?
– কিসের‌ ভয়?
– যদি আমার রক্তে তোমার স্ত্রীর শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়!
– এভাবে কথার মারপ্যাচে আমাকে আঘাত না করলেও পারো।তোমার এমন ভাবে বলা
কথা গুলো ছুরির মত আঘাত করে বুকে।
– তোমার অবহেলা গুলোও আমাকে এভাবেই আঘাত করে।
-আমিতো তোমার শরীর খারাপ হবে ভেবে বলেছি কথাটা।
– আমার কথা তুমি নাইবা ভাবলে..

এমন সময় নার্স এসে বিজয় কে বললো,আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন,আর রক্তের প্রয়োজন পরেনি,মা ও বাচ্চা দুজনেই সুস্থ।আমি আর বিজয় ছোটোর‌‌ কাছে গেলাম।নার্স বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিলো আমাদের দিকে,আমি হাত বাড়ালাম কোলে নেওয়ার জন্য কিন্তুু ছোটো নার্স কে বললো, বাচ্চাকে আগে ওর বাবার কোলে দিন পরে অন্যকেউ নিবে।আমি হাত নামিয়ে নিলাম।নার্স বাচ্চাটাকে বিজয়ের কোলে দিলো, বিজয় মেয়ে কে কোলে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিলো।তার চোখের কোণ বেয়ে একফোটা পানি ঝরে পড়লো।আমি তার চোখে মুখে বাবা হওয়ার আনন্দ দেখতে পেলাম।তার অনুভূতিটা আমিও মন থেকে অনুভব করছিলাম।বাবা হওয়ার সুখ যে কত টুকু তাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
ইস কত কষ্টইনা করেছি একটা বাচ্চার জন্য ডাক্তার, কবিরাজ আরো কত জায়গায় গিয়েছি।কবিরাজের কথায় শীতের দিন মাঝরাতে গোসল করে ওষুধ খেয়েছি,তারপর ঠান্ডা জ্বরে বিছানায় পড়েছিলাম কতদিন তবুও কোনো কিছুতেই কোনো লাভ হয়নি অথচ ছোটো কত সহজেই মা হয়ে গেলো।তার কোনো কবিরাজের দরকার পড়লোনা,তার জন্য স্বামীর ভালোবাসাটাই যথেষ্ট ছিলো।

তিনদিন পর ছোটো কে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।শাশুড়ি মা নাতনি কে কোলে নিয়ে তার গলার চেইন খুলে পরিয়ে দিলেন আর নাতনির নাম রাখলেন পরী।দেখতেও পরীর মত।মায়ের মতই সুন্দরী হয়েছে।
পরী রাতে খুব জ্বালায় তাই ছোট ঠিক মত ঘুমাতে পারেনা।দিনের বেলায় আমি ছোটো কে বলি,তুই একটু ঘুমা রাতে তো ঘুমাতে পারিস না আমি পরী কে দেখবো।ছোটো তাই করে রাতে ও পরী কে নিয়ে থাকে আর আমি দিনের বেলায়।
এখন আমার অনেক টা সময় পরীর সাথে কেটে যায়।ওর হাত পা নাড়াচাড়া,ওর হাসি খেলাধুলা এগুলো আমাকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও সব কষ্ট ভুলিয়ে রাখে।সতীনের মেয়ে‌ ভেবে যেখানে হিংসা হওয়ার কথা,সেখানে আমি পরী কে খুব বেশীই ভালোবাসি। ওর নিস্পাপ মুখটা আমাকে বার বার ওর কাছে টানে।আমিযে ওর মধ্যে আমার বিজয়ের আনন্দ কে খুজে পাই।
তবে ইদানিং ছোটো পরী কে আমার কাছে বেশি আসতে দেয়না।আমি পরী কে আদর করি এটা ওর পছন্দ না।আমার থেকে পরী কে দূরে সরিয়ে রাখে।নানান সময় নানান কথার মাঝে অপমান করে আমাকে,তবুও আমি পরীর থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারিনা।পরী ও আমাকে দেখলেই কোলে আসার জন্য অস্থির হয়ে যায়।

একদিন পরী খেলতে খেলতে পরে গিয়ে ব্যাথা পেলো,যদিও আমি সামনেই ছিলাম। ঠোট কেটে রক্ত পড়ছিলো,আমি রক্ত বন্ধ করানোর চেষ্টা করছিলাম।ছোটো দৌড়ে এসে পরী কে আমার কোল থেকে কেরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
– তুমি সামনে থাকতে পরী ব্যাথা পেলো কিভাবে?
– খেলতে খেলতে কিভাবে যেনো পরে গেলো জানিনা।
– জানো‌‌ না নাকি ইচ্ছা করেই ব্যাথা দিয়েছো?
– কি বলছিস এসব,এটা তুই বলতে পারলি?
– কেনো পারবোনা,তুমি যে আমাকে হিংসা করো আমি জানিনা নাকি!
– আজ পর্যন্ত তোর ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু করেছি আমি?
– করো নাই তবে,করতে কতক্ষন।নিজে তো মা হতে পারোনি,তাই আমাকেও সন্তান ছাড়া করতে চাও?তুমি পরীর আশেপাশে না আসলেই খুশি হবো।
বিজয় এসে জিজ্ঞেস করলো
-কি হইছে,এত চিল্লাচিল্লি কিসের?
– আমি বললাম,তোমার বৌ আমাকে পরীর কাছে যেতে মানা করলো।আমি নাকি পরী কে ইচ্ছা করে ব্যাথা দিয়েছি।বিজয় ছোটো কে কিছু বললো না, উল্টা আমাকেই বললো,তুমি পরীর কাছে এসো না তাহলেই তো হয়।

রাত বাজে তিনটা,কিছুতেই ঘুম আসছে না।বার বার ছোটর‌ বলা কথা গুলো মনে পরছে,আর কান্না পাচ্ছে।
আমি মা হতে পারিনি বলে,পরীর ক্ষতি করবো এইটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠে অথচ ছোটো কত সহজেই কথাটা বলে ফেললো।
না বিছানায় শুয়ে থাকতে পারছিনা।আস্তে করে উঠে বারান্দায় চলে গেলাম,যেনো শাশুড়ি জেগে না যায়।খুব চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছে,মুখে কাপড় চাপা দিয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম।এই কান্নাই তো আমার একমাত্র সঙ্গী,কান্না করেই মনের কষ্ট গুলোকে হালকা করতে পারি।কাদতে পারি বলেই এখনও বেচে আছি।আকাশে কত সুন্দর চাঁদ ঝলমল করছে।আমার মনে এত মেঘ কেনো।মেঘ জমতে জমতে মনের ভেতরে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে,তবুও এক টুকরো আশা নিয়ে বেঁচে আছি যদি কখনো এই মেঘ ভেঙ্গে সূর্য উঠে।

পেছন থেকে কে যেনো ঘাড়ে হাত রাখলো,আমি চমকে গিয়ে
– কে???
– আমি।
– মা আপনি এখানে?
– তুই ঘুমাসনি‌ কেনো?
– এমনি ঘুম আসছেনা
– আমি তোর থেকে সব কিছু কেরে নিয়েছি তাই না?বিজয় কে‌ কেরে নিয়েছি,তোর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছি।
– না মা,সবই আমার ভাগ্য।
– নারে‌‌ মা ভাগ্য না,সব কিছু আমার কারনেই হয়েছে। আমার কারনেই তোর মত একটা দুখি‌‌ মেয়ে আজ ছন্নছাড়া।সব ই আমার দোষ।
– দোষ না মা,এটা আপনার অধিকার।ছেলের ঘরে সন্তান দেখার ইচ্ছাটা কোনো দোষের নয়,।আমি কাওকে দোষারোপ করিনা,আমার কপালে যা ছিল তাই হইছে। কিন্তূ মা আমিতো নিজের থেকেই সব অধিকার ছেরে দিয়েছি স্বামী,ঘর,সুখ সবই তো ছোট কে দিয়ে দিয়েছি।ওর মেয়েটা কে‌ নিয়ে একটু খেলি বলে,ওর সহ্য হয় না।আমি নাকি পরী কে ওর কাছ থেকে কেরে নিতে চাই,ও এই কথাটা বলতে পারলো।কিভাবে পরলো মা ও এই কথাটা বলতে?তার উপর বিজয় ও আমাকে পরীর কাছে যেতে মানা করলো,কেনো করলো মা এমন টা বলতে পারেন?
শাশুড়ি মা আর কোনো কথা বললেন না,আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন।আমিও ছোট বাচ্চাদের মত তাকে আগলে ধরে কাদতে লাগলাম।এই মাঝরাতে যখন সবাই ঘুম,আমি আর আমার শাশুড়ি কান্নায় ব্যাস্ত।

সকালে রান্না করছিলাম এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো দরজা খুলতেই অবাক হয়ে গেলাম
– কিরে কুইন তুই এখানে?
– কেনো এসে কি খুব অপরাধ করে ফেলেছি।
– আরেহ না,কি বলছিস এইসব?আয় ভেতরে আয়।
শাশুড়ির সাথে কুইনের পরিচয় করিয়ে দিলাম।শাশুড়ি বললো ,তোমরা ঘরে গিয়ে গল্প করো,আমি চা নাস্তা পাঠাচ্ছি।আমরা
ঘরে এসে বসলাম।আমি বললাম
– এতদিন পর কিভাবে আসলি?
– তোর কথা মনে পড়লো তাই চলে আসলাম।
– বাসা চিনলি কিভাবে?
– ইচ্ছা থাকলে সবই হয়,ইচ্ছা ছিলো তাই খুজে নিয়েছি।
– আচ্ছা কেমন আছিস বল?
– তুই কেমন আছিস সেটা বল?
– একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে,আছি ভালই।
– এটাকে কি ভালো থাকা বলে?
-দামী শাড়ি,ভালো খাবার, বড়ো ঘর আর কি লাগে ভালো থাকার জন্য?
– আর স্বামী?তাকে কি পাশে লাগেনা ভালো থাকার জন্য
– পাশেই তো আছে।
– সেটা তো শুধু নামে,সত্যিটা তুইও জানিস আমিও জানি।এভাবে কি বেচে থাকা যায়?
-‌ বেচেই‌ তো আছি,মরিনি তো!
-দয়া করে চুপ করবি তুই?নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছিস কি হাল হয়েছে তোর?কেনো এভাবে নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রেখেছিস!এসব করে কি প্রমাণ করতে চাস,তুই দুনিয়ার সব চেয়ে ভালো মেয়ে ,মুখ বুঝে সব সহ্য করতে পারিস!
– এছাড়া কিই বা করার আছে আমার?
– অনেক কিছু করার আছে।তুই ভুলে যাস কেনো,তুই একজন মাস্টার্স কমপ্লিট করা মেয়ে,তুই চাইলেই একটা ভালো জব করতে পারিস।
– বিজয় রাজি হবেনা।
– বিজয় কি আধও তোর কথা ভাবে?
একজন শিক্ষিত মেয়ে হয়ে, ঘরের ভেতর নিজেকে বন্দী করে রেখে,এমন দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বেচে থাকার কোনো মানে হয় না।কেনো মিছেমিছি পরে আছিস এই সংসারে,এত অপমানের পরেও,কিসের আশায়?তোর বেঈমান স্বামী তো খুব সুন্দর করেই সংসার করে যাচ্ছে,আর তুই কেদে কেদে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিস।
– বিজয় কে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবোনা।
– আমি বলছিনা তুই তোর স্বামীর সংসার ছেড়ে দে,শুধু বলছি এই মিথ্যে মায়া থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আয়।তুই না সব সময় বলতি লেখাপড়া শেষ করে একটা ভালো চাকরি করবি,তাহলে এখন কোথায় গেলো তোর সেই স্বপ্ন?
– স্বপ্ন দেখতে যে ভুলে গেছি।
– ভুলে গেলে চলবেনা, বাচতে হলে সপ্ন দেখতে হবে,ভালো থাকতে হলে সে গুলো পূরণ করার চেষ্টা করতে হবে।তোকে নিজের ভালো থাকার পথ খুজে নিতে হবে। একবার বাইরে বেরিয়ে দেখ,তুই কত স্বাধীন।একটা জব কর,নিজেকে কাজে ব্যাস্ত করে দেখ কতটা ভালো লাগে।সবার জীবনেই কিছু না কিছু কষ্ট আছে,তাই বলে সেই কষ্টের কথা ভেবে মূল্যবান সময় টাকে নষ্ট করা যাবেনা।কষ্টের মাঝেই সুখ খুজে নিতে হবে। বেচে থাকা ই সব না,ভালো থাকাও জরুরি।নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে।
– আচ্ছা আমিতো কখনো তোকে এইসব ব্যাপারে কিছু বলিনি,তাহলে তুই জানলি কিভাবে?
– ঐযে বললাম না ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছু হয়,ইচ্ছে ছিলো তাই জেনে গেছি।আর সতীনের সংসারে একটা মানুষ কেমন থাকতে পারে,সেটা তুই বলার পর আমি জানবো?তোর কষ্টটা যদি না জানি,না বুঝি তাহলে কেমন বন্ধু আমি!
– আচ্ছা বাদ দে,এখন নাস্তা কর।

সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে ছিলাম,শাশুড়ি এসে পাশে বসলেন,জিজ্ঞেস করলেন
– কিরে মন খারাপ?
– নাহ্ ভাবছি।
– কি ভাবছিস?
– আমি একটা জব করতে চাই।
– কেনো তোর কি কোনো কিছুর জন্য টাকা লাগবে?
– না মা,আসলে ব্যাপারটা তেমন না।আমি চাইছি নিজেকে কোনো কাজে ব্যাস্ত রাখতে।বাড়িতে থাকলে পরীর থেকে দূরে থাকতে পারিনা,পরীর কাছে যাওয়া ও ছোটোর‌ পছন্দ না।এভাবে দিনকে দিন আমি ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছি,আর মাসের শেষে হাত খরচের টাকাটাও বিজয়ের কাছ থেকে নিতে হবেনা।সব ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি,এখন আপনি কি বলেন?
– আমি আর কি বলবো,আমিতো জিবনে তোকে কম কষ্ট দেইনি।তোর যেটা ভালো লাগে কর তবে একটা শর্ত আছে।
– কি শর্ত?
– যাই করিস এই বাড়ি ছেড়ে তুই যেতে পারবিনা,তোর সাথে গল্প না করে যে আমার ঘুম হয় না।
– আচ্ছা মা তাই হবে।তবে ভাবছি বিজয় কি রাজি হবে?
– কথা বলে দেখ কি বলে।

আমি রাতে ওদের ঘরে গেলাম,ওদের বলতে যেই ঘরটা এক সময় আমার ছিলো।প্রায় দুই বছর পর এই ঘরটায় আসলাম।অনেক কিছু চেঞ্জ করা হয়েছে এই ঘরে,আলমারির জায়গায় টেবিলে রাখা হয়েছে,খাট যেখানে ছিলো সেখানে নাই,অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।আগের মত কিছু নেই, ছোটো নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছে।যাইহোক আমি ঘরে ঢুকার আগে একটু কাশি দিয়ে নিলাম।ছোটো বললো কে ,আমি ভেতরে যেতেই
বিজয় বললো
– তুমি?
– একটা কথা বলার ছিলো।
– কি বলো?
ছোটো বললো এখন কথা বলা যাবেনা,পরী ঘুমিয়েছে উঠে পরবে। বিজয় বললো,
– সুফিয়া তাহলে চলো ছাদে গিয়ে কথা বলি।
– এত রাতে ছাদে কেনো,থাক তাহলে কালকে সকালে বলবো।
– নাহ্ এখনই চলো,সকালে আমার সময় নেই।
ছোটো রাগে জলছে,ও ভেবেছিলো পরীর ঘুম ভাঙ্গার কথা বললে হয়তো বিজয় আমার সাথে কথা বলবেনা।কিন্তু এতে হিতের বিপরীত হয়ে গেলো।আমি ছোটোর কান্ড দেখে না হেসে পারলাম না।যেখানে আমি নিজের থেকেই সব ছেড়ে দিয়েছি,তবুও যে এত কিসের ভয় ওর বুঝিনা।
আমি আর বিজয় ছাদে গেলাম…

চলবে…
সালমা আক্তার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here