সতীনের ঘর পর্ব -০৩

সতীনের ঘর
পর্ব ৩

গেটের সামনে গিয়ে দেখি শাশুড়ি মা বৌকে বরণ করার জন্য দাড়িয়ে আছেন।আমি বৌ এর মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু দেখতে পাচ্ছিনা,লম্বা ঘোমটা তার উপর এত মানুষের ভিড় এড়িয়ে দেখার কোনো সুযোগ পাচ্ছিনা।এই সব হুড়োহুড়ি থেকে একটু দূরে এসে দাড়িয়ে রইলাম।কি দরকার অযথা ভিড় বাড়ানোর।কিছুক্ষন পর বৌ কে বরণ করে গাড়ি থেকে নামানো হলো।কে যেনো ঘোমটা টা তুললো,আমি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।বাহ্ কি সুন্দর দেখতে,লম্বা ফর্সা একদম আমার শাশুরির মনের মত।এতদিনে আমার শাশুরির ইচ্ছা পূরণ হলো তাহলে।তার খুব ইচ্ছা ছিলো তার ছেলের বউ ফর্সা হবে,আমার গায়ের রং ময়লা বলে কত কথাই না শুনেছি।
সবাই যখন বলছিলো, বৌ দেখতে অনেক সুন্দর একদম চাঁদের মত,তখন পাশে দাড়িয়ে থাকা আমার বরের ঠোঁটের কোণে হাসির ঝলক দেখতে পেলাম।নাহ্ এ হাসি তো কোনো মিথ্যে হাসি নয়,এত মনের আনন্দে ফুটে ওঠা প্রাপ্তির হাসি।তবে কি সেও মুগ্ধ হয়ে গেলো তার রূপে!

রাতে নতুন বৌ আর বিজয় কে একসাথে খেতে দেওয়া হলো।বিজয়ের বন্ধুবান্ধব,ছোট বোন, বড় বোন,বাবা মা সবাই ছিলো সেখানে শুধু আমিই ছিলাম না।সবাই যার যার মতো খাওয়া শেষ করে উঠলো,অথচ কেউ একবার আমার খাওয়ার কথা‌ মনেও করলো না!বিজয় তো একবার জিজ্ঞেস করতে পারতো আমার কথা,ও কি জানেনা আমিযে ও কে ছাড়া খাইনা।যখন নতুন এসেছিলাম এই বাড়িতে,খাবারের অভাব না থাকলেও,আমাকে খাবারে অনেক কষ্ট দেওয়া হতো।একদিন বিজয়ের চোখে ব্যাপারটা ধরা পরলো,সেদিনের পর থেকে সে আমাকে রেখে কখনো খায়নি।অথচ এতদিনের অভ্যাস সে আজ কিভাবে ভুলে গেলো।যে মানুষটা বিয়েতে রাজি ছিলোনা,সে মানুষটা বিয়ে না করতেই এতোটা পাল্টে গেলো কিভাবে?

আজ আমার বিছানায় নতুন বৌ কে থাকতে দেওয়া হলো।খুব কষ্ট হচ্ছে ঘরটা ছাড়তে।ঘরের প্রতিটা জিনিষ খুব যত্ন সহকারে নিজের হাতে সাজিয়েছিলাম,আজ সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেলো।আমি বিজয়ের মুখের দিকে একবুক আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম,ভেবে ছিলাম ও বলবে,সুফিয়া তুমি কোথাও যাবেনা,এই ঘর তো একমাত্র তোমার।এই ঘরে একমাত্র তোমার থাকার অধিকার আছে,আর কারো না।কিন্তু আশাহত হয়ে‌ চলে আসলাম অন্য ঘরে।মনে হলো সেও চাচ্ছে আমি এ ঘর থেকে চলে যাই।
স্বামী হারালাম,ঘর হারালাম,কবে জানি এই বাড়ি থেকেও হারিয়ে যাবো নিঃশব্দে।
আজ আমি একদম নিঃস্ব, বাবা হারিয়ে যেই মানুষ টাকে বেচে থাকার জন্যে আকরে ধরে ছিলাম সেই মানুষটাই আজ খুব যত্ন করে হৃদয়টা ভেঙে দিলো। আসলে প্রিয় মানুষরাই তো পারে,এত যত্ন নিয়ে কষ্ট দিতে…

না,কিছুতেই ঘুম আসছেনা।এই একটা সমস্যা আমার,নিজের বিছানা ছেড়ে অন্য বিছানায় ঘুমোতে পারিনা।
আচ্ছা সত্যিই বিছানা নাকি ঘুম না আসার কারনটা নিজের থেকেই লুকাতে চাইছি আমি?
দীর্ঘ দশ বছরে কখনো বিজয়কে‌ ছাড়া ঘুমাইনি। বাপের বাড়ী নেই,যাওয়ার মতো ও কোনো জায়গা ছিলোনা,তাই কখনো আলাদা থাকা হয়নি। অথচ আজ একই বাড়িতে দুজন আলাদা।এতদিনের অভ্যাস কি আর একদিনে ভোলা যায়।যার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতাম,তার বুকে আজ অন্য কেউ মাথা রেখে ঘুমাবে।বিজয় কি জানেনা একা থাকা কতটা কষ্টের,আমি যে তাকে ছাড়া ঘুমোতে পারিনা সে কি বুঝেনা?
আর বুঝবেই বা কি করে,এখানে আমি একা থাকলেও,ওর পাশে তো আজ সুন্দরী নতুন বৌ।
বুকের ভিতর চিন চিন করে ব্যাথা করছে,গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।মনে হচ্ছে এখনই বুঝি মারা যাবো।এমন ভাবে বেচে থাকার চেয়ে মৃত্যুতেই শান্তি মনে হচ্ছে।

রাতটা কোনো মতে কাটিয়ে সকালে উঠেই সংসারের কাজে হাত লাগলাম।কিছুক্ষন পর বিজয় এসে নাস্তার টেবিলে বসলো,ওর বৌ এখনও নিচে নামেনি হয়তো গোসল নিয়ে ব্যাস্ত।আমি বিজয়কে ‌নাস্তা দিলাম।সুযোগ পেয়ে একটা প্রশ্ন করে বসলাম
– বাসর রাত কেমন কাটলো?
-কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,নাস্তা করেছো?
– আমি এই দশ বছরে কখনো তোমাকে ছাড়া খেয়েছি?
– রাতে খাওনি তুমি???
– আমার খাওয়ার খোজ কে রাখে?
– এখনই খেয়ে নাও,পরে কাজ করো।
– আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছো?
বিজয় আর কথা না বাড়িয়ে টেবিল থেকে নাস্তা না খেয়েই‌ উঠে পরলো।ও আমার চোখে চোখ রাখার সাহস পেলোনা।
কিছুক্ষন পর নতুন বৌ নিচে নেমে এলো।শাশুড়ি মা, বৌ এর সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো।আমাকে দেখিয়ে বললো,এইটা তোমার সতীন।এতক্ষন সবাইকে সালাম দিলেও আমাকে সে সালাম দেইনি।আমি বললাম তুমি আমাকে কি বলে ডাকবে জানিনা,আমি তোমাকে ছোট এবং তুই করেই ডাকবো।

এভাবেই চলছিলো দিনকাল।বিজয়ের থেকে দুরত্ব দিন দিন বেড়েই চললো।মাসে দুই একদিন সে আমার ঘরে এসে থাকতো,দায়িত্ব হিসেবে। আমিও সেটাকে ভালোবাসা ভেবে খুশি থাকতাম।যাইহোক ভালোবাসার মানুষের কাছাকাছি আছি,মাসে এক দুই বার হলেও তো তার দেখা পাই এটাই যথেষ্ট।
এখন তো আমার তাকে ছাড়া খাওয়া,থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে।আগে যখন ছোট ছিলোনা,রাত এগারোটা পর্যন্ত বিজয়ের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতাম,ছোট এসে সেই কষ্ট থেকে আমাকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে।একদিন আমাকে রাতের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখে ছোট বললো,
– বুবু তুমিতো সারাদিন অনেক কাজ করো,এত রাত পর্যন্ত তোমার খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে হবেনা।তুমি ঘুমাও গিয়ে,আমি ওনাকে খাবার দিয়ে দিবো।
একদিন যার মুখ দেখে সারাদিনের কষ্টের কথা ভুলে যেতাম,আজ তার জন্য অপেক্ষা করা ও বারণ।আমি মুখ ফুটে কিছু না বললেও আমার বুঝতে বাকি নেই,কৌশলে আমাকে বিজয়ের থেকে আরো এক ধাপ দূরে সরানো হলো।তবুও আমি ছোট কে কোনো দোষ দেইনা।ছোট তো আমার সতীন, কিন্তুু বিজয় তো আমার স্বামী।সে যখন আমার খোজ নেয়না,সতীন কে দোষ দিয়ে কি হবে।

এর মাঝে শ্বশুর মারা গেলো হঠাৎ,বাড়িতে কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেলো।শ্বশুরের মৃত মুখটা দেখে বাবার কথা খুব মনে পড়ছিলো।বিজয় সেদিন সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাদছিলো আর বলছিলো,আমিও তোমার মত বাবা হারা হয়ে গেলাম।
ইদানিং শাশুড়ি অসুস্থ থাকে বেশি,রাতে ঘুমায় না ঠিক মত।খাওয়া দাওয়া না করে শুধু কান্নাকাটি করে।তিনিও একা আমিও একা,তাই মাঝে মাঝে রাতে আমি তার সাথেই থাকি।শাশুরির সাথে সম্পর্ক টা এখন মধুময় হয়ে‌ উঠেছে।অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করি দুজনে,এক সময় গল্প করতে করতে সে ঘুমিয়ে যায়,আমার রাত টা মাঝে মাঝে ঘুমহীন কেটে যায়।মাঝরাতের আকাশের সাথে যে আমার একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।কত ঘুমহীন রাতের সাক্ষী এই রাতের আকাশ।বারান্ধায় দাড়িয়ে আকাশ দেখে দেখেই অনেক রাত কাটিয়ে দেই।

ছোট ও ইদানিং খুব অসুস্থ থাকে,খায়না।শাশুড়ি বললো ডাক্তার দেখাতে।সন্ধ্যায় বিজয় ছোট কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো,রাতে ফিরে আসলো সুখবর নিয়ে। বিজয় ‌ মা কে খুশিতে চিৎকার করে জানালো,উনি দাদী হতে চলেছেন।এতদিনে এই ঘরে নতুন মেহমান আসছে।মিষ্টি নিয়ে মায়ের মুখে তুলে দিলো,আমিও সেখানে দাড়িয়ে ছিলাম আমার মুখেও মিষ্টি তুলে দিয়ে বললো
-সুফিয়া অবশেষে আমি বাবা হবো ,এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে আমার।
– আর আমি হবো তোমার বাচ্চার সৎ মা।
– এভাবে বলছো কেনো,তুমি খুশি হউনি?
– কেনো খুশি হবো না,এই দিনটা দেখার জন্যই তো তোমাকে বিয়ে করিয়ে ছিলাম।
বিজয় আজও এড়িয়ে গেলো আমাকে,কথা বাড়ালো না।কেনো জানি আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনা ও।মুখে খুশির কথা বললেও,মন থেকে খুশি হতে পারিনি,সতীন বলেই হয়তো।

এখন বিজয় ছোট কে খুব যত্ন করে।নিজের হাতে খাইয়ে দেয়,উপর থেকে নিচে নামতে দেয়না।আমিও যতটুকু পারি করি,না হলে যে সবাই বলবে সতীন বলে হিংসা করি।তবে মনে মনে সহ্য করতে পারতাম না ওদের এত ভালোবাসা। হিংসা, না পাওয়ার ব্যাথা,হারানোর শোক সবকিছু আষ্টেপিষ্টে জাপটে ধরেছে আমায়।
মাঝে মাঝে শাশুড়ি মা বিজয় কে‌ দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিতো,বলতো
– বাবা সুফিয়াও কিন্তুু তোর স্ত্রী,ওকেও একটু সময় দিস।তাই মাঝে মাঝে দায়িত্ব পালন করার জন্য আমার কাছে আসতো, তাও আবার শাশুড়ি মনে করিয়ে দেবার পর। কিন্তুু এখন আর আমার এইটা ভালো লাগেনা।যেখানে ভালোবাসা নেই , সেখানে এই শারীরিক সম্পর্কটা শুধুই নোংরামি।আস্তে আস্তে ওর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনলাম।কখনো ওর সামনে পরতাম না। ও সারাদিন বাসায় থাকতোনা,সকালে যেতো আসতো অনেক রাতে।শুক্রবার বাসায় থাকলে দেখা হলেও কথা বলতাম না।আগে মাঝে মাঝে শাশুড়ি রুমে থাকতাম এখন পার্মানেন্ট থাকতে শুরু করেছি।যেনো কোনো ভাবেই দায়িত্ব নামের নোংরামি টা আমার সাথে না হয়। কবে যে কতটা দূরে চলে এসেছি সেই খোজ ও সে রাখেনি।

দেখতে দেখতে চলে আসলো কাঙ্খিত সেই দিন।আজ ছোটর ‌ডেলিভারি ডেট।বেলা বারোটায় সিজার হওয়ার কথা।আমার স্বামী বাবা হবে,শাশুড়ি দাদী হবে আর আমি হবো সৎ মা….

চলবে…
সালমা আক্তার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here