সতীনের ঘর পর্ব -০২

সতীনের ঘর
পর্ব ২

দরজা খুলে দেখি বাড়িওয়ালা চাচা,সাথে আরো দুই জন ছেলে তমাল আর সুজন।বাড়ির সামনে আরো অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে।আমি কিছু বলার আগেই তমাল আর সুজন ঘরে ঢুকে বিজয় কে শার্টের কলার ধরে বাইরে বের করলো।আমি বললাম
– কি হয়েছে,ওনার সাথে এমন ব্যাবহার করছেন কেনো,ওনার দোষ কি?
– কি দোষ জানিস না?দিন দুপুরে পুরুষ মানুষ ঘরে আইনা রাখিস আবার বলিস দোষ কি?
– কি বলছেন এইসব! উনি আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়ি,কিছুদিন ধরে ভার্সিটিতে যাইনা বলে খোজ নিতে এসেছে,আর কিছুনা।
বাড়িওয়ালা চাচা বললো এই ছেলেরে আরো অনেকবার আমি এই এলাকাতে ঘুর ঘুর করতে দেখছি,আইজকা হাতে নাতে ধরলাম।
তমাল আর সুজন আজকে উঠে পরে লেগেছে আমাকে কলঙ্কিনী প্রমাণ করতে।এই দুইটা ছেলে আমাকে খুব উত্যক্ত করতো অবশেষে পাত্তা না পেয়ে‌ পিছু ছেড়ে দিয়েছিলো,আজ সুযোগ পেয়ে প্রতিশোধ ও নিয়ে নিচ্ছে।

যখন কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না,তখনই বাড়িওয়ালী চাচী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো
– আপনারা কেমন মানুষ হ্যা?এতদিন ধরে এই মেয়েটা এই এলাকায় থাকে,কখনো কি খারাপ কিছু দেখছেন?আজ একজন ছেলে বাসার ভিতর ঢুকতে দেখে বাসায় এসে এমন হইচই শুরু করছেন।সদ্য মেয়েটার বাপ মারা গেছে,এই মেয়েটার মনের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে একবার ভেবে দেখেছেন?
আর ছেলেটা এসেছে তো বেশিক্ষণ হয়নি।আজ এই মেয়েটার কেউ নেই বলে আপনারা বিনাদোষে তাকে দোষী করছেন অথচ যখন আপনাদের নিজের মেয়েরা‌ স্কুল বা কলেজ থেকে কোনো বন্ধু নিয়ে আসে,তখন তো আপনারা সেটা খুব সহজেই মেনে নেন।একজন মানুষ খোজ নিতে আসতেই পারে তার মানে এই না যে তার সাথে মেয়েটির কোনো বাজে সম্পর্ক আছে।মেয়েটির কেউ নেই বলে আপনারা এমন করছেন?ভেবে দেখেন কালকে আপনিও হয়তো‌ থাকবেন না আপনার মেয়ের পাশে,তখন কি হবে ভেবে দেখেছেন?

বাড়িওয়ালী চাচীর কথা শুনে সবাই যার যার মতো চলে গেলেন।এ যাত্রায় চাচীর জন্য বেচে গেলাম।আমি সবার সামনে বিজয়‌কে চলে যেতে বললাম,ও কি জানি বলতে চাইলো আমি না শুনেই ঘরের ভেতর চলে আসলাম।তারপর থেকে বাড়িওয়ালী চাচীর সাথে আমার একটা অন্যরকম ভালো সম্পর্ক তৈরি হলো।উনি আমার ভালো মন্দ খোজ রাখতেন।

প্রায় একমাস পর ভার্সিটিতে আসলাম।আমাকে নিয়ে মজা করা ছেলে গুলো এখন আমাকে দেখলে অন্যদিকে ফিরে থাকে,যেনো আমার দিকে তাকাতে তারা লজ্জা পায়।তাদের চোখে আমি অপরাধ বোধ দেখতে পাই।ক্লাস শেষে মাঠের এক কোণে একাই বসে ছিলাম। এত বড়ো দুনিয়াতে আমার কেউ নেই ভেবে মাঝে মাঝে আমার খুব হাশি পায়।একটা বান্ধবী আছে কুইন নামে,তাকেও আজ দেখছিনা মনে হয় আসেনি।আমার মোবাইল ও নেই যে ফোন করে খবর নিবো।আসলে আমি গরীব বলে আমার সাথে কেউ বন্ধুত্বও করেনা।হঠাৎ বিজয় পাশে এসে বসলো,আমি ওখান থেকে চলে আসতে চাইলে, ওরনা ধরে থামিয়ে দিল।আমি রেগে গিয়ে বললাম

– বাসায় কলঙ্কিনী বানিয়ে শান্তি হয়নি,এখন কি এখানেও কলঙ্কিনী বানাতে চান?
– সরি
– সরি বললেই কি সব কিছুর সমাধান হয়ে যায়?কি ভাবেন নিজেকে?কেনো আমাকে খারাপ প্রমাণ করতে উঠে পরে লেগেছেন?কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার?আপনার জন্য এখন আমি এলাকাতে মুখ দেখাতে লজ্জা পাই,আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি লেগে গেছে।গরীব বলে কি আমার কোনো প্রেস্টিজ নেই?আমিও মানুষ প্লিজ আমাকে দয়া করে ছেরে দিন।আমি এমনেই মনের ভিতর অনেক কষ্টের বোঝা নিয়ে আছি প্লিজ আপনি আমার সেই কষ্টের পরিমাণ আর বাড়িয়ে দিবেন না, দয়া করুন আপনার উপর, দয়া করুন।

বিজয় আমার ওরনা ছেরে শক্ত করে আমার হাতটা ধরলো,নরম কণ্ঠে বলতে লাগলো
– ভালোবাসি তোমাকে তাই এমন পাগলামি করি।তোমার কষ্টের বোঝা বাড়াতে না,তোমার মনকে হালকা করতে চাই।তোমার সব রাগ,অভিমান,কষ্ট,ভালোবাসা সব নিজের করতে চাই।আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো,শুধু বলো না।ভয় পাও যদি আবার নতুন করে কষ্ট পাও এই ভেবে।আমি তোমাকে কথা দিলাম আমি কোনোদিন তোমাকে কষ্ট দিবনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমিও আমাকে ভালোবাসো তবে কিসের এত লুকোচুরি! কি চুপ করে আছো কেনো?ভালোবাসোনা আমায়?আমার কাছে স্বীকার না করলেও নিজের কাছে কি অস্বীকার করতে পারবে?আমি দেখেছি তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা।
– আপনি আমাকে সত্যিই ভালোবাসেন?
– অনেক ভালোবাসি
– কি লাভ ভালোবেসে যদি বিয়েই না হয়?
– তুমি চাইলে সবই হবে
আপনার পরিবার কি আমাকে মেনে নিবে?
– আমি আমার পরিবারের এক মাত্র ছেলে,আমার পরিবার আমাকে অনেক ভালোবাসে তাই আমার কথা তারা ফেলতে পারবেনা।
– তাহলে তাদের কে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।
– কার কাছে পাঠাবো,তোমার তো কেউ নেই।
– আমি যাদের বাড়িতে থাকি তাদের কাছেই পাঠাবেন।এখন তো ওনারাই আমার গার্জেন।
– আচ্ছা তাহলে রেডি থেকো কালকে।
আমি মুচকি হাশি দিয়ে সায় জানালাম।
সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত দুইজন একসাথে ছিলাম।জীবনের অনেক কথাই একে অপরের সাথে শেয়ার করলাম।

পরের দিন বিকেলে কয়েকজন‌ মহিলা আসলো আমাকে দেখতে।আমার হাত দেখছিলো,পা দেখছিলো,চুল দেখছিলো।আমার পরিবারের কথা জানতে চাইলে,সবটা খুলে বললাম।আমি তাদের ভাবশাপ দেখে বুঝলাম আমাকে তাদের পছন্দ হয়নি।বাড়িওয়ালী চাচী তাদের আপ্যায়ন করলেও তারা কিছু মুখে দেননি।
যাওয়ার সময় একজন মহিলা বলে গেলো
– শুনো মেয়ে বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যেওনা।আমি বিজয়ের সব আবদার মেনে নিলেও এটা মানতে পারবোনা।তুমি আমাদের বাসার বউ তো দূরের কথা, কাজের মেয়ে হওয়ার ও যোগ্য না।আমার ছেলের আসে পাশে তোমায় যেনো কখনো না দেখি।কথাটা মনে রেখো।
কথা শুনে মনে হলো উনি সম্ভবত বিজয়ের মা হবেন।আমি জানতাম আমাকে তাদের পছন্দ হবেনা।তাই তাদের কথায় বেশি কষ্টও হচ্ছেনা,আগের থেকেই প্রস্তুত ছিলাম তো ব্যাপারটার জন্য তাই হয়তো।

অন্যদিকে বিজয়ের মা,বোন বিজয় কে বকাবকি করছিলো
– কি দেখে পছন্দ করলি এই মেয়েকে?না ভালো দেখতে ,না কোনো ভালো পরিবারের।থাকে একটা নোংরা বস্তিতে।গায়ের রং ও তো ময়লা।তুই শেমলা আমার ইচ্ছা ছেলের বউ ফর্সা হবে।আমার ছেলের রুচি যে এতটা খারাপ এটা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। ছিঃ মানুষকে মুখ দেখাবো কিভাবে।
– মা আমি তো তার রূপকে ভালোবাসিনি,আমিতো তার দারিদ্রতাকে ভালোবেসেছি।আমিতো ভালোবেসেছি তার হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্টকে।একজন মানুষের কতটা ধর্যো থাকলে সব অপমান মুখ বুঝে সইতে পারে,আমিতো তাকে দেখেই বুঝেছি।কতটা সাহসী হলে একটা সংসারের দায়িত্ব নেওয়া যায়,এটা ওকে দেখে শেখা উচিৎ।
– বাবারে আবেগ দিয়ে গল্পঃ কবিতা চলে,জিবন চলেনা।ওই মেয়ে কে আমি কোনোদিন ও আমার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবোনা।
– কিন্তু মা আমিও যে তাকে ছাড়া আর কাউকে আমার স্ত্রী বলে মানতে পারবোনা।
– তাহলে শুনে রাখ,ওই মেয়েকে বিয়ে‌ করলে তোকে এই বাড়ি ছাড়তে হবে।
– তুমি যদি চাও তবে তাই হোক।তবুও আমি সুফিয়াকে ছাড়তে পারবোনা।

রাত বাজে এগারোটা,কে যেনো দরজায় টোকা দিচ্ছে।এত রাতে কে আসতে পারে।এখন তো কারও আসার কথা না,তাহলে?ভয়ে‌ ভয়ে দরজা খুললাম। একি বিজয়!এত রাতে?আপনি এখানে কেনো? কেউ দেখলে কি হবে জানেন?
– যা হবার তাই হবে।আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জড়িয়ে ধরলো।আমিও কেনো জানি নিজেকে সামলাতে পারলাম না,জড়িয়ে ধরলাম তাকে।দুইজনের কষ্ট যে আজ একটাই।পাওয়ার আগেই না হারিয়ে ফেলি ।কতক্ষন এভাবে ছিলাম জানিনা তবে চোখ খুলতেই বাড়িওয়ালী আর বাড়িওয়ালা কে দেখতে পেলাম।চাচা তো খুব রেগে গেছেন।কিন্তু বিজয়ের কোথায় তিনি মাথা ঠান্ডা করলেন।
– চাচা আজ রাতেই আমরা বিয়ে করতে চাই,আপনারা কি আমাদের বাবা মা হয়ে পাশে থাকবেন?আমি আমার বন্ধুবান্ধব কে কাজী নিয়ে আসতে বলেছি।কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে পড়বে।

সেদিন রাতেই আমাদের বিয়ে হল।তারপর প্রায় বছর খানেক শ্বশুর বাড়ির সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিলোনা।একদিন শাশুড়ি এসে খুব কান্নাকাটি করে নিয়ে গেলেন আমাদের কে বাড়িতে।বাড়িতে তুললেও মন থেকে কখনো মেনে নেননি আমাকে।অনেক কষ্ট সহ্য করেছি,তবুও দিন শেষে ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে সব কষ্ট ভুলেছি।বিয়ের দশ বছর হলেও একটা বাচ্চার মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি।ডাক্তার বলেছে আমি কখনো মা হতে পারবোনা।তবুও হাল ছাড়িনি।যতটুকু সম্ভব ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।ভেবেছিলাম শাশুড়িকে একজন নাতি বা নাতনি উপহার দিয়ে তার মনে জায়গা করে নিবো,ভাগ্যের কি পরিহাস তা আর হলোনা।অবশেষে বাধ্য হয়েই নিজের স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি করিয়েছি।সে রাজি ছিলোনা,অনেক কসম দিয়ে,কান্নাকাটি করে রাজি করিয়েছি।এছাড়া আমার কি বা করার ছিলো!আমার সুখের জন্য আমিতো বিজয়ে কে বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত করতে পরিনা।তবে বিয়েতে রাজি করানোর পর শাশুরির রাগ আমার উপর অনেক টা কমে গেছে সেটা আমি খেয়াল করে দেখেছি।যাইহোক শাশুরির মনে একটু জায়গা পেয়েছি এটাই বা কম কিসের!

এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারবোনা।গাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙলো।তাহলে কি বউ নিয়ে চলে এসেছে?

চলবে….
সালমা আক্তার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here