আজ আমার বরের বিয়ে।ভুল বললাম,আজকের পর সে শুধু আমার বর নয়,আমার সতীনের ও বর হবে। সুন্দর করে নিজের হাতে সাজিয়ে দিলাম তাকে। শ্যামলা রঙের,লম্বা মানুষটাকে সাদা পাঞ্জাবিতে বেশ লাগছে।বিয়ের পাগরী মাথায় পরিয়ে দিতে চাইলাম,সে একটু বিরক্তির সাথে বলে উঠলো
– হইছে তো!আমি কি প্রথম বিয়ে করতে যাচ্ছি???
– প্রথম বিয়েতে তো পাগরী পড়ার সৌভাগ্য হয়নি তাই এখন যখন সুযোগ পেয়েছ
পরে নাও।
কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা কেমন যেনো ভারী হয়ে আসলো আমার।নিজেকে কোনমতে সামলে নিলাম।
শাশুড়ি মা পাশের ঘর থেকে বেশ তাড়া দিচ্ছে
– তাড়াতাড়ি কর বাবা,দুপুর হয়ে যাচ্ছে দূরের রাস্তা,বউ নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে তো!রাত হয়ে গেলে আবার ঝামেলা। নিয়ম কানুনের ব্যাপার স্যাপার ও তো আছে তাইনা।প্রথমেই যদি আমার কথা মতো চলতি তাহলে এই অলক্ষির মুখ দেখা লাগতোনা।এতদিনে নাতি নাতনীদের মুখ দেখে ফেলতাম।কপাল খারাপ আমার।যাওয়ার সময় এই অলক্ষীর মুখ দেখে যেনো বের হইতে না হয়,খেয়াল রাখিস।
– হইছে তো মা,আজ ও এইসব নাই বা বললে,তোমার কথা মতই তো সব হচ্ছে।বেচারি কে এখন একটু শান্তি দাও।
একটু ধমকের শুরেই বলে উঠলো বিজয়।
আমি বিজয়ের মুখ আঙ্গুলের স্পর্শে চেপে ধরলাম
– থাকনা!শুভ কাজে যাচ্ছো,মায়ের সাথে এভাবে কথা বলোনা।উনি আবার কষ্ট পাবেন।আমার এইসব রোজ শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।এখন আর কষ্ট হয় না।
– সত্যি করে বলো তো,তোমার কি একটুও কষ্ট হচ্ছেনা??
– নাহ্
– সত্যি?
-আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে?আজকে তো তুমি শুধু আমার,কালকে থেকে তুমি তো ভাগ হয়ে যাবে,এইটা বলে আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।কেদেই ফেললাম।
– দেখো তুমি এমন করলে কিন্তু আমি সত্যি বিয়ে করতে যাবো না।আমি কিন্তু এমন প্রস্তাবে কখনোই রাজি ছিলাম না।শুধু তোমার কথায় রাজি হয়েছি।তবে তুমি এটাও জেনে রাখো,বিয়ে হয়তো করছি বাট তাকে আমি কখনোই মেনে নিতে পারবোনা।আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
বিজয় আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো।
বড়ো ননদ এসে আমাদের এই অবস্থায় দেখে মুখ বেঁকিয়ে বলতে লাগলো
– তোমাদের নাটক শেষ হলে এবার এগোতে পারি?বেলা সাড়ে বারোটা বাজে।নাটক দেখতে দেখতে এখন আর ভাল্লাগেনা।
বিজয় আমাকে ছেড়ে দিলো।
আমি চোখ মুছে বিজয় কে বিদায় জানালাম।
জানালা দিয়ে ওদের গাড়িতে উঠে যাওয়া দেখছিলাম।যতক্ষণ না গাড়িটা চোখের আড়াল হলো ঠাই দাড়িয়ে ছিলাম।
ওরা যাওয়ার সাথে সাথে,বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম। আহ্ কি কষ্ট,এত কেনো কষ্ট হচ্ছে আমার।বিজয় তো বলেছে সে বাধ্য হয়েই বিয়েটা করছে,ভালোবেসে তো নয়।আর বিয়ে করতে তো আমিই রাজি করিয়েছি।সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে।নতুন বিয়েটা তো শুধু মাত্র একটা সন্তানের জন্য।একজন উত্তরাধিকারের জন্য।যদি আমি একজন সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখতাম তাহলে হয়তো এই দিনটা কোনোদিন আমার জিবনে আসতো না।
আজ পুরোনো দিনের কথা গুলো খুব মনে পড়ছে।যেদিন প্রথম বিজয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। ইস কি বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম সেদিন। ভার্সিটিতে ঢুকতেই উষ্ঠা খেয়ে পরে গিয়ে জুতা জোড়া গেলো ছিড়ে।সবার কি অট্রহাশি।আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম।আসলে জুতা ছেরাতে যতটা না লজ্জা পাচ্ছিলাম তার চেয়ে বেশি লজ্জা পাচ্ছিলাম ওই ছেলে গুলার সামনে এমন ভাবে পরে যাওয়াতে।
ওরা অনেক গুলা ছেলে,একজন আরেকজনের সাথে বলাবলি করছে।
– এভাবে হাসার কি হলো?একজন মানুষ পরে গেছে কোথায় তোরা হেল্প করবি, সেটা না করে তোরা হাসছিস!
– আরেহ হাসছি কি সাধে নাকি! দেখ না মেয়েটার জুতা ছিড়ে গেছে,আর এই জুতা যে আরো কতবার ছিড়েছে হিসাব নেই,দেখ জুতা জোড়া তে খালি সেলাই আর সেলাই।দেড়শো টাকার জুতায় ,সেলাই দেড়শো টার কম হবেনা।
– আরেহ মনে হয় হার কিপটার জাত।
– মনে হয় ময়লার ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছে।
– এইডারে তো আমি প্রতিদিন দেখি এক জামা পইরা আসে,ধুইতে ধুইতে জামার রং নষ্ট হয়ে গেছে তাও নতুন জামা বানায়না।
চা ওয়্যালা চা দিতে দিতে বললো,মেয়েটা অনেক কষ্ট কইরা লেখা পড়া করে।মা নাই,বাপ ঘরে পরা।
এই মেয়েটা দর্জগীরি আর টিউশনি কইরা অনেক কষ্টে নিজের পরা লেখা আর সংসার চালায়।
– আমিতো ভেবে ছিলাম এইটা হার কিপটার বাচ্চা কিন্তু এখন তো শুনছি একদম ফকিরের বাচ্চা,হাহাহা।
কথাটা শুনে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না,অনেক কষ্ট করে উঠে ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললাম
– এইযে শুনুন,মানুষের দরিদ্রতা নিয়ে মজা করবেন না।আমি গরীব এটা কি আমার অপরাধ? হ্যাঁ আমি আপনাদের মত দামী জামা কিনতে পারিনা,প্রতিদিন নতুন নতুন জামা পড়ার সামর্থ্য আমার নাই,এটা কি আমার অন্যায়?এক জুতা যতদিন পারি সেলাই করে পরি,কারণ যেই দেড়শো টাকা দিয়ে আমি নতুন জুতা কিনবো,সেই দেড়শো টাকা দিয়ে আমার দুই দিনের বাজার চলে।তাই দশ টাকা দিয়ে সেলাই করে নিলে আমার খুব বেশি অসুবিধা হবেনা কিন্তু যদি সময় মত বাবার মুখে খাবার আর ওষুধ তুলে দিতে না পারি তাহলে আমার বাবা কে বাঁচাতে পারবোনা।আমার পৃথিবীতে শুধু বাবা ছাড়া আর কেউ নেই।এইযে এত কষ্ট করছি কেনো জানেন? মনে একটা বড়ো আশা নিয়ে,যদি কখনো লেখাপড়া করে একটা ভালো চাকরি করতে পারি,তাহলে বাবাকে নিয়ে একটু ভালো মন্দ খেয়ে বেঁচে থাকবো।আপনারা বড়োলোক ঠিক ই কিন্তুু আপনাদের মনটা অনেক ছোট।মানুষকে সাহায্য করতে না পারলে ,কষ্ট দেওয়ার অধিকার আপনাদের নাই,মনে রাখবেন কথাটা।
আমি যখন এই কথা গুলো বলছিলাম,ছেলে গুলো আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে ছিলো।কোনো কথা বলা বা তর্ক কিছুই করেনি।তবে একটা জিনিষ খেয়াল করেছিলাম,সব ছেলেদের মধ্যে একটা চশমা পরা ছেলে চুপ ছিলো।যখন সব গুলো ছেলে আমাকে নিয়ে মজা করছিলো,তখনও ঐ চশমা পরা ছেলেটা তেমন কিছু করেনি,সে ফোন টিপা নিয়ে ব্যাস্ত ছিল বলেই হয়তো তেমন কিছু করেনি অথবা হতে পারে খুব ভদ্র।যখন আমি কথা গুলো বলছিলাম সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।
খুব কেদেছিলাম সেদিন।ক্লাস না করেই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
পরেরদিন যখন ভার্সিটিতে গেলাম,চশমা পড়া ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো
– সরি
– কেনো?
– কালকের ব্যাপারটার জন্য।
– আপনি তো কিছু করেন নি,তাহলে ক্ষমা চাচ্ছেন যে?
– আমার ওদের কে থামানোর উচিত ছিলো,ওরা যখন হাসাহাসি করছিলো আমার বাধা দেওয়া দরকার ছিলো বাট আমি তা না করে চুপ ছিলাম।
– তাতে কি,ওরা তো আর মিথ্যে কিছু বলেনি,শুধু আমার কাছে শুনতে খারাপ লাগছিলো।
– যদি আমি আপনাকে কিছু দেই,নিবেন?
– আমাকে দেখে কি আপনার খারাপ মেয়ে মনে হয়?
– আমি কখন বললাম আপনি খারাপ মেয়ে?
– বলেননি তবে বিনা কারণে অপরিচিত কাওকে কিছু দেওয়া অবশ্যই কোনো ভালো লক্ষণ হতে পারেনা।
– আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।
– সেটা হলেই খুশি হবো। এই বলতে বলতে ক্লাসে ঢুকে গেলাম।
ইদানিং এই ছেলেটা আমার পেছনে লেগেই থাকে,আমি যখন টিউশনিতে যাই,তখন ঐ পথে দাড়িয়ে থাকে।ভার্সিটিতে গেলে জোর করেই কথা বলে।কি চায় আমার কাছে?আমার আশেপাশে ঘোরাফেরা, আমাকে আড় চোখে দেখা,আমি কোথায় যাই নজর রাখা, কেনো করে এইসব।যা খুশি করুক তাতে আমার কি।
এক সপ্তাহ পর
দরজায় এসে কে যেনো নক করলো,আমি বললাম ভেতরে আসুন।আমার বাসায় সারাদিন অনেক মানুষ ই আসে,কাপড় বানাতে দিয়ে যায়, বানানো হলে নিয়ে যায়।
তাই কে এসেছে না দেখেই ভেতরে আসতে বললাম।মানুষটা ভেতরে আসতেই চমকে উঠলাম,আপনি?
– তুমি একসপ্তাহ ধরে ভার্সিটিতে যাওনা কেনো?
– আপনি বাসা চিনলেন কিভাবে?
– সেই চা ওয়ালার কাছ থেকে।
– কি চান আপনি?
– তুমি ভার্সিটিতে যাওনা কেনো? আপাতত এই টুকুই জানতে চাই।
– আমার বাবা মারা গেছে,এক সপ্তাহ আগে।
– কিভাবে!?
– অসুস্থ তো অনেকদিনের,ওইদিন হঠাৎ করেই….
-এখন কি হবে?কিভাবে একা একা থাকবে?
– কি আর হবে…,কপালে যা আছে তাই হবে।আপনি এখন প্লিজ চলে যান,কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
– তুমি যাবে আমার সাথে?
– কোথায়!
– আমার বাড়িতে?
– আপনার বাড়িতে গিয়ে কি করবো?
– আমার সাথে থাকবে।
– হাহাহা,ভালই মজা করেন।
– মজা না,সত্যি বলছি।
– কোনটা সত্যি?
– আমি তোমাকে ভালোবাসি,এটাই সত্যি।
– ভালোবাসা গরীবের জন্য না।
দরজায় আবার কে যেনো টোকা দিলো,ভয়ে আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছিলো,কেও দেখলে আবার কি ভাববে কে জানে।
যেমনটা ভয় পাচ্ছিলাম ঠিক তেমন টাই হলো,মানুষ বলেনা যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়।আমার বেলাতেও হলো তেমন।দরজা খুলে দেখি বাড়িওয়ালা।
সতীনের ঘর
প্রথম পর্ব
সালমা আক্তার